শিশুকাল থেকে সময়ের সাথে মানুষ ধীরে ধীরে বড় হয়। শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য পেরিয়ে অবধারিতভাবে পৌঁছে যায় বার্ধক্যে। বয়স হয়ে যাওয়ার ফলে তাদের দেখভাল করার জন্য সার্বক্ষণিক তদারকি ও সঙ্গ প্রয়োজন হয়ে পড়ে। উন্নত দেশগুলোতে বৃদ্ধাশ্রম মূলত ‘নার্সিং হোম’ নামে পরিচিত। আমেরিকাতেই প্রায় ১৫ লাখ নারী-পুরুষ বৃদ্ধাশ্রমে বাস করে আসছেন। ১৬ হাজারেরও বেশি নার্সিং হোম তাদের সেবায় নিয়োজিত রয়েছে। নার্সিং হোমগুলোতে ঘটে যাওয়া কষ্ট, ভয়, শিহরণ এবং চমক মিশ্রিত ভিন্ন ভিন্ন আটটি মর্মান্তিক ঘটনার বর্ণনা থাকছে এই লেখায়।
বন্য প্রাণীর আক্রমণ
২০১৬ সালে, ফ্লোরিডার ঘটনা। ৯১১ এর অপারেটর স্টেরলিং কোর্ট গ্রেসাস রিটায়ারমেন্ট লিভিং সেন্টার থেকে একটি কল পান। তাকে জানানো হয়, ওখানে বসবাসরত বয়স্ক ব্যক্তিদেরকে কিছু একটা নৃশংসভাবে আক্রমণ করছে। ঘটনা তদন্তে বেরিয়ে আসে, নার্সিং হোমের বাইরে একজন বয়স্কা মহিলাকে কামড়ে দেয়ার পর এক হিংস্র কাঠবেড়ালি নার্সিং হোমের ভেতরে ঢুকে পড়েছিল! তারপর এর ওর গায়ে লাফিয়ে উঠে ইচ্ছেমতো আঁচড়ে-কামড়ে রক্তাক্ত ও জখম করে পালিয়ে গেছে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শেষে এরপর নার্সিং হোমের বাসিন্দারা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে শুরু করলে কয়েকদিন পর কাঠবিড়ালী আবার তার রক্তপিপাসা মেটাতে হাজির হয়। কিন্তু এবার তার কপাল মন্দ। আগে থেকে প্রস্তুত থাকা একজন স্টাফ কাঠবেড়ালিটিকে গুলি করে ভবলীলা সাঙ্গ করে দেন।
একই বছর দক্ষিণ ক্যারোলিনার ব্রুকডেল সিনিয়র লিভিং সেন্টারে ঘটেছিল এক মর্মান্তিক ঘটনা। স্থানীয় এক পুকুরের দৃশ্য উপভোগ করছিলেন ৯০ বছর বয়স্কা বোনি ওয়াকার। কিন্তু আচমকা একটি অ্যালিগেটর এসে তার উপর হামলা করে এবং তাকে কামড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে। পরবর্তীতে বোনি ওয়াকারের খণ্ডিত লাশ ও অ্যালিগেটর দুটোকেই সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা হয়।
বিষক্রিয়া
নিউ জার্সি, ১৯৮১ সালের ক্রিসমাস। শেডি লেন হোমে উৎসবমুখর পরিবেশ বিদ্যমান। কিন্তু হঠাৎ করেই ওখানকার ১২০ জন বাসিন্দা ও স্টাফ খাবারের বিষক্রিয়ার ফলে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে ল্যাবরেটরি টেস্টে জানা যায়, উৎসবে থাকা এগনগ নামের খাবারে স্যালমনেল্যা ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি ছিল। ব্যাকটেরিয়ার প্রভাব এতোটাই ভয়াবহ ছিল যে চারজন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
একই বছর জুলাইতেও স্যালমনেল্যা ব্যাকটেরিয়ার ফলে সৃষ্ট বিষক্রিয়ায় মিনেসটা নার্সিং হোমের চারজন বয়স্কা নারী ও ৪৮ জন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।
২০১২ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার লুমিসে গোল্ডেন এজ ভিলায় বুনো মাশরুম মিশিয়ে বানানো স্যুপ খেয়ে একদিনেই মারা গিয়েছিলেন দুজন। সেইসাথে আরও চারজন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন মারাত্মকভাবে।
অগ্নিকাণ্ড
মিশিগানে অবস্থিত ক্লেরা বার্টন কনভেলেন্সে ১৯৯৯ সালে রাত নয়টার একটু আগে বিকট বিস্ফোরণে আগুন ধরে যায়। এতে ওখানকার বাসিন্দা ও স্টাফরা মারাত্মকভাবে দগ্ধ হন। দমকল কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছাবার আগেই পুরো নার্সিং হোম পুড়ে স্রেফ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়ে যায়। এই দুর্ঘটনায় পাঁচজন বয়স্ক ব্যক্তি মারা যান। ২০ জনকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, নার্সিং হোমের বেসমেন্টে থাকা বয়লার থেকে অনাকাঙ্খিতভাবে গ্যাস লিক হয়েছিল। আর সেই গ্যাসের কারণেই একপর্যায়ে বিস্ফোরণ ঘটে। বয়লারটির রক্ষণাবেক্ষণের সাথে জড়িত কোম্পানীগুলোর বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা দায়ের করেন মৃত ব্যক্তিদের স্বজনেরা। মামলার ফলস্বরূপ কোম্পানিগুলোকে ১৫ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ গুণতে হয়।
মারাত্মক ভুল
২০০০ সালের ঘটনা। ডেটনের ক্যারেজ-বাই-দ্য-লেক নার্সিং হোমে অক্সিজেন সরবরাহ সিস্টেমে অক্সিজেন ট্যাঙ্কের জায়গায় ভুলক্রমে নাইট্রোজেন সিলিন্ডার জুড়ে দেয়ায় একে একে সকল বাসিন্দা অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে কর্তৃপক্ষ ভুল সিলিন্ডারের বিষয়টি জানতে পারে। কিন্তু সিলিন্ডারের গায়ে স্পষ্ট করে নাইট্রোজেনের লেবেল থাকার পরও কেন এমন মারাত্মক ভুল হলো? কেউ ইচ্ছেকৃতভাবে কাজটা করেছে কিনা সেটা দেখার জন্য তদন্ত শুরু হয়। উদ্ধারকারী দল নার্সিং হোমে অসুস্থ ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছুতে পৌঁছুতে বেশ কয়েকজন বাসিন্দা কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে আক্রান্ত হন। ৭০ বছর বয়সী পালিন টেস নামের একজন বাসিন্দা ঘটনাস্থলে মৃত্যুবরণ করেন।
অন্যদিকে হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান ৭৬ বছর বয়সী হেলেন টমলিন। তার কিছুক্ষণ পর আরও একজন বাসিন্দা ইহলোক ত্যাগ করেন এবং মোট ৮ জনকে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে এই ঘটনাকে একটি দুর্ঘটনা হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং নার্সিং হোম কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা তাদের তৎকালীন অক্সিজেন সরবরাহ প্রতিষ্ঠান বিওসি গ্যাসেস এর সাথে আর কোনো লেনদেন করবে না।
প্লেন ক্র্যাশ
কেমন হবে যদি একটি প্লেন এসে আপনার রুমের সাথে সংঘর্ষ বাঁধিয়ে দেয়? অদ্ভুত না বিষয়টা? ঠিক এই ঘটনাই ঘটেছিল ২০১৪ সালে, ফ্রান্সের ভুবরেতে। একটি ড্যাসাল্ট আলফা মিলিটারি ট্রেইনিং জেট এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল এক নার্সিং হোমে, যেখানে ৭৫ জন বয়স্কা পঙ্গু নারী বাস করছিলেন। প্লেনটি ঠিক কী কারণে ওরকম দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছিল সেটি আজও অজানা রয়ে গেছে। দুর্ঘটনার ফলে ৬৩ বছর বয়স্কা এক নারী মারা যান এবং অনেকে গুরুতরভাবে আহত হন।
বাসে আগুন
সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সাল। হাস্টন এলাকায় হারিকেন রিটা ধেয়ে আসছে। ব্রাইটন গার্ডেন্স নার্সিং হোমের বাসিন্দাদেরকে নিরাপদে অন্য এলাকায় সরানোর জন্য একটি বাস ভাড়া করা হয়। ৩৭ জন বয়স্ক ব্যক্তিকে তুলে দেয়া হয় বাসে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ১৫ ঘণ্টা পর বাসটিতে আগুন লেগে যায় এবং ২৪ জন যাত্রী তখনও বাসের ভেতরে অবস্থান করছিলেন। উদ্ধারকর্মীরা বাসের কাছে পৌঁছুনোর আগেই হঠাৎ করে বাসটি বিস্ফোরিত হয়।
বয়স্ক যাত্রীদের শ্বাস-প্রশ্বাসের সুবিধার্থে রাখা অক্সিজেন ট্যাংক লিক হয়ে অক্সিজেন বেরোনোর ফলে অতর্কিতভাবে এই বিস্ফোরণটি ঘটেছিল। বিস্ফোরণের মাত্রা এতোটাই ভয়াবহ ছিল যে লাশ দেখে মৃতদেরকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। হতাহতদের পরিবারের কাছে সঠিক লাশ পৌঁছে দেয়ার জন্য ডেন্টাল রেকর্ড চেক করতে হয়েছিল। তবে এতজন যাত্রী মারা গেলে বাসের ড্রাইভার আর ক্রুরা কিন্তু দিব্যি বেঁচে গিয়েছিল। দুর্ঘটনার ৫ দিন পর ড্রাইভারকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। ক্রুটিপূর্ণ বাস চালানো এবং দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় তাকে।
আর্সেনিক
উইন্ডসোর, কানেকটিকাটে ‘আর্চার হোম ফর এজড পিপল’ নামে একটি নার্সিং হোম চালু করেন অ্যামি আর্চার গিলিগ্যান নামের এক মহিলা। সময়টা তখন ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দ। অ্যামি আর্চারের উদ্যোগটা প্রশংসনীয় হলেও একটা বিষয়ে খটকা বাঁধে। কারণ, তিনি মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে আর্সেনিক ক্রয় করতেন। বলতেন, নার্সিং হোমে ইঁদুর মারার জন্য এই আর্সেনিক তার প্রয়োজন। কিন্তু পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যায়, যখন লক্ষ্য করা হয়, নয় বছরে তার নার্সিং হোমের ৬০ জন বাসিন্দা আর্সেনিকের কারণে মারা গেছেন। সন্দেহভাজন হিসেবে অ্যামিকে ১৯১৬ সালে গ্রেফতার করা হয়। তদন্তে বেরিয়ে আসে নার্সিং হোমের খাবারে অ্যামি আর্চার নির্বিকারভাবে আর্সেনিক মিশিয়ে দিতেন!
আদালত সবকিছু বিবেচনা করে অ্যামিকে সেকেন্ড-ডিগ্রি মার্ডার চার্জে অভিযুক্ত করে যাবজ্জীবন জেল প্রদান করেন। তবে অ্যামির মানসিক সমস্যা আছে ধরে নিয়ে তাকে জেল থেকে মেন্টাল ইন্সটিটিউশনে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৬২ সালে ৮৯ বছর বয়সে অ্যামি আর্চার মৃত্যুবরণ করেন।
লেলিহান শিখা
ওয়ারেনটন নার্সিং হোম। ফেব্রুয়ারি মাসের কোনো এক রবিবার; ১৯৫৭ সাল। চার্চের লোকদের সাথে সুন্দর সময় অতিবাহিত করছিলেন নার্সিং হোমের বয়স্ক ব্যক্তিরা। কিন্তু হঠাৎ করে নার্সিং হোমের আড়াই তলা ভবনটিতে আগুন লেগে যায়। মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে পুরো ভবন ছেয়ে যায় আগুনে। দমকল কর্মীরা দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখেন দোতলার জানালা দিয়ে কয়েকজন বয়স্ক ব্যক্তি প্রাণ বাঁচাতে বিপদজনকভাবে নিচে লাফ দিচ্ছেন! দুর্ভাগ্যবশত ভবনটিতে কোনো ফায়ার এস্কেপ বা জরুরি মুহূর্তে ব্যবহার করার জন্য কোনো বিশেষ সিঁড়ির ব্যবস্থা ছিল না। এই অগ্নিকাণ্ডে ৭২ জন হতাহত হন। বলা হয়ে থাকে, আমেরিকার নার্সিং হোম ইতিহাসে এত বড় দুর্ঘটনা আর হয়নি। মৃত ৭২ জনের মধ্যে ১৪ জন এতোটাই জঘন্যভাবে পুড়ে গিয়েছিল যে তাদের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি তখন। অগত্যা তাদেরকে ওয়ারেনটন সেমেট্রিতে গণকবর দেয়া হয়।
প্রায় একই ধরনের দুর্ঘটনা আবারো ঘটে ১৯৬৩ সালের নভেম্বরের ২৩ তারিখে। ওহিওর ফিচভিলে অবস্থিত গোল্ডেন এজ নার্সিং হোমে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ৬৩ জন বয়স্ক ব্যক্তি মারা যান। মৃত্যুকালে তারা কেউ কেউ বিছানায় ছিলেন আর কেউ কেউ হুইলচেয়ারে ছিলেন অসহায় অবস্থায়। জরুরি মুহূর্তে বের হওয়ার রাস্তাটা এতটাই সরু ছিল যে হুইলচেয়ার সেই রাস্তায় ঢুকতে পারেনি। দুঃখের বিষয়, এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি তখন খুব একটা আলোর মুখ দেখতে পায়নি, কারণ আগের দিন প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি’র হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছিল।
যত ব্যস্ততাই থাক না কেন সন্তানের উচিত নিজের বাবা-মায়ের সেবা, যত্ন করা। বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে এভাবে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় কারো বাবা-মায়ের প্রাণহানি হোক, এটা কখনোই কাম্য নয়।
ফিচার ইমেজ: hips.hearstapps.com