ভারতীয় রাজনৈতিক, লেখক ও প্রাক্তন আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ড. শশী থারুর। ভারতে ব্রিটিশ শাসন নিয়ে কাজ করেছেন তিনি, রচনা করেছেন Inglorious Empire: What the British did to India নামক একটি তুমুল আলোচিত বই। ২০১৭ সালের মার্চে প্রকাশিত হয় বইটি। তখনই বইটির প্রচারণার লক্ষ্যে যুক্তরাজ্যে যান তিনি। লন্ডন স্কুল অভ ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সে বসে বইটির বিষয়বস্তু সম্পর্কে তিনি একটি সাক্ষাৎকার দেন সাউথ এশিয়া সেন্টারের পরিচালক ড. মুকুলিকা ব্যানার্জিকে। সেই সাক্ষাৎকারের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ তুলে ধরা হচ্ছে রোর বাংলার পাঠকদের জন্য।
ব্রেক্সিট নিয়ে আলোচনা এখন তুঙ্গে। এই সময়ে আপনি লিখছেন, উত্তর-ঔপনিবেশিক কর্তব্য হিসেবে ব্রিটিশ স্মৃতিকারতাকে শান্ত করার প্রয়োজনীয়তা এখনই সবচেয়ে বেশি। আপনি কি বিশদে ব্যাখ্যা করবেন যে এ কথা দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছেন?
গত ১৫-২০ বছর ধরে বন্যার তোড়ের মতো অসংখ্য জনপ্রিয় ও ভালো-মূল্যায়ন পাওয়া, ক্ষেত্রবিশেষে বেস্টসেলারের তকমা পাওয়া, বই প্রকাশিত হয়েছে, যেগুলোতে আবারো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা চলেছে। যেমন ধরুন, প্রফেসর নায়াল ফারগুসন দাবি করছেন, উত্তর-ঔপনিবেশিক অর্থনীতির ভিত তৈরি করে দেওয়ার পেছনে ব্রিটিশদের অপরিহার্য ভূমিকা রয়েছে। তাদের বদৌলতেই আজ উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশগুলো একবিংশ শতকের বিশ্বায়নের ফায়দা লুটতে পারছে। বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে এই দাবিকে আমার খানিকটা আপত্তিকর মনে হলেও, এতে অন্তত কিছুটা হলেও সত্যতা রয়েছে।
কিন্তু অনেকে আরো বেশি মিথ্যা দাবি করছেন, যেমন- লরেন্স জেমস ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে আখ্যায়িত করেছেন নিখাদ পরোপকারিতার চর্চা হিসেবে। জনপরিসরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে এমন জড়বুদ্ধির মতো গ্ল্যামারাইজ করার প্রবণতাকে কখনোই খুব একটা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়নি। আমি নিশ্চিত যে অনেক পণ্ডিতই এসব দাবি খারিজ করে দেবেন। কিন্তু বইগুলোতে সামগ্রিক যে চিত্র আঁকা হয়েছে, তা পড়ে গড়পড়তা বুদ্ধিবৃত্তির পাঠকরা ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশদের কেবল ইতিবাচক উপস্থাপনই দেখতে পাবে। কেননা ইতোমধ্যেই তারা এমন সব টেলিভিশন শো-ও দেখে ফেলেছে, যেগুলোতে টিনের চশমার ভেতর থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে রোমান্টিসাইজ করা হয়েছে।
মোটেই আশ্চর্যের বিষয় না যে ২০১৪ সালের একটি ইউগভ জরিপে দেখা গেছে ৫৯ শতাংশ ইংরেজ জনগণই মনে করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য একটি ভালো ব্যাপার ছিল। তারা এ নিয়ে গর্বিত, এবং একে ফিরেও পেতে চায়। তবে আমি যখন আমার বইটি লিখছিলাম, তখন জানতাম না যে ২০১৬ সালে ফের এমন একটি জরিপ হয়েছে। ২০১৬ সালে ইউগভের সেই জরিপে দেখা গেছে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ব্যাপারে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করে ৪৪ শতাংশ মানুষ। সংখ্যাটি যদিও নেমে এসেছে, তারপরও ৪৪ বেশ তাৎপর্যপূর্ণ একটি সংখ্যা। এর নেপথ্যে একটি ব্যাখ্যাই থাকতে পারে যে ইংরেজদের কাছে এ প্রসঙ্গে খুব বেশি পরিমাণ তথ্য নেই, তারা এ ব্যাপারে যথেষ্ট শিক্ষা বা সচেতনতা লাভ করেনি। এবং আমার মনে হয়, এই সমস্যা নিয়ে এখন কথা বলা দরকার। এটি খুবই লজ্জাজনক একটি বিষয় যে এদেশে ঔপনিবেশিক ইতিহাস সম্পর্কে কিছু না জেনেও ইতিহাসে ‘এ’ লেভেল সম্পন্ন করে ফেলা যায়। যা হোক, আমি তো এমনকি এ কথাও বলব যে আপনার জেন অস্টিন পড়া উচিত হবে না, যদি না আপনি এটি অনুধাবন করতে পারেন যে অস্টিন তার লেখায় যে জীবনধারার বর্ণনা দিয়েছেন, সেই জীবনধারার দাম মিটিয়েছে ক্যারিবিয়ানের চিনির কারখানার দাসেরা, তাদের রক্ত-ঘামের বিনিময়ে। ব্রিটেনে এই অজ্ঞানতার অদৃশ্য উপস্থিতি রয়েছে গত ২০০ বছর ধরেই, এবং এই ভুল সংশোধন আবশ্যক।
ঔপনিবেশিকতা সম্পর্কে আপনার যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেখানে মুঘল সাম্রাজ্যের অবস্থান কোথায়? এর আগে আপনি আপনার বইতে উল্লেখ করেছেন যে ব্রিটিশরা ভারতের পূর্ববর্তী দখলদারদের চেয়ে একদমই আলাদা ছিল।
ব্রিটিশরা ভিন্ন ছিল এই অর্থে যে তাদের কোনো দায়বদ্ধতা ছিল না দেশটির প্রতি। মুঘলরা ছিল এমন ধরনের দখলদার, যারা আগেও এ দেশে এসেছিল, এবং পরে এখানেই থেকে যায় এবং এদেশের সঙ্গে আত্মিকভাবে জড়িয়ে পড়ে। যেমন ধরুন, প্রত্যেক মুঘল সম্রাটই (প্রথমজন বাদে) ছিলেন কোনো না কোনো ভারতীয় নারীর গর্ভজাত সন্তান। মুঘলরা ভারতকে তাদের নিজেদের বাড়ি হিসেবে দেখত। তারা কখনো ফিরে যায়নি, কিংবা কখনো নিজেদের সব ধন-সম্পত্তিকে ফেরতও পাঠিয়ে দেয়নি। তারা ভারতে বিনিয়োগ করেছে, এখানে শিল্পী ও প্রকৌশলী, চিকিৎসক, সঙ্গীতবিদ, চিত্রকরদের নিয়ে এসেছে, এবং এই নতুন অঞ্চলের সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছে।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে, ব্রিটিশরা তা করেনি। ব্রিটিশ রাজের লক্ষ্য ছিল ভারত থেকে অর্থ ও সম্পদ হাতিয়ে নিয়ে সেগুলোকে ইংল্যান্ডে ফেরত পাঠানো। এক হিসেবে জানা গেছে, এমনকি ভারতে কর্মরত ব্রিটিশ সরকারি চাকুরিজীবীরাও তাদের বেতনের ৮০ শতাংশ ফেরত পাঠাত ইংল্যান্ডে। একসময় দিল্লির দরবারকে কেন্দ্র করে বিলাসবহুল পণ্যের নানা ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছিল। সেখান থেকেই উৎপন্ন হতো শ্রেষ্ঠতম রেশমি কাপড়, গহনা এবং অভিজাতবর্গের আরাম-আয়েশের দ্রব্যাদি। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে সেসব শিল্পের পতন ঘটে। কারণ ব্রিটিশরা ভারতীয় শৌখিনতায় আগ্রহী ছিল না। তারা তাদের টাকা পাঠিয়ে দিত নিজ দেশে, তারপর বিলাসদ্রব্য কিনত লন্ডন ও প্যারিস থেকে।
আপনি এমন দাবিরও সমালোচনা করেছেন যে ব্রিটিশরা ভারতকে নানা ক্ষেত্রে গণতন্ত্র দিয়েছে। বিশেষভাবে সংসদীয় ব্যবস্থাকে আপনি উল্লেখ করেছেন ভারতীয় রাজনীতির বহু সমস্যার উৎস হিসেবে। কীভাবে এই ব্যবস্থার সংস্কার করা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
আমি এই ব্যবস্থার জায়গায় নিয়ে আসতাম প্রেসিডেনশিয়াল ব্যবস্থা, কিংবা নিদেনপক্ষে এমনভাবে সংসদীয় ব্যবস্থার সংস্কার করতাম যাতে রাষ্ট্রপতির হাতেই প্রকৃত ক্ষমতা যায়, এবং রাজ্য ও জাতীয় সংসদের ইলেক্টোরাল কলেজের পরিবর্তে তিনি সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। তাছাড়া ব্যবস্থাটি এমনভাবেও গড়ে তুলতে হবে, যেন বিধানিক সভার সংখ্যাগরিষ্ঠতার পরিবর্তনের উপর ভিত্তি করেই নতুন নতুন সরকার না আসে। আমি দৃঢ়ভাবে ক্ষমতার পৃথকীকরণে বিশ্বাসী। আমার মনে হয় না যে আপনি যাদেরকে নির্বাচিত করবেন আইন প্রণয়নকারী হিসেবে, তারাই আবার হয়ে উঠবেন নির্বাহী শাসক। কারণ এগুলো ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্ব, এবং এগুলোর সংজ্ঞায়নও হওয়া উচিত সেভাবেই।
ভারতের পরিস্থিতিতে প্রেসিডেনশিয়াল ব্যবস্থাই কেন বেশি কার্যকর হবে?
প্রথম চ্যালেঞ্জটি হলো দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতার। এই মুহূর্তে সংসদীয় ব্যবস্থায় এত বেশি পরস্পরবিরোধী প্রভাব যে কারো হাতেই সত্যিকারের ক্ষমতা নেই। ব্যতিক্রমী শক্তিশালী শাসক হিসেবে আগে ভারত পেয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীকে, এবং এখন রয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু ২০১৪ সাল অবধি, বিগত ২৫ বছরে, প্রতিটি সরকারই জোট গড়ে তুলেছে এবং অন্যের সমর্থন-সহযোগিতার উপর নির্ভরশীল থেকেছে। এভাবে প্রতিটি সরকারই পতিত হয়েছে তাদের সম্ভাব্য সর্বনিম্ন অবস্থানে। তাই কোনো সংস্কার, কোনো সাহসী পদক্ষেপই ফলপ্রসূ হবে না, যদি না আপনার জোটের সকল সদস্য দলই ঐক্যমতে পৌঁছায়। এভাবে সৃষ্টি হয় নিষ্ক্রিয়তা ও সিদ্ধান্তহীনতার; দেশ যে ধরনের নিষ্পত্তিমূলক কার্যক্রম চায় তা অর্জিত হয় না। তার উপর আরেকটি প্রশ্নও রয়ে যায় যে, কে কোন কাজের জন্য দায়ী থাকবে? যখন আমি প্রেসিডেনশিয়াল ব্যবস্থার কথা বোঝাচ্ছি, আমি শুধু দিল্লিকেই বোঝাচ্ছি না, আমি বোঝাচ্ছি রাজ্য সরকার, পৌর মেয়র, গ্রাম প্রধান সকল স্তরের কথা। আমি চাই তাদের সকলের হাতেই যেন প্রকৃত ক্ষমতা থাকে।
তার মানে সেখানে একটি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের ব্যাপারও জড়িত থাকবে?
ঠিক তাই। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি একজন পৌর মেয়রের কথা। তার পদটা তো নিছকই কৌতুক। কোনো কাজেই তার কর্তৃত্ব বা বাজেটীয় নিয়ন্ত্রণ নেই। মেয়ররা নির্বাচিত হন ঠিকই, কিন্তু তাদেরকে নির্বাচিত করা জনগণের প্রতি তাদের কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না, কেননা তাদের নিজেদেরই তো কোনো কাজের ক্ষমতা নেই। প্রকৃতপক্ষে, আমরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখেছি, যার ফলে যেকোনো ভারতীয় শহরে মিউনিসিপ্যাল কমিশনারের মতো একজন অনির্বাচিত আমলার কাছেও একজন নির্বাচিত মেয়রের চেয়ে বেশি ক্ষমতা ও বাজেটীয় কর্তৃত্ব কুক্ষিগত থাকে।
এই সমস্ত কিছুর সংস্কার করতে হবে যাতে করে আমরা এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি যেখানে নির্ধারিত সময়ের জন্য নির্দিষ্ট ক্ষমতা ও বাজেটীয় কর্তৃত্ব দিয়ে কিছু মানুষকে নির্বাচিত করা যায়। এটাও নিশ্চিত করতে হবে যেন জোটের কোনো একটি অংশ বেঁকে বসলেই তাদের দপ্তর অকার্যকর বা ভঙ্গুর হয়ে না যায়। তাদেরকে চার বছর, পাঁচ বছর, বা যেকোনো একটা নির্ধারিত মেয়াদ দেওয়া হোক, এবং এই সময় শেষে তাদেরকে নিজ নিজ কাদের জন্য জবাবদিহি করা হোক। তখন আর কোনো অজুহাতেরই অবকাশ থাকবে না: আপনার হাতে ক্ষমতা ছিল, কী করেছেন আপনি আমাদের জন্য?
সংসদীয় ব্যবস্থা হয়তো কাজ করবে কোনো ছোট দ্বীপরাষ্ট্রে, যেখানে এমনকি আজকের দিনেও একজন সংসদ সদস্য মাত্র ১ লক্ষ ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করেন। এদিকে আমি প্রতিনিধিত্ব করি ২০ লক্ষ ভোটারের। একবার ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি কমিটি এসেছিল দিল্লিতে। একজন এমপি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি আপনার এলাকার জনগণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন?” আমি বললাম, “হ্যাঁ, করি তো।” তিনি বললেন, “কোনোদিন যদি অনেক চাপ থাকে, সেদিন আমি ৭-৮ জনের সঙ্গে দেখা করতে পারি।” জবাবে আমি বললাম, “চাপমুক্ত দিনগুলোতে আমি তিন ঘণ্টার মতো সময়ে ২৫০ জনের সঙ্গে দেখা করি।” ভারতে বিষয়গুলো আসলে এমনই। এখানকার মানদণ্ডই একেবারে ভিন্ন। এবং সংসদীয় ব্যবস্থা পরিচালনার প্রক্রিয়া থেকেই আমাদের নানা ধরনের সমস্যা উদ্ভূত হয়। এসব সমস্যা এড়ানো যেত, যদি আমাদের একটি সোজাসাপ্টা প্রেসিডেনশিয়াল ব্যবস্থা থাকত।
এর আগে আপনি আপনার বইয়ে আলোচনা করেছেন যে ব্রিটেন কীভাবে ভারতীয় টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। কিন্তু আপনি এ কথাও উল্লেখ করেছেন যে ঢাকা এখন আবার টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। আপনার কি মনে হয় না এই আধুনিক প্রেক্ষাপটেও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শোষণমূলক নীতি এক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা রাখছে?
হ্যাঁ, আজকের দিনেও ভিন্ন ধরনের শোষণ থাকতে পারে। তারপরও, নিদেনপক্ষে এটি ঢাকার জিডিপিতে অবদান তো রাখছে। অথচ ব্রিটিশ আমলে সেই অবদান দৃশ্যমান হতো ল্যাঙ্কাশায়ারে।
ব্রিটিশ শাসনের কি কোনো ইতিবাচক ঐতিহ্য বর্তমান রয়েছে?
অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলছি, হ্যাঁ। অন্যভাবে বলতে গেলে, ব্রিটিশরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে, নিজের আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে কিংবা লাভের পরিমাণ বাড়াতে, এমন অনেক কিছুই নিয়ে এসেছিল ভারতে, যেগুলো স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে ভারতের উপকারে আসছে। কিন্তু যেসব কাজের পেছনে ভারতের উপকার করার কোনো উদ্দেশ্যই ছিল না, সেগুলোর জন্য ব্রিটিশদের কৃতিত্ব দেওয়া খানিকটা বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। যেমন- আপনি বলতে পারেন রেল ব্যবস্থার কথা। আজকের ভারতের জন্য অপরিহার্য রেলপথগুলো। ভারতের জীবন বাঁচানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ রক্তকণিকা বলা যায় তাদের। কিন্তু আপনার ভুলে গেলে চলবে না যে এই রেল ব্যবস্থা ভারতে নিয়ে আসা হয়েছিল কেবলই ভারতের অভ্যন্তরের সম্পদ ও সংস্থানকে বিভিন্ন বন্দর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে, যেন সেগুলো জাহাজে করে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়া যায়। এছাড়াও এসব রেলপথ দিয়ে সৈন্যদল পাঠানো হতো ব্রিটিশ শাসনকে টিকিয়ে রাখার জন্য।
তাছাড়া রেলপথগুলো তৈরি হয়েছিল ভারতের বিপুল অর্থের বিনিময়ে। পুরো টাকাই বহন করেছিল ভারতীয়রা, আর ব্রিটিশ বিনিয়োগকারীরা প্রচুর লাভ করেছিল। ১৮৫০ থেকে ১৮৭৫ সালের মধ্যে এটাই ছিল লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে সবচেয়ে লাভজনক বিনিয়োগ, কেননা ব্রিটিশ সরকার তখন যে দরে স্টক বিক্রি করছিল তা থেকে দ্বিগুণ অর্থ ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকত। ব্রিটিশ সরকার এটি করতে পারছিল, কারণ ভারতীয় করদাতারাই মূলত রেলপথ নির্মাণের খরচ বহন করছিল। আরো একটি বিষয় হলো, ভারতে এক মাইল রেলপথ তৈরি করতে ওই একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে সমদূরত্বের রেলপথ তৈরির চেয়ে ৯ গুণ বেশি অর্থ খরচ হয়েছিল। মানে শুরু থেকে শেষ অবধি এই রেলপথ তৈরিকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশরা রক্ত চুষেছে ভারতীয়দের।
অনেক অপেক্ষার পর অবশেষে যখন তারা যাত্রী কামরা যোগ করল, সেগুলোতে সরু কাঠের টুকরো দিয়ে খুবই অপ্রীতিকর অবস্থার বেঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়। অথচ এর জন্যও তারা তৎকালীন সময়ের হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি যাত্রী ভাড়া নির্ধারণ করে ভারতীয়দের জন্য। একাধারে তারা ব্রিটিশ কোম্পানিদের কাছ থেকে নিতে থাকে মাল বহনের জন্য বিশ্বের সর্বনিম্ন ভাড়া। কেবল ১৯৪৭ সালের পর স্বাধীন ভারতীয় সরকার এসেই প্রাধান্যের বিষয়টি উল্টে দেয়, মানুষের পরিবহনের খরচ কমিয়ে আনে। আজকের দিনে ভারতীয় রেলে ভ্রমণ বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে সস্তা না হলেও, অন্যতম সস্তা তো বটেই। অন্যদিকে মালামাল পরিবহনের ভাড়া তুলনামূলকভাবে বেশি খরচসাপেক্ষ। অবশ্যই, এখন পরিবহনের জন্য বেশি দাম চুকাতে হচ্ছে ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে, যা তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো সুখকর বিষয় নয়। কিন্তু এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রেলে চেপে যাতায়াতকে ভারতের সাধারণ নাগরিকদের জন্য সুবিধাজনক করে তোলা হয়েছে কেবল স্বাধীনতার পরই।
কেউ হয়তো তারপরও দাবি করবে, ইংরেজি ভাষা নিশ্চিতভাবেই আমাদের জন্য আজ উপকার বয়ে আনছে, আমরা বিশ্বায়নের সুবিধা নিতে পারছি। কিন্তু তবুও বলতে হয়, ব্রিটিশরা যখন ইংরেজি ভাষার সঙ্গে ভারতীয়দের পরিচয় করিয়ে দিল, স্পষ্টতই তাদের সুদূরতম অভিসন্ধিও ছিল না সাধারণ গণমানুষকে এই ভাষায় শিক্ষিত করার। তারা চেয়েছিল নিছকই একটি সংকীর্ণ শ্রেণির দোভাষি, যারা শাসক ও শাসিতের মধ্যে যোগাযোগের সেতুবন্ধন তৈরি করবে। তাদের বাজেট ব্যবস্থা দেখেই পরিষ্কার হয়ে যায়, ভারতীয়দের শিক্ষিত করার জন্য অর্থ বিনিয়োগের কোনো পরিকল্পনা তাদের ছিল না। ১৯৩০’র দশকের আমেরিকান ইতিহাসবিদ উইল ডুরান্ট জানিয়েছিলেন, সমগ্র ব্রিটিশ ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রের বাজেট ১৯৩০ সালে নিউ ইয়র্ক স্টেটের হাই স্কুল বাজেটের অর্ধেকেরও কম ছিল। এক বছর তারা সেনাবাহিনীর ব্যারাক সংস্কারের জন্য শিক্ষাক্ষেত্রের চেয়ে বেশি খরচ করে। এমনই ছিল তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যে, ভারতের উন্নয়নের জন্য ব্রিটিশদের কৃতিত্ব দেওয়া যায় না। নিজেদের স্বার্থোদ্ধারের জন্য যেটুকু ইংরেজি ভাষা আমদানির দরকার ছিল, সেটুকুই তারা ভারতে এনেছিল। কারণ তাদের উদ্দেশ্য ছিল একটি কেরানি শ্রেণি গড়ে তোলা, যারা তাদেরকে সেবা দিতে পারবে।