২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২। বেলা প্রায় ৩টা।
আগের দিনই কেবল ঢাকা এসেছেন তিনি। স্ত্রী আমেনা আর তার একমাত্র সন্তান বাদল, কদিন আগেই মাত্র জন্ম হলো তার। কিন্তু এ সুখকর ঘটনার সাথে কাটাকাটি হতেই যেন আমেনার মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়ল। শাশুড়িকে ভর্তি করানো হয়েছে গতকাল ঢাকা মেডিকেলে। এক আত্মীয়ার বাসায় রাতটা কাটিয়ে এখানে চলে এসেছেন শাশুড়ির সেবা করতে।
তার নাম জব্বার, আব্দুল জব্বার। শিশুকাল কাটিয়েছেন ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে। তিনি ছিলেন খুবই গরিব পরিবারের সন্তান, বাবা কৃষক। ১৫ বছর বয়সেই বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলেন, নারায়ণগঞ্জের জাহাজঘাটে এসে দেখা হলো এক ইংরেজ সাহেবের সাথে। তিনি তাকে চাকরি দিলেন বার্মায়। ১০-১২ বছর সেখানে কাটিয়ে ফিরে এলেন দেশে। বন্ধুর বোন আমেনা খাতুনকে বিয়ে করে ফেললেন। আর এই তো কদিন আগে ঘর আলো করে এলো তাদের সন্তান বাদল।
অসুস্থ শাশুড়ির জন্য কিছু ফলমূল কেনা দরকার। তার সাথে অল্পখানিক কথা বলে ফল কিনতে বেরিয়ে পড়লেন আব্দুল জব্বার। ঢাকার কাহিনী এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেননি তিনি। মেডিকেলের গেটের বাইরে আসতেই দেখলেন বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করবার দাবিতে অনবরত শ্লোগান দিয়ে যাচ্ছে ছাত্র-জনতা।
ফল আনবার কথা ভুলে গেলেন জব্বার। চলে গেলেন মিছিলের একদম সামনের দিকে। কিন্তু এরপরেই সব অন্ধকার। হঠাৎ পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি করে বসলো, আর তার প্রথমদিকের শিকার হলেন আব্দুল জব্বার। লুটিয়ে পড়লেন কিছু বুঝে উঠবার আগেই। তাকে নিয়ে যাওয়া হলো ডিএমসিতেই, যেখান থেকে তিনি এসেছিলেন। কিন্তু সেদিন রাতেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা গেলেন তিনি, বয়স মাত্র ৩৩।
পুলিশ যে গুলিটা চালিয়েছিল, সেটা আসলেই ছিল খুব এলোপাথাড়ি। একটি গুলি ছুটে যায় হোস্টেলের ১২ নং শেডের বারান্দায়, যেখানে ছিলেন আবুল বরকত। সেখানেই লুটিয়ে পড়েন তিনি। তিনি অবাক হয়ে তার ক্ষতের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন, “আরে, আমার দেখি গুলি লেগেছে…”। সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাশ করে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছিলেন। তাকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে, কিন্তু রাত আটটায় তিনি চলে যান ওপারে। বয়স ছিল মাত্র ২৫। রাতেই এক ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে তাকে দাফন করা হয় আজিমপুর কবরস্থানে।
আরো যারা শহীদ হয়েছিলেন এই ভাষা আন্দোলনে (প্রায় ১২ জন) তাদের মধ্যে ছিলেন আব্দুস সালাম। পেশায় তিনি ছিলেন ডিরেক্টরেট অব ইন্ডাস্ট্রিজ বিভাগের পিয়ন, থাকতেন নীলক্ষেতের কোয়ার্টারে। ২১ ফেব্রুয়ারি ডিএমসির সামনের রাস্তায় তিনি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিক্ষোভে অংশ নেন। আর পুলিশের এলোপাথাড়ি গুলিতে তিনি লুটিয়ে পড়েন, তবে তখনই মারা যান নি। মারা যান দেড় মাস পর, এপ্রিলের সাত তারিখে, ২৭ বছর বয়সে।
অপেক্ষাকৃত ভাল আর্থিক অবস্থায় ছিলেন রফিকউদ্দিন আহমদ। কলকাতায় পড়ালেখা করে, দেশে এসে ম্যাট্রিক পাস করেন। পড়েন আইকম ক্লাস পর্যন্ত। এক পর্যায়ে কাজ শুরু করেন বাবার প্রেস পরিচালনার। ১৯৫২ সালে তিনি ছিলেন জগন্নাথ কলেজের হিসাব বিজ্ঞানের ছাত্র। ২১ ফেব্রুয়ারি, ডিএমসির হোস্টেল প্রাঙ্গণে পুলিশের গুলি এসে সরাসরি আঘাত হানে আন্দোলনরত রফিকের মাথায়। সেখানেই তার খুলি উড়ে যায়। ছয়-সাত জন ধরাধরি করে তাকে এনে রাখেন ঢাকা মেডিকেলের এনাটমি হলের পেছনের বারান্দায়। ১৭ নং রুমের পূব দিকে তার লাশ পড়ে ছিল। ড. মশাররফুর রহমান খান তার ছিটকে পড়া মগজ হাতে করে কুড়িয়ে নিয়ে আসেন।
রাত তিনটায় সামরিক বাহিনীর প্রহরায় আজিমপুর কবরস্থানে শহীদ রফিককে সমাহিত করা হয়। তার বয়স হয়েছিল মাত্র ২৬। তিনি ছিলেন এই নির্মম আক্রমণে প্রথম শহীদ।
আন্দোলনে অংশ নেয়া কর্নেল এস ডি আহমদ এর ভাষ্যমতে,
“দুপুর প্রায় পৌনে তিনটা হবে। বিনা ওয়ার্নিংয়ে পুলিশ ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ছুঁড়তে আরম্ভ করল। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, ফাঁকা গুলি, পুলিশ বোধ হয় ছাত্র-জনতার বিরাট সমাবেশ ভেঙে দিতে ভয় দেখাতে ফাঁকা গুলি ছুঁড়ছে। পরক্ষণেই বুঝলাম, আসল গুলিই ছুঁড়ছে। আমি ছিলাম তখন টিনের চোঙ্গা হাতে আমাদের হোস্টেলের ১৫ নম্বর ব্যারাক বরাবর ফুলার রোডের ধারে। আমার অবস্থান থেকে প্রায় তিন গজ দূরে ভিড়ের মধ্যে ২০-২২ বছরের একটি ছেলে রক্তঝরা একটা মাথার খুলির ওপরের অংশটা বাটির মতো হাতের তালুতে ধরে চিৎকার করে বলতে লাগল, “এই দেখুন, পুলিশের নৃশংসতা!” তাকিয়ে দেখলাম, বাটির মতো মাথার খুলির অংশটিতে রয়েছে রক্তময় কিছু মাথার ঘিলু। কী নিদারুণ এই দৃশ্য! পরে জানা গেল, এটা ছিল শহীদ রফিকের মাথার খুলির অংশ।”
একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা সবাই জানলেও, খুব কম মানুষ জানেন বাইশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা। আগের দিনের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদ ও রাষ্ট্রভাষা বাংলা করবার আন্দোলন চলছিল সেদিনও, নওয়াবপুর রোডে। সেদিন সকাল দশটার দিকে রঘুনাথ লেনের বাসা থেকে সাইকেলে চড়ে অফিসের জন্য বেরিয়ে পড়েন শফিউর রহমান, তিনি ছিলেন ঢাকা হাইকোর্টের হিসাব রক্ষণ শাখার কেরানী। নওয়াবপুর রোড পার হবার সময় পুলিশ সেদিনই গুলি চালায়। রাইফেলের গুলি এসে লাগে শফিউরের পিঠে। সরকারি অ্যাম্বুলেন্সে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেলে। সেখানে ডক্টর অ্যালিন্সন তার অপারেশন করেন, বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন তার বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী আর কন্যা শাহনাজ। দেখা গেল, তার কলিজা ছিঁড়ে গিয়েছে। সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায় তিনি মারা যান, ৩৪ বছর বয়সে। কিন্তু মারা যাবার পর তার লাশ পুলিশ আত্মীয়দের কাছে হস্তান্তর করেনি। পরে তাকে শহীদ আবুল বরকতের কবরের পাশেই দাফন করা হয়।
অহিউল্লাহ নামের একজন ৮/৯ বছর বয়সী শিশুও মারা যায় পুলিশের গুলিতে। ভাষা শহীদদের ২০০০ সালে মরণোত্তর একুশে পদক দেয়া হয়। শহীদ শফিউরকে এ পদক দেয়া হয় ২০০৫ সালে।
এ আন্দোলনের পেছনের কিছু কথা না বললেই নয়। কেন হয়েছিল এই ভাষা সংগ্রাম? তার চেয়েও বড় কথা, উর্দু ভাষাই বা কেন রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলা হয়েছিল?
দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভাগ হয়ে যায় পাকিস্তান আর ভারতে। দু’পাশে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান আর মাঝে হিন্দুপ্রধান ভারত।
মোঘল সুলতানদের আমল থেকে আরবি-ফারসি ভাষা প্রচলিত হয়ে যায়, যা কিনা ‘ইসলামিক ভাষা’ নামে পরিচিত ছিল। এক পর্যায়ে ফারসি পারা লোক সহজে চাকরি পেয়ে যাবে, এই আশায় ‘ইসলামিক ভাষা’র গুরুত্ব বেড়ে যায় মুসলিম সমাজে। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনামলে যখন ইংরেজি চলে এলো, তখন মুসলিম সমাজ এক প্রকার গোঁ ধরে ইংরেজি থেকে প্রথমে মুখ ফিরিয়ে নেয়। যেন ধর্ম গেল বলে! তা-ও ভাগ্য ভালো যে কিছু সমাজ সংস্কারকদের কল্যাণে দেরিতে হলেও হুঁশ ফেরে মুসলিমদের, তারা ইংরেজি শেখে।
সেই উনিশ শতকের মাঝ থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমদের মাঝে উর্দুকে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা চালানো হয়, যার পেছনে ছিলেন স্যার খাজা সলিমুল্লাহ, স্যার সৈয়দ আহমদ খান প্রমুখ। ইন্দো-আর্য পালি-প্রাকৃতের অপভ্রংশ উর্দু গড়ে ওঠে ফার্সি, আরবি আর তুর্কি ভাষার প্রভাবে। সময়কালটা ছিল দিল্লি সালতানাত আর মোঘল সাম্রাজ্য। যেহেতু আরবি হরফে লেখা, তাই তার একটা ইসলামিক গুরুত্ব সর্বদাই ছিল। অন্যদিকে প্রায় একই রকম ভাষা হলেও হিন্দি লেখা হতো ভিন্ন হরফে। অন্য দেবনগরী হরফের ক্ষেত্রেও একই কথা- এগুলোকে হিন্দুত্বের বৈশিষ্ট্য বলে ধরে নেয়া হত। বাংলাও এই আওতার বাইরে পড়েনি।
ইসলাম যখন ইরানে গ্রহণ করে নেয়া হয়, তখনো সেখানে আরবিকে গ্রহণ করা হয়নি মন থেকে। ৩০০ বছর রাষ্ট্রভাষা হিসেবে আরবি থাকলেও শেষ পর্যন্ত ফার্সি (পার্সিয়ান) ভাষাই সবলে টিকে ছিল। এক পর্যায়ে এটাই ‘ইসলামিক ভাষা’ হয়ে গেল। তুর্কিরাও একই কাজ করেছিল, তুর্কি ভাষা টিকিয়ে রেখে। যেহেতু মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) ছিলেন আরবের অধিবাসী, তাই অন্যান্য সকল ধর্মগ্রন্থের মতো কুরআন তাঁরই ভাষাতে, অর্থাৎ আরবিতে নাজিল হয়। তাই ইসলামিক গুরুত্বপূর্ণ বাণীগুলোও ছিল আরবিতে। কিন্তু আরবির মর্যাদা আরো বেশি বাড়াবার জন্য এক পর্যায়ে উৎপন্ন হয় অসংখ্য জাল হাদিস।
মুসলিমরা যখন পারস্য বিজয়রত ছিল, তখন পারস্য (ইরান, যাদের ভাষা ফার্সি) তাদের কাছে ছিল চরম শত্রু। এমন কথাও মুসলিমদের মাঝে প্রচলিত হয়ে যায় যে, “বেহেশতের ভাষা আরবি আর দোজখের ভাষা ফার্সি”। অবশ্যই এমন কোনো কথা আসলে নেই। বরঞ্চ বহু শতক পর ফার্সি হয়ে গেল আরেকটি ‘ইসলামিক’ ভাষা! অথচ তৎকালীন মুসলিম বলুন কিংবা পাকিস্তান সরকারই বলুন, কেউ এই কুরআনের আয়াত উল্লেখ করবার প্রয়োজন মনে করেনি,
“তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের বর্ণ আর ভাষার বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।” (সুরা রূম, ৩০:২২)
যা-ই হোক, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর, পাকিস্তানের মোট ৬.৯ কোটি মানুষের মাঝে ৪.৪ কোটি মানুষই ছিল পূর্ব বাংলার। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার, পূর্ব পাকিস্তানে তো দূরের কথা, পশ্চিম পাকিস্তানেও সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা উর্দু ছিল না। কেবল একটি রাজনৈতিক আর ইসলামিক দিক থেকে সমৃদ্ধ ভাষা হবার বদৌলতে উর্দুকে বেছে নেয়া হলো পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে। তবে ওদিকের মানুষের মুখের ভাষার সাথে উর্দুর যতটা মিল, ততটা মিল কিন্তু ছিল না বাংলাদেশে। যে কারণে ওদিকে উর্দু শেখা তুলনামূলক সহজ ছিল, যদি কারো জানা না-ও থাকে; তাই সকল যুক্তিতেই বাংলাভাষীদের উপর উর্দু চাপিয়ে দেয়া ছিল বিশাল একটা অন্যায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
উর্দু ভাষার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল আরো অনেক আগেই। সেই ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে ভারতীয় মুসলিমদের ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা’ উর্দু করবার প্রস্তাব দেয়া হয়, যেখানে বাংলার সমর্থকগণ তীব্রভাবে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
মজার ব্যাপার হলো, ভারত বিভাগের আগেই যখন বোঝা যাচ্ছিল দুই রাষ্ট্র গঠিত হতে যাচ্ছে, তখন উর্দুর আগেই বাংলাকে নব্য পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়। গণ আজাদী লীগ এ প্রস্তাব দেয় ১৯৪৭ সালের জুলাইতে। তারা এ নিয়ে প্রচারণাও চালায় অনেক। তখনকার পত্রিকায় বাংলা ভাষার পক্ষে বুদ্ধিজীবীরা লেখালেখি করতে লাগলেন, যেগুলোর মধ্যে আব্দুল হক এবং ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর লেখা দুটো উল্লেখযোগ্য। তবে তারা মূলত বাংলাকে প্রাদেশিক ভাষার করার পক্ষে লিখেছিলেন।
উর্দু যেমন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বেমানান, তেমনই বাংলা বেমানান পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। তাই একক রাষ্ট্রভাষা কোনো বৈষয়িক সমাধান ছিল না। অবশ্য সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা চিন্তা করলে বাংলারই এ মর্যাদা পাবার কথা ছিল, কিন্তু সেটা আবার হতো পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যভাষীদের উপর চাপিয়ে দেয়া ভাষা। সে দিকটা বিবেচনায় রেখে নতুন রাজনৈতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিশ একটি বই বের করে, যার নাম ছিল ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা- বাংলা না উর্দু’। সেখানে দু’ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার সুপারিশ করে তারা এবং এ নিয়ে সভাও করে।
কিন্তু ১৯৪৭ এর ডিসেম্বরে পুরো ঘটনা পাল্টে যায়, যখন ৫ তারিখ করাচিতে শিক্ষা সম্মেলনে কেবল উর্দুকেই প্রাদেশিক ভাষা ও প্রাথমিক স্তরে আবশ্যিক বিষয় হিসেবে ব্যবহার করবার প্রস্তাব গৃহীত হয়। পরদিনই এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এসে জড়ো হয়ে প্রতিবাদ করে এবং উর্দুর পরিবর্তে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করবার দাবি জানায়। এটাই ছিল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ভাষা নিয়ে প্রথম সভা। একই সাথে পূর্ব পাকিস্তানের দাপ্তরিক ভাষাও বাংলা করবার দাবি জানানো হয়। ডিসেম্বরের শেষ দিকে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। বলা বাহুল্য, পশ্চিম পাকিস্তান এ দাবির প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন ছিল। পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে বাংলাকে বাদ দেয়া হয়। তখন তমদ্দুন মজলিশ পূর্ব বাংলার গণপরিষদের মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার আর নুরুল আমিনের সাথে মিটিং করে, এরপর মুখ্য মন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথেও দেখা করে; যেন সাধারণ পরিষদকে এ ব্যাপারে অবহিত হয়।
কিন্তু এ ব্যাপারে সবচেয়ে সোচ্চার যিনি হন, তিনি হলেন পূর্ব বাংলার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি গণপরিষদে বাংলাতে কথা বলবার জন্য সংশোধনী আনেন। বাংলা বাতিলের প্রতিবাদ জানান। পরিষদের কিছু সদস্য একমত হলেও, প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান বললেন, এটা পাকিস্তানে বিভেদ সৃষ্টির একটা চেষ্টা। উর্দু হলো লক্ষ কোটি মুসলিমের ভাষা। সুতরাং মুসলিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কেবল উর্দুই হতে পারে। ফলাফল হিসেবে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব বাতিল হলো। পরবর্তীতে তাকে ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ কুমিল্লায় তার নিজের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় পুত্রসহ এবং নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব বাতিলের প্রতিবাদ করে তমদ্দুন মজলিশ। ১১ মার্চ, ১৯৪৮ তারিখে হরতাল দেয়া হয়। ভোরবেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ছাত্ররা বেরিয়ে আসে। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতেও হরতাল পালিত হয়। সকালবেলা ছাত্রদের একটি দল রমনা পোস্ট অফিসে গেলে তাদের গ্রেফতার করা হয়। আরেকটি দল সচিবালয়ের সামনে পিকেটিং করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়। এর প্রতিবাদে বিকেলবেলা আবার সভা হয়, সেখানেও পুলিশ এসে অনেককে আটক করে নিয়ে যায়। ছাত্ররা মিছিল নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসার দিকে যেতে থাকে, হাই কোর্টের কাছে যেতেই তাদের বাধা দেয়া হয়। তখন মিছিল দিক পরিবর্তন করে সচিবালয়ের দিকে যেতে থাকে। এ সময় হঠাৎ পুলিশ মিছিলে অতর্কিতে হামলা চালায়। আহত হন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক সহ অনেকেই। অবরোধ চলে ১৫ মার্চ পর্যন্ত; বগুড়া, রাজশাহী, যশোর, খুলনা সহ অনেক জেলায়।
এদিকে ‘কায়েদে আজম’ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর পূর্ব পাকিস্তান সফরের দিন এগিয়ে আসতে লাগল। তাই খাজা নাজিমুদ্দিন প্রস্তাব দিলেন আন্দোলনকারীদের সাথে আলোচনার। আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ এ ব্যাপারে জানলেও অনেকে জানতে পারেননি। কারাগারে আটকদের সম্মতিতে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এদিকে অন্যরা এ ব্যাপারে না জানায় কর্মসূচি অব্যাহত রাখে। কিন্তু জানতে পারার পর ছাত্ররা একে ষড়যন্ত্র হিসেবে ধরে নেয় এবং এ ব্যাপারে খাজা নাজিমুদ্দিনের স্পষ্ট মন্তব্য চায়। কিন্তু খাজা নাজিমুদ্দিন মুখ খোলেননি।
১৯ মার্চ, ১৯৪৮। জিন্নাহ ঢাকায় এলেন। যার হাত ধরে পাকিস্তানের সৃষ্টি, সেই জিন্নাহর এই প্রদেশে এটাই ছিল প্রথম আর শেষ ভ্রমণ। তিনি ছিলেন নয় দিন, ঢাকা আর চট্টগ্রামে। তাকে স্বাগত জানাতে হাজারো মানুষ জড়ো হয় বিমানবন্দরে। তাকে দেখার জন্য রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে তারা।
২১ মার্চ সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে এক গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। সেখানে তিনি ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, ভাষা আন্দোলন মুসলিমদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, জনগনের মধ্যে যারা ষড়যন্ত্রকারী রয়েছে, তারা কখনোই ক্ষমা পাবে না।
“Let me make it very clear to you that the state language of Pakistan is going to be Urdu and no other language. Anyone who tries to mislead you is really the enemy of Pakistan. Without one state language, no nation can remain tied up solidly together and function. Look at the history of other countries. Therefore, so far as the state language is concerned, Pakistan’s shall be Urdu.”
জিন্নাহর এই কথায় তাৎক্ষনিকভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে উপস্থিত ছাত্রসহ জনতার একাংশ। তবে শুরুতে হাততালিটা কানে বাজে খুব! বক্তব্যের ভিডিও দেখে নিতে পারেন নিজেই-
২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গিয়ে তিনি একই ধরনের বক্তব্য রাখেন। তিনি উল্লেখ করেন, এই আন্দোলন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ এবং অভিযোগ করেন, কিছু লোক এর মাধ্যমে তাদের স্বার্থসিদ্ধি করতে চাচ্ছে। যখন তিনি উর্দুর ব্যাপারে তার অবস্থানের পুনরুল্লেখ করেন, তখন ডিপ্লোমা ডিগ্রি গ্রহণ করতে সেখানে উপস্থিত থাকা ছাত্র আব্দুল মতিন চেয়ারের উপর উঠে দাঁড়ান এবং জোরে বলে ওঠেন, “না, এটা হতে পারে না!” উপস্থিত ছাত্ররা সমস্বরে “না, না!” বলে চিৎকার করতে থাকে। জিন্নাহ তার জীবনে কোনো দিন এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হন নি। তিনি কিছু সময় চুপ করে থাকলেন। তারপর আবার কথা বলা শুরু করলেন। এই প্রতিবাদকেও তিনি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে উল্লেখ করলেন।
২৪ তারিখই তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে মিটিং করেন, সেখানে তিনি খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে করা চুক্তিকে ‘চাপের মুখে করা চুক্তি’ বলে উড়িয়ে দেন। অনেক তর্কের মাঝে শেষ হয় সভা। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে ছাত্ররা তার কাছে স্মারকলিপি দেয়। মিটিং এর মাঝে জিন্নাহ চ্যালেঞ্জ করে বসলেন- “উর্দু ভাষা কত সমৃদ্ধ, বাংলাভাষী বিখ্যাত কাউকে কি দুনিয়া কোনো দিন দেখেছে?” পাকিস্তানের জাতির জনকের এহেন জ্ঞানের অভাব ছাত্রদের স্তম্ভিত করে। তারা আর নিজেদের ধরে রাখতে পারেনি। জিন্নাহ আদৌ কাজী নজরুল ইসলাম, বঙ্কিমচন্দ্র কিংবা নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম শুনেছেন কিনা জিজ্ঞেস করলেন তারা। জিন্নাহ থতমত খেয়ে কোনো উত্তর দিতে পারলেন না।
দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে এই প্রথম জিন্নাহ এমন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন, যেখানে তাকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখা হয়নি। কোথাও কোথাও বলা হয়েছে যে, জিন্নাহকে একপেশে ব্রিফিং দেয়া হয়েছিল পূর্ব বাংলা নিয়ে। বলা হয়েছিল, বাংলার দাবি কেবল কিছু ষড়যন্ত্রকারী হিন্দু, কমিউনিস্ট আর পাকিস্তানবিরোধী বিপথগামীদের চাল।
২৮ মার্চ জিন্নাহ ঢাকা ত্যাগ করেন। সেদিন সন্ধ্যাবেলা তিনি রেডিওতে সেই একই কথা বলেন, বাংলার কোনো স্থান নেই। অবাক করা ব্যাপার, জিন্নাহ নিজে উর্দু লিখতে বা পড়তে পারতেন না, বরং তিনি জানতেন গুজরাটি। তারপরও কেন তার এই উর্দুপ্রিয়তা!
জিন্নাহ চলে যাবার পর ছাত্রলীগ আর তমদ্দুন মজলিশ এর সভা হয়। পরবর্তীতে তমদ্দুনের এই ভাষা আন্দোলন ব্যর্থ হওয়াতে তারা কমিউনিস্টদের দায়ী করে এবং আন্দোলন থেকে সরে আসে।
১১ সেপ্টেম্বর জিন্নাহ মারা গেলেন। তখন খাজা নাজিমুদ্দিন পদোন্নতি পেয়ে জিন্নাহর পদ পেয়ে গেলেন, হলেন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল। নুরুল আমিন হয়ে গেলেন বাংলার মুখ্য মন্ত্রী। যদিও আসল ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের হাতেই ছিল।
১৯৪৮ সালের নভেম্বর মাসে দশ দিনের সফরে লিয়াকত আলী খান পূর্ব পাকিস্তান আসেন। ২৭ তারিখ তাকে একটি সংবর্ধনা দেয় ঢাকা ইউনিভার্সিটি সেন্ট্রাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (DUCSU)। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ডাকসুর সহ-সভাপতি লিয়াকত খানকে একটি স্মারকলিপি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয় যেখানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করবার প্রস্তাব থাকে। স্মারকলিপি লিখে দেন সলিমুল্লাহ হলের আব্দুর রহমান চৌধুরী, যিনি আগে খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে মিটিং করেছিলেন আবার জিন্নাহর সাথে সেই উত্তপ্ত সভাতেও ছিলেন (পরে তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি হন)। ডাকসুর সহ-সভাপতি ছিলেন অরবিন্দ বসু। তিনি হিন্দু হবার কারণে সংগ্রাম পরিষদ ধারণা করল, এটা পশ্চিম পাকিস্তানের সন্দেহের কারণ হতে পারে, যেহেতু তারা হিন্দুদের প্রতি খুবই বিরূপ। এজন্য সহ-সভাপতির বদলে সেই স্মারকলিপি পাঠের দায়িত্ব পড়ে সাধারণ সম্পাদক গোলাম আযমের উপর, পরবর্তীতে যাকে সবাই চিনেছে জামায়াতে ইসলামির প্রতিষ্ঠাতা এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী হিসেবে। অবশ্য লিয়াকত আলী খান একটুও পাত্তা দেন নি এই দাবিতে।
উল্লেখ্য ১৯৭০ সালের ২০ জুন দৈনিক ‘আজাদ’ পত্রিকার পঞ্চম পৃষ্ঠায় “বাংলা ভাষার আন্দোলন করা ভুল হইয়াছে” শিরোনামের প্রতিবেদনে গোলাম আযমের বক্তব্য প্রকাশিত হয়।
২৭ ডিসেম্বর শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান বললেন, “এখন থেকে ইসলামের স্বার্থে বাংলাকে আরবি হরফে লিখতে হবে, এই হিন্দুয়ানি হরফ বাদ দিয়ে। কারণ প্রত্যেক বাংলা অক্ষর কোনো না কোনো হিন্দু দেব দেবীর সাথে সম্পর্কিত।” তার মতে, পাকিস্তান আর দেবনগরী হরফ এক সাথে থাকতে পারে না। অবশ্যই বাংলাকে কুরআনের ভাষার সাথে সম্পর্কিত করতে হবে। তাই তিনি এখন থেকে আরবি হরফে বাংলা লিখতে হবে বলে মত দিলেন (যেমনটা উর্দু হয়েছিল, আরবি হরফে হিন্দি)!
বরাবরের মতোই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু হলো, প্রতিবাদলিপি দেয়া হলো। এ ব্যাপারে ডক্টর শহীদুল্লাহর সহায়তা চাইলেও সেবারে তার সাহায্য পাওয়া যায় নি।
৯ মার্চ, ১৯৪৯ তারিখে পূর্ব বাংলা সরকার একটি কমিটি গঠন করে- ‘পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি’। এর প্রধান ছিলেন মাওলানা মুহাম্মদ আকরাম খান, অন্য ১৬ সদস্যের মাঝে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহও ছিলেন। ৬ ডিসেম্বর কমিটি রিপোর্ট দেয়। বিক্ষুব্ধ জনতাকে শান্ত করতে মন্ত্রণালয়কে দেয়া সে রিপোর্টে বলা ছিল, হয়তোবা বাংলাকে আরবি হরফে লেখা যাবে, কিন্তু সেটা ২০ বছরের আগে নয়। আরো বলা হয়, ভাষাটিকে সংস্কৃত প্রভাব থেকে মুক্ত করা যেতে পারে, আর উর্দুকে ‘সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ’ করা যেতে পারে, যেন দুই পাকিস্তানের ঐক্যতা আনা যায়। পরে অবশ্য সরকার বাংলাকে ইংরেজি হরফে লিখবার প্রস্তাবও দেয়, তাও যেকোনো প্রকারে ‘হিন্দুয়ানি’ দূর করা দরকার তাদের কাছে। তবে এগুলোর কোনোটাই সফল হয়নি।
কিন্তু ১৯৫০ এর এপ্রিলে পূর্ব বাংলার জেলায় জেলায় ২০টি এডুকেশন সেন্টার স্থাপন করে, সেখানে আরবি হরফে বাংলা লেখা শেখানো শুরু হয়! অনেক বড় অংকের টাকা খরচ করা হয় এর জন্য। পাঠ্যবইগুলো আরবি হরফে প্রিন্ট করতে বলা হয়। বলা হয়, যারা এভাবে লিখবে, সেসব লেখককে পুরস্কৃত করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্ররা এর প্রতিবাদ করেন, প্রশ্ন তুলেন ডক্টর শহীদুল্লাহও। জনমত বিরুদ্ধে যায় দেখে পরে এ প্রজেক্ট লস দিয়ে বাতিল করা হয়।
১৯৪৯ সালের পহেলা জানুয়ারি ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বললেন, “বাংলা ভাষাই বাংলার হিন্দু মুসলিমের ঐক্যের মাধ্যম। এটাই আমাদের বাঙ্গালিত্বের পরিচায়ক।” তার এই কথা প্রবলভাবে নিন্দিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। দৈনিক আজাদ তাকে সমালোচনা করে কলাম ছাপায়।
ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, “বাংলার জন্য আলাদা একটা একাডেমি খোলা উচিৎ।” মজার ব্যাপার হলো, ১৯৫৫ সালে ঠিকই বাংলা একাডেমি খোলা হয়। তবে সেটা এমন এক জায়গায়, যেখানে বাংলাবিরোধীর আস্তানা ছিল- খোদ খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসস্থান। এখন সেটাই বাংলা একাডেমি।
এরপরের ইতিহাস মোটামুটি আমরা সবাই জানি, তাও মুক্তিযুদ্ধউইকি থেকে সংক্ষেপে না বললে আসলে জানাটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন খাজা নাজিমুদ্দিন ২৫শে জানুয়ারি ঢাকায় আসেন এবং ২৭শে ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানের এক জনসভায় দীর্ঘ ভাষণ দেন। তিনি মূলত জিন্নাহর কথারই পুনরুক্তি করে বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচারিত তার ভাষণে তিনি আরো উল্লেখ করেন, কোনো জাতি দুইটি রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারেনি।
নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২৯শে জানুয়ারি প্রতিবাদ সভা এবং ৩০শে জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালন করে। সেদিন ছাত্র ও নেতৃবৃন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমবেত হয়ে ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে তারা তাদের মিছিল নিয়ে বর্ধমান হাউজের (বর্তমান বাংলা একাডেমি) দিকে অগ্রসর হয়।
১৯৫২ সালের ৩১শে জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত সভায় মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ৪০ সদস্যের ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’ গঠিত হয়। সভায় আরবি হরফে বাংলা লেখার সরকারী প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করা হয় এবং ৩০শে জানুয়ারির সভায় গৃহীত ধর্মঘটে সমর্থন দেয়া হয়। পরিষদ ২১শে ফেব্রুয়ারি হরতাল, সমাবেশ ও মিছিলের বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে।
পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হয়। সমাবেশ থেকে আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাবের প্রতিবাদ এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের দাবি জানানো হয়। ছাত্ররা তাদের সমাবেশ শেষে এক বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের করে।
২০শে ফেব্রুয়ারি সরকার এক মাসের জন্য সভা, সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। ঐদিন রাতে বৈঠক করে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে এবং পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।
২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হয়। তারা ১৪৪ ধারা জারির বিপক্ষে স্লোগান দিতে থাকে এবং পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্যদের ভাষা সম্পর্কে সাধারণ জনগণের মতকে বিবেচনা করার আহবান জানাতে থাকে।
পুলিশ অস্ত্র হাতে সভাস্থলের চারিদিকে প্রাচীর তৈরি করে। বিভিন্ন অনুষদের ডীন এবং উপাচার্য সে সময় উপস্থিত ছিলেন। বেলা সোয়া এগারটার দিকে ছাত্ররা গেটে জড়ো হয়ে প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নামতে চাইলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস বর্ষণ করে ছাত্রদের সতর্ক করে দেয়।
কিছু ছাত্র এই সময়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের দিকে দৌড়ে চলে গেলেও বাকিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পুলিশ দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং পুলিশের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। উপাচার্য তখন পুলিশকে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ বন্ধ করতে এবং ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ত্যাগ করতে বলেন। কিন্তু ছাত্ররা ক্যাম্পাস ত্যাগ করার সময় পুলিশ তাদের গ্রেফতার করা শুরু করলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার করে তেজগাঁও নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। এই ঘটনায় ছাত্ররা আরও ক্ষুদ্ধ হয়ে তাদের কর্মকাণ্ড পুনরায় শুরু করে। এই সময় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে কিছু মহিলা তাদের এই বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে।
বেলা ২টার দিকে আইন পরিষদের সদস্যরা আইনসভায় যোগ দিতে এলে ছাত্ররা তাদের বাধা দেয় এবং সভায় তাদের দাবি উত্থাপনের দাবি জানায়।
কিন্তু পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে, যখন কিছু ছাত্র সিদ্ধান্ত নেয়, তারা আইন সভায় গিয়ে তাদের দাবি উত্থাপন করবেন। ছাত্ররা সেই উদ্দেশ্যে রওনা করলে বেলা ৩টার দিকে পুলিশ দৌড়ে এসে ছাত্রাবাসে গুলিবর্ষণ শুরু করে।
এরপরের ঘটনা আর ২২ ফেব্রুয়ারির ঘটনা এই পোস্টের শুরুতেই বলা হয়েছে।
২৩ ফেব্রুয়ারি সারা রাত ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রবৃন্দ শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরিতে কাজ করেন। এটি ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখের মধ্যে সম্পূর্ণ হয়েছিল। তাতে একটি হাতে লেখা কাগজ যুক্ত করা হয়েছিল, যাতে লেখা ছিল ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’। এটি উদ্বোধন করেন আন্দোলনে শহীদ শফিউর রহমানের পিতা। স্মৃতিস্তম্ভটি পুলিশ ফেব্রুয়ারি ২৬ তারিখে ভেঙে দেয়।
২১ ও ২২শে ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর সরকার আন্দোলনের বিপক্ষে জোর প্রোপাগান্ডা চালাতে থাকে। তারা জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকে যে, কমিউনিস্ট ও পাকিস্তান বিরোধীদের প্ররোচণায় ছাত্ররা পুলিশকে আক্রমণ করেছিল। তারা বিভিন্নভাবে তাদের এই প্রচারণা অব্যাহত রাখে। তারা সারা দেশে লিফলেট বিলি করে। সংবাদপত্রগুলোর উপর তাদের ইচ্ছামাফিক সংবাদ পরিবেশনের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে থাকে।
১৬ই এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খুললে সেদিন ছাত্ররা সমাবেশ করে। কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় কর্মপরিষদ ২১শে ফেব্রুয়ারি স্মরণে শহীদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানও দিবসটি পালনে সম্মত হন, প্রস্তাবটি তিনিই উত্থাপন করেছিলেন।
১৮ই ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা শান্তিপূর্ণভাবে ২১শে ফেব্রুয়ারি পালনের উদ্দেশ্যে প্রশাসনের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ভাষা আন্দোলনের প্রথম বার্ষিকী সারা দেশব্যাপী যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়। অধিকাংশ অফিস, ব্যাংক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মানুষ প্রভাতফেরীতে যোগ দেন। হাজার হাজার মানুষ কালো ব্যাজ ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আসে এবং মিছিল করে প্রাঙ্গণ ত্যাগ করে।
প্রায় লাখো লোকের উপস্থিতিতে আরামানিটোলায় বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে এক দফা দাবি জানানো হয়, ভাষার দাবির সাথে সাথে মাওলানা ভাসানীসহ সকল রাজবন্দীদের মুক্তির দাবি করা হয়। রেলওয়ের কর্মচারীরা ছাত্রদের দাবির সাথে একমত হয়ে ধর্মঘট পালন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাসের ছাত্ররা শহীদদের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
অন্যদিকে পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ফজলুর রহমান বলেন যে, বাংলাকে যারা রাষ্ট্রভাষা করতে চায়, তারা দেশদ্রোহী। তার এই বক্তব্যে জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে কালো ব্যাজ দেখায়। সাধারণ মানুষের মাঝে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ লেখা সম্বলিত স্মারক ব্যাজ বিলি করা হয়। ভাষা সংগ্রাম কমিটি দিবসটি পালন উপলক্ষে সমাবেশ আহবান করে। আন্দোলনকে আরো বেগবান করার জন্য বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে বিশেষ পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
ভাষা আন্দোলনের মূল অনুপ্রেরণাদায়ী সঙ্গীত “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি…” সেই বছর কবিতা আকারে লিফলেটে প্রকাশিত হয়। দু’বছর পর আবারো শহীদ মিনার বানানো হয় নতুন করে। বড় করে ডিজাইন করে বানানো শুরু হয় ১৯৫৭ সালে, আর্কিটেক্ট হামিদুর রহমানের ডিজাইন মাফিক। ১৯৫৮ সালের মার্শাল ল এর কারণে কাজ থেমে যায়, কাজ শেষ হবার পর ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম উদ্বোধন করেন শহীদ মিনার। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনী ভেঙে ফেলে শহীদ মিনার, কিন্তু ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকার পুনর্নিমাণ করে সেটি।
১৯৫৬ সালে প্রথমবারের মতো সরকারের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় ২১শে ফেব্রুয়ারি পালিত হয়। সেদিন প্রথম শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। পাকিস্তানের গণপরিষদে পাঁচ মিনিট বন্ধ রাখা হয় ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে। দেশব্যাপী পালিত হয় শহীদ দিবস এবং বেশীরভাগ প্রতিষ্ঠান ছিল বন্ধ। আরমানিটোলায় এক বিশাল সমাবেশের নেতৃত্ব দেন মাওলানা ভাসানী।
ভাষা আন্দোলন শুরুর প্রায় দশ বছর পর বাংলা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায় ১৯৫৬ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারি। সংবিধানের ২১৪ অধ্যায়ে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে লেখা হয়: “The state language of Pakistan shall be Urdu and Bengali”।
উল্লেখ্য, ১৯৬১ সালের ১৯ মে আসামের শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালায়, সেখানে ১১ জন বাঙালি নিহত হয়। পরবর্তীতে আসামের তিন বাংলা-প্রধান জেলায় বাংলাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ভাষা আন্দোলনের পর জাতীয়তা নিয়ে সচেতনতা বেড়ে ওঠে। আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়। ১৯৬৮ সালে আইয়ুব খান আবারো বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানে এখনো হিন্দুয়ানি প্রভাব রয়ে গেছে।”
মাতৃভাষার জন্য এমন রক্তঝরা আন্দোলন বাংলা ছাড়া আর কোনো ভাষার নেই। এর স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে, যা বাংলাদেশে একই সাথে শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হয়।
কিন্তু আজও ইতিহাসবিমুখতার কারণে আমাদের এরকম পরিস্থিতি দেখা লাগে:
নতুন প্রজন্মের সকলে যেন আরো ইতিহাস সচেতন হয়ে ওঠে এমন প্রত্যাশাই আমাদের সকলের। ভাষা শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে শেষ করছি।
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি?”
ফিচার ছবিসূত্র: miui