দেশে দেশে যুদ্ধ বাঁধবার কথা উঠলে দক্ষিণ আমেরিকার বর্তমান অবস্থা বেশ সন্তোষজনক বলতে হয়। দু-দুটো মহাযুদ্ধের ছোবল থেকে বেঁচে যাওয়ার কারণেই হয়তোবা এই অবস্থা। তাছাড়া দক্ষিণ আমেরিকার একনায়কেরা নিজেদের জনগণকে শায়েস্তা করতে আর গৃহযুদ্ধের হ্যাপা সামলাতেই বেশি মনোযোগী থাকায় ফকল্যান্ডের যুদ্ধ ছাড়া হাল আমলে তেমন কোনো রক্তক্ষয়ী আন্তঃদেশীয় যুদ্ধ দক্ষিণ আমেরিকায় সংঘটিত হয়নি। তবে গত শতকের কথা আলাদা।
প্যারাগুয়ে, পারানা আর উরুগুয়ে নদী দ্বারা পুষ্ট লা প্লাটা অঞ্চল আয়তনে দক্ষিণ আমেরিকার চারভাগের একভাগ এবং আমাজন অঞ্চলের পরেই মহাদেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম অববাহিকা। দক্ষিণ-পূর্ব বলিভিয়া, দক্ষিণ ব্রাজিল, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে আর আর্জেন্টিনার উত্তরভাগ জুড়ে বিস্তৃত অত্যন্ত উর্বর এই অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর উত্তেজনার অন্ত ছিল না।
১৮৬৪ সালে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা আর উরুগুয়ে মিলে লড়তে নেমেছিল প্যারাগুয়ের বিরুদ্ধে। লা প্লাটার বিরাট অববাহিকা অঞ্চল জুড়ে এই বিরাট যুদ্ধে প্যারাগুয়ে দেশটি সম্পূর্ণ গুড়িয়ে গিয়েছিল। প্রাণে বেঁচে ছিল মোটে হাজার তিরিশেক পুরুষ। লাতিন আমেরিকার ইতিহাসে প্যারাগুয়ের যুদ্ধ নামে পরিচিত এই যুদ্ধ নিয়েই আজকে আলাপ হবে।
প্রেক্ষাপট
সুশাসক হিসেবে স্প্যানিশ বা পর্তুগীজদের সুনাম কোনোকালেই ছিল না। দক্ষিণ আমেরিকাজুড়ে স্প্যানিশ বা পর্তুগীজরা বড় বড় শহরগুলো বসিয়েছে সমুদ্রতীর ঘেঁষে। বিরাট এই মহাদেশের ভেতরটা একেবারে ফাঁকা ছিল না অবশ্য। গহীন জঙ্গল আর বিরাট জলাভূমির মাঝে বিশাল বিশাল র্যাঞ্চ বসিয়ে থাকতো গাউচোদের দল। আর জঙ্গলে, প্রান্তরে পালিয়ে বেড়াতো রেড ইন্ডিয়ান গোত্রগুলো। ইউরোপীয় শাসকেরা যখন বিদায় নেওয়া শুরু করে, তখন তাদের সৃষ্ট বিশৃংখল শাসনব্যবস্থা জন্ম দেয় অনেকগুলো যুদ্ধের।
মে বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে ১৮১০ সালে আর্জেন্টিনা স্বাধীন হয়। ১৮১১ সালে প্যারাগুয়ে স্বাধীন হয়। উরুগুয়ে ১৮২১ সাল পর্যন্ত আর্জেন্টিনার সাথে থাকবার পরে ব্রাজিলের অধীনে চলে যায়। পরে ১৮২৮ সালে উরুগুয়েও স্বাধীনতা লাভ করে। প্যারাগুয়ে দেশটি সে আমলে আকারে ছিল বিরাট। বর্তমান আর্জেন্টিনার মিসিওনেস, ফরমোজা, ব্রাজিলের রিও গ্রান্দে দে সুল প্রদেশগুলো প্যারাগুয়ের সরকারের হাতে ছিল। প্যারাগুয়ের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ছিল ব্রাজিলের মাতে গ্রোসো প্রদেশ। প্রদেশটি ব্রাজিলের কেন্দ্রের সাথে যুক্ত ছিল নদীপথের মাধ্যমে। এই প্যারাগুয়ে নদী আবার প্যারাগুয়ে সরকারের নিয়ন্ত্রাণাধীন অঞ্চল দিয়ে বয়ে গিয়েছে। ব্রাজিলের জাহাজগুলো প্যারাগুয়ে সরকারকে চড়া শুল্ক দিতে বাধ্য থাকতো। এছাড়া আপা আর ব্রাঙ্কো নদীর মধ্যকার অঞ্চলের মালিকানা নিয়েও দুই দেশের মধ্যে বিরোধ ছিল।
প্যারাগুয়ের দক্ষিণের প্রতিবেশী আর্জেন্টিনার ক্ষমতায় ছিলেন বার্তেলোমি মিত্রে। প্যারাগুয়ের একনায়ক ফ্রান্সিসকো সোলানো তাকে বেশ বিশ্বাস করতেন। ওদিকে উরুগুয়ের ব্রাজিলপন্থী দল কলোরাডো পার্টি এবং ক্ষমতাসীন প্যারাগুয়েপন্থী দল ব্লাঙ্কোর মধ্যে হরদম মারামারি লেগেই থাকতো। ১৮৬৪ সাল নাগাদ এই দাঙ্গাহাঙ্গামা অনেক বেড়ে গেলে প্যারাগুয়ে শংকিত হয়ে পড়ে।
স্বাধীনতার পর থেকেই প্যারাগুয়ে শাসন করেছেন হোসে ফ্রান্সিয়া, তার ভাতিজা কার্লোস সোলানো লোপেজ এবং তার বড় ছেলে ফ্রান্সিসকো সোলানো লোপেজ। এই শাসকেরা কেউ বাইরের বিশ্বের সাথে যোগাযোগ রাখতেন না বললেই চলে। কড়া রক্ষণাত্মক নীতির কল্যাণে প্যারাগুয়ে সে আমলে স্বনির্ভর একটি দেশ ছিল, প্রতিবেশীদের তুলনায় জীবনযাত্রার মানও ছিল অনেক উঁচু। প্যারাগুয়ের শক্তিশালী নৌবাহিনী ছিল, ছিল লক্ষাধিক সৈন্যের বিরাট এক সেনাবাহিনী। ফ্রান্সিসকো সোলানো নিজের দেশ তথা নিজের ক্ষমতা জাহির করবার জন্য অত্যন্ত ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলেন।
১৮৬০ এর দশকে প্যারাগুয়ের মোট জনসংখ্যা ছিল ১৩-১৪ লক্ষের মতো। বিপরীতে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা আর উরুগুয়ের সম্মিলিত জনসংখ্যা ছিল ১ কোটির বেশি। কিন্তু আত্মবিশ্বাসী লোপেজ ওসব নিয়ে ভাবলেন না। উরুগুয়েতে ব্লাংকো আর কলোরাডো পার্টির মধ্যকার যুদ্ধের দায়ে তিনি ব্রাজিলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন।
প্যারাগুয়ের আক্রমণ
লোপেজ ভেবেছিলেন মিত্রে যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকবেন। তাই ১৮৬৪ সালে ব্রাজিলের মাতে গ্রোসো প্রদেশে হামলার পাশাপাশি তিনি আর্জেন্টিনার কাছে বিশেষ একটি আবদার পাঠালেন। প্যারাগুয়ে আর উরুগুয়ের মধ্যে কোনো সীমান্ত নেই, উরুগুয়েতে যেতে হলে পথিমধ্যে আর্জেন্টিনার করিয়ান্থেস অথবা ব্রাজিলের রিও গ্রান্দে দে সুলে প্রবেশ করা লাগবে। ব্রাজিল যেহেতু শত্রুদেশ, কাজেই লোপেজ দাবি জানালেন যেন তার সেনাদেরকে আর্জেন্টিনা নিরাপদে উরুগুয়েতে যাওয়ার সুযোগ দেয়।
কিন্তু প্রত্যাশামতো আর্জেন্টিনা কোনো সাহায্য তো করলোই না, উল্টো নিজেদের নৌপথ ব্যবহার করার সুযোগ করে দিল ব্রাজিলকে। ক্রুদ্ধ সোলানো ১৮৬৫ সালে যুগপৎ আক্রমণ করে বসলেন করিয়ান্থেস আর রিও গ্রান্দে দে সুল। ফলে আর্জেন্টাইন শাসক ব্রাজিল আর উরুগুয়ের ব্রাজিল পন্থীদের সাথে জোট বাঁধলেন। সেসময় সবাই ভেবেছিল প্যারাগুয়েই আসল দোষী, কিন্তু পরে দেখা যায় উরুগুয়ে, ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা আগেই প্যারাগুয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য একটা গোপন সম্মতি চুক্তি করেছে। যা-ই হোক, করিয়ান্থেস আক্রমণ করার ফলে আর্জেন্টিনায় প্যারাগুয়ের বিরুদ্ধে বিপুল জনমত গড়ে ওঠে। লোপেজের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াইয়ে নামলো আর একটি দেশ।
ব্রাজিলের পাল্টা জবাব, আর্জেন্টিনার সাফল্য
রিয়েচুয়েলোর যুদ্ধে প্যারাগুয়ে নৌবাহিনীকে গুঁড়িয়ে দিয়ে যৌথশক্তি যুদ্ধে নামলো। এর আগে প্যারাগুয়ে বেশ কতগুলো যুদ্ধে জিতলেও নৌবাহিনীর অনুপস্থিতি তাদেরকে ভোগাতে লাগলো। ঐ অঞ্চলে নদীপথই ছিল রসদ সরবরাহের সেরা ভরসা। ১৮৬৫ সালের শেষে আর্জেন্টিনা হারানো জায়গা পুনরুদ্ধার করে ফেললো, ব্রাজিলও এগোতে লাগলো। পরের বছর প্যারাগুয়ের মাটিতে পা রাখলো শত্রুসেনারা। তুয়ুতির যুদ্ধ সহ কয়েকটা মারাত্মক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে হারার পর সোলানো লোপেজ বুঝলেন যুদ্ধ জেতা সম্ভব নয়। কিন্তু তার সন্ধিপ্রস্তাব কেউ মানলো না। উল্টো কড়া কড়া সব দাবি জানাতে লাগলো। কিছুকাল বাদে কুরুপাইটির যুদ্ধে লোপেজের সেনাদল জিতে গেলে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার নেতাদের মধ্যে মতভেদ শুরু হয়। যা-ই হোক, পরে তারা আবার একজোট হয়ে হামলা শুরু করে। ১৮৬৮ সালে দুর্ভেদ্য হুমাইতা দুর্গের পতন ঘটে। মিত্রশক্তির সর্বাধিনায়ক মিত্রে পদত্যাগ করেন। এরপর থেকে যুদ্ধ মূলত ব্রাজিলের সেনাদলই চালাবে।
তবে সবদিক থেকে ঘেরাও হয়ে প্যারাগুয়ে সরকারের অবস্থা তখন খুবই দুর্বল। বড় নদীগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার নৌবাহিনী। এদিকে পশ্চিমের প্রতিবেশী বলিভিয়া সরকারও বন্ধুভাবাপন্ন নয়। ১৯৬৯ এর জানুয়ারিতে রাজধানী আসুনসিওনের পতন হলো। প্রথাগত যুদ্ধেরও ইতি ঘটে প্যারাগুয়ের মাটিতে। ফ্রান্সিসকো সোলানো লোপেজ পালিয়ে যান।
গেরিলা লোপেজ
প্যারাগুয়ের একনায়ক ফ্রান্সিসকো সোলানো কিন্তু জনপ্রিয় লোক ছিলেন। তার সেনাদলের প্রায় পুরোটাই সাবাড় হয়ে গেলেও তিনি হতোদ্যম হলেন না। উল্টো শিশু, কিশোর, নারীসহ অসংখ্য মানুষ নিয়ে বিরাট এক গেরিলা বাহিনী গড়ে তুললেন। তাদের না ছিল উর্দি, না ছিল প্রশিক্ষণ। পুরনো বন্দুক, তলোয়ারে সজ্জিত এই বাহিনী ব্রাজিলের সামনে বিশেষ কোনো প্রতিরোধ গড়তে পারেনি।
প্যারাগুয়েতে রাস্তাঘাট বিশেষ ছিল না। যোগাযোগ যা হওয়ার সবই নৌপথে। এখন নৌপথগুলোর নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় প্যারাগুয়ের গেরিলারা বিশেষ সমস্যায় পড়ে যায়। শত্রুরা প্যারাগুইয়ানদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালায়। লুটপাট, ধর্ষণ, খুনের পাশাপাশি আগুনে পুড়িয়ে দেয় ঘরবাড়ি, খেত খামার। ১৮৭০ সালে সেরো কোরার জঙ্গলের মধ্যে এক নদীর তীরে ব্রাজিলীয় সেনাদের সাথে সংঘর্ষে নিহত হন প্রেসিডেন্ট লোপেজ। প্যারাগুয়াইয়ানরা অবশেষে যুদ্ধের ইতি টানতে বাধ্য হয়।
পরিশেষে
লাতিন আমেরিকার ইতিহাসের সবথেকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হিসেবে ধরা হয় প্যারাগুয়ে যুদ্ধকে। প্যারাগুয়ে তার মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশকে যুদ্ধে হারায়। কোনো কোনো গবেষকের মতে পুরুষদের ৯০ ভাগই নাকি যুদ্ধে মারা পড়েছিল। এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত কম থাকায় সংখ্যার ব্যাপারে একেবারে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব না।
বিজয়ী দেশগুলো প্যারাগুয়েকে ইচ্ছেমত কাটাছেঁড়া করে নিল। মাতে গ্রোসো দে সুল প্রদেশটি নিল ব্রাজিল। ফরমোসা আর মিসিওনেস প্রদেশ কব্জা করলো আর্জেন্টিনা। এই মারাত্মক ক্ষতি সামলাতে প্যারাগুয়ের বহু দশক লেগে গিয়েছে। দেশটি স্বাধীনতা পরবর্তী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুযোগও হারায় এই যুদ্ধের কারণে। প্যারাগুয়ের প্রধান পণ্য ইয়ারবা মাতের বাজার হাতছাড়া হয়ে যায়। যুদ্ধ পরবর্তী দশকের পর দশক কুশাসনের কারণে প্রতিবেশীদের তুলনায় প্যারাগুয়ে অনেক পিছিয়ে পড়ে।
প্রতিবেশীদের মধ্যে ব্রাজিল লাতিন আমেরিকায় যুদ্ধে জিতে প্রচুর যশ কামিয়ে নেয়। এর সেনাবাহিনী সামনের দশকগুলোতে খুবই প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। উরুগুয়ের ব্রাজিলপন্থী কলোরাডো দল ১৯৫৮ সাল অবধি ক্ষমতা ধরে রাখে। আর্জেন্টিনা যুদ্ধের পরে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি করে এবং বিশ্বের সপ্তম শীর্ষ ধনী দেশে পরিণত হয়।
ফিচার ইমেজ – Pinterest