বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান উন্নতির ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পুরো বিশ্ব বিভিন্ন রকমের নিত্যনতুন মারণাস্ত্রের সাথে পরিচিত হয়েছিল। অস্ত্রশস্ত্র, যন্ত্রপাতি, যানবাহনের পাশাপাশি অনেক অদ্ভুত কৌশলেরও আশ্রয় নিতে দেখা গিয়েছে বিভিন্ন দেশকে। তবে সবগুলোই যে বিখ্যাত বা নিজ নিজ কাজে সফল হয়েছিলো, তা কিন্তু নয়। এমন কিছু উদ্ভট যন্ত্র এবং প্রযুক্তিরও দেখা মিলেছিলো, যেগুলো যুদ্ধের সময় খুব একটা সুফল দেখাতে পারেনি, বরং নিজেদেরই মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। আজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত সফল এবং অসফল এমনই কিছু উদ্ভট প্রযুক্তির কথা বলা হবে।
বিস্ফোরক ইঁদুর
ফ্রান্সের পতনের পর উইনস্টন চার্চিল শপথ নিয়েছিলেন, তিনি পুরো ইউরোপ জ্বালিয়ে ছাড়বেন। সেই লক্ষ্য পূরণ করার জন্য কিছু বৃটিশ গোয়েন্দাদের উপর দায়িত্ব দেয়া হয় গোপন বোমা তৈরি করার। যার ফলে এমন সব বোমা তৈরি করা হয়েছিলো, যেগুলো জেমস বন্ড দেখলেও হিংসে করতেন। বোমাগুলো দেখতে ছিল সাবান, স্যুটকেস, জুতো, মদের বোতল, এমনকি ইঁদুরের মতোও।
কিছু বৃটিশ গুপ্তচরের উপর দায়িত্ব পড়েছিল শত্রুদের মাঝে গিয়ে এসব বিস্ফোরক স্থাপন করে আসার। তো এই বিস্ফোরক ইঁদুর স্থাপনের ক্ষেত্রে তারা যা করতেন তা হলো, প্রথমত স্থানীয় ছাত্রের ছদ্মবেশ ধারণ করতেন। তারপর ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করবেন এই কারণ দেখিয়ে তারা শত শত ইঁদুর জোগাড় করতেন। পরে সেই ইঁদুরগুলোর পেট কেটে পুরোটা প্লাস্টিকের বিস্ফোরক দিয়ে পূর্ণ করে সেলাই করে দিতেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এই ইঁদুরগুলোকে সেই সময়ে প্রচলিত সকল কয়লার বয়লারের কাছে রেখে আসা। যাতে দেখা মাত্র সেগুলোকে বয়লারের আগুনে নিক্ষেপ করা হয়। আর নিক্ষেপ করলেই হবে ব্যাপক বিস্ফোরণ!
তবে যেভাবে আশা করা হয়েছিলো সেভাবে ইঁদুরগুলোকে কাজে লাগানো যায়নি। কারণ মৃত বিস্ফোরক ইঁদুরগুলো সেভাবে ব্যবহার করার আগেই সকল পরিকল্পনা ধরা পড়ে যায়। কারণ শত শত বিস্ফোরক ইঁদুর বহনকারী এমন একটি বাক্স জার্মানদের হাতে ধরা পড়ে। যখন তারা বুঝতে পারলো মৃত ইঁদুরগুলোর পেটে রয়েছে বিস্ফোরক, তারা আশংকা করলো হয়তো এরকম হাজার হাজার ইঁদুর ইতোমধ্যে পুরো জার্মানিতে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই তারা সকল সামরিক স্কুলগুলোয় ছাত্রছাত্রীদের মাঝে ইঁদুরগুলোর ছবি প্রদর্শন করতে লাগলো, যাতে ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের এলাকার সর্বত্র খুঁজে অবশিষ্ট ইঁদুরগুলোকেও বের করে ফেলে। আর এভাবেই অদৃশ্য ইঁদুরগুলো জার্মানদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। তাই ইঁদুরগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করা না গেলেও একদিক দিয়ে অনেক যন্ত্রণা দিয়ে ছেড়েছিল জার্মানদের।
ভি-৩ কামান
পুরো একটি পাহাড় জুড়ে তৈরি করা এই কামানটিকে বলা হতো জার্মানির ‘প্রতিশোধ গ্রহণের কামান’। এর পূর্বের ভি-১ ছিল একটি ক্রুজ মিসাইল এবং ভি-২ ছিল একধরনের রকেট। ‘ইংল্যান্ড ক্যানন’ নামেও পরিচিত এই ভি-৩ কামানের পুরো নাম হচ্ছে ‘Vergeltungswaffe 3 Cannon’। এই ১৩০ মিটার লম্বা শক্তিশালী কামানটি ইংলিশ চ্যানেল দিয়ে সরাসরি ফ্রান্স থেকে লন্ডনে গোলা নিক্ষেপ করার জন্য তৈরি করা হয়েছিলো। ১৯৪৪ সালের মে মাসে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এই ভি-৩ কামানের গোলা প্রায় ৫৫ মাইল দূরে গিয়ে আঘাত হানতে সক্ষম। তার দু’মাস পরে পুনরায় পরীক্ষা করা হলে দেখা গেলো, তা এবার ৫৮ মাইল দূরে গিয়ে আঘাত করতে পারছে।
তবে মাত্র দুটি ভি-৩ কামান তৈরি করা হলেও শুধু একটি কামান সত্যিকার অর্থেই যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিলো, যা থেকে ১৯৪৫ সালের ১১ জানুয়ারি থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট ১৮৩ রাউন্ড গোলা নিক্ষেপ করা হয়েছিলো। কিছুদিন আগে স্বাধীন হওয়া লুক্সেমবার্গ ছিল ভি-৩ এর মূল লক্ষ্য। কিন্তু এই বৃহৎ অস্ত্রটি নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেনি। যুদ্ধে অনেকটাই ব্যর্থ হিসেবে ধরা হয় ভি-৩ কে। কারণ ১৮৩ রাউন্ড গোলা নিক্ষেপ করা হলেও ১৪২ রাউন্ড লক্ষ্যে পৌঁছুতে পেরেছিল। কিন্তু নিক্ষেপিত এই ১৪২ রাউন্ড গোলাতেও মাত্র ১০ জন মারা গিয়েছিল। আহত হয়েছিল শুধু ৩৫ জন।
দোরা এবং গুস্তাভ রেল কামান
জার্মানরা যে আসলেই বড় বড় যন্ত্রপাতি, অস্ত্রশস্ত্র এবং মারণাস্ত্র বানানোর দিকে বেশি পটু ছিল, তা তাদের দোরা এবং গুস্তাভ কামান দুটি দেখলে বোঝা যায়। ৩১.৫ ইঞ্চি ক্যালিবারের এই জার্মান কামান দুটি এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হওয়া সবচাইতে বড় কামান হিসেবে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে।
তবে আকারে বৃহৎ হওয়ায় যুদ্ধের সময় কামান দুটির বিভিন্ন অংশ আলাদা আলাদা করে পরিবহন করে নিয়ে যাওয়া হতো, তারপর একত্রে জোড়া লাগানো হতো, তারপর নির্দিষ্ট স্থানে তৈরি মঞ্চে সেগুলোকে আরোপিত করা হতো। এই পুরো কার্যপ্রণালী সম্পূর্ণ করতে প্রায় ৪,০০০ লোক লাগতো। ব্যয়বহুল এই বিশাল যন্ত্র দুটিকে বিমান হামলা থেকে রক্ষা করার জন্য জার্মানি পুরো একটি সৈন্যদল মোতায়েন করেছিল। এছাড়াও মিত্রবাহিনীরা যাতে ভুলে এগুলোকে হামলা করে না বসে, সেজন্যও বিশেষ এক সেনাবাহিনী গঠন করা হয়েছিল।
তবে যুদ্ধের সময় শুধু গুস্তাভকেই ব্যবহার করা হয়েছিলো। ১৯৪২ সালে সেবাস্তপল বাজেয়াপ্ত করার সময় গুস্তাভ থেকে ৪২ বার গোলা নিক্ষেপ করা হয়। এর প্রত্যেকটি গোলার ভর ছিল ১১,০০০ পাউন্ড বা ৪,৮০০ কেজি, যেগুলো ১০০ ফুট পাথর দিয়ে ঘেড়া গোলাবাড়িকেও ধ্বংস করে দিতে পারতো। তবে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে কামান দুটিকে একটি শিল্প হিসেবে ধরা হলেও, এগুলো সত্যিকার অর্থে নির্মাণ সামগ্রীর, মানবশক্তির এবং প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অপচয় ছিল।
ওহকা কামিকাজি অ্যাটাক প্লেন
জাপানিজরা যে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে বেশ এগিয়ে গিয়েছিলো, তার প্রমাণ হলো তাদের উদ্ভাবিত এই ‘ইয়োকোসুকা MXY-7‘ মডেলের ওহকা কামিকাজি বোমারু বিমান, যা প্রথম দেখা যায় ১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এটি এমন একটি বিমান ছিল, যার পুরোটাই ধরা চলে একটি রকেট-বোমা। এটি একজন পাইলট নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো। ওহকা প্রায় ২,৬৪৩ পাউন্ড ভরের টর্পেডো বহন করতো।
যুদ্ধের সময় ওহকাকে অন্য একটি প্লেনে করে নিয়ে আসা হতো। লক্ষ্যের কাছাকাছি আসা মাত্র ওহকাকে ছেড়ে দেয়া হতো। ওহকায় অবস্থানরত পাইলট লক্ষ্যবস্তুর কাছে আসা মাত্র রকেট ইঞ্জিন চালু করে দিতো, যার ফলে ওহকা বুলেটগতিতে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতো।
তবে শত্রুরা এ ধরনের আক্রমণ বুঝে ফেলার পর যখনই ওহকা বহনকারী বিমান দেখতো, তখনই তা আক্রমণ করতো। ফলে এই কামিকাজি আক্রমণ খুব বেশি সফলতার মুখ দেখেনি। সফলতা বলতে ওহকা শুধু একবার এক আমেরিকান যুদ্ধজাহাজকে ডুবিয়ে দিতে পেরেছিল।
রাশিয়ার এন্টি-ট্যাংক কুকুর
রাশিয়ানরা তাদের পূর্বাঞ্চল রক্ষায় জার্মানদের কাছে যাচ্ছেতাইভাবে নাস্তানাবুদ হচ্ছিলো। নিশ্চিত পরাজয় রুখতে তারা যত রকমের চেষ্টা, কৌশল ছিল সব প্রয়োগ করা শুরু করে এক এক করে। সেগুলোর মধ্যে একটি ছিল তাদের বিখ্যাত ‘এন্টি-ট্যাংক ডগ‘ কৌশল। প্রাথমিকভাবে এই কুকুরগুলোকে কোনো একটি স্থানে বোমা প্রতিস্থাপন করে আসার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিলো। তারা নির্দিষ্ট স্থানে মুখে করে বোমা নিয়ে যেত এবং সেখানে তা রেখে নিজের প্রশিক্ষকের কাছে ফেরত আসতো।
কিন্তু যুদ্ধের সময় কোনো ট্যাংকের কাছে কুকুরগুলোকে পাঠানো একরকম অসম্ভবই ছিল। তাই রাশিয়ানরা শেষমেশ কুকুরগুলোকে বোমা সহই উড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
এজন্য তারা যা করতো তা হলো, প্রথমে কুকুরগুলোকে অভুক্ত রাখতো কয়েকদিন থেকে। তারপর নিজেদের ট্যাংকের নিচে খাবার রেখে কুকুরগুলোকে দেখিয়ে দিতো খাবারের অবস্থান। এভাবে সবসময় ট্যাংকের নিচে খাবার পেয়ে অভ্যস্ত হয়ে যেত তারা।
যুদ্ধের সময়ও ঠিক এভাবেই অভুক্ত রাখা হতো কুকুরগুলোকে। তারপর তাদের গায়ে ২৬ পাউন্ড ওজনের বোমা বেঁধে দেয়া হতো। যখন কোনো শত্রু ট্যাংক চোখে পড়তো, তখন কুকুরগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হতো। অভাগা কুকুরগুলো খাবারের আশায় ট্যাংকগুলোর দিকে ছুটতো। কুকুরগুলো ট্যাংকের নিচে যাওয়া মাত্র তাদের গায়ে লাগানো বোমার লিভার ট্যাংকের নিচের অংশের সাথে লেগে বোমাটিকে বিস্ফোরিত করে দিতো।
এই আত্মঘাতী কুকুরগুলো এতোটাই কার্যকর ছিল যে পরবর্তীতে জার্মানরা যেকোনো কুকুর দেখলেই গুলি করা শুরু করতো। রাশিয়ানরা এ ধরনের বিভিন্ন কাজে প্রায় ৪০ হাজার কুকুর ব্যবহার করেছিলো, যেগুলো প্রায় ৩০০’র মতো জার্মান ট্যাংক ধ্বংস করেছিলো।
গোলিয়াথ মাইন
গোলিয়াথ হলো একটি রিমোট-কন্ট্রোলড বিধ্বংসী বহনকারী যান। একে জার্মানদের মিত্রবাহিনীরা ‘ডুডলবাগস’ বলেও ডাকতো।
১৯৪২ সালে জার্মানদের আবিষ্কার করা এই যানটি প্রায় ১৬৫ পাউন্ড ভরের বোমা বহন করতে পারতো। এর মূল লক্ষ্যবস্তুগুলো ছিল প্রধানত ট্যাংক, সেতু, বিভিন্ন ভবন এবং অধিক শত্রু সৈন্য রয়েছে এমন জায়গা। এই যন্ত্রগুলোকে মূলত তার দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হতো এবং লক্ষ্যবস্তুর সাথে সংঘর্ষ লাগলে সেগুলো বিস্ফোরিত হতো। এরকম প্রায় ৪,৬০০ এর মতো যন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিলো, যেগুলোর মধ্যে কয়েকটি অপেক্ষাকৃত বড় আকারেরও ছিল। বড় আকৃতির যানগুলো ২২০ পাউন্ডের মতো বোমা বহন করতে পারতো।
কিন্তু যুদ্ধের মতো জায়গায় জার্মানদের জন্য এই যন্ত্রগুলো ছিল অনেক ধীরগতির, নিয়ন্ত্রণ করাও ছিল কঠিন। তাই সফলতাও ছিল অনেক কম। তবে এটা মানতেই হবে, এ ধরনের যন্ত্রের ধারণা সে সময়ের তুলনায় অনেকখানিই এগিয়ে ছিল। শুধু দরকার ছিল আরো উন্নত প্রযুক্তির।
ফিচার ইমেজ: oldmachinepress.files.wordpress.com