ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় উইলিয়াম ছিলেন লুইয়ের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। বেশ ক’বারই তিনি ফ্রেঞ্চদের সাথে যুদ্ধ করেছেন। তাকে ইংল্যান্ডে ব্যস্ত দেখে লুই নেদারল্যান্ডসের উপর আঘাত হানবার পরিকল্পনা করলেন। উইলিয়ামের প্রিন্সিপালিটি দখল করে নেবার অভিলাষও তার ছিল। ঠিক এই সময়েই ফ্রেডেরিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। তার পাঠানো সেনাদের উপস্থিতিতে ফেঞ্চ আগ্রাসনের পরিকল্পনা থমকে যায়।
গ্র্যান্ড অ্যালায়েন্স যুদ্ধ
বহু রক্তপাত আর বেশ কয়েকটি শান্তিচুক্তির পরেও ইউরোপের আকাশে কালো মেঘ যেন কাটছিলই না।মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের খেলায় ফ্রেঞ্চ সম্রাট চতুর্দশ লুইয়ের সম্প্রসারণবাদী মনোভাব পরাশক্তিগুলোকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। ১৬৮৬ সালে অস্ট্রিয়ার নেতৃত্বে লিগ অফ অগসবুর্গ গঠিত হলেও এর মূল উদ্দেশ্য ছিল তুর্কিদের মোকাবেলা করা, ফ্রেঞ্চরা সামরিক ক্ষমতা প্রদর্শন করতে শুরু করলেও লিওপোল্ড নিশ্চেষ্ট ছিলেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৬৮৯ সালে নতুন সদস্যদের সমন্বয়ে গ্র্যান্ড অ্যালায়েন্স গঠিত হলো। ফ্রান্সের সাথে আবার শুরু হলো লড়াই। নয় বছরের যুদ্ধ নামেও এই যুদ্ধ ইতিহাসে বিখ্যাত। এর একদিকে ফ্রান্স, অন্যদিকে ছিল তৎকালীন অন্যান্য ইউরোপিয়ান শক্তি। গ্র্যান্ড অ্যালায়েন্সের নেতা ইংল্যান্ড এবং নেদারল্যান্ডসের রাজা উইলিয়াম। তাকে ব্যতিব্যস্ত রাখতে লুই সেনাদল দিয়ে সিংহাসনচ্যুত দ্বিতীয় জেমসকে আবার ইংল্যান্ডে পাঠালেন। ১৬৮৯ সালের মার্চে জেমস আয়ারল্যান্ডে অবতরণ করলে ডাবলিন তাকে রাজা মেনে নেয়।
ফ্রেঞ্চ এবং আইরিশ মিলিত সেনাদল নিয়ে তিনি উইলিয়ামের বিরুদ্ধে অগ্রসর হলেন। এপ্রিলে তিনি উলস্টার প্রদেশের দখল নিতে গিয়ে ব্যর্থ হন। জুনে উইলিয়ামের সেনাবাহিনী উত্তর আয়ারল্যান্ডে প্রবেশ করে। ছোটখাট সংঘর্ষ চলতে থাকে। ১৬৯০ সালের ১১ জুলাই চূড়ান্ত ফয়সালার জন্য বয়েন নদীর দুই পারে দুই দল জমায়েত হলো। কিন্তু বয়েনের (Boyne) লড়াইয়ে উইলিয়ামের কাছে জেমস হেরে যান। জেমস ফ্রান্সে ফিরে আসেন, আর উইলিয়ামের জেনারেলরা আয়ারল্যান্ড পুনর্দখলে অভিযান চালান, উইলিয়াম মনোযোগ দিলেন লুইয়ের দিকে। জেমস এরপর আর কখনোই সিংহাসনের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারেননি।
এদিকে উইলিয়ামকে ইংল্যান্ডে ব্যস্ত রেখে লুই দুই দল সেনা প্রেরণ করে ফেলেছেন। প্রুশিয়ান সেনাদের উপস্থিতিতে তিনি সরাসরি নেদারল্যান্ডসে অভিযান না চালিয়ে রাইন অতিক্রম করে জার্মানিতে সেনা পাঠান। একদল সেনা জার্মানির কোলনে এসে উপস্থিত হলো এখানকার আর্চবিশপের পদে লুইয়ের সমর্থিত ব্যক্তিকে অধিষ্ঠিত করতে। আরেকদল চলে গেল প্যালাটাইনে। সেখানকার শাসকের মৃত্যুর পর ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, একে কাজে লাগিয়ে লুই প্যালাটাইনে ফ্রেঞ্চ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিলেন। লুইয়ের বিরুদ্ধে ইউরোপিয়ান পরাশক্তিগুলো গ্র্যান্ড অ্যালায়েন্স নামে একজোট হলো, তাদের নেতৃত্ব নিলেন ইংল্যান্ড এবং নেদারল্যান্ডসের রাজা উইলিয়াম।
এই দলে অস্ট্রিয়া আর স্পেনের সাথে জার্মানি থেকে ব্র্যান্ডেনবার্গ-প্রুশিয়া, বাভারিয়া, হ্যানোভার, স্যাক্সোনি আর ডাচি অফ স্যাভোয় ছিল। সম্মিলিত সেনাদল কোলন আর প্যালাটাইনে ফ্রেঞ্চ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়। এদিকে ক্যাটালোনিয়া আর উত্তর ইতালিতেও ফ্রেঞ্চরা আক্রমণ চালায়। ফলে চারটি ফ্রন্টে একযোগে লড়াই শুরু হলো। ইংল্যান্ড আর নেদারল্যান্ডসের নৌবাহিনীও এতে অংশগ্রহণ করে। দীর্ঘ লড়াইয়ে ফ্রেঞ্চরা সবার বিপক্ষে একাই টিকে ছিল। তারা অনেক নতুন এলাকাও অধিকারে নেয়। এদিকে ফ্রেডেরিকের সেনারা এই যুদ্ধে বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে ব্র্যান্ডেনবার্গ-প্রুশিয়ার জন্যে সম্মান বয়ে আনে।
সন্ধি
যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত সব পক্ষই শান্তিচুক্তির জন্য আলোচনা করতে আগ্রহী ছিল। বহু রক্তক্ষয়ের পরে অবশেষে তুরিনে ১৬৯৬ সালে স্যাভোয়ের সাথে ফ্রান্সের সন্ধি হলো। ১৬৯৭ সালে রিজউইক চুক্তি গ্র্যান্ড অ্যালায়েন্স যুদ্ধের অবসান ঘটায়। ফ্রেঞ্চরা দখলকৃত অনেক অঞ্চল ছেড়ে দেয় এবং উইলিয়ামকে ইংল্যান্ডের বৈধ রাজা মেনে নেয়। নেদারল্যান্ডসকে দেয়া হয় বাণিজ্যিক সুবিধা। পরাশক্তিগুলো সবাই কিছু না কিছু পেয়ে যায়। কিন্তু ব্র্যান্ডেনবার্গ-প্রুশিয়ার কপালে জুটল ফক্কা।
ফ্রেডারিক যা আশা করেছিলেন, রাজা হিসেবে লিওপোল্ডের অনুমোদন কিংবা নিজ রাজ্যে নতুন ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্তি, কিছুই বাস্তবে পরিণত হলো না। তিনি এজন্য দায়ী করলেন এতদিনের বিশ্বস্ত উপদেষ্টা ড্যাঙ্কেলম্যানকে। তাকেই দেয়া হয়েছিল এই যুদ্ধে প্রুশিয়ান বাহিনীর পরিচালনার ভার। ফলে রিজউইক চুক্তির পরে ভাল কিছু না পাওয়ায় ফ্রেডেরিক গেলেন খেপে। তিনি ড্যাঙ্কেলম্যানকে জেলে পুরলেন। ১৭০৭ সালে ক্রাউন প্রিন্সেস সোফি ডরোথির হস্তক্ষেপে মুক্ত মিললেও ড্যাঙ্কেলম্যান আর কখনোই রাজদরবারে পূর্বের প্রতিপত্তি ফিরে পাননি।
স্প্যানিশ সিংহাসনের উত্তরাধিকারের যুদ্ধ এবং ফ্রেডেরিকের ইচ্ছেপূরণ
গ্র্যান্ড অ্যালায়েন্স যুদ্ধে সুস্পষ্টভাবে কোনো বিজয়ী ছিল না। অনবরত লড়াইতে ক্লান্ত সব পক্ষ সাময়িক বিরতি নিতে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল মাত্র। কিন্তু ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের খেলা শেষ হয়নি। নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় স্প্যানিশ সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে। ফ্রেডেরিকের হাতে এইবার সুবর্ণ এক সুযোগ ধরা দিল।
তৎকালীন স্পেন ছিল বিরাট এক কনফেডারেশন। নেদারল্যান্ডসের কিছু অংশ (স্প্যানিশ নেদারল্যান্ডস), মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকার বিরাট এলাকা, ইতালির বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড ছাড়াও ছড়ানো ছিটানো অনেক কলোনি ছিল এর অন্তর্ভুক্ত। ১৬৬৫ সালে চার বছর বয়সে স্পেনের রাজদণ্ড হাতে নেন রাজা দ্বিতীয় চার্লস। তিনি ছিলেন অস্ট্রিয়ান হাবসবুর্গ বংশীয়। তিনি প্রথমে বিয়ে করেছিলেন ফ্রান্সের ত্রয়োদশ লুইয়ের নাতনি, রাজকন্যা মেরি লুইসকে। ফলে ফ্রান্সের ক্ষমতাধিন বুর্বন রাজবংশের (House of Bourbon) সাথে তার আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি হয়। ১৬৮৯ সালে মেরি লুইসের মৃত্যু হলে চার্লস প্যালাটাইনের ইলেক্টরের মেয়ে মারিয়াকে বিয়ে করেন। কিন্তু শারীরিক অক্ষমতার জন্য চার্লস সন্তান উৎপাদনে ব্যর্থ ছিলেন। ফলে সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয় এবং তার বোনদের সন্তানের কথা সামনে চলে আসে। চার্লসের এক বোন মারিয়া থেরেসা ছিলেন ফ্রান্সের তৎকালীন রাজা চতুর্দশ লুইয়ের স্ত্রী, আরেক বোন মার্গারেট থেরেসার বিয়ে হয়েছিল হলি রোমান এম্পায়ার প্রথম লিওপোল্ডের সাথে। মার্গারেট থেরেসার কন্যা মারিয়া অ্যান্টোনিয়া আর তার স্বামী বাভারিয়ার প্রিন্স এবং ইলেক্টর ম্যাক্সের সন্তান যুবরাজ জোসেফ ফার্দিন্যান্ড।
যখন এটা পরিস্কার হয়ে গেল চার্লস কোনো উত্তরাধিকারী রেখে যেতে পারবেন না তখন স্পেনের সিংহাসন নিয়ে শুরু হলো হাবসবুর্গ আর বুর্বনদের দাবা খেলা। ১৬৯৮ সালে ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া আর ইংল্যান্ডের মধ্যে ফার্স্ট ট্রিটি অফ পার্টিশন স্বাক্ষরিত হয়। ইংল্যান্ডের স্বার্থ ছিল ভূমধ্যসাগরে তাদের বাণিজ্যপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, তাই তাদের কাছে স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের বিলিবন্টন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সবাই মিলে জোসেফ ফার্দিন্যান্দকে স্পেনের উত্তরাধিকারী নির্বাচন করে এবং স্প্যানিশ নেদারল্যান্ডস ও স্পেনের কলোনিগুলো তার হাতে ছেড়ে দিতে সম্মত হয়। ইতালিতে স্পেনের অংশ অস্ট্রিয়া আর ফ্রান্সের মাঝে ভাগাভাগির ফয়সালা হলো। মিলান পেল অস্ট্রিয়া, আর নেপলস এবং সিসিলি নিল ফ্রেঞ্চরা। এ সবকিছু হচ্ছিল চার্লসকে বাইরে রেখেই।
জোসেফ ফার্দিন্যান্ড কিন্তু স্পেনের রাজা হতে পারলেন না। ১৬৯৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি মারা যান। ফলে ফ্রান্স আর অস্ট্রিয়ার সাজানো পরিকল্পনা ভেঙে পড়ল। জুন মাসে ইংল্যান্ড আর ফ্রান্স এক চুক্তি করল, যেখানে পরের বছর ডাচ সাম্রাজ্যও স্বাক্ষর করে। স্পেন, স্প্যানিশ নেদারল্যান্ডস আর তাদের কলোনির অধিকর্তা হিসেবে প্রথম লিওপোল্ডের দ্বিতীয় সন্তান আর্চডিউক চার্লসের নাম প্রস্তাবিত হয়। ইতালিতে স্পেনের সমস্ত অংশ ফ্রান্সের ভাগে পড়ে। কিন্তু এখানে ভজঘট লাগিয়ে দেন হলি রোমান এম্পেরর স্বয়ং। তিনি সন্তানের জন্য অখন্ড স্পেন দাবি করে চুক্তি স্বাক্ষরে বিরত থাকেন।
এদিকে রাজা দ্বিতীয় চার্লস তার সাম্রাজ্য খণ্ডিত হয়ে যাক এটা কখনোই চাচ্ছিলেন না। ফলে প্রথম চুক্তিতেও তিনি রাজি ছিলেন না। এবার তিনিসহ স্প্যানিশ অভিজাতেরা দ্বিতীয় চুক্তির বিরোধিতায় কোমর বেঁধে লাগল। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে চার্লসের মনে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল হলো যে একমাত্র চতুর্দশ লুইয়ের পক্ষেই সম্ভব একীভূত স্প্যানিশ কনফেডারেশন বজায় রাখা। কাজেই ১৭০০ সালে তিনি লুইয়ের নাতি ফিলিপকে স্প্যানিশ মুকুটের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেন। কয়েক মাস পরে নভেম্বরে চার্লসের মৃত্যু ঘটল। নভেম্বরের ১৪ তারিখ চতুর্দশ লুই নাতিকে স্পেনের রাজা পঞ্চম ফিলিপ হিসেবে ঘোষণা করেন। ফ্রেঞ্চ সেনাবাহিনী স্প্যানিশ নেদারল্যান্ডসের দখল নেয়। ফলে ১৭০১ সালে লিওপোল্ডের সাথে অস্ট্রিয়া ইংল্যান্ড আর ডাচ সাম্রাজ্য ফ্রান্সের বিপক্ষে জোট গঠন করে। শুরু হলো স্প্যানিশ উত্তরাধিকারের যুদ্ধ (War of the Spanish Succession)।
এদিকে গ্র্যান্ড অ্যালায়েন্স যুদ্ধে প্রুশিয়ান বাহিনীর দক্ষতা সবার নজর কেড়েছিল। তাছাড়া ইলেক্টর হিসেবে ফ্রেডেরিকের আলাদা প্রভাবও যেকোনো পক্ষের কাছেই মূল্যবান। ফ্রান্সের সাথে লড়াই অত্যাসন্ন বুঝে অস্ট্রিয়া তাই ফ্রেডেরিককে দলে টানার চেষ্টা করল। ফ্রেডেরিক এবার কোনো ভুল করলেন না, তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন তাকে রাজা উপাধি প্রদান করলেই কেবল তিনি অস্ট্রিয়ার দলে যোগ দেবেন। তিনি যুক্তি দিলেন ব্র্যান্ডেনবার্গ হলি রোমান এম্পায়ারের অংশ ভাল কথা, কিন্তু ডুকাল প্রুশিয়া তো এম্পায়ারের সীমানার বাইরে। তাহলে তাকে প্রুশিয়ার রাজা ঘোষণা দিতে তো আইনগত কোনো বাধা নেই। অস্ট্রিয়ান হাবসবুর্গরা মেনে নিল। ১৬ নভেম্বর ১৭০০ সালে ফ্রেডেরিকের সাথে লিওপোল্ডের গোপনে এক চুক্তি স্বাক্ষর করে। ফ্রেডেরিককে প্রুশিয়ার রাজা মেনে নেয়া হয়, তবে এখানে টেকনিক্যাল একটি কৌশল অবলম্বন করা হলো। তাকে ডাকা হলো কিং ইন প্রুশিয়া বলে, কিং অফ প্রুশিয়া নয়। এর দ্বারা বোঝানো হলো তার রাজকীয় মর্যাদা শুধুমাত্র প্রুশিয়ার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, ব্র্যান্ডেনবার্গের উপর নয়। পরে ফ্রেডেরিকের নাতি ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেটের সময় তিনি কিং অফ প্রুশিয়া উপাধি ধারণ করেন।
রাজা হবার বিনিময়ে ফ্রেডেরিক অস্ট্রিয়ার রাজকীয় সেনাবাহিনীতে নিয়মিত প্রুশিয়ান সৈন্যদের সাথে অতিরিক্ত আরো আট হাজার যোদ্ধা প্রেরণ করেন। এছাড়া তিনি স্প্যানিশ সিংহাসন আর হলি রোমান এম্পায়ারের নির্বাচনে, এবং অন্যান্য অনেক বিষয়ে জার্মান রাষ্ট্রগুলোর সম্মেলনে হাবসবুর্গদের পক্ষে ভোট দিতে প্রতিশ্রুতি দেন। কনিগসবার্গে অভিষেক করে রাজা ফ্রেডেরিক চলে এলেন বার্লিন, নিজের রাজা উপাধি কাজে লাগিয়ে জার্মানিতে হনজোলার্ন বংশের ভূখণ্ডগুলো একত্রিত করতে লাগলেন। প্রুশিয়া যত দিন টিকে ছিলে বার্লিন ছিল তার রাজধানী।
উত্তরাধিকার যুদ্ধের পরিণতি
এদিকে ১৭০১ সালে লড়াই শুরু হলে প্রুশিয়ার সাথে হ্যানোভার, পর্তুগাল এবং আরো কিছু জার্মান রাজ্য ফ্রান্সের বিপক্ষ শিবিরে যোগ দেয়। ওদিকে বাভারিয়া, কোলন, মান্টুয়া আর স্যাভয় চতুর্দশ লুয়ের দলে ভিড়ল। তবে ১৭০৩ সালে স্যাভয় দল বদল করে। ১৭০২ সালে ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় উইলিয়ামের মৃত্যু হলে ফ্রেঞ্চবিরোধি জোটে তাদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে কিছুটা শঙ্কা তৈরি হয়। তবে উইলিয়ামের উত্তরাধিকারী রানী অ্যান জোটের পক্ষে লড়াই জারি রাখেন।
সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে ফ্রেঞ্চরা প্রথমে বেশ সাফল্য অর্জন করে। ১৭০৪ সালে চতুর্দশ লুই সরাসরি হাবসবুর্গ রাজধানী ভিয়েনা দখলের পরিকল্পনা করেন, তিনি জানতেন সফল হলে লিওপোল্ড কোণঠাসা হয়ে পড়বেন। তখন তাকে চাপ দিয়ে সুবিধাজনক শর্তে চুক্তি করা যাবে। সম্মিলিত ফ্রেঞ্চ-বাভারিয়ান সেনাবাহিনী ভিয়েনার দিকে যাত্রা করলে দানিউবের তীরে ছোট্ট গ্রাম ব্লানহাইমের (Blenheim) কাছে ব্রিটিশ জেনারেল মার্লবোরো (Marlborough) এবং স্যাভয়ের সেনাপতি ইউজিন তাদের বাধা দেন। ফ্রেঞ্চরা পরাজিত হয়ে পিছু হটে যায়। এরপর সম্মিলিত জোট বাহিনীর চাপে তারা দখলকৃত বহু অঞ্চল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ১৭০৬ সালে তুরিন অবরোধ ব্যর্থ হবার পর ইতালি থেকে লুই ফ্রেঞ্চ সেনাদের ফিরিয়ে নেন। কিন্তু স্পেনে পঞ্চম ফিলিপ ঠিকই গদি ধরে রাখেন।
১৭০৮ সালে শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি সুযোগ তৈরি হয়। ত্যক্ত-বিরক্ত লুই সন্ধির প্রস্তাব দেন। কিন্তু ব্রিটিশরা দাবি করে বসে যে ফ্রেঞ্চ সেনারা যেন ফিলিপকে স্পেনের সিংহাসন থেকে অপসারণ করে। নিজের নাতিকে উৎখাত করার এই অদ্ভুত দাবি যে লুইয়ের মনঃপুত হয়নি তা বলাই বাহুল্য। তিনি সন্ধির চেষ্টা বাতিল করে লড়াই চালিয়ে যান। তিন বছর ধরে এরপর মোটামুটি অচলাবস্থা বিরাজ করে। এদিকে ১৭১১ সালের এপ্রিলে লিওপোল্ডের সন্তান আর্চডিউক চার্লস অস্ট্রিয়ান হাবসবুর্গদের উত্তরাধিকারী নির্বাচিত হন। সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী তার হাতেই স্পেনের মসনদ তুলে দেবার কথা ছিল। কিন্তু তিনি পরবর্তী হাবসবুর্গ সম্রাট মনোনীত হওয়ায় তার হাতে স্পেনের ক্ষমতা ছেড়ে দেবার ব্যাপারে ইংল্যান্ড এবং ডাচ সাম্রাজ্যের ভাবান্তর উপস্থিত হয়।
চার্লসের হাতে এত বড় সাম্রাজ্য তুলে দেবার জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াকে তারা অনর্থক মনে করল। এদিকে জেনারেল মার্লবোরোকেও সেনাদায়িত্ব থেকে ১৭১১ সালে অপসারণ করা হলো। সব পক্ষই যুদ্ধ করতে অনিচ্ছুক হওয়ায় ১৭১২ সালে আরম্ভ হলো শান্তি আলোচনা। জোটের সদস্য দেশগুলোর সাথে ফ্রান্সের আলাদা আলাদাভাবে উট্রেখট (Utrecht ), রাস্টাট (Rastatt) আর ব্যাডেন (Baden) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফিলিপ স্পেনের রাজা থেকে যান, কিন্তু স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের অনেক এলাকা বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যায়। ভূখণ্ড প্রাপ্তির দিকে থেকে সবথেকে বেশি লাভবান হল ইংল্যান্ড। আগের মতোই প্রুশিয়ার ভাগ্যে তেমন কিছু জুটল না। উট্রেখট চুক্তির ফলে তারা পেল সুইজারল্যান্ডের একখণ্ড এলাকা নুশ্যাটেল (Neuchâtel) আর রাইনের তীরবর্তী কিছু জমি।
ফ্রেডেরিকের শাসন এবং পরবর্তী রাজা
ফ্রেডেরিক তার রাজত্বকে ভাগ করলেন কয়েকটি প্রদেশে। প্রতিটি প্রদেশের জন্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন করা হলো। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে স্থাপিত হল কলকারখানা, সরকারি জমি শিল্পোন্নয়নের কাজে ব্যবহৃত হতে লাগল। শিল্পকলার প্রতি অনুরাগ থেকে ফ্রেডেরিক প্রচুর খরচ করতেন। এই ব্যাপারে তার দ্বিতীয় স্ত্রী সোফি শার্লট অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়। ১৭০০ সালে ফ্রেডেরিক উদ্বোধন করেন অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস, বিখ্যাত দার্শনিক লিবনিজ (Gottfried Wilhelm Leibniz) ছিলেন এর প্রথম প্রেসিডেন্ট।
উত্তরাধিকার হিসেবে ফ্রেডেরিক নির্বাচন করেন তার বেঁচে থাকা সন্তান ফ্রেডেরিক উইলিয়ামকে (জন্ম ১৬৮৮), যার জন্ম হয়েছিল দ্বিতীয় স্ত্রী সোফি শার্লটের গর্ভে। ফ্রেডেরিকের প্রথম স্ত্রী এলিজাবেথ হেনরিয়েটার ঘরের কন্যাসন্তান লুইস ডরোথি নিঃসন্তান অবস্থায় ১৭০৫ সালে মারা যান। ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের বড় ভাই ফ্রেডেরিক অগাস্টের মৃত্যু হয় শিশুকালেই। তৃতীয় স্ত্রী সোফিয়া লুইসের সাথে ফ্রেডেরিকের কোনো সন্তান হয়নি। ফলে ১৭১৩ সালে ফ্রেডেরিক মারা গেলে ফ্রেডেরিক উইলিয়াম হলেন প্রুশিয়ার দ্বিতীয় রাজা, প্রথম ফ্রেডেরিক উইলিয়াম।
অ্যাম্বার রুম
অ্যাম্বার হলো গাছের রস নিঃসৃত একপ্রকার রেজিন, যার জমাটবদ্ধ রূপ রত্নপাথর হিসেবে বেশ মূল্যবান। বাল্টিক সাগরের তীরে অ্যাম্বারের বিশাল ডিপোজিট ছিল। ফ্রেডেরিক উইলিয়াম ও তার স্ত্রী সোফি-শার্লট অ্যাম্বার ব্যবহার অনন্য কোনো শিল্পকর্মের পরিকল্পনা করেছিলেন। ১৭০১ সালে স্থপতি আন্দ্রেয়াস শ্লুটাকে এই দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি বার্লিনে রাজার বাসস্থান শার্লটেনবার্গ প্রাসাদের একটি কক্ষকে অ্যাম্বারের প্যানেল দিয়ে সাজিয়ে তুলতে চাইলেন। ড্যানিশ অ্যাম্বার হস্তশিল্পি উলফ্র্যামকে সাথে নিয়ে তিনি কাঠের ব্লকের উপর অ্যাম্বার, সোনা আর অন্যান্য মূল্যবান পাথর বসিয়ে তিনি তৈরি করলেন সুদৃশ্য প্যানেল। ১৭০৭ সাল থেকে শ্যাচট (Ernst Schacht) আর টুরাউ (Gottfried Turau) তাদের কাজ এগিয়ে নেন। অবশেষে বার্লিনের সিটি প্যালেসে এই প্যানেলগুলো স্থাপন করা হয়। ১৭১৬ সালে জার পিটার দ্য গ্রেট বার্লিনে এসে অ্যাম্বার রুম দেখে মুগ্ধ হন। রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের রাস্তা দেখতে পেয়ে তৎকালীন রাজা পিটারকে অ্যাম্বার রুম উপহার দেন (রোর বাংলায় প্রকাশিত অ্যাম্বার রুমের ঘটনা পড়তে ক্লিক করুন এখানে)।
এই সিরিজের আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে:
১) পর্ব ১ – প্রাচীন প্রুশিয়া
২) পর্ব ২ – ব্র্যান্ডেনবার্গ-প্রুশিয়া
৩) পর্ব ৩ – ইউরোপের আকাশে কাল মেঘ