স্ট্যান্ডিং আপ টু দ্য বুলিস
এপ্রিল ১৯৪৮
“স্যার-ম্যাডামদের কথামতো চলবে। মনে রেখ মা, তারাই তোমাকে সঠিক পথটা দেখিয়ে দেবেন।” চতুর্থ শ্রেণীতে ক্লাস শুরুর আগে বাবা সাচিকোকে আবারও সেই একই কথা মনে করিয়ে দিলেন।
সাচিকোর স্কুলের বিল্ডিংয়ের প্রায় পুরোটাই নতুন করে বানানো হয়েছিল। কিন্তু খেলার মাঠে তখনও কাচের টুকরা, সিমেন্ট আর ধ্বংসের অন্যান্য স্মৃতিচিহ্ন পড়ে ছিল। সে ক্লাসরুমে ইতস্ততভাবে মাথা ঢোকাতেই স্যার তাকে ভেতরে আসতে বললেন। অন্যান্য শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, “কোয়াগি থেকে আসা তোমাদের নতুন বন্ধু সাচিকোকে সবাই স্বাগত জানাও।“
একটি ডেস্কে গিয়ে বসে পড়লো সাচিকো। সে আশা করেছিল, হয়তো এক-দুজন পরিচিত মুখের সন্ধান সে পাবে। কিন্তু কাউকেই তার কাছে তেমনটা মনে হলো না। আর তারা তাকে চিনবেই বা কীভাবে? এখানের অল্প যে ক’টি ছেলেমেয়ে বোমা হামলা থেকে বেঁচে গিয়েছিল, সাচিকো তাদেরই একজন।
সহপাঠীদের দিক থেকে নজর সরিয়ে ক্লাসে মনোযোগ দিলো সাচিকো। গণিত ক্লাসের সময় স্যার বোর্ডে বেশ কিছু গাণিতিক সমস্যা তুলে দিয়ে সেগুলোর সমাধান জানতে চাইলেন। সাচিকো হাত তুললো। যতবারই স্যার তার কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, প্রতিবারই সে সঠিক জবাব দিয়েছিল।
দুপুরে টিফিনের সময় সাচিকোর এক সহপাঠিনীরই কী যেন হলো। তাকে দেখে একটি দলের নেতা গোছেরই মনে হচ্ছিলো। কোয়াগির স্কুলে উপহাসের শিকার হবার কথা মনে পড়ে গেলো সাচিকোর। এবার আবার কী হলো? মেয়েটা কি তার জামাকাপড় পছন্দ করেনি? নাকি তার চুল নিয়ে কোনো সমস্যা?
মাঠেই সেই মেয়েটি সবকিছু পরিষ্কার করে দিলো। সাচিকো যে স্যারের প্রতিটি প্রশ্নেরই ঠিক ঠিক জবাব দিতে পেরেছিল- এ বিষয়টিই ভালো লাগেনি মেয়েটির। সেই সাথে তার দলের অন্যান্য মেয়েরা যখন সাচিকোর সাথে পরিচিত হতে চাইলো, তখন তার মেজাজটা আরো বেশিই খারাপ হয়ে যায়।
খেলার মাঠে সবার সামনেই সাচিকোকে উত্যক্ত করতে থাকে সে। হুমকি দিয়ে বলে, “ভালো হয়ে যাও। আমার দুজন বড় ভাই আছে।“
দুই ভাই? এই হুমকি শুনে ভয় পাওয়ার বদলে সাচিকোর মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। আকি, ইচিরো বেঁচে থাকলে আজ নিশ্চয়ই সাচিকোকে এমন পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করতে আসতো তারা। মনটা দুঃখে ভরে গেলো তার। স্কুল থেকে বাসায় ফিরে অঝোরে কাঁদতে থাকলো সে।
“সাচিকো,” মেয়েকে বুকে টেনে নিলেন মা। “আমার দিকে তাকাও মা। বোমা হামলার পর থেকে তুমি এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারোনি।” এটুকু বলেই মা কাগজ আর পেন্সিল এনে মেয়ের হাতে ধরিয়ে দিলেন। “তোমার মনে যা আসে তা-ই লেখো সাচিকো। এই দুর্ঘটনার পর থেকে তোমার মনের কথাগুলো তুমি কাউকেই খুলে বলোনি। বসো, চিন্তা করে গুছিয়ে লেখো।“
সাচিকো লিখতে চাচ্ছিলো না। মায়ের এমন প্রস্তাবে সে কোনো আগ্রহই খুঁজে পাচ্ছিলো না। মা আবারও তাকে লিখতে বললেন।
সাচিকোর স্মৃতিগুলো সব জট পাকিয়ে ছিলো। লিখতেই হবে? তাহলে কোথা থেকে শুরু করবে সে? ঘর থেকে বের হয়ে সামনেই একটি পাথরের উপর বসলো সে। বাইরে আলো পরিমাণ স্বাভাবিকভাবেই বেশি। সেই সাথে ছিলো বেশি জায়গা, বেশি নীরবতা। কিন্তু কোথা থেকে শুরু করবে সে?
ডিমের কাহিনী দিয়ে? ডিমের কাহিনী দিয়েই শুরু করতে পারতো সে। ছোট্ট তোশির জন্য প্রতিদিনই একটি করে ডিম নির্ধারিত ছিলো। কিন্তু সেদিন মুরগি কোনো ডিম পাড়েনি।
আরো অনেক কিছুই মনে করতে চাইলো সাচিকো। সেদিনের সেই বিমান হামলার সাইরেন, সবকিছু নিরাপদ মনে করা, তার বন্ধুবান্ধব যারা তার সাথে হাড়ি-পাতিল খেলতে চেয়েছিল, সেই হাস্যোজ্বল মুহুর্তগুলো, আকাশ থেকে ভেসে আসা বিমানের ইঞ্জিনের গর্জন, ‘টেকি’ বলে বন্ধুবান্ধবদের চেচিয়ে ওঠা, বিষ্ফোরণের চোখধাধানো আলো- বোমা হামলার কাছাকাছি সময়ের সকল স্মৃতিই সাচিকোর মনের জানালায় উঁকি দিয়ে গেল।
সেই বিভীষিকা, সেই উত্তাপ, সেই গন্ধ, সেই ভয়, ছোট্ট তোশি, আকি, ইচিরো- সবার কথা, সবকিছুর কথাই তার মাথায় এলো।
সাচিকো লিখতে আরম্ভ করলো। হাত ব্যথা হবার আগপর্যন্ত, অন্তরের দুঃখ কিছুটা হলেও কমার আগপর্যন্ত, মনের আকাশে জমাট বাঁধা মেঘগুলো সরে যাবার আগপর্যন্ত সে লিখেই গেলো।
পরদিন মায়ের কথামতো স্কুলে গিয়েই সেই লেখাটি সাচিকো তার স্যারের হাতে ধরিয়ে দিলো। স্যার মনোযোগ দিয়ে পুরো কাহিনীই পড়লেন। তার দম যেন বন্ধ হয়ে আসলো। “তোমার জীবনে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেছে সাচিকো?”
দু’পক্ষের নীরবতায় সময় যেন আরও ধীরে ধীরে কাটতে লাগলো।
“তোমার বন্ধুদের জানার জন্য কেন এটা স্কুলের খবরের কাগজে ছাপতে দিচ্ছো না?”
যেদিন স্কুলের খবরের কাগজে সাচিকোর কাহিনী ছাপা হয়েছিলো, সেদিন প্রতিটি শিক্ষার্থীই তার কাহিনী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছিল। এই দিনটির কথা সাচিকো খুব ভালোভাবেই মনে রাখবে। কারণ, এরপর থেকে আর কেউই তাকে কোনোদিন উত্যক্ত করেনি।
… … … …
আগস্ট মাসটা যত এগিয়ে আসছিলো, পারমাণবিক বোমা হামলার কথা স্মরণ করে নাগাসাকির আকাশ-বাতাস ততই ভারী হয়ে উঠছিলো। বোমা হামলার তৃতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে স্মরণসভা, মৃতদের প্রতি সম্মান জানানো এবং জীবিতদের মাঝে আশার বাণী ছড়িয়ে দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছিল সরকারের লোকেরা। স্কুলের জন্য সাচিকো নাহয় আকি, ইচিরো আর তোশির কাহিনী লিখেছিল। কিন্তু নিজের মৃত ভাইদের প্রতি সম্মান দেখাতে এর চেয়ে বেশি আর কী-ই বা তার করার ছিল?
আগস্টের ৯ তারিখ সকালে মা এক ব্যাগ বরফের টুকরো নিয়ে আসলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাদের পরিবারের কেউই সেই স্মরণসভায় যোগ দেবে না। এর বদলে বাবা, সাচিকো আর মিসা দাদীমার গামলাটা ঘিরে দাঁড়ালো। মা তখন তাতে বরফগুলো রাখছিলেন। প্রচণ্ড জ্বরে কাতরাতে থাকা অবস্থায় জিহ্বায় এক টুকরো বরফ রাখতে পারাই ছিলো ইচিরোর শেষ কাজ। সিদ্ধান্ত হলো, ১৯৪৫ সালের ৯ আগস্টকে তাদের পরিবার এভাবেই স্মরণ করবে।
ওদিকে শহরে বোমা বিস্ফোরণের ঠিক কেন্দ্রস্থলে জড়ো হয়েছিল অগণিত মানুষ। ঠিক সকাল ১১টা ২ মিনিটে পুরো নাগাসাকি শহরই নীরবতার চাদরে ঢেকে গেলো। মৃতদের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনে করতে উপস্থিত সকলেই মাথা নত করলো। বাড়িতে বাবা, মা, সাচিকো আর মিসা দাদীমার গামলার সামনে মাথা নত করেছিল।
বিস্ফোরণস্থলে জড়ো হওয়া সকলেই ফিসফিস করে মৃতদের নাম উচ্চারণ করছিলো আর ক্ষমা করে দিতে চেষ্টা করছিলো। কিন্তু কাদের ক্ষমা করতে চাচ্ছিলো তারা? নিজেদেরকে? নাকি একে অপরকে? বেঁচে যাওয়া সেই মানুষগুলোকে কি তারা ক্ষমা করতে চাচ্ছিলো, যারা মৃত্যুপথযাত্রী কাউকেই শেষপর্যন্ত ধরে রাখতে পারেনি? বোমা হামলার পরও যারা বেঁচে গিয়েছিল, প্রিয়জন হারানোর শোকের পাশাপাশি তাদের বুকে নিজেদের বেঁচে থাকার অপরাধবোধও চেপে বসেছিল!
সমবেত জনতা সমস্বরে বলছিলো, “কখনো না, আর কখনও না।”
বাসায় মা তখন কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বাবা বলছিলেন, “যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। কেমন হতো যদি আরেকটা বিপর্যয় নেমে আসতো? যদি আবারও যুদ্ধ লাগতো? তুমি কি বিষয়টা চিন্তা করতে পারো? না, যুদ্ধটা শেষ হয়ে গেছে। এটাই ভালো খবর। এটাই আসল কথা।”
সাচিকোও বাবার কথাগুলো মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতে চাইলো।
এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্বসমূহ
১) পর্ব – ১ || ২) পর্ব – ২ || ৩) পর্ব – ৩ || ৪) পর্ব – ৪ || ৫) পর্ব – ৫ || ৬) পর্ব – ৬ || ৭) পর্ব ৭ || ৮) পর্ব ৮ || ৯) পর্ব ৯ || পর্ব ১০ || পর্ব ১১