পাঁচশো বছর আগের কাহিনী। ইউরোপীয় সমাজে তখনও অভিজাততন্ত্রের জয়জয়কার, গীর্জার হাতে তখনও বিশাল ক্ষমতা। ইউরোপীয়রা তখন আধুনিকতার দিকে গুটি গুটি পা ফেলছে, ইতালির ফ্লোরেন্সে রেঁনেসা কেবল শুরু হয়েছে। উৎসুক নাবিকেরা তখন বিশাল পালতোলা জাহাজে করে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিচ্ছেন, ঔপনিবেশিক যুগ শুরু হওয়ার সমস্ত মঞ্চ প্রস্তুত হয়ে গিয়েছে। অর্থনৈতিক উদ্যোগ নেয়ার মতো বুর্জোয়া শ্রেণীর বিকাশ সেসময় ক্রমশ বাড়ছে ইউরোপীয় সমাজে, শ্রমের মালিকানার রদবদল শুরু হয়ে গিয়েছে। ঠিক এরকম সময়েই এক অদ্ভুত রোগ হানা দিল ইউরোপে।
স্ট্রাসবার্গ শহরটি এখন ফ্রান্সের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত হলেও সেসময় সেটি ছিল সুবিশাল রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে। এই শহরটিতেই ‘ফ্রাউ ট্রফিয়া’ নামের একজন মহিলা বসবাস করতেন সেই সময়ে, আজ থেকে পাঁচশো বছর আগে। (জার্মান ভাষায় বিবাহিত মহিলাদের ফ্রাউ (Frau) হিসেবে সম্বোধন করা হয়। ইংরেজিতে যেমন Mrs. ব্যবহার করা হয়, ঠিক তেমনই।) একদিন হলো কী, সেই মহিলা হঠাৎ করে স্ট্রাসবার্গের রাস্তায় নেমে নাচতে শুরু করলেন। নাচ বলতে যেই সেই নাচ নয়, একেবারে যেন নাচের ‘ম্যারাথন’ প্রতিযোগিতা শুরু করে দিয়েছিলেন! একেবারে ক্লান্ত হয়ে শরীর অবশ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি নাচতেই থাকলেন। পথচারীরা তার নাচে খুশি হয়ে প্রথমে হাততালি দিচ্ছিল, পরবর্তীতে অনেকে তার সাথে যোগও দিল।
ফ্রাউ ট্রফিয়া নামের সেই নারী ঐতিহ্যবাহী স্ট্রাসবার্গ শহরের রাস্তায় একাকী নাচতে থাকলে বোধহয় আর কোনো সমস্যা হতো না । কিন্তু দেখা গেল, প্রতিদিন তার সাথে যোগ দেয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এক সপ্তাহ শেষে তার সাথে নাচতে যোগ দেয় প্রায় ৩৪ জন মানুষ, আর এক মাস শেষে সংখ্যাটি গিয়ে দাঁড়ায় ৪০০ জনে! স্ট্রাসবার্গের রাস্তায় নৃত্যকলার প্রদর্শনী রীতিমতো উন্মাদনায় রূপ নিতে খুব একটা দেরি করেনি।
স্ট্রাসবার্গ শহরের কর্তৃপক্ষ নাচের উন্মাদনায় বেশ বিপাকে পড়ে যায়। কারণ শহরের কর্মক্ষম জনসংখ্যার একটি বড় অংশ উন্মাদের মতো নাচতে শুরু করেছিল, আর এই উন্মাদনা মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ছিল পুরো শহরে। সব অধিবাসী যদি নাচতে শুরু করে তাহলে কর দেবে কে? শহরের কর্তৃপক্ষ অনেক ভেবে শেষে ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা’র সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বিশাল স্টেজ সাজানো হয়, গায়ক-নর্তকীদের ভাড়া করে নিয়ে আসা হয়। কর্তৃপক্ষের ধারণা ছিল এমন, হয়তো নাচতে নাচতে বিরক্ত হয়ে বা একেবারে ক্লান্ত হয়ে একসময় লোকেরা আবার স্বাভাবিকতা ফিরে পাবে। কিন্তু বাস্তবে ঠিক উল্টোটা ঘটে। আরও বেশি করে মানুষ যোগ দিতে থাকে। তবে প্রায় তিন মাস অতিবাহিত হওয়ার পর আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। একসময় যেভাবে হঠাৎ করে কোরিওমানিয়া নামের এই অদ্ভুত মহামারী শুরু হয়েছিল, ঠিক একইভাবে হঠাৎ করে তা থেমে যায়।
এতটুকু পড়ার পর মনে হতে পারে এসব বোধহয় নিছক গালগল্প বা রূপকথা। ইতিহাসে বোধহয় কখনও এরকম হয়নি, বানোয়াট কথা বলে বোকা বানাতে চাইছে লেখক। শত শত মানুষ কেন রাস্তায় কোনো কারণ ছাড়া উন্মাদের মতো নাচতে থাকবে? এটাও কি সম্ভব?
ইতিহাস বলে, এরকম ঘটনা বাস্তবেই সেসময়ে ঘটেছিল। তা-ও শুধু একটি শহরে নয় কিংবা মাত্র একবার নয়। পুরো চৌদ্দ শতকে ইউরোপের বিখ্যাত রাইন নদীর তীরঘেঁষে গড়ে ওঠা শহরগুলোতে অনেকবার এই ধরনের অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু স্ট্রাসবার্গ শহরের মতো একেবারে নির্দিষ্ট করে তা ইতিহাসের পাতায় তুলে ধরা হয়নি। সেই সময়ের শারীরতত্ত্ববিদ প্যারাসেলসাসের বিবরণে আমরা স্ট্রাসবার্গের ঘটনা জানতে পারি। কোরিওমানিয়া (Choreomania) নামের রোগটির ইতিহাসে স্ট্রাসবার্গ শহরের ঘটনাটি বিশেষ জায়গা দখল করে থাকবে সবসময়।
কোরিওমানিয়া নামের গণহারে মানসিক বিকারগ্রস্থতার ঘটনা একসময় সমাজে বেশ বাজে প্রভাবের সৃষ্টি করতে শুরু করে। স্ট্রাসবার্গ শহরে যখন কোরিওমানিয়ার ঘটনা শুরু হয়, তখন দিনে প্রায় পনেরজন করে মানুষ মারা যেতে শুরু করে। কারণ মানুষগুলো এত বেশি পরিমাণে নাচছিল যে, তাদের পায়ের তালু ফেটে রক্ত বের হওয়ার পরও তাদের থামার কোনো লক্ষণ ছিল না। অতিরিক্ত ক্লান্তিতে একসময় তুলনামূলক বয়স্ক মানুষেরা হার্ট অ্যাটাক কিংবা স্ট্রোক করে মারা যেত। এটাই ছিল মূলত কোরিওমানিয়ার প্রধান সমস্যা। এভাবে একসময় সমাজে বসবাসরত মানুষের একটি বড় অংশ মারা গেলে মানবিক বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছিল।
কোরিওমানিয়া নামের এই অদ্ভুত এক মহামারী, যেটিতে মানুষেরা দলবেধে পাগলের মতো অনবরত নাচতে থাকে, তার পেছনে কারণগুলো একটু দেখে নেয়া যাক।
ইউরোপের সন্ন্যাসিনীদের জন্য সংরক্ষিত যে মঠ ছিল, তাতে প্রায়ই কোরিওমানিয়ার ঘটনা ঘটতে দেখা গিয়েছে বিগত শতকগুলোতে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব মঠে নিজের অমতে শুধু পরিবারকে খুশি করতে অনেক মেয়ে চলে আসতো। এখানকার পরিবেশ পরিবারের মতো ছিল না, এখানকার মানুষগুলো পরিবারের সদস্যদের মতো ছিল না। একদিকে ফেলে আসা পরিবারের চিন্তা, অপরদিকে গীর্জার আধ্যাত্মিক পরিবেশে মনোযোগ দেয়ার তাড়া– দুই দিক ঠিক রাখতে গিয়ে সন্নাসিনীদের অনেকেই একেবারে ছোট থেকে হতাশার মাঝে বড় হতে হতে একসময় প্রবল মানসিক চাপ তথা ‘ট্রমা’র মধ্যে পড়ে যায়। এ সময় তারা নিজেদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে ও অপ্রাসঙ্গিক আচরণ করতে থাকে, যাকে বিশেষজ্ঞরা কোরিওমানিয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
ইউরোপের গীর্জার দায়িত্বে থাকা পাদ্রিরা কোরিওমানিয়ার ঘটনাকে ‘সেইন্ট ভিটাস’ নামের একজন খ্রিস্টান দরবেশের অভিশাপের ফল হিসেবে বর্ণনা করতেন। তাদের মতে, ধর্মীয় বিধিনিষেধ অমান্য করায় সেইন্ট ভিটাসের অভিশাপে মানুষগুলো এই ধরনের অপ্রাসঙ্গিক আচরণ করেছে, তাদের উপর শয়তান ভর করেছে। পাদ্রিরা সেইন্ট ভিটাসের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার উপদেশ দিতেন।
বিশ শতকে এসে কিছু বিজ্ঞানী কোরিওমানিয়ার রহস্য উদঘাটন করতে কোমর বেধে নেমেছিলেন। গবেষণার মাধ্যমে তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ময়দায় জন্মানো একধরনের বিষাক্ত ছত্রাক পেটে গেলে মানুষ তীব্র মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হয়। সাধারণত এলএসডি নামের যে রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে (একপ্রকার মাদকও বটে), সেটিতে যে উপাদান থাকে, এই ছত্রাকেও সেই উপাদান পাওয়া যায়। ফলে এই ছত্রাক পেটে গেলে মানুষ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো অনিচ্ছাকৃতভাবে নাড়াচাড়া করতে থাকে। তাই বিশ শতকের সেই গবেষকদের ধারণা, হয়তো রুটির মাধ্যমে সেই ছত্রাক পেটে প্রবেশ করেছিল এবং মানুষগুলো নিজেদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হাত-পা চালাতে শুরু করে। কিন্তু আধুনিক সময়ে এসে অন্যান্য বিজ্ঞানীরা জানান, এলএসডির উপাদানসমৃদ্ধ ছত্রাক পেটে গেলে কিছুক্ষণ হয়তো হাত-পা বিশৃঙ্খলভাবে নড়তে পারে, এত দীর্ঘসময় ধরে তা হওয়ার কথা না।
ইতিহাসবিদদের কেউ আবার সেসময়ের আর্থসামাজিক পরিবেশকে দায়ী করেছেন। স্ট্রাসবার্গের ঘটনা যখন ঘটে, তখন সেই শহরে প্রচন্ড দুর্ভিক্ষ চলছিল। অভিজাতরা খাবার কিনতে সমর্থ হলেও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গিয়েছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম। তাই খাবার না পেয়ে মানুষের অবস্থা এমন হয়েছিল যে, তখন এ ধরনের গণহারে মানসিক বিকারগ্রস্থতা সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।
মহামারী যেভাবে গণহারে কোনো অঞ্চলের সমস্ত অধিবাসীর জীবন বিপন্ন করে তুলত, কোরিওমানিয়ার মতো মহামারীর সেরকম কোনো ভয়াবহ পরিবেশ সৃষ্টি করতো না। ইতিহাসে প্রাণঘাতী মহামারী যেভাবে এসেছে, তার তুলনায় কোরিওমানিয়ার ঘটনা খুব বেশি নেই। আধুনিক সময়ে এসে এই ঘটনা আরও কমে গিয়েছে। কোরিওমানিয়া হঠাৎ করে একটি সমাজে স্থবিরতার সৃষ্টি করতো, যেটি কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। একটি মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে কোনো শহরের মানুষজন ঘরের বাইরে এসে ইচ্ছেমতো নাচছে– বিষয়টা অদ্ভুতই বটে!