মধ্যযুগে ইউরোপের আতঙ্ক ছিলো প্লেগের মহামারী। কোটি কোটি মানুষ অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে ধুঁকে ধুঁকে মারা গিয়েছে এ রোগের কবলে পড়ে। তাদের চিকিৎসা করতে আসত যে ডাক্তার, সমাজের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘প্লেগ ডাক্তার’ নামে। কোনো শহরে যখন প্লেগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে যেত, তখন সেখানকার জনগণ সবাই চাঁদা তুলে তাকে নিয়ে আসতো রোগ নিরাময়ের আশায়। যেহেতু প্রাপ্ত পারিশ্রমিকে সবার অর্থই ছিলো, তাই প্লেগ ডাক্তারও রোগীর মাঝে ধনী-দরিদ্র ভেদাভেদ না করে সবার চিকিৎসা করতেন।
মাঝে মাঝে অবশ্য এর ব্যতিক্রম ঘটতো। যদি তিনি রোগীকে বাড়তি সেবা দিতেন এবং কিছু বাড়তি ওষুধও সরবরাহ করতেন (যা ছিলো কেবলই লোক দেখানো), তবে তিনি তাদের কাছে বাড়তি অর্থ দাবি করে বসতেন। আর তারা যে প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন চিকিৎসক ছিলেন, এমনটা বলারও জো নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা হয় চিকিৎসাপেশায় তেমন একটা সুবিধা করতে না পেরে বিপজ্জনক এ পেশায় নাম লেখাতেন, নাহয় হতেন তরুণ চিকিৎসক যারা নিজেদের একটি ক্ষেত্র তৈরি করতে চাচ্ছিলেন।
ডাক্তারের পোশাক বললেই আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে সাদা এপ্রন পরিহিত একজন মানুষের চেহারা, যিনি তার রোগীকে সুস্থ করার জন্য নিজের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ডাক্তারদের এই সাদা পোশাকও যে এসেছে চমৎকার এক বিবর্তনের ভেতর দিয়ে, সেই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছিলো ‘একটি সাদা এপ্রন ও একজন ব্যাচেলরের অজানা ইতিহাস’ শীর্ষক লেখাটিতে। প্লেগ ডাক্তারদের পোশাক এমন ছিলো যে তাদের দেখলে রোগী আসলে কোনো মানুষকে দেখছে নাকি যমেরই প্রতিমূর্তি দেখছে সেই বিষয়ে সন্দিহান হয়ে যেত। পুরো শরীর জুড়ে বিস্তৃত আলখাল্লা, হাতে লাঠি ও দস্তানা, মাথায় টুপি, চোখে উদ্ভট চশমা এবং মুখমন্ডল ঢাকতে ব্যবহৃত পাখির ঠোঁটের মতো মুখোশটি দেখলে আজকের দিনেও যে কেউ ভিড়মি খেতে বাধ্য।
চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাস সম্বন্ধে ধারণা রাখেন, এমন ব্যক্তিবর্গের মতে, প্লেগ ডাক্তারদের বিচিত্র এ পোশাকের প্রস্তাবক সপ্তদশ শতাব্দীর চিকিৎসক চার্লস ডি লর্ম। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের পরিহিত বর্ম দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৬১৯ সালে তিনি সর্বপ্রথম আপাদমস্তক ঢাকা এ পোশাকের কথা চিন্তা করেন। তবে কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে চতুর্দশ শতকের প্লেগ ডাক্তাররাও পাখির মুখের ন্যায় মুখোশ ব্যবহার করতেন। সপ্তদশ শতকে প্লেগ ডাক্তারদের উদ্ভট এমন সাজসজ্জা নিয়ে বেশ জনপ্রিয় একটি কবিতাও প্রচলিত ছিলো।
As may be seen on picture here,
In Rome the doctors do appear,
When to their patients they are called,
In places by the plague appalled,
Their hats and cloaks, of fashion new,
Are made of oilcloth, dark of hue,
Their caps with glasses are designed,
Their bills with antidotes all lined,
That foulsome air may do no harm,
Nor cause the doctor man alarm,
The staff in hand must serve to show
Their noble trade where’er they go.
প্লেগ ডাক্তারের পোশাক
এবার চলুন এই প্লেগ ডাক্তারের পোশাকের নানা অংশ সম্পর্কেই জেনে নেয়া যাক।
১) চশমা
প্লেগ ডাক্তারদের মুখোশে লাগানো থাকতো বিশেষ ধরনের এ চশমাগুলো। বাইরের বিষাক্ত পরিবেশ থেকে চোখকে সুরক্ষা দিতেই বানানো হয়েছিলো এগুলো।
২) লাঠি
আজকের দিনে ডাক্তারদের কথা চিন্তা করলে, কল্পনার সেই ডাক্তারের গলায় আমরা নিজ থেকেই ঝুলিয়ে দেই একটি স্টেথোস্কোপ। ওদিকে ইউরোপের তৎকালীন প্লেগ ডাক্তারদের হাতে শোভা পেত একটি লাঠি। রোগীদের শরীরের নানা অংশ পর্যবেক্ষণ করতে, রোগীর পরিবারের সদস্যদের কোথায়, কখন, কী করা লাগবে এবং সর্বোপরি লোকজনকে নিজেদের থেকে দূরে রাখতে এই লাঠি ব্যবহার করতো ডাক্তাররা।
৩) ওভারকোট
ডাক্তারদের পুরো শরীরটাই ঢাকা থাকতো চামড়ার তৈরি বিশেষ একপ্রকার কোটে। ধারণা করা হতো, চামড়ার দৃঢ়তাই ডাক্তারদের প্লেগের হাত থেকে সুরক্ষা দেবে। তবে বাড়তি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এর উপরে মোম কিংবা প্রাণীজ চর্বির আস্তরণও দেয়া হতো। এগুলোই প্লেগের দূষিত বাতাস এবং রোগীর দেহ থেকে নিঃসৃত নানা তরল থেকে ডাক্তারকে সুরক্ষা দিতো।
৪) হ্যাট
মধ্যযুগীয় ডাক্তারদের পোশাকের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিলো হ্যাট। লোকে বিশ্বাস করতো, হ্যাটের প্রান্তভাগের বর্ধিত অংশ ডাক্তারকে বাড়তি সুরক্ষা প্রদান করে থাকে। ১৬৬৫ সালে লন্ডনে প্লেগ যখন মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলো, তখন সেখানকার প্লেগ ডাক্তারদের এ হ্যাটগুলো ব্যবহার করতে দেখা যেত। তবে বাস্তবতা হলো, সেসব ডাক্তারদের অধিকাংশই ছিলো অদক্ষ। ভালো ডাক্তারেরা আগেই তাদের ধনী রোগীদের সাথে লন্ডন ছেড়ে পালিয়েছিলো। ফলে অদক্ষ সেসব ডাক্তারের যাওয়া আর না যাওয়ার মাঝে তেমন কোনোই পার্থক্য ছিলো না।
৫) মুখোশ
উপরে এতক্ষণ ধরে যে চারটি অংশ নিয়ে আলাপ করা হলো, সেগুলোর কোনোটিই একজন প্লেগ ডাক্তারকে এতটা বিখ্যাত করে তুলতে পারে নি, যতটা করেছিলো পাখির ঠোঁটের আকৃতির এ মুখোশটি। কিম্ভূতকিমাকার এ মুখোশওয়ালা একজন ডাক্তারকে দেখে মানসিকভাবে দুর্বল রোগী যে আশ্বস্ত হবার বদলে আরো বেশি ভয় পেয়ে যেত, সেটা তো না বললেও চলে। এর ভেতরে ভরে দেয়া হতো নানা ঔষধি গাছগাছড়া, ফুল ও অন্যান্য অস্বাস্থ্যকর তেল। ডাক্তাররা বিশ্বাস করতো, নাকের ভেতরে থাকা এ উপাদানগুলো বাইরের দূষিত বাতাসকে ভেতরে প্রবেশে বাধা প্রদান করবে।
চিকিৎসাপদ্ধতি
এতক্ষণ ধরে তো প্লেগ ডাক্তার আর তার বিচিত্র পোশাকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হলো। এবার নাহয় তার চিকিৎসাপদ্ধতি সম্পর্কেই কিছু কথা হয়ে যাক।
১
প্রথমেই ধারালো ব্লেড দিয়ে রোগীর কনুইয়ের ভেতরের যেদিকে সবচেয়ে বেশি ব্যথা হচ্ছে, সেই অংশটা কেটে ফেলা হতো। এরপর সেখানে জোঁক লাগিয়ে দেয়া হতো যেন সেগুলো বিষাক্ত রক্ত চুষে নিতে পারে। রোগীর অসুখের মাত্রা যদি বেশি হতো, তবে এভাবে অন্যান্য আরো জায়গায় কেটে জোঁক লাগিয়ে রাখা হতো। রক্ত পান করতে করতে জোঁকগুলো যখন খসে পড়তো, তখন ক্ষতস্থানটি পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দেয়া হতো।
২
অ্যাঞ্জেলিকা (সুগন্ধি লতাবিশেষ), জুনিপার (চিরসবুজ একপ্রকার গুল্ম, যার কালো ফল দিয়ে ওষুধ তৈরি করা হয়), ডুমুর ফল, জাফরান এবং ভিনেগার মিশিয়ে ওষুধ বানানো হতো। স্বাদ বৃদ্ধির জন্য এতে আরো যোগ করা হতো জায়ফল। এটা রোগীকে গরম গরম খাওয়ানো হতো।
৩
শরীরে প্লেগের বিস্তার বৃদ্ধির সাথে সাথে বিভিন্ন অংশে, বিশেষত কুঁচকি ও বগলে, ফোস্কা পড়তো। যত দ্রুত সম্ভব এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া লাগতো, কারণ জীবাণুর আখড়া ছিলো এ ফোস্কাগুলোই। এসব জায়গায় লিলির মূল, এল চূর্ণ ও ম্যালো নামক একপ্রকার বুনো গাছ একত্রে পিষে প্রলেপ তৈরি করে লাগানো হতো।
৪
রোগী যদি নড়াচড়া করতে সক্ষম হতো, তাহলে তাকে অগ্নিকুণ্ডের কাছাকাছি নিয়ে বসিয়ে রাখা হতো। আর যদি সেটা করতে না পারতো, তাহলে তার বিছানার চারদিকে গরম পানিতে পরিপূর্ণ বোতল রেখে দেয়া হতো। এভাবে প্রায় ঘণ্টা তিনেক রোগীকে রেখে দেয়া হতো, যাতে সে ঘামতে থাকে। ধারণা করা হতো, এভাবে ঘামলে রোগীর শরীর থেকে প্লেগের জীবাণু বেরিয়ে যায়। এরপর রোগীর পুরো শরীর মুছে তাকে আবার বিছানায় শুইয়ে দেয়া হতো।
৫
রোগী যখন বিশ্রামে থাকতো, তখন পরামর্শ দেয়া হতো ঘর থেকে মিয়াস্মা অর্থাৎ দূষিত বায়ু তাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে। এজন্য ঘরে রোজমেরি, সেজ ও ল্যাভেন্ডার একত্রে ঝুলিয়ে রাখা হতো, বিশেষত অসুস্থ ব্যক্তি যে কক্ষে থাকতো সেখানে, যাতে করে সেগুলোর সুগন্ধ মিয়াস্মাকে তাড়িয়ে দেয়।
৬
উপরে বর্ণিত চিকিৎসাগুলোই নিয়মিতভাবে একের পর এক দিয়ে যাওয়া হতো। খাবার হিসেবে দেয়া হতো সাধারণ নানা খাদ্যোপাদান; যেমন- মুরগি কিংবা বিয়ার দিয়ে ধোয়া কচি বাছুরের মাংস। কাজ হলে এতেই হয়ে যেত, রোগী এগিয়ে যেত সুস্থতার দিকে; নাহলে আস্তে আস্তে রোগী এগোতে থাকতো জীবনের চিরন্তন সত্য পরিণতির দিকে।
উদ্ভট আরো কিছু চিকিৎসা
এগুলো তো ছিলো কেবল ডাক্তারের দেয়া মূল চিকিৎসা, এর পাশাপাশি আরো কিছু কাজও করতো মানুষ।
১) প্লেগকে ঈশ্বরের অভিশাপ মনে করে নিজেকে ক্রমাগত চাবুক মারতো। লোকে ভাবতো, এতে করে হয়তো উপরওয়ালার ক্ষমালাভের মাধ্যমে রোগমুক্তি ঘটবে।
২) আক্রান্ত স্থানে মুরগি ঘষত। তাহলে জীবাণু নিরীহ এ প্রাণীর দেহে স্থানান্তরিত হয়ে যাবে বলে ভাবত তারা।
৩) মুরগিতে কাজ না হলে কবুতর কেটে টুকরা টুকরা করে এর নাড়িভুঁড়ি সারা শরীরে মাখাত।
৪) ফোস্কা গলিয়ে সেখানে মানবমল, গাছের রজন ও মূল পিষে লাগিয়ে রাখত।
৫) ধনী ব্যক্তিরা পান্না চূর্ণ করে সেটা তরকারি সিদ্ধ পানিতে মিশিয়ে এক ঢোকে গিলে নিত।
৬) পচা গুড় খাওয়ানো হতো, সেটিও থাকতো কমপক্ষে দশ বছরের পুরনো।
৭) মলমূত্রের গন্ধযুক্ত বাতাস বাইরের পরিষ্কার (কিন্তু প্লেগের জীবাণুযুক্ত) বাতাসকে তাড়িয়ে দেবে, এ আশায় মানুষজন পয়ঃপ্রণালীতে গিয়ে বসে থাকতো।
৮) মানবমূত্র দিয়ে গোসলের কথাও শোনা যায়।
৯) কখনো কখনো ‘ইহুদীরাই এমন প্রাণঘাতী রোগের জন্য দায়ী’ এমনটা ভেবে তাদেরকে একত্রে বেঁধে, ঘরের ভেতর আটকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হতো।