ঝড়ের মুখে
যুদ্ধ শেষ হলেও বিপদ কিন্তু কাটেনি। বাতাসের গতিপ্রকৃতি দেখে ব্রিটিশরা বুঝতে পারল যে দ্রুত ঘনিয়ে আসছে বিশাল ঝড়। কিন্তু সমস্যা হলো গোলার লড়াইয়ের পর ব্রিটিশদের অনেকগুলো জাহাজ ভয়াবহভাবে বিধ্বস্ত। প্রচুর মেরামত করতে হবে পুনরায় এগুলোকে চলাচলের যোগ্য করে তুলতে। ২১ অক্টোবর থেকেই নাবিকেরা লেগে গেল সমস্ত জঞ্জাল পরিষ্কার করে জাহাজ মেরামতের কাজে। ২২ তারিখ সাগর এমনই উত্তাল হয়ে উঠল যে কাজ চালিয়ে যাওয়াই দুরূহ হয়ে উঠল। বাধ্য হয়ে বন্দি ফরাসি ও স্প্যানিশ নাবিকদের মুক্ত করে তাদের নিয়েই কাজে নামল ব্রিটিশ নাবিকেরা। মাত্র একদিন আগে যারা একে অপরকে হত্যা করতে চাইছিল, প্রকৃতির খেয়ালে আজ তারাই কাঁধে কাধ মিলিয়ে কাজ করছে। দ্রুত জাহাজ ছাড়া হলো, গন্তব্য জিব্রাল্টার।
ঝড়ের দাপটে সাগর তার বুকে থাকা জাহাজগুলো নিয়ে ছেলেখেলায় মেতে উঠল। রিডাউটেবলের দুরবস্থার কারণে ব্রিটিশ সুইফটশুর জাহাজ তাকে নিজের সাথে বেঁধে রেখেছিল। কিন্তু প্রচণ্ড বাতাস আর ঢেউয়ে রিডাউটেবলে পানি উঠতে থাকলে পরিষ্কার হয়ে গেল যে জাহাজের দিন শেষ হয়ে এসেছে। দ্রুত অন্যান্য জাহাজ থেকে নৌকা পাঠানো হলো রিডাউটেবলে থেকে যাওয়া আহত নাবিকদের নিয়ে আসতে। কিন্তু জাহাজ এত দ্রুত ডুবছিল যে মাত্র ১০০ জনকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। ২২ অক্টোবর রাত দশটার দিকে রিডাউটেবল তলিয়ে গেল আটলান্টিকে। কয়েকজন নাবিক কাঠের টুকরো ধরে ভেসে ছিল, তাদের পরদিন ভোরে অন্য জাহাজ তুলে নেয়।
বেলেইলকে টেনে নিতে থাকে ফ্রিগেট নাইয়াড, উদ্দেশ্য জিব্রাল্টার। ফুগু আর মনার্কও জিব্রাল্টারের পথে থাকার সময় পাথরের সাথে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যায়। মনার্কে ফরাসিদের সাথে টেমেরেইরের ৩০ জন নাবিক ছিল। সবার সলিল সমাধি হলো। আলজেসিরাসের ৫০ জন ব্রিটিশ নাবিক বন্দি শত্রু নাবিকদের নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে কাদিজে এসে পৌঁছল। এখানে ব্রিটিশদের উল্টো বন্দি করে স্প্যানিশরা।
ত্রিনিদাদ তিন দিন ধরে ভেসে থাকে সাগরে। এই সময় ব্রিটিশ জাহাজ রিভেঞ্জ আর অ্যাজাক্স মৃতদের সাগরে ফেলে দিয়ে ত্রিনিদাদের আহতদের নৌকায় তুলে নিয়ে আসতে থাকে। ত্রিনিদাদে থাকা ১,১১৫ জন মানুষের মাত্র অর্ধেককে বাঁচানো সম্ভব হয়। ২৪ অক্টোবর প্রতিকূল আবহাওয়ায় উদ্ধার অভিযান বন্ধ করে দেয়া হয়, তখনও জাহাজের রয়ে গিয়েছিল গুরুতরভাবে আহত অনেক লোক। তাদের নিয়ে ডুবতে থাকে ত্রিনিদাদ।
কলিংউডের পতাকাবাহী জাহাজ সভারেইনকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে আরেক ব্রিটিশ জাহাজ। নেলসনের মৃতদেহ নিয়ে ভিক্টরিকে টেনে নেয় ব্রিটিশ নেপচুন। ২৮ অক্টোবর নিরাপদেই জিব্রাল্টার প্রণালীতে প্রবেশ করল ভিক্টরি আর নেপচুন।
এদিকে গ্র্যাভিনার সাথে কাদিজের দিকে চলতে থাকা জাহাজগুলোতে ছিলেন ফরাসি কমোডোর কসম্যাও। ২৩ অক্টোবর তিনি পাঁচটি জাহাজ নিয়ে আবার নাক ঘোরালেন খোলা সমুদ্রের দিকে। তার লক্ষ্য কাদিজের পাশ দিয়ে যাবার সময় ব্রিটিশ জাহাজ দখল করা। অবস্থা বেগতিক দেখে কলিংউড নির্দেশ দিলেন দখল করা জাহাজ পুড়িয়ে ডুবিয়ে দেয়ার। কনকারার টেনে নিচ্ছিল ফরাসি ফ্ল্যাগশিপ বুস্যান্টরকে। কলিংউডের আদেশে তারা বুস্যান্টরকে ছেড়ে দেয়। ব্রিটিশ নাবিকসহ ভাসতে ভাসতে বুস্যান্টর পার্শ্ববর্তী উপকূলের দিকে চলে যায়। ইন্ডম্পটেবলসহ ফরাসি দুটি জাহাজের অনেক নাবিককে তুলে নেয়। ওদিকে বুস্যান্টর কাদিজের কাছে চলে এলে জাহাজে থেকে যাওয়া ব্রিটিশ নাবিকদের বন্দি করা হয়।
এদিকে কসম্যাওর বহরে যোগ দেয় পাঁচটি ফ্রিগেট। এই নিয়ে তিনি মুখোমুখি হলেন দশটি ব্রিটিশ জাহাজের। তবে বড় রকমের কোনো সংঘাত এখানে হলো না। কসম্যাও ব্রিটিশদের দখলকৃত স্যান্টা অ্যানা আর নেপচুনো জাহাজ দুটি পুনরায় ছিনিয়ে নিলেও তাকে গচ্চা দিতে হয় তিনটি জাহাজ। সাগরের অবস্থার ক্রমেই অবনতি হতে থাকলে দুই পক্ষই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে চলে যায়। কলিংউড দখল করা সমস্ত শত্রুজাহাজই ধ্বংস করে দেয়ার সিদ্ধান্ত এর ফলেই নিয়েছিলেন, কারণ ঝড়ের মুখে তার নিজের বাহিনী বাঁচানোর চিন্তাই ছিল সবার আগে। তবে শেষাবধি তিনি একটি ফরাসি ও তিনটি স্প্যানিশ জাহাজ অক্ষত রাখতে সমর্থ হন।
এদিকে ইন্ডম্পটেবল প্রায় ১,০০০ লোক নিয়ে ধাক্কা খায় তীরের সাথে। প্রচণ্ড শব্দ করে দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায় জাহাজ। মাত্র ১০০ জনের মতো প্রাণে বাঁচতে সমর্থ হলো। স্প্যানিশ জাহাজ রায়ো কাদিজের দিকে আসার পথে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ ডনেগলের হস্তগত হয়। ঝড়ের কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অনেক ব্রিটিশ জাহাজ থেকে অনেক নাবিক সাগরে পড়ে যায়, তাদের অধিকাংশই স্প্যানিশ নিয়ন্ত্রিত এলাকার তীরে ওঠে। এখানে তারা শত্রুদের হাতে বন্দি হয়।
এই ট্রাফালগারের ক্যাম্পেইনের সর্বশেষ লড়াই সংঘটিত হলো নভেম্বরের ২ তারিখ। ফেনেস্টার অন্তরীপের অদূরে বিস্কে উপসাগরে স্যার রিচার্ড স্ট্র্যাচেন চারটি জাহাজ নিয়ে ফরাসি ল্যু পেলির ফরমিডেবল এবং আরো তিনটি জাহাজের সাথে লড়াইতে জড়িয়ে পড়েন। ব্রিটিশদের মাত্র ২৪ জন নিহত ও ১১১ জন আহতের বিপরীতে ফরাসিদের ৭৫০ জন মারা যায়। চারটি শত্রুজাহাজ হস্তগত করে স্ট্র্যাচেন প্লাইমাউথে নিয়ে আসেন, যেগুলো পরে রয়্যাল নেভির হয়ে সাগরে নামানো হয়।
গ্র্যাভিনার নেতৃত্বে থাকা কয়েকটি জাহাজ কাদিজে এসে পৌঁছে। ক্ষতস্থানে সংক্রমণের কারণে স্প্যানিশ অ্যাডমিরাল মৃত্যুবরণ করেন। আহতদের আহাজারিতে কেঁপে ওঠে চারিদিক। প্রায় দশদিন ধরে কাদিজের লোকেরা আহতদের জাহাজ থেকে নামিয়ে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যায়। এদিকে ১৫ অক্টোবর ভিল্যেনুভকে প্রতিস্থাপন করা অ্যাডমিরাল রসিলি কাদিজে এসে পৌঁছেছেন। তার কাঁধে দায়িত্ব পড়ল ট্রাফালগারের পরাজয়ের খবর নেপোলিয়নকে জানানো। তিনি আহতদের চিকিৎসা আর নিহতদের কবরস্থ করার ব্যবস্থাও গ্রহণ করলেন।
বিজয়ের বার্তা
কলিংউডের লেখা বিজয়ের খবর নিয়ে লেফটেন্যান্ট লেপোন্টিয়ের পিকল জাহাজে করে ৫ নভেম্বর পৌঁছলেন ইংল্যান্ডের ফ্যালমাউথ। কয়েকবার ঘোড়া বদলিয়ে পরদিন ভোর ১:৩০ মিনিটে তিনি এসে পৌঁছলেন লন্ডনের হোয়াইট হলে অবস্থিত রয়্যাল নেভির হেডকোয়ার্টারে। নৌবাহিনীর কর্মকর্তা উইলিয়াম মার্সডেন অবিলম্বে মিডলটনকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে বিজয়ের সুসংবাদ দিলেন। নেলসনের মৃত্যুর কথাও তার কানে দেয়া হলো। দ্রুত ট্রাফালগারের খবর লিখিত আকারে প্রধানমন্ত্রী, রাজা এবং লন্ডনের সংবাদপত্রের কাছে বিলি করা হলো।
ইংল্যান্ডের তখন একটা জয়ের খুব দরকার। মাত্র একদিন আগেই খবর এসেছে নেপোলিয়ন অস্ট্রিয়ানদের এক বাহিনীকে পরাস্ত করেছেন। পরবর্তীতে অস্টারলিটজের যুদ্ধে তিনি অস্ট্রো-রাশিয়ান মিলিত শক্তিকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। কিন্তু ট্রাফালগারের কারণে সাগরে রয়্যাল নেভি ঠিকই আধিপত্য বজায় রাখে।
নেলসনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া
২৮ অক্টোবর জিব্রাল্টারে আহতদের নামায় ভিক্টরি। এক সপ্তাহ পর নেলসনের মরদেহ নিয়ে ভিক্টরি যোগ দেয় ব্রিটিশ নৌবহরের সাথে। ২৩ ডিসেম্বর জাহাজ এসে পৌঁছল পোর্টসমাউথে। এখান থেকে আলাদা জাহাজ পতাকা মোড়ানো কফিন বয়ে নিয়ে যায় গ্রিনউইচের হাসপাতালে। সেখানে তিন দিন ধরে প্রায় এক লাখ লোক কফিনের সামনে এসে শোক প্রকাশ করে।
১৮০৬ সালের জানুয়ারির ৮ তারিখ টেমস ধরে অসংখ্য নৌকার মধ্য দিয়ে কফিন নিয়ে আসা হয় লন্ডন। ৯ তারিখে রাস্তার দুধারে দাঁড়িয়ে থাকা হাজার হাজার লোকের মাঝ দিয়ে কফিন নিয়ে যাওয়া হয় সেন্ট পল’স ক্যাথেড্রালে। কফিনের সঙ্গী হন রাজপরিবারের সদস্য, মন্ত্রীপরিষদ, অভিজাতবর্গ, ৩২ জন অ্যাডমিরাল, শতাধিক ক্যাপ্টেনসহ বহু উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব।
বন্দি ফরাসি অ্যাডমিরাল ভিল্যেনুভক নিয়ে আসা হয়েছিল লন্ডনে। তিনিও শরিক হন নেলসনের শেষযাত্রায়। ক্যাথেড্রালে আনুষ্ঠানিকতা শেষে নেলসনকে কবরস্থ করা হয়। লন্ডনের ট্রাফালগার চত্বরের নাম হয় তারই নামে। নেলসনের নামে ইংল্যান্ডের অনেক জায়গায় রাস্তাঘাটের নামকরণও করা হয়। ইংল্যান্ড ২১ অক্টোবর ট্রাফালগার দিবস হিসেবে পালন করে থাকে।
ফরাসি অ্যাডমিরাল ভিল্যেনুভ ১৮০৫ সালের শেষদিকে মুক্তি পেয়ে ফ্রান্সে ফিরে আসেন। এখানে তিনি নতুন করে সামরিক বাহিনীতে যোগদানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এরই মধ্যে ১৮০৬ সালের ২২ এপ্রিল পরেই রেনে শহরের এক হোটেলে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। তার শরীরে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন ছিল। সাধারণভাবে ট্রাফালগারে পরাজয়ের লজ্জায় তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে উল্লেখ করা হলেও অনেকে এখানে ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পান।
নেলসন রাষ্ট্রীয়ভাবে এমা হ্যামিল্টনের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ জানিয়ে লিখে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক না থাকায় তার অনুরোধ উপেক্ষা করা হয়। তবে নেলসন এবং আগের স্বামীর থেকে পাওয়া টাকাকড়ি দিয়ে হ্যামিল্টন তার মেয়ে হোরাশিয়াকে নিয়ে অনেকদিন ভালই চলছিলেন। কিন্তু তার খরচের হাত ছিল অনেক লম্বা। ফলে প্রচুর দেনায় জড়িয়ে পরে তিনি পালিয়ে যান ক্যালাইসে। সেখানেই ১৮১৫ সালে কপর্দকহীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। হোরাশিয়াকে দত্তক নেন নেলসনের ছোট বোন। তিনি মারা যান ১৮৮১ সালে।
ট্রাফালগারের গুরুত্ব
ট্রাফালগারের সংঘর্ষের ব্যাপকতা একটি উদাহরণ দিলে নিশ্চিতভাবে বোঝা যাবে। দশ বছর পর সংঘটিত ইতিহাসবিখ্যাত ওয়াটারলুর যুদ্ধে ট্রাফালগারের থেকে বেশি সেনা অংশ নিলেও গোলাবারুদ খরচ হয়েছিল ট্রাফালগারের মাত্র ৭.৩ ভাগ। ট্রাফালগারে ব্রিটিশ বহরে ছিল ২,১৪৮টি কামান এবং ১৭,০০০ এর মতো নাবিক। অন্যদিকে ফরাসি-স্প্যানিশ যৌথ বাহিনীর ছিল ২,৬৩২টি কামান এবং প্রায় ৩০,০০০ সেনানী। দুই পক্ষের সম্মিলিত সামরিক শক্তির হিসেবে তৎকালীন অন্যতম বৃহৎ নৌযুদ্ধ হিসেবে ট্রাফালগার স্বীকৃত।
ট্রাফালগারকে মনে করা হয় ইতিহাসের অন্যতম মোড় নির্ণায়ক নৌযুদ্ধ। এর মাধ্যমে নেপোলিয়নের সাগরপথে ইংল্যান্ডে প্রবেশের পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়ে। তবে ট্রাফালগারের সবথেকে বড় সুফল ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী ফরাসি ও স্প্যানিশ নৌবাহিনীকে হটিয়ে একক শক্তি হিসেবে সাগরে ব্রিটেনের আত্মপ্রকাশের পথ সুগম হওয়া। সাগরে অজেয় রয়্যাল নেভির হাত ধরেই দিকে দিকে ব্রিটিশ উপনিবেশ গড়ে ওঠে, ফুলেফেঁপে উঠতে থাকে ব্রিটিশ অর্থনীতি।
পরবর্তী এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে বজায় ছিল রয়্যাল নেভির আধিপত্য। তবে এটাও ঠিক যে কিছু কিছু ঐতিহাসিক এককভাবে এই কৃতিত্ব ট্রাফালগারকে দিতে নারাজ। তাদের যুক্তি- ট্রাফালগারে ফরাসি নৌবাহিনীর ক্ষুদ্রাংশই অংশ নিয়েছিল। তাদের বড় একটি বহর তখনও ব্রেশটে এবং অন্যান্য কিছু বন্দরে অক্ষত ছিল। ট্রাফালগারের পরবর্তী অন্যান্য নৌযুদ্ধের পরেই কেবল ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির আধিপত্য নিশ্চিত হয়। তবে এটা তারা মেনে নেন যে স্প্যানিশ নৌশক্তি ট্রাফালগারের ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি।