পোল্যান্ড-হাঙ্গেরি: পরস্পরকে ভাই ভাবে যে দুই দেশ

‘বন্ধু রাষ্ট্র’ কথাটি আজকাল খুবই পরিচিত। বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশের পক্ষেই আর বিচ্ছিন্ন বা একা থাকা সম্ভব হয় না। নিজেদের স্বার্থেই, হোক তা অর্থনৈতিক কিংবা নিরাপত্তাজনিত, তাদেরকে অন্য নানা দেশের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়। এই সম্পর্ককে তারা নাম দেয় ‘বন্ধুত্ব’।

কিন্তু সেই বন্ধুত্ব এতটাই ঠুনকো যে, বিপদের মুখে এক বন্ধু আরেক বন্ধুর পিঠে ছুরি বসিয়ে দিতেও কার্পণ্য করে না। অবশ্য এজন্য ঢালাওভাবে কোনো একটি দেশকে দায়ী করাও আবার সম্ভব না। সব দেশই যে আগে নিজের স্বার্থ দেখবে, পরে বন্ধু রাষ্ট্রের, সেটিই তো স্বাভাবিক।

দিনশেষে তাই বিভিন্ন দেশের মধ্যকার তথাকথিত বন্ধুত্বের সম্পর্ক আর বন্ধুত্ব থাকে না, সেটি পরিণত হয় একধরনের খেলায়। হাসি হাসি মুখ করে রেখেও সর্বদা দুই দেশের মধ্যে চলে ঠাণ্ডা লড়াই। সবাই থাকে সুযোগের সন্ধানে, কীভাবে নিজের সঠিক সময়ে কিংবা বন্ধুর দুর্বল মুহূর্তে কোনো একটা অসাধারণ চাল দিয়ে বাজিমাৎ করে ফেলা যায়।

তাই সত্যিই অবাক হতে হয়, যখন দেখা যায় এই একবিংশ শতকের বিশ্বেই দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের মধ্যকার সম্পর্ক এত বেশি গাঢ় যে, তারা নিজেদেরকে শুধু বন্ধু বা সুহৃদই ভাবে না। পরস্পরকে ‘ভাই’ বলেও ভাবে তারা।

দারুণ ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরির মধ্যে; Image Source: bocskairadio.org

পোলিশ ভাষায় তো এই ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক নিয়ে কবিতাও রয়েছে,

Polak, Węgier — dwa bratanki,
i do szabli, i do szklanki,
oba zuchy, oba żwawi,
niech im Pan Bóg błogosławi.

এই কবিতার আক্ষরিক অনুবাদ করলে দাঁড়ায় অনেকটা এমন,

পোল্যান্ড আর হাঙ্গেরি — দুই ভাই তারা,
যুদ্ধ যুদ্ধ খেলে আবার আনন্দে হয় মাতোয়ারা,
খুব তারা সাহসী, খুব প্রাণবন্ত,
ঈশ্বরের আশীর্বাদে তাদের জীবন হোক অনন্ত।

কেউ যেন না ভাবেন, এই দুই দেশের সম্পর্কের মাত্রা স্রেফ এটুকুতেই সীমাবদ্ধ। দুই দেশই জাতীয়ভাবে পারস্পরিক সম্পর্ককে এত বেশি গুরুত্ব প্রদান করেছে যে, বছরের একটি দিন তারা এই ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ককে উদযাপনের নিমিত্তে সরকারি ছুটিও পালন করে। ২০০৭ সাল থেকে চলছে এই প্রথা। সে বছর দুই দেশের সংসদই সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেয় যে প্রতি বছরের ২৩ মার্চ পালিত হবে “পোলিশ-হাঙ্গেরিয়ান বন্ধুত্ব দিবস”

সাম্প্রতিক অতীতে দেশ দুটির মাঝে আরো কিছু চমৎকার সাদৃশ্য দেখা গেছে। যেমন- তারা উভয়ই ন্যাটোর পূর্ণ সদস্য, এবং তারা ন্যাটোতে যোগদান করেছিল একই দিনে (১২ মার্চ, ১৯৯৯)। আবার দুটি দেশই ইউরোপিয়ান ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ভিসেগ্রাদ ফোরের (স্লোভাকিয়া ও চেক প্রজাতন্ত্রের পাশাপাশি) সদস্য।

আজকের এই বৈশ্বিক বিবাদ-বিদ্বেষ-উত্তেজনার যুগে অভিন্ন সীমারেখা দ্বারা বিভক্ত দুটি প্রতিবেশী দেশের মধ্যকার এমন অন্তরঙ্গ সম্পর্ক সত্যিই বিস্ময়ের জন্ম দেয়।

এমনই বন্ধুত্ব পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরির নাগরিকদের; Image Source: Nick Haslam/Alamy

দুই দেশের অন্তরঙ্গ সম্পর্কের সাক্ষ্য দেয় হাঙ্গেরির ভেসপ্রেমে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অভ প্যানোনিয়ার ইতিহাসবিদ ও পোলোনিস্ট (পোলিশ ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ), অধ্যাপক গাবোর লাগজির বলা কথাগুলোও।

“হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডের মধ্যকার বন্ধুত্বের সম্পর্ক একটি অসাধারণ বিষয়। এটি অনেকটা যেন এমন যে দুটি ওক গাছ আলাদা জায়গায় বেড়ে উঠেছে, কিন্তু তাদের শেকড় একই জায়গায় মথিত, তাদের জন্ম একই মাটিতে। আমরা আসলে গত প্রায় এক হাজার বছর ধরেই পরস্পরের সাথে গভীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্কে আবদ্ধ।”

তবে হাজার বছর পূর্বে ঠিক কীভাবে এই বন্ধুত্বের শুরু হয়েছিল, সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। এই দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের সবচেয়ে প্রাচীন দৃষ্টান্তের হদিস পাওয়া যায় মধ্যযুগে। ১৩৪২ সালে হাঙ্গেরি ও ক্রোয়েশিয়ার রাজা হন লুইস দ্য গ্রেট। ১৩৭০ সালে তিনি পোল্যান্ডেরও রাজা হন, এবং ১৩৮২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ পদে বহাল থাকেন।

একই সাথে দুটি পৃথক সাম্রাজ্যের রাজত্ব করা সম্ভব হয়েছিল, কারণ লুইস দ্য গ্রেট একাধারে ছিলেন তার বাবা প্রথম চার্লসের (হাঙ্গেরি ও ক্রোয়েশিয়ার রাজা) উত্তরাধিকারী, আবার মামা তৃতীয় ক্যাসিমির দ্য গ্রেটের (পোল্যান্ডের রাজা, পিয়াস্ট রাজবংশের সর্বশেষ) উত্তরাধিকারী। মূলত রাজা ক্যাসিমিরের কোনো বৈধ পুত্রসন্তান ছিল না। তাঁর মৃত্যুর পর যেন কোনো রাজবংশীয় অনিশ্চয়তা দেখা না যায় এবং বংশের ধারাও স্বচ্ছ থাকে, তা নিশ্চিত করতেই তিনি নিজের উত্তরাধিকার হিসেবে নির্বাচন করে গিয়েছিলেন ভাগ্নে লুইসকে। তাকে নির্বাচনের কারণও ছিল সুস্পষ্ট: তার ছিল রাজ্য পরিচালনার অতীত অভিজ্ঞতা।

লুইসের পর পোল্যান্ডের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন তার ছোট কন্যা, সেইন্ট ইয়াদভিগা। তিনি ছিলেন পোল্যান্ডের ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় শাসকদের একজন। আজও পোল্যান্ড জুড়ে স্মরণ করা হয় তাকে।

ইতিহাস আজও মনে রেখেছে সেইন্ট ইয়াদভিগাকে; Image Source: Wikimedia Commons

পঞ্চদশ শতকে আরো একবার পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরি অভিন্ন রাজা কর্তৃক শাসিত হয়। এবার ছিলেন পোল্যান্ডের তৃতীয় ভ্লাদিসওয়া। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে তিনি বুলগেরিয়ার ভার্নাতে তুর্কিদের সাথে যুদ্ধে পর্যদুস্ত হন।

ষোড়শ শতকে ফের একজন হাঙ্গেরিয়ান আসেন পোল্যান্ডের ক্ষমতায়। ১৫৭৬ সালে পোল্যান্ডের মানুষই তাদের শাসক হিসেবে নির্বাচিত করেন ট্রান্সিলভানিয়ান যুবরাজ স্টিফেন বাথোরিকে। তিনিও বর্তমানে বিবেচিত হন পোল্যান্ডের ইতিহাসের মহান শাসকদের একজন হিসেবে।

তবে পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরির মধ্যকার সম্পর্ক গাঢ় করতে কেবল রাজকীয় শাসকদেরই একক ভূমিকা ছিল না। এক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা ছিল এক পোলিশ জেনারেল জোসেফ বেমেরও, যিনি ১৮৪৮ সালে হাঙ্গেরিয়ান বিপ্লবের সময় হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ড দুই দেশেরই জাতীয় বীরে পরিণত হন।

হাঙ্গেরিয়ান বিপ্লবে পোল্যান্ডের কাছে জমা হওয়া ঋণ হাঙ্গেরি শোধ করে ১৯১৯ থেকে ১৯২১ পর্যন্ত চলা পোলিশ-সোভিয়েত যুদ্ধে। বেলা কুন সরকারের উৎখাত ঘটলে, পোল্যান্ডকে সাহায্য করতে ৩০,০০০ সৈন্য প্রেরণ করে হাঙ্গেরি।

হাঙ্গেরি-পোল্যান্ড সম্পর্কের আরো একটি অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয় ১৯৩৯ সালে, যখন হাঙ্গেরি আশ্রয় দেয় লক্ষাধিক বাস্থারা পোলিশ শরণার্থীকে। সেই সময় হাঙ্গেরি ছিল জার্মানির মিত্র রাষ্ট্র, কিন্তু তারপরও দেশটি পোলিশ শরণার্থীদের জন্য পরিণত হয়েছিল স্বর্গভূমিতে। বুদাপেস্টের জার্মান দূতাবাসে কর্মরতরা এ নিয়ে খুবই অসন্তুষ্ট ছিল, তবু হাঙ্গেরির অভিজাত সম্প্রদায় থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মজীবী শ্রেণী, সকলের ব্যাপক সহানুভূতি ঝরে পড়েছিল পোলিশদের জন্য। তাই জার্মানি কর্তৃক হাঙ্গেরি দখল হওয়ার আগ পর্যন্ত পোলিশরা সম্পূর্ণ নিরাপদে ছিল সেখানে।

১৯৫৬ সালের হাঙ্গেরিয়ান বিপ্লব; Image Source: Michael Rougier—The LIFE Picture Collection/Getty Images

১৯৫৬ সালে আবারো যে হাঙ্গেরিয়ান বিপ্লব হয়েছিল, তাতে বড় ভূমিকা ছিল পোল্যান্ডের। পোলিশ অক্টোবরের সমর্থনে বুদাপেস্টে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করেছিল। তাদের দাবি ছিল যেন হাঙ্গেরিতেও এমন সংস্কার করা হয়। এরই সূত্র ধরে শুরু হয় ১৯৫৬-এর হাঙ্গেরিয়ান বিপ্লব। পোলিশরাও এগিয়ে আসে হাঙ্গেরিয়ানদের সাহায্যার্থে। তারা আন্দোলনরতদের রক্ত দিতে শুরু করে। ১৯৫৬ সালের ১২ নভেম্বর পর্যন্ত ১১,১৯৬ জন পোলিশ নাগরিক রক্ত দিয়েছিল হাঙ্গেরিকে। এছাড়া পোলিশ রেড ক্রস শুধু বিমানযোগেই ৪৪ টন মেডিকেল সাপ্লাই প্রেরণ করেছিল হাঙ্গেরিতে। সড়ক ও রেলপথে সাপ্লাইয়ের পরিমাণ নিঃসন্দেহে আরো অনেক বেশি ছিল।

দ্বিতীয় হাঙ্গেরিয়ান বিপ্লবের ৬০ বছরপূর্তি এবং হাঙ্গেরি-পোল্যান্ডের সম্পর্ককে সম্মানিত করার লক্ষ্যে ২০১৬ সালকে ঘোষণা করা হয় হাঙ্গেরিয়ান-পোলিশ সংহতি বর্ষ হিসেবে।

সুতরাং বুঝতেই পারছেন, ইতিহাসজুড়ে পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরির পরস্পরের পাশে এসে দাঁড়ানোর ইতিহাস এতটাই লম্বা ও সমৃদ্ধ যে, আজকের এই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়েও তাদের বন্ধুত্ব, কিংবা ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অক্ষুণ্ন রয়েছে। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই হাঙ্গেরির কোনো না কোনো মন্ত্রী পোল্যান্ড সফরে যান, এবং একই চিত্র দেখা যায় পোলিশ মন্ত্রীদের ক্ষেত্রেও।

বিজোড় বছরগুলোতে বন্ধুত্ব দিবস পালিত হয় পোজনানে; Image Source: Jan Wlodarczyk/Alamy

আর এই সবকিছুর বাইরে প্রতি বছর ২৩ মার্চ বন্ধুত্ব দিবস পালন তো আছেই। দুই দেশই সে দিনটিতে মেতে ওঠে উৎসবে। তবে জোড় সংখ্যার বছরগুলোতে প্রধান উৎসবের আসর বসে হাঙ্গেরির গেয়রে, আর বিজোড় সংখ্যার বছরগুলোতে বসে পোল্যান্ডের পোজনানে। এই উৎসবে দুই দেশের সাধারণ মানুষ তো বটেই, পাশাপাশি একত্র হয় প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও। তবে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের তারকারা হন প্রধান আকর্ষণ। দুই দেশের নাটক ও চলচ্চিত্র উৎসব, গানের কনসার্ট, চিত্র প্রদর্শনী প্রভৃতির মাধ্যমে মহা সমারোহে পালিত হয় দিনটি।

এভাবেই প্রতি বছর দুই দেশের সম্পর্ক ক্রমশই মজবুত হচ্ছে। তাই তো পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরির মানুষেরা দুই দেশের মধ্যস্থিত সীমানা এবং ভিন্ন ভিন্ন ভৌগোলিক অবস্থানের বিভেদ ভুলে, গলাগলি করে বলতে পারে,

“আমরা বন্ধু জন্ম জন্মান্তরের!”

ইতিহাসের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/

This article is in Bengali language. It is about the bilateral relationship between Poland and Hungary. Necessary references have been hyperlinked inside.

Featured Image © Daily News Hungary

Related Articles

Exit mobile version