ভারত মহাসাগরের বুকে মোট ১,১৯০টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ছোট এক দেশ মালদ্বীপ। দক্ষিণ এশিয়ার অপরূপ সুন্দর দেশটি ১৯৬৫ সালের ২৬ জুলাই ব্রিটেনের কাছে থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার পর মালদ্বীপের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ইব্রাহিম নাসির।
তার সময়ে মালদ্বীপের অনেক উন্নয়ন হলেও তার বিরোধী শিবিরে শত্রুর অভাব ছিল না। ব্রিটিশ আমলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। এ কারণে নাসিরের প্রেসিডেন্ট হওয়ার বিষয়টি অনেকেই মানতে পারেননি।
তখন মালদ্বীপের শাসনব্যবস্থা ছিল মজলিস কেন্দ্রিক। মজলিস থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করা হতো। কিন্তু মজলিসে যেসব সদস্য থাকতেন তারা জনগণের সরাসরি ভোটেও নির্বাচিত নয়। বরং জনগণের ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে মজলিস তথা পার্লামেন্ট গঠন করা হতো। ফলে মালদ্বীপে তখন প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা ছিল না।
১৯৭৮ সালে মজলিসের সমর্থন নিয়ে মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন মামুন আবদুল গাইয়ুম। এর আগে ইব্রাহিম নাসিরের সরকারে তিনি পরিবহন মন্ত্রী ছিলেন। ক্ষমতার বসার পর থেকে গাইয়ুমের বিরুদ্ধে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য ১৯৮০ ও ১৯৮৩ সালে দুবার অভ্যুত্থান ঘটানো হয়। কিন্তু দুবারই গাইয়ুম-বিরোধীরা ব্যর্থ হলেও তারা চেষ্টা অব্যাহত রাখে।
তারা তৃতীয় অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালায় ১৯৮৮ সালের ৩ নভেম্বর। যেদিন রাষ্ট্রপতি আবদুল গাইয়ুমের ভারত সফরে আসার কথা ছিল। কিন্তু তার এই সফরের সময়সূচী ফাঁস হয়ে গেলে বিরোধীরা অভ্যুত্থানের ফন্দি আঁটে। কিন্তু ঘটনার কিছুটা আঁচ করতে পেরে সফর বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেন গাইয়ুম।
ভারত সরকার আগে থেকে গাইয়ুমকে আনার জন্য দিল্লি থেকে একটি বিশেষ বিমান পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তার জন্য সেই বিমান উড্ডয়নও করেছিল। বিমানটি যখন তার গন্তব্যের মাঝপথে, তখন মামুন আবদুল গাইয়ুম ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে সফর বাতিল করার অনুরোধ করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী তার প্রস্তাবে সম্মতি দেন।
গাইয়ুমের সফরকে সামনে রেখে মালদ্বীপে থাকা ভারতীয় হাইকমিশনার এ কে ব্যানার্জি দুদিন আগে দিল্লি চলে আসেন। আমন্ত্রিত অতিথির সফরের সময় খাতিরযত্নে যাতে কোনো কমতি না হয় সেসব দেখভালের জন্য তিনি আগেভাগেই দিল্লি এসেছিলেন।
মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতির সাথে ব্যানার্জির দারুণ সম্পর্ক ছিল। ক্রিকেটভক্ত গাইয়ুমের সাথে তিনি অসংখ্যবার ক্রিকেটও খেলেছেন। যার ফলে গাইয়ুমের সফর নিয়ে একে ব্যানার্জির ব্যস্ততা একটু বেশিই ছিল। কিন্তু সফর বাতিল হওয়ায় তিনি পরিবারের সাথে দুদিন সময় কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন।
ঘটনার দিন ভোরে ব্যানার্জি দিল্লির ডিফেন্স কলোনিতে নিজ বাসায় গভীর ঘুমে ছিলেন। ভোর সাড়ে ছয়টায় মালদ্বীপ থেকে তার সচিবের ফোনে তার ঘুম ভেঙে যায়। তার সচিব জানান, মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে ভোর সাড়ে চারটা থেকে গোলাগুলি চলছে। অস্ত্রধারীরা রাষ্ট্রপতি আবদুল গাইয়ুমের বাসভবনে হামলা করেছে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে তিনি নিরাপদ স্থানে যেতে সক্ষম হয়েছেন।
এ কে ব্যানার্জি তখন ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা নিরাপদে আছেন কি না তা জানতে চান। অপরপাশ থেকে তাকে আশ্বস্ত করার পর তিনি জানতে চান অভ্যুত্থানের খবরটি কতটুকু সত্য। যখন জানতে পারেন মামুন আবদুল গাইয়ুমের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা আনবারি সাত্তার স্বয়ং খবরটি দিয়েছেন, তখন আর কোনো সন্দেহ ছিল না।
রাষ্ট্রপতি গাইয়ুমের বিশ্বস্ত কয়েকজনের মধ্যে সাত্তার ছিলেন অন্যতম। তাকে ভারতীয় দূতাবাসে যোগাযোগ করার আদেশ দিয়েছিলেন গাইয়ুম। সাত্তার কোনোক্রমে ভারতীয় দূতাবাসের সচিবের বাসায় আসতে সক্ষম হন। রাষ্ট্রপতি গাইয়ুম ভারতের সাহায্য প্রার্থনা করেছেন এই বার্তাটি তিনি পৌঁছে দেন।
যেভাবে মালে শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল বিদ্রোহীরা
অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিলেন মালদ্বীপের ব্যবসায়ী আব্দুল্লাহ লুথিফি। তাকে সাহায্য করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল উমা মহেশ্বরানের নিয়ন্ত্রণাধীন শ্রীলঙ্কার বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন পিপলস লিবারেশন অর্গানাইজেশন অব তামিল এলেম (প্লট)।
যদিও প্লটকে গড়ে তুলেছিল ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী ‘র’। পাশাপাশি অর্থায়নও করেছিল তারা। তাদের উদ্দেশ্য ছিল প্লটকে লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল এলেম (এলটিটিই) এর প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো। কিন্তু ভারতের অর্থায়নে গড়ে ওঠা এক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনই সেদিন ভারতের মিত্র মালদ্বীপকে সঙ্কটে ফেলে দিয়েছিল।
একদিন শ্রীলঙ্কায় আব্দুল্লাহ লুথিফির বাড়িতে গিয়ে তাকে মালদ্বীপে অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রস্তাব দেন মহেশ্বরান। এক্ষেত্রে তিনি অস্ত্রধারী যোদ্ধাদের দিয়ে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন। লুথিফি বসবেন রাষ্ট্রপতির পদে। আর মহেশ্বরান এর বিনিময়ে আর্থিক ও ব্যবসা সংক্রান্ত কিছু সুবিধা নেবেন। পাশাপাশি দ্বিতীয় আরেকটি দেশে তারা নিজেদের ঘাটিও তৈরি করতে পারবেন।
৩ নভেম্বর মামুন আবদুল গাইয়ুম ভারত সফরে যাবেন নিশ্চিত হওয়ার পর লুথিফি ও মহেশ্বরান সেই দিনটিকে বেছে নেন। ঘটনার দুদিন আগে ৮০ জন সশস্ত্র যোদ্ধা নিয়ে শ্রীলঙ্কার সমুদ্র উপকূল থেকে সকাল সাড়ে আটটায় মাছ ধরার দুটি ট্রলার ছিনতাই করে মালের উদ্দেশ্যে রওনা দেন লুথিফি। মালে পৌঁছানোর পর একটি ট্রলার প্রেসিডেন্সিয়াল জেটিতে এবং আরেকটি বাণিজ্যিক পোতাশ্রয়ে নোঙ্গর করে।
ট্রলার থেকে নেমে একদল রেডিও ও টেলিভিশন সম্প্রচার কেন্দ্রের দখল নেয়। আরেক দল রিপাবলিক স্কয়ারে নেমে রাষ্ট্রপতি ভবন দখল করার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু তারা তখনো জানতেন না যে গাইয়ুম তার ভারত সফর বাতিল করেছেন। বিদ্রোহীরা প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসে আক্রমণ করে। গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় গাইয়ুমের। তার বিরুদ্ধে যে অভ্যুত্থান হবে সে বিষয়ে তিনি আন্দাজ করতে পারলেও এর পেছনে কারা রয়েছেন তা তিনি নিশ্চিত করে জানতেন না।
তার সরকারি বাসভবনের বাইরে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের অবস্থান তিনি নিজ কক্ষ থেকেই দেখেন। কিন্তু তারা সংখ্যায় কতজন এবং তাদের হাতে কী ধরনের অস্ত্র রয়েছে সে বিষয়ে কোনো তথ্য ছিল না। বিদ্রোহীরা গুলি চালাতে চালাতে ভবনের ভেতরের দিকে প্রবেশ করতে থাকে। তখন রাষ্ট্রপতি তার নিজের নিরাপত্তার জন্য স্ত্রী ও সন্তানকে সাথে নিয়ে বাড়ির পশ্চিম দিক দিয়ে পালিয়ে আসেন।
এর আগেই মালে শহরে ত্রাস সৃষ্টি করেছে বিদ্রোহীরা। রাস্তায় এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে বেশ কয়েকজনকে হত্যাও করে তারা। গাইয়ুম এর মধ্যেই উপ-প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইলিয়াস ইব্রাহিমের বাড়িতে যান। পরে তিনি রাষ্ট্রপতিকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান। কিন্তু তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না। রাষ্ট্রপতিকে রেখে বাড়ি ফেরার পথে বিদ্রোহীরা তার উপর হামলা। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও তার পায়ে গুলি লাগে। সেই অবস্থাতেই তিনি বাড়ি ফিরতে সক্ষম হন।
এদিকে প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসে হামলা চালানোর সময়ই একটি দল মালদ্বীপের ন্যাশনাল সিকিউরিটি সার্ভিস (এনএসএস) এর প্রধান কার্যালয়ে হামলা চালায়৷ রাষ্ট্রপতির বাসভবনের কাছেই ছিল এনএসএস এর প্রধান কার্যালয়। এই সংস্থার অধীনে মালদ্বীপের পুরো সামরিক ব্যবস্থা পরিচালিত হতো। ফলে এর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার অর্থ হলো মালদ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া।
সেই সময় এনএসএস এর সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র ২ হাজার। সেদিন রাতে প্রধান কার্যালয়ে তাদের সংখ্যা ছিল বড়জোর ১৫০-২০০ জন। কিন্তু মালদ্বীপের এই বাহিনীর যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ ছিল না। এছাড়া তারা এর আগে কখনো এমন পরিস্থিতির সম্মুখীনও হয়নি।
তারপরও সেখানকার নিরাপত্তা প্রহরী হোসেন নাদিম বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে একাই লড়াই শুরু করেন। কিন্তু বিদ্রোহীদের গুলিতে তার বুক ঝাঁঝরা হয়ে যায়। সেই সাথে এনএসএস এর নিয়ন্ত্রণ চলে যায় বিদ্রোহীদের হাতে। এরপর বিদ্রোহীরা শহরের ব্যাংক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোতে লুটপাট চালাতে শুরু করে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তারা শান্ত ও সুন্দর মালে শহরকে নরকের রূপ দেয়।
সময় যত বাড়তে থাকে মালে শহরে লাশের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। সেই সাথে শহরে বিদ্রোহীদের সংখ্যা বেড়ে যায় বলে ধারণা করা হয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মালে শহরের গুরুত্বপূর্ণ ভবন বিদ্রোহীরা কব্জা করে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও পানির সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। তখন মালদ্বীপের পররাষ্ট্র সচিব ইব্রাহিম জাকি প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশে সাহায্যের জন্য আবেদন করেন। এর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র ছিল।
শ্রীলঙ্কা ও সিঙ্গাপুর তাদের এমন অভিযান পরিচালনা করার মতো সক্ষমতা নেই জানিয়ে দেয়।অপরদিকে পাকিস্তান থেকে মালদ্বীপের দূরত্ব অনেক। সেই সাথে ভারতের কাছে থেকে তারা কোনো সাহায্য পাবে না। যার ফলে তাদের পক্ষে মালদ্বীপকে এককভাবে সামরিক সহায়তা দেওয়া সম্ভব হবে না জানিয়ে দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপে ছিলেন। কিন্তু সেখান থেকে মালদ্বীপ আসতে কয়েকদিন লাগবে। ফলে তাদের চটজলদি কোনো সহায়তা দেওয়ার সুযোগ ছিল না। অন্যদিকে যুক্তরাজ্য মালদ্বীপকে ভারত সরকারের সহায়তা নেওয়ার পরামর্শ দেয়। কারণ, সেখানে ভারতের আধিপত্যই বেশি। এবং তারা ভৌগোলিকভাবেও সুবিধাজনক অবস্থানে।
প্রাথমিকভাবে মামুন আবদুল গাইয়ুম নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারলেও, তা কত সময় নিরাপদ থাকবে তার নিশ্চয়তা ছিল না। ফলে অতিদ্রুত প্রতিবেশী কোনো রাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার প্রয়োজন ছিল। কেননা মালদ্বীপের নিজস্ব নিরাপত্তা ইতোমধ্যে বিদ্রোহীদের সামনে কোনো প্রতিরোধই গড়তে পারেনি। তখন মালদ্বীপের কৌশলগত ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারত মালে শহরে অভিযান পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেয়। কেমন ছিল সেই অভিযান?