হার্ট আইল্যান্ড; নিউ ইয়র্কের একটি দ্বীপ, যা কি না বহু বছর ধরে গোরস্থানের ভূমিকা পালন করে আসছে। মৃত মানুষদের মাঝে যারা এতটাই দরিদ্র যে শেষকৃত্যানুষ্ঠান করার মতো সামর্থ্যটুকুও নেই তাদের চিরনিদ্রার জায়গা হয় এই দ্বীপের মাটি। নিউ ইয়র্ক শহরের স্বজনহীন, অজ্ঞাতনামা, বেওয়ারিশ যাবতীয় মৃতদেহের শেষ ঠিকানা হিসেবে পরিচিত এই দ্বীপটি। একাধিক মহামারিতে মারা যাওয়া অসংখ্য মানুষ, যাদের পরিচয় নির্ণয় করা যায়নি, শেষাবধি তারা এখানেই ঘুমিয়ে আছেন আশ্চর্য নীরবতায়।
ব্রংসে অবস্থিত এই দ্বীপটি নিউ ইয়র্ক কিনে নেয় ১৮৬৮ সালে এবং গণকবরস্থান হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয় ১৮৬৯ সাল থেকে। শুরু থেকে ফি বছর প্রায় ১,০০০ এরও বেশি লাশ দাফন করা হয়েছে এই দ্বীপটিতে এবং এর বিপরীতে প্রায় ৪০টির মতো মৃতদেহের দাবী নিয়ে স্বজনেরা পরবর্তীতে কোনো সময়ে ফিরে আসেন। প্রতিটি বেওয়ারিশ লাশ দাফনের পূর্বে শহরের অফিস অভ দ্য চিফ মেডিক্যাল এক্সামিনার ঠিক ৩০ দিন অপেক্ষা করেন। এই সময়ের মাঝে মৃতের কোনো পরিচয় পাওয়া না গেলে অথবা কোনো পরিচিতজন দাবী নিয়ে না এলে তাকে সমাহিত করা হয়। কিন্তু বর্তমানে চলমান কোভিড-১৯ মহামারিতে নিউ ইয়র্ক শহরে প্রতিদিন লাশের সংখ্যা বেশুমার হয়ে যাওয়াতে কর্তৃপক্ষ প্রথমে ৬ দিন, এরপর ১৪ দিন এবং সবশেষে ১৫ দিন অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। ১৫ দিনের মাঝে মৃত ব্যক্তির পরিচয়ের সুরাহা না হলে তার শেষকৃত্যানুষ্ঠান করা হয়।
প্রতি সপ্তাহে নিউ ইয়র্ক শহর পরিচালিত সকল মর্গ থেকে অজ্ঞাতনামা সব মৃতদেহ হার্ট আইল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হয় শেষকৃত্যের উদ্দেশ্যে। দ্বীপের মাটিতে তারা শায়িত হন নামহীন সমাধিস্তম্ভের পাদদেশে। মৃত্যুর সাথে সাথে এসব ব্যক্তির একসময়কার নাম-পরিচয় সবই হারিয়ে যায়! প্রতি বছর প্রায় সহস্রাধিক লাশের ঠিকানা হয়ে উঠে এই দ্বীপটি। অদ্যাবধি প্রায় ১০ লাখেরও বেশি পরিচয়হীন মৃত ব্যক্তির সমাধি রয়েছে সেখানে।
চলমান করোনাভাইরাস মহামারিতে হার্ট আইল্যান্ডের পরিস্থিতিও বদলে গেছে অনেকটাই। কোভিড-১৯ এর কারণে প্রতিদিন নিউ ইয়র্ক শহরে মারা যাচ্ছে শত শত মানুষ। শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যরা কোয়ারেন্টিনের দরুন বাধ্যতামূলকভাবে ঘরে অবস্থান করছেন এবং পুরো শহর এই করোনাভাইরাসের সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে লক ডাউন অবস্থায়। অন্যদিকে সম্প্রসারিত চিকিৎসাব্যবস্থাও সকল রোগীকে পর্যাপ্ত পরিমাণে সেবা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। এছাড়াও শহরের প্রতিটি মর্গই তাদের ধারণক্ষমতায় পৌঁছে গেছে ইতিমধ্যে। এমতাবস্থায় নিউ ইয়র্ক শহর কর্তৃপক্ষ নিরুপায় হয়েই হার্ট আইল্যান্ডকে বেছে নেয় সমাধিস্থল হিসেবে।
নিউ ইয়র্কের মেয়র বিল ডি ব্ল্যাসিও সম্প্রতি এক টুইটে জানিয়েছেন তার সমবেদনার কথা। তিনি বলেন,
প্রতিনিয়ত মৃত্যু দেখতে দেখতে আমরা সকলেই শোকস্তব্ধ। মৃতের সংখ্যা বাড়ছে মানে বহু মানুষ তাদের হারানো প্রিয়জনকে ব্যক্তিগতভাবে শেষ বিদায়টুকু জানাতে পারছেন না। সকলের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, হার্ট আইল্যান্ডে সকল মৃতদেহকে একত্রে সমাহিত করা হবে না। প্রতিটি মৃতদেহকে আলাদা আলাদাভাবে যথাযথ মর্যাদার সাথে বিবেচনা করে সমাধিস্থ করা হবে, কেননা যারা মারা গেছেন তারা এই নিউ ইয়র্ক শহরেরই বাসিন্দা এবং আমাদেরই প্রতিবেশী ছিলেন।
২০০ বছর ধরে বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত হওয়ার পর ১৮৬৮ সালে নিউ ইয়র্ক শহর দ্বীপটিকে কিনে নেয়। এর পরের বছর ৪৫ একর জমি আলাদাভাবে সমাধিস্থল হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। প্রাথমিকভাবে এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য ছিল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের মাঝে যারা নিদারুণ অর্থকষ্টে ভোগেন এবং স্বজন হারালেও শেষ বিদায়টুকু জানানোর মতো আর্থিক সঙ্গতি যাদের নেই তাদের হয়ে কাজ করা। এখন পর্যন্ত শেষকৃত্যানুষ্ঠান ও সমাধিস্থ করাই এই দ্বীপের মূল দায়িত্ব, যার সমুদয় আইনগত অধিকার নিউ ইয়র্ক শহরের ডিপার্টমেন্ট অভ কারেকশনের হাতে ন্যস্ত।
শত বছরের পুরোনো এই সমাধিস্থলে প্রথম সমাহিত ব্যক্তির নাম লুইসা ভ্যান স্লাইক। ১৮৬৯ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সেই তিনি যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। কোনো পরিবার বা ব্যক্তিই পরিচয়ের কোনো দাবী নিয়ে না আসায় তাকে এখানে কবর দেওয়া হয়। অব্যবহিত পরের বছরেই পীতজ্বরের প্রকোপ দেখা দিলে হার্ট আইল্যান্ডকে কোয়ারেন্টিন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়, কেননা তখন ধারণা করা হতো উৎকট গন্ধ থেকেই এই রোগ ছড়ায়। পরবর্তীতে হোয়াইট প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে এই দ্বীপেই একটি হাসপাতাল তৈরি করা হয় যার উদ্দেশ্য ছিল এই মহামারির প্রাদুর্ভাব ঠেকানো। প্রতি ৭ জন আমেরিকানের মাঝে ১ জনকে আক্রান্ত করা এই মহামারির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের গৃহীত প্রথম পদক্ষেপ ছিল হার্ট আইল্যান্ডে এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা।
১৯৮৫ সালে এইডস নিয়ে যখন সারা বিশ্বে আতঙ্ক তৈরি হলো, তখন এই দ্বীপটি আরেকবার যেন নিজের বুক পেতে দিল মৃতদের গ্রহণের উদ্দেশ্যে। একে একে শহরের সকল শেষকৃত্যানুষ্ঠান আয়োজনকারী প্রতিষ্ঠানের দরজা বন্ধ হতে শুরু করল এইডসের ডামাডোলে। কেউই এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য সহানুভূতির হাত বাড়াতে রাজি হলো না। অবশেষে হার্ট আইল্যান্ডের একেবারে সর্ব দক্ষিণে অন্য সব সমাধি থেকে বেশ দূরে ১৭টি লাশ দাফন করা হয়, যাদের প্রত্যেকেই এইডসে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। সতর্কতার অংশ হিসেবে তাদের প্রত্যেককেই ১৪ ফুট গভীর গর্ত করে সমাধিস্থ করা হয় সেসময়। সমাধিফলকে এইডস আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা প্রথম শিশুটির স্মৃতির উদ্দেশ্যে “SC-B1, 1985” কথাটি উল্লেখ করা হয়।
১৯৮০ ও ‘৯০ এর দিকে এইডসে আক্রান্ত অসংখ্য মৃতদেহ এখানেই সমাধিস্থ হয়। তখনকার সমাজে এই রোগকে কেন্দ্র করে প্রচলিত বেশ কিছু ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কারের দরুন এখানে এইডসে মৃত্যুবরণকারী মানুষের সঠিক সংখ্যাটি কখনোই হিসেব রাখা হয়নি, তবে ধারণা করা হয় সমগ্র পৃথিবীতে হার্ট আইল্যান্ডই সর্বাধিক সংখ্যক এইডস রোগীর সমাধিস্থল।
সাম্প্রতিক সময়ে সর্বশেষ হার্ট আইল্যান্ড ব্যাপক আকারে সমাধিস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয় ২০০৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারির সময়।
সমাধিস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার পূর্বে হার্ট আইল্যান্ড বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছিল। ১৬৫৪ সালে চিকিৎসক থমাস পেল সেখানকার অধিবাসীদের কাছ থেকে এই দ্বীপটি কিনে নেন একটি আনুষ্ঠানিক সন্ধিপত্রের মাধ্যমে। গৃহযুদ্ধ চলাকালে ইউনাইটেড স্টেটস কালারড ট্রুপসের সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্যও এই দ্বীপটি ব্যবহৃত হয়েছিল। উনিশ শতকের শেষ দিকে এসে নিউ ইয়র্ক সিটি লুনাটিক অ্যাসাইলামের নারী শাখা হিসেবে এই দ্বীপটিকে ব্যবহার করা হয়েছিল, যদিও কোনো মহিলারই সেখান থেকে সুস্থ হওয়ার খবর মেলেনি। কর্তৃপক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী- ভর্তি হওয়া নারীদের প্রত্যেকের মানসিক অবস্থা ক্রনিক পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৬০ ও ‘৭০ এর দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংশোধনী কেন্দ্র, মিসাইল উৎক্ষেপণ কেন্দ্র এবং মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র হিসেবে এই দ্বীপটি ব্যবহৃত হয়।
করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে বর্তমানে দ্বীপটিতে জনসাধারণের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গেল বছরের ডিসেম্বর মাসে নিউ ইয়র্ক মেয়র ডি ব্ল্যাসিও চারটি বিল স্বাক্ষর করেন, যার মাধ্যমে দ্বীপটিতে দর্শনার্থীদের প্রবেশাধিকার ও শোক প্রকাশ করার সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনাভাইরাসের তাণ্ডব শেষ হলে হয়তো নিউ ইয়র্ক শহরের অনেক অধিবাসীই যাবেন এই দ্বীপে মৃতদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে।