বসরার খেজুর কুঞ্জের মধ্যে দুর্গের মতো বিশাল প্রাসাদের এক প্রশস্ত কামরায় পায়চারি করছেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। মাঝে মাঝে দেখছেন দেওয়ালে লটকানো মানচিত্রটি। তার চেহারায় অসাধারণ মনোবল ও দৃঢ়তা প্রতিভাত হচ্ছিল। চোখে বুদ্ধির দৃপ্তি এবং দৃষ্টি ভীতিসঞ্চারক। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ছিলেন এমন এক শাসক, যার লৌহ কঠোর হস্ত থেকে শত্রু-মিত্র সকলেই মুক্তি পার্থনা করত।
হাজ্জাজ বিন ইউসুফ গভীরভাবে নিমগ্ন ছিলেন বোখারা আক্রমণ করার পরিকল্পনা নিয়ে। এজন্য তুর্কমেনিস্তানের শাসক কুতায়বার কাছ থেকে একজন যোগ্য ও বিচক্ষণ সেনাপতি চেয়ে পাঠান তিনি। সেনাপতি ইতিমধ্যে চলেও এসেছেন। কিন্তু সেই সেনাপতি হিসেবে যে তারই আপন ভাতিজা, মাত্র ১৭ বছর বয়সী মুহাম্মদ বিন কাসিমকে পাঠানো হবে, সেটা তার ধারণাতেও ছিল না। যদিও বয়স কম, কিন্তু মুহাম্মদ বিন কাসিম শৌর্যবীর্য ও বীরত্বে কোনো অংশেই কম ছিলেন না। তুর্কমেনিস্তান শাসকের অগ্রগামী বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন তিনি।
এমতাবস্থায় হাজ্জাজ বিন ইউসুফের প্রশস্ত কামরায় রুমালে লেখা একটি চিঠি হাতে একজন দূত প্রবেশ করল। দূতের পোশাক ধূলিমলিন এবং সুন্দর চেহারা ক্লান্ত ও বিষণ্ণ। জীর্ণ পোশাক আর শীর্ণ চেহারাই বলে দিচ্ছে যে বিগত কয়েক দিন তার উপর দিয়ে কী পরিমাণ ঝড় বয়ে গেছে। তিনি এসেছেন সিন্ধু থেকে। এক বিশেষ বার্তা নিয়ে। দূত সিন্ধু রাজা দাহিরের অত্যাচারের কথা বর্ণনা করলেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে। বর্ণনা করলেন সেখানে মুসলিম নারীদের অসহায়ত্বের কথাও।
ঘটনাটি ছিল এমন, ব্যবসায়িক কাজে শ্রীলংকা দ্বীপে অনেক পূর্ব থেকেই অনেক আরব বসবাস করত। ইসলামের আবির্ভাবের পর এসব আরবের অধিকাংশই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। সেখানে নির্মিত হয় বেশ কিছু মসজিদ ও ধর্মীয় শিক্ষালয়। শ্রীলংকার রাজার সাথেও মুসলমানদের সম্পর্ক ছিল ভাল।
এরপর ৭০৭ খ্রিস্টাব্দে শ্রীলঙ্কা থেকে একটি জাহাজে করে ঐ অঞ্চলে বসবাসরত মুসলমান পুরুষগণ হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব অভিমুখে যাত্রা করে। এর মধ্যে আবুল হাসান নামক এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীও ছিলেন, যিনি লঙ্কা দ্বীপে বসবাসরত মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন। কিন্তু এক বছর পার হয়ে গেলেও ঐ জাহাজ এবং জাহাজের যাত্রীদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। এমনকি সৌদি আরব কিংবা তৎকালীন মুসলিম রাজ্যগুলোতে খোঁজ নিয়েও তাদের কোনো হদিস পাওয়া গেল না। তখন ধারণা করা হলো, হয় জাহাজটি সিন্ধু উপকূলে এলে জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল, আর না হলে সেটি সাগরে ডুবে গেছে।
এভাবেই কেটে গেল কয়েক বছর। তখন উমাইয়া খলিফা ছিলেন আল ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক। মুসলমানদের এই দুর্দশার কথা খলিফার কানে যাওয়ার পর যুবায়ের নামক এক প্রতিনিধিকে পাঠানো হলো শ্রীলংকায়। যুবায়ের শ্রীলংকায় গিয়ে সকলের সাথে কথা বলে মতামত জানতে চাইলেন। অধিকাংশ এতিম ও বিধবা নারী আরবে ফেরত আসতে চাইল। কারণ শ্রীলংকাতে তাদের অভিভাবক বলতে কেউ ছিল না। সেই মতেই সবকিছু প্রস্তুত হয়ে গেল। আরব দেশে ফেরত আসার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হলো। শ্রীলংকার রাজা খলিফার জন্য অঢেল ধন-সম্পদ এবং উপঢৌকনসহ একটি জাহাজ পূর্ণ করে দিলেন। অপর একটি জাহাজে ওঠানো হলো মুসলিম নারী ও শিশুদের।
৭১১ সালের জুন মাসে ভারত মহাসাগরের তীর ঘেঁষে এগিয়ে চলেছে দুটি জাহাজ। একটিতে অঢেল ধন-সম্পদ ও উপঢৌকন, অপরটিতে বৃদ্ধ, অসহায় নারী ও শিশুরা। কোনো কোনো সূত্রমতে, জাহাজের সংখ্যা ছিল সাতটি। সিন্ধু বন্দরের কাছাকাছি আসলে জাহাজগুলো জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। সিন্ধুর উপজাতি মেড এবং রাজা দাহিরের সৈন্যরা মিলিত হয়ে এই কাজটি করেছিল বলে ধারণা করা হয়। ধন-সম্পদ সব লুটপাট করে নিয়ে যায় তারা। নারী-পুরুষ সকল যাত্রীদেরকেই বন্দী করা হয়। বাধা দিতে গেলে অনেককে হত্যাও করা হয়।
হাতেগোনা কয়েকজন পালিয়ে আশ্রয় নেন গহীন বনের মধ্যে অবস্থিত এক পুরনো দুর্গে। তাদের মধ্যে ছিলেন আবুল হাসানের কন্যাসহ কয়েকজন নারী-পুরুষ এবং মুসলিম শাসকের পাঠানো প্রতিনিধি যুবায়ের। এভাবে কয়েকদিন পার হয়ে গেলেও অসহায় নারীদের জন্য মুসলমানদের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য আসল না। মূলত তাদের এই অসহায়ত্বের কথা মুসলিম শাসকের কান পর্যন্ত পৌঁছানোর কোনো অবলম্বনও ছিল না। তখন অসহায় ও নিরুপায় নারীরা তাদের রুমালের উপরে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখে যুবায়েরকে দেন। যুবায়ের অনেক বাধা টপকে ঝড়ঝঞ্ঝা মোকাবেলা করে গোপনে চিঠি নিয়ে বসরা পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হন এবং তুলে দেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফের হাতে। কিছু কিছু ঐতিহাসিক চিঠি লেখার এই ঘটনাকে অস্বীকার করেন। তারপরও ঐতিহাসিক প্রেক্ষিপটে এর কিছু সত্যতা পাওয়া যায়।
হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ছিলেন দৃঢ়চেতা, কঠোর এবং নির্দয়। রাজা দাহিরের সাথে তার শত্রুতা পুরনো। ইতোপূর্বেও তার এক বিশাল বাহিনী রাজা দাহিরের সামনে পদানত হয়ে ফিরে এসেছে। তার পূর্বেও অনেক শাসক ভারত আক্রমণ করে ব্যর্থ হয়েছে।
ভারতবর্ষের উপর মুসলমানদের নজর পড়েছিল হযরত ওমর (রা) এর সময় থেকেই। কারণ এই উপমহাদেশের ধন-সম্পদ আর ঐশ্বর্য সম্পর্কে আরবদের জানতে বাকি ছিল না। ইসলামের আবির্ভাবের অনেক পূর্ব থেকেই আরব বণিকরা এদেশে ব্যবসার উদ্দেশ্যে নিয়মিত যাতায়াত করত। ইসলামের আবির্ভাবের পর অনেক সাহাবী ব্যবসায়ীও উপমহাদেশে অসংখ্য জাহাজ ভিড়িয়েছেন। এ সমস্ত কারণে মুসলমানদের কিংবা বাহিরাগতদের এ অঞ্চল বার বার প্রলুব্ধ করেছে বিজয়ের জন্য।
হযরত ওমর (রা) এর শাসনামলে ৬৩৭ সালে সমুদ্রপথে একদল সৈন্য ভারতবর্ষ অভিমুখে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া এবং দূরতম অভিযানের জন্য এই মিশন বাতিল হয়ে যায়। এরপরেও একাধিকবার সিন্ধু জয়ের জন্য মুসলিমরা ব্যর্থ অভিযান চালিয়েছে। সর্বশেষ সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে আফগানিস্তানের অধিকাংশ অঞ্চল উমাইয়া খিলাফতের অধিকারে চলে আসে। দখলে আসে বেলুচিস্তান ও মাকরান অঞ্চলও। এরপর আর ভারতের দিকে মুসলমানরা নজর দেয়ার তেমন একটা সময় পায়নি।
চিঠিটা আগাগোড়া কয়েকবার পড়লেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। মাত্র কয়েক বছর আগে চোখের সামনে সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়েরকে নিহত হতে দেখেও যে চোখে বিন্দুমাত্র দয়ার উদ্রেক হয়নি, আজ সিন্ধু দেশে এক মুসলিম বালিকার অসহায়ত্বের কথা শুনে সেই চোখ অশ্রু সজল হয়ে উঠল। তার ভেতরে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠলেও এই মুহূর্তে তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল ভিন্ন চিন্তা। তিনি চিন্তিত ছিলেন বোখারা আক্রমণ নিয়ে। এমন একটা পরিস্থিতিতে সিন্ধুর মতো বিশাল বাহিনীর সামনে দাঁড়ানোর জন্য যথেষ্ট সৈন্য-সামন্ত এবং অর্থ তার হাতে নেই।
কিন্তু তিনি দমে গেলেন না। আপন ভাতিজা মুহাম্মদ বিন কাসিম এবং যুবায়েরকে পাঠিয়ে দিলেন দামেস্কে খলিফা ওয়ালিদ ইবনে মালেকের দরবারে। সাথে তিনি একখানা চিঠিও লিখে দিলেন খলিফা বারাবর। ক্ষিপ্রগতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে মুহাম্মদ এবং যুবায়ের চলে গেলেন দামেস্কে খলিফা ওয়ালিদের দরবারে। খলিফা চিঠি পড়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। কারণ আরব কন্যার চিঠিটি ছিল খুবই আবেগপূর্ণ এবং নিজের সতীত্ব ও সম্ভ্রম রক্ষার আর্তনাদ।
চিঠি পড়ার পর ওয়ালিদ ইবনে মালেক অনুমতি দিতে দেরি করলেন না। তবে অধিকাংশ মুসলিম সৈন্য তখন ইরাক, তুর্কমেনিস্তান ও আফ্রিকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধরত ছিল। তাই মুসলিম জাহানের নতুন করে অভিযান পরিচালনার জন্য কোনো সৈন্য উদ্বৃত্ত ছিল না। এজন্য সৈন্য সংগ্রহের দায়িত্ব খলিফা মুহাম্মদ ইবনে কাসিমের হতে ছেড়ে দেন। দায়িত্ব পাওয়ার পর মুহাম্মদ আর দেরি করলেন না। যুদ্ধের নাকারা বাজিয়ে দিলেন। দামেস্ক থেকে কিছু সৈন্য তার দলে নাম লেখাল। এরপর তিনি তীব্র বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন বসরা অভিমুখে। দামেস্ক থেকে সংগ্রহ করা ৫ হাজার সৈন্যও তার সাথে চলল।
বসরায় পৌঁছেই তিনি সৈন্য সংগ্রহে নেমে পড়লেন। রাস্তার মোড়ে মোড়ে জনসাধারণকে জড়ো করে আরব কন্যা সেই আর্তনাদমাখা ঠিকানা পড়ে শোনাতে লাগলেন। জ্বালাময়ী ভাষণে যুদ্ধের জন্য আহ্বান জানালেন। বসরার অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু ও বৃদ্ধরাও ঘর থেকে বের হয়ে আসলো এই জ্বালাময়ী ভাষণ শুনে। সৈন্যদের মিছিল শুরু হয়ে গেল বসরার অলিগলিতে। এদের অনেকেই প্রশিক্ষিত এবং পেশাদার সৈনিক ছিল না। এমনকি অনেকেই ছিল যারা ইতিপূর্বে কখনও যুদ্ধই করেনি। দূরদেশে আক্রমণকারী সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে এক ১৭ বছর বয়সী তরুণের উপর ন্যস্ত হওয়ার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে এটাই বোধহয় প্রথম।
আরব কন্যার আর্তনাদে জ্বলে উঠলো পুরো বসরা নগরী। যার যতটুকু সামর্থ্য ছিল তা-ই দিয়ে সাহায্য করতে লাগল। নারীরা তাদের গলার হার, কানের দুল খুলে দিয়ে দিল। মুহাম্মদ বিন কাসিমের স্ত্রী জোবাইদা তো সমস্ত স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি করে তার হাতে তুলে দিলেন। এভাবেই যুদ্ধের সমস্ত ব্যয় ভার বহন করা হয়েছিল।
উল্লেখ্য, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ মাকরানের শাসনকর্তা মুহাম্মদ ইবনে হারুনের মাধ্যমে ওবায়দুল্লাহর নেতৃত্বে ২০ জন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল রাজা দাহিরের নিকট পাঠিয়েছিলেন যেন মুসলিম বিধবা নারী ও এতিম শিশুদের ফেরত দেয়া হয় এবং অপরাধী জলদস্যুদের বিচার করা হয়। কিন্তু এমতাবস্থায় মাকরানের শাসনকর্তা মুহাম্মদ ইবনে হারুনের কাছ থেকে একটি বার্তা এসে পৌঁছালো। জানা গেল- ওবায়দুল্লাহর নেতৃত্বে যে ২০ জন লোকের যে প্রতিনিধিদল দেবলে পাঠানো হয়েছিল, তাদের মধ্যে মাত্র দুজন জীবন নিয়ে ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছে। বাকি সবার প্রাণনাশ করা হয়েছে। প্রতিশোধস্পৃহার আগুনে এ খবর যেন আরও তেল ঢেলে দিল।
সর্বসাকুল্যে মুহাম্মদ বিন কাসিম ১২ হাজার সৈন্যের একটি কাফেলা নিয়ে সিন্ধু অভিমুখে যাত্রা করলেন। এর মধ্যে ৬ হাজার ছিল অশ্বারোহী, ৩ হাজার পদাতিক এবং বাকি ৩ হাজার রসদবাহী উটের সাথে ছিল। এদিকে এই খবর রাজা দাহির আগেই পেয়ে যান। তার প্রায় ৭০ হাজার সুপ্রশিক্ষিত সৈন্য তখন দেবল দুর্গ পাহারারত।
৭১১ সালের নভেম্বরে মুহাম্মদ বিন কাসিম শিরাজ হয়ে মাকরানে পৌঁছালেন। মাকরানের সীমান্ত অতিক্রম করার সময় লাসবানের পার্বত্যাঞ্চলে তাকে অনেক বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। কারণ পাহাড়ের খাজে খাজে সিন্ধু রাজার তীরন্দাজ সৈন্যরা অবস্থান করছিল। এসব বাধা অতিক্রম করে তিনি যাত্রা অব্যাহত রাখেন।
প্রথমেই তিনি দেবল দুর্গ অবরোধ করলেন। কয়েক মাস অবরোধ করে রাখার পর দেবল দুর্গ মুসলমানদের অধিকারে চলে আসে। রাজা দাহির তার সৈন্য-সামন্ত নিয়ে পালিয়ে আশ্রয় নেন রাওয়ার দুর্গে। এরপর বিন কাসিম মাত্র ৪ হাজার সৈন্য দেবলে রেখে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। উল্লেখ্য, রাজা দাহিরের উপরে স্থানীয় বৌদ্ধ, জেঠ, মেঠদের ব্যাপক ক্ষোভ ছিল। মুহাম্মদ বিন কাসিমের এই অভিযানে তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। জেঠ, মেঠ ও বৌদ্ধ সৈন্যরাও যোগ দেয় মুহাম্মদের দলে। আবার অনেক হিন্দু সৈন্যও রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মুহাম্মদের সৈন্যদের সাথে যোগদান করে। কাজেই মুহাম্মদ বিন কাসিম মাত্র ১২ হাজার সৈন্য নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও ক্রমান্বয়ে সেই সৈন্যসংখ্যা বাড়তে থাকে। স্থানীয় সৈন্যদের সাহায্যে প্রায় বিনাযুদ্ধে বহু এলাকা জয় করতে থাকেন তিনি।
মুহাম্মদ বিন কাসিম তার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে ঘোড়ার ক্ষুরের দাপটে ধুলা উড়িয়ে অগ্রসর হতে লাগলেন উত্তর থেকে পশ্চিম দিকে। রাওয়ারে পৌঁছানোর পূর্বেই দাহির তার ৫০ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিমের অগ্রযাত্রা রোধ করতে আসেন। বিন কাসিম যুদ্ধ শুরুর পূর্বেই সিন্ধু নদী অতিক্রম করেন। এসময় তার বাহিনীতে ঠিক কত সৈন্য ছিল ইতিহাসে এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে রাজা দাহিরের চেয়ে তার বাহিনীতে সৈন্যসংখ্যা ছিল অনেক কম এতে কোনো সন্দেহ নেই। সিন্ধু অতিক্রম করে মুহাম্মদ বিন কাসিম তার বাহিনী নিয়ে রাওয়ার দুর্গ থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে তাঁবু খাটান।
সেখানে উভয়পক্ষের মধ্যে কয়েকদিনব্যাপী তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। অবশেষে রাজা দাহির পরাজিত ও নিহত হন। ৭১২ সালের ১২ জুন মুহাম্মদ বিন কাসিম চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেন। দাহিরের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী রানী বাঈ এবং তার পুত্র অবস্থান নেন রাওয়ার দুর্গের ভেতরে। কিন্তু সেখানও তিনি নিজেকে নিরাপদ মনে করতে পারলেন না। অবশেষে দুর্গের পতন হলে তিনি তার পুত্র ও সেবিকাদের নিয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। রাওয়ার দুর্গ জয়ের মাধ্যমে সমগ্র সিন্ধু মুহাম্মদ বিন কাসিমের আয়ত্তে চলে আসে। কয়েক মাসব্যাপী চলা এই অভিযানে দেবল ও রাওয়ার দুর্গ জয়ের মাঝখানে মুহাম্মদ আরও কয়েকটি শহর জয় করেন, যেমন- ব্রাহ্মণ্যবাদ, বধু, নিরুন, মুলতান ইত্যাদি।
মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে সিন্ধু বিজয় ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। সিন্ধু বিজয়ের পরই অসংখ্য মুসলিম শাসক ভারত অভিযানের সুযোগ পেয়েছেন। সিন্ধু বিজয় ভারতীয় উপমহাদেশ আক্রমণের জন্য মুসলমানদের পথ খুলে দেয়। এজন্য সিন্ধুকে বলা হতো উপমহাদেশের ‘বাবুল ইসলাম’ বা ইসলামের প্রবেশপথ। যদিও মুহাম্মদ বিন কাসিমের বিজিত অঞ্চল মাত্র ৫০ বছর মুসলমানদের অধিকারে ছিল, তারপরেও এ বিজয়ের প্রভাব ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী।