ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) ভেতরের লম্বা করিডর ধরে হেঁটে গিয়ে বামদিকের খোলা মাঠের দিকে তাকালেই চোখে পড়বে হালকা হলুদরঙা ছোট্ট এক স্থাপনার। স্থাপত্যরীতির দিক থেকে একেবারেই বেমানান জরাজীর্ণ এই স্থাপনাকে দেখে অনেক ছাত্রই-শিক্ষকই হয়তো একে স্রেফ এড়িয়ে গেছেন, কেউ হয়তো কৌতূহলী হয়ে উঁকিঝুঁকিও মেরেছেন, আবার গেটের ওপরে খোদাই করা ‘আঁকাবাঁকা ইংরেজি’ বর্ণগুলো দেখে কেউ কেউ হয়তো স্থাপনাটি সম্পর্কে আরো ভালোভাবে জানার চেষ্টা করেছেন। তবে এড়িয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা হয়তো ভাবতেও পারেননি এই স্থাপনাটির সাথে জড়িয়ে আছে হোমার-সক্রেটিসের দেশের ইতিহাস!
কালিকট বন্দরে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো ডা গামা পা রাখার পর ইউরোপ থেকে একে একে হাজির হয়েছে ওলন্দাজ, ফরাসি আর ইংরেজরা। দিনেমার আর সুইডিশরাও ব্যবসার কাজে খানিক ঢুঁ মেরে গিয়েছিল। তবে ইংরেজদের প্রবল ‘দৌরাত্ম্যে’ কেউই তেমন সুবিধা করে উঠতে পারেনি, ফরাসিরা ঘাঁটি গেড়েছে ভিয়েতনামে, ইন্দোনেশিয়ার মশলার লাভজনক ব্যবসা ছেড়ে ইংরেজদের সাথে ঘোঁট পাকাতে চায়নি ওলন্দাজরাও। পর্তুগিজরাও তাদের ছোট্ট ‘গোয়া’ আর মালাক্কার অংশবিশেষ নিয়ে এশিয়ায় সাম্রাজ্য পাট চুকিয়েছিল, অন্যদিকে স্পেনীয়দের একমাত্র অবলম্বন ছিল ফিলিপিন্স। জার্মানরাও পাপুয়া নিউ গিনিতে ঘাঁটি গেড়েছিল, তবে তাও বাকিদের তুলনায় বহু যুগ পরে। ইউরোপের এই সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর কাছে অনেকটাই চাপা পড়ে গিয়েছে ব্যবসার জন্য নিজের দেশ ছেঁড়ে আসা আর্মেনীয়-গ্রিকরা।
আরমানিটোলার আর্মেনীয় গির্জা বা পোগোজ স্কুলের কারণে আর্মেনীয়দের নাম কিছুটা উচ্চারিত হলেও কালের আবর্তে মাউন্ট অলিম্পাসে থাকা জিউসের সন্তানদের কথা ভুলে গেছে হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাই। টিএসসি কোণে অযত্নে পড়ে থাকা ঐ স্থাপনাটিই পূর্ববাংলার বুকে টিকে থাকা গ্রিকদের একমাত্র চিহ্ন।
হেলেনীয়দের আগমন
ভারতবর্ষে ইউরোপীয়দের আগমন ঘটেছিল গ্রিকদের হাত ধরে, খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে। আলেকজান্ডারের বাহিনীর নামের আগে ‘মেসিডন’ থাকলেও মোটাদাগে বেশিরভাগ সৈন্যই ছিল এজিয়ান সাগরের সৈকতে বেড়ে ওঠা গ্রিকরা। আলেকজান্ডার ইন্দু নদী পর্যন্ত থেমে গেলেও তার উত্তরসূরীরা ছাড়িয়ে গেল তাকেও। ‘দ্য গ্রেট ইস্টার্ন সী’ দেখার সৌভাগ্য ‘দ্য গ্রেট’-এর না হলেও সেই সাগরে থমকে যাওয়া হুগলি নদীর পাড়েই আস্তানা গাড়লো গ্রিকরা। আসার সময় কেউ কেউ বেছে নিয়েছিল দুর্গম পারস্য-আফগানিস্তানের উত্তপ্ত পথ, আবার কেউ কেউ এসেছিল তাদের ইউরোপীয় সঙ্গীদের সাথে ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে কলকাতায় আস্তানা গেড়েছিল গ্রিকরা, মুরগিহাট্টার ভার্জিন মেরি অফ দ্য রোজারিতে দুটো গ্রিক সমাধির নামফলকে এর প্রমাণ মেলে। ১৭১৩ এবং ১৭২৮ সালে তৈরি এই সমাধিফলক মুঘল যুগে তৈরি হলেও ইউরোপীয়দের মধ্যে তারাই শেষ জাতি যারা ভারতবর্ষে খুঁটি পুঁতেছে।
গ্রিকদের আগমনের পরবর্তী ধারা শুরু হয়েছে বাংলায় ইংরেজদের শাসন শুরু হওয়ার পর। তুর্কো-রাশিয়ান যুদ্ধের সময় থ্রাসিয়ার (বর্তমান বুলগেরিয়া) অভিজাত দুই শহর আদ্রিয়ানোপোলিস ও ফিলিপোপোলিস ধ্বংস হয়ে গেলে বাংলায় ছুটে আসেন সেখানকার গ্রিকরা। এছাড়াও ভাগ্য ফেরাতে ভারতে আসা ইংরেজ জাহাজেও ভিড়ে যান আয়োনিয়ান সাগর আর এজিয়ান সাগরের দ্বীপগুলোতে থাকা গ্রিকদের কেউ কেউ, যাদের আশ্রয় হয় এই বাংলা। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের শুমারি অনুযায়ী বাংলায় প্রায় ১২০টি গ্রিক পরিবার থাকতো, যাদের বেশিরভাগই ছিল জব চার্নকের তৈরি কলকাতায়।
ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের দলিল অনুযায়ী এই গ্রিক ব্যবসায়ী সমাজের নেতা ছিলেন আলেকজান্দ্রোস আরজিরিস (Alexandros Argyres), তার হাত ধরেই বাংলায় গ্রিকরা স্বীকৃতি লাভ করে। তার নামের সাথে জড়িয়ে আছে কলকাতার প্রথম গ্রিক অর্থোডক্স গির্জার ইতিহাসও।
১৭৭০ সালে ‘আলেকজান্ডার’ জাহাজে ইংরেজ ক্যাপ্টেন থর্নহিলের দোভাষী হিসেবে কাজ নিয়েছিলেন আরজিরিস। যাত্রাপথেই সমুদ্র উত্তাল হয়ে পড়ে এবং প্রায় ডুবে যেতে থাকে, তখন আরজেরিস প্রার্থনা করেন কলকাতায় বেঁচে পৌঁছাতে পারলে সেখানে একটি গির্জা নির্মাণ করবেন। অবশেষে নিজের প্রার্থনার বদৌলতেই হয়তো নিজের প্রাণ নিয়েই বেঁচে ফেরেন তিনি। কলকাতায় পৌঁছিয়েই তিনি তৎকালীন বাংলার গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের কাছে যান অর্থোডক্স গির্জা নির্মাণের অনুমতির জন্য। ওয়ারেন হেস্টিংস অনুমতি দিলেও গির্জা নির্মাণ দেখে যেতে পারেননি তিনি। ১৭৭৭ সালের ঢাকায় মারা যান আরজিরিস, তার ৩ বছরের মাথায় তার সম্পত্তি থেকে দান করা ৩০ হাজার রুপি দিয়েই কলকাতার শহরতলী ‘ধী কলকাতা’য় (পরবর্তীতে আমরাতোল্লাহ নামকরণ করা হয়) নির্মাণ করা হয় গির্জাটি। গির্জার অভ্যন্তরে মার্বেল পাথরে এর প্রতিষ্ঠাতা ও পৃষ্ঠপোষকদের নাম লেখা রয়েছে, যাদের মধ্যে রয়েছে ওয়ারেন হেস্টিংস, আরজিরিসসহ আরো বেশ কয়েকজন গ্রিক ও ইংরেজ ব্যবসায়ীদের নাম।
১৭৮৬ সালে অ্যাথেনীয় দিমিত্রিওস গ্যালানোসকে কলকাতায় পাঠানো হয় গ্রিক বাচ্চাদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করার জন্য। তবে স্কুল প্রতিষ্ঠার ৬ বছরের মাথায় গ্যালানোস সংস্কৃত শিক্ষার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান বেনারসে এবং ১৮৩৩ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় ৪০ বছর সংস্কৃতের পেছনেই জীবন ব্যয় করেছেন তিনি। ব্রিটিশ ক্রিশ্চিয়ান সিমেটারিতে সমাহিত করার পর তার পাণ্ডুলিপিগুলো অ্যাথেন্সের জাতীয় লাইব্রেরিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে সেখান থেকেই এগুলোর দশটি পাণ্ডুলিপি ৭ খণ্ডে প্রকাশিত হয়।
গ্রিক অভিবাসীরা নতুন দেশে মানিয়ে নেওয়ার ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে থাকলেও গ্রিসে তাদের পরিবার-পরিজনের কথা ভুলে যায়নি, যারা গ্রিসে অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। বিদ্রোহের পেছনে থাকা গুপ্তসংগঠন ‘সোসাইটি অফ দ্য ফ্রেন্ডস’ (Φιλική Εταιρεία) বিদেশে থাকা গ্রিকদের সাহায্য চাইলে কলকাতায় থাকা গ্রিকরা হাত বাড়িয়ে দিতে কার্পণ্য করেনি। ১৮০২ সালের ইস্টার সানডে উপলক্ষে কলকাতার গির্জায় জড়ো হওয়া গ্রিকরা এক ঐতিহাসিক শপথ গ্রহণ করেন:
“এই কলকাতায় থাকা সকল গ্রিক ব্যবসায়ী যারা এসেছেন পন্টোস থেকে, এবং বিথিনিয়া, কাপ্পাডোসিয়া ও এইওলিয়া থেকে, যারা এসেছেন আইওনিয়া এবং গ্রিসের মূল ভূখন্ড থেকে, এবং যারা এসেছেন বারবারিয়া (উত্তর আফ্রিকা), মিশর ও কন্সট্যান্টিনোপলসহ বিশ্বের অন্যান্য জায়গা থেকে, পুনরুত্থানের এই পবিত্র দ্বিতীয় দিনে আমরা একসাথে জড়ো হয়েছি এবং পবিত্র শপথ গ্রহণ করছি। আমরা গ্রিকদের পুনরুত্থানের জন্য কলকাতা থেকে আমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ এবং সোনারূপাসহ অন্যান্য সম্পত্তি দান করলাম। এসব সম্পদের ওপর অন্য কেউ হাত দেবে না। গ্রিক রাজ্যের জন্য এটি দান করা হলো যাতে তারা ঈশ্বরের ইচ্ছায় আবারো স্বাধীন হতে পারে।”
১৯২০ সালে কলকাতায় থাকা গ্রিকরা সিদ্ধান্ত নেয় পুরনো গির্জা ও এর আশেপাশে থাকা গোরস্থানের জন্য ব্যবহৃত জমি বিক্রি করে অন্যত্র সরে যাবে। গোরস্থানটিকে নারকেলডাঙা ও ফুলবাগানের সাথে লাগোয়া ক্রসরোডের কাছে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং নতুন গির্জার জন্য কালীঘাটে জমি কেনা হয়। কালীঘাটে নিও-ক্ল্যাসিকাল ডোরিক ঘরানার অসাধারণ একটি অর্থোডক্স গির্জা তৈরি করে তারা, সাথে পাদ্রীর জন্য একটি দোতলা বাড়িও তৈরি করা হয়। গির্জার অর্থসংস্থানের একটি বড় অংশ আসে তুলা ও সিল্ক ব্যবসায়ী র্যালি ভ্রাতৃদ্বয়ের কাছ থেকে, যারা ছিলেন র্যালি’স কোম্পানির মালিক। কলকাতায় ৩ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান দেওয়া কোম্পানিটি এখনো টিকে রয়েছে, যদিও বর্তমান মালিক ভারতীয়।
বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যার তীরে
কলকাতার বাইরে সবচেয়ে বড় গ্রিক সমাজ গড়ে ওঠে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে। ১৭৭৭ সালে আরজিরিস মারা যাওয়ার পর ঢাকা ও বাকেরগঞ্জে থাকা সম্পত্তি ভাগ হয়ে যায় তার ছেলেদের মাঝে। আর্মেনীয়দের মতো গ্রিকরাও মূলত পাট, লবণ আর অন্য ছোটখাট ব্যবসা চালাতো।
১৮২১ সালে ঢাকায় চক বাজারের উত্তরদিকে থাকা মুকিম কাটরা রোডের পাশে একটি অর্থোডক্স গির্জা নির্মাণ করে গ্রিকরা, গির্জার নামকরণ করা হয় সেইন্ট থমাসের নামানুসারে। যিশু খ্রিস্টের ১২ জন শিষ্যের একজন এই সেইন্ট থমাস ভারতে এসেছিলেন বলে মনে করা হয় এবং গ্রিকদের তুলনায় ভারতীয় খ্রিস্টানরাই সেইন্ট থমাসকে বেশি মান্য করেন। গির্জাটি ১৮২১ সালে তৈরি হলেও টিএসসির সমাধিফলকগুলোর সবগুলোই এর আগে তৈরি, ফলে ধারণা করা যায় যে, এর আগেও ছোট কোনো গির্জা ছিল অথবা এই অঞ্চলে আর্মেনীয় বা দক্ষিণ ভারতীয় গির্জা ছিল। ঢাকার এই গির্জায় পাদ্রী হিসেবে যারা আসতেন তারাও এসেছিলেন মিশরের সিনাই পর্বতের প্রাচীন মঠ থেকে।
ড. টেইলরের ‘টপোগ্রাফি অফ ঢাকা’ বই থেকে জানা যায়, গ্রিকরা ঢাকায় এসেছিলো অন্যদের চেয়ে সবার শেষে, তাছাড়া তাদের সংখ্যাও ছিল তুলনামূলক কম। তার বই অনুযায়ী ১৯৩৮ সালে ঢাকায় ৪০টি আর্মেনীয় ও ১২টি গ্রিক পরিবার বাস করতো, যেখানে ১৮৩২ সালে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট হেনরি ওয়াল্টারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গ্রিকদের ২১টি বাড়ি ছিল।[১] ১৮৪০ এর দশক থেকেই কাঁচামালের চাহিদা কমে যাওয়ায় গ্রিক ব্যবসায়ীদের সংখ্যা পড়তির দিকে চলে যায়। ১৮৫০ সালের মধ্যে গ্রিকদের সংখ্যা একেবারেই কমে যায়।
১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে গির্জাটি ধ্বসে পড়ে এবং পরিত্যক্ত অবস্থাতেই থেকে যায়। এ থেকে বোঝা যায় তৎকালীন ঢাকায় গ্রিকরা একেবারেই ছিল না অথবা থাকলেও অল্প কয়েকজন ছিল, যাদের অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি অনেকটাই কমে গিয়েছিল। কলকাতার গ্রিকরা ঢাকার গির্জা পরিত্যক্ত হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখেন যে স্থানীয় লোকেরা ভেঙে পড়া গির্জার মার্বেল চুরি করে নিয়ে গেছে।
১৯১৩ সালে গ্রিকদের পরিত্যক্ত জমিতে ব্রিটিশ সরকার একটি মেডিকেল কলেজ খোলার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেখানে মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজের (বর্তমান স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ) নির্মাণকাজ শুরু করা হয়। পাদ্রী ফাদার ভেলাডিওসের মতে মেডিকেল কলেজটির স্থপতি ছিলেন ডক্সিয়াডেস নামক একজন গ্রিক, যিনি কর্তৃপক্ষের কাছে ভেঙে পড়া গির্জাটির স্তম্ভগুলো দিয়ে একটি গ্রিক স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করার অনুরোধ করেন। ধারণা করা হয় স্মৃতিস্তম্ভটি রমনার পুরনো সমাধিক্ষেত্রে স্থানান্তর করা হয়।
১৯১৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতার দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় স্মৃতিস্তম্ভটির একটি ছবি প্রকাশ করা হয়, ছবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, রমনা রোডের ডানপাশে থাকা গ্রিক সমাধিক্ষত্র পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে এবং স্থানীয় লোকজন পাথরের সমাধিফলকগুলো চুরি করে নিজেদের বাড়ি বানানোর কাজে ব্যবহার করছে। প্রতিবেদনটি দেখে তৎকালীন ব্রিটিশ পাদ্রী ফাদার মিডলটন ম্যাকডোনাল্ড পূর্ব বাংলার চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে অনুরোধ করেন পরিত্যক্ত সমাধিক্ষেত্রটির ব্যপারে কোনো ব্যবস্থা নিতে। অবশেষে গভর্নর লর্ড কারমাইকেল সমাধিফলকগুলো রক্ষা করার জন্য আরেকটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করার নির্দেশ দেন। স্মৃতিস্তম্ভটির ভেতরে ১০টি সমাধিফলক স্থাপন করা হয়। র্যালি ভ্রাতৃদ্বয়ের অনুরোধে ভারতবর্ষের অর্থোডক্স গির্জার প্রধান আথানাসিওস অ্যালেক্সিও কলকাতা থেকে স্মৃতিস্তম্ভটি উদ্বোধন করতে আসেন। ১৯২১ সালে স্মৃতিস্তম্ভের জায়গাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়, তবে স্থাপনাটিকে আর সরিয়ে নেওয়া হয়নি।
অনেক সমাধিফলক থাকলেও মাত্র ১০টি সমাধিফলক কেন স্মৃতিস্তম্ভটির ভেতরে স্থাপন করা হলো তা নিয়ে কিছু বিতর্ক রয়েছে। র্যালি ভাইদের ম্যানেজার এবং ভারতে গ্রিসের রাষ্ট্রদূত থিওডোরোস পৌলিসের মতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ যখন শুরু করা হয়, তখন পুরো জায়গাটি আবার ঢেলে সাজানো হয়। গ্রিকদের গোরস্থানটির উপর মাটি ঢেলে ঘাসের লন বানানো হয়। অর্থাৎ, টিএসসির সবুজ মাঠটি আদতে গ্রিকদের সমাধিস্থল ছিল!
১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় স্মৃতিস্তম্ভটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে এর আগেও হতে পারে। দীর্ঘদিন অবহেলার মধ্যে পড়ে থাকা স্থাপনাটিকে অবশেষে ১৯৯৭ সালে নয়াদিল্লীর দূতাবাসের মাধ্যমে গ্রিক সরকার সংস্কার করার উদ্যোগ নেয় এবং সেই থেকে প্রায়-হলুদরঙা স্মৃতিস্তম্ভটি ওখানেই রয়েছে।
শেষের শুরু
১৯৬০ সালে কলকাতার শেষ গ্রিক বংশধররা ইংল্যান্ড ও গ্রিসে পাড়ি জমালে কলকাতার গির্জাটি বন্ধ হয়ে যায়। ৯ বছর পর অস্ট্রেলিয়া থেকে অর্থোডক্স পাদ্রী ফাদার ক্যালিস্ট্র্যাটস আদামৌ গির্জাটি পুনরায় চালু করার জন্য দুই বছর চুক্তিতে কলকাতায় আসেন। তিনি যখন আসেন তখন পুরো ভারতবর্ষে মোট ৩২ জন গ্রিক থাকতেন, যাদের ব্যাপারে তিনি তার ‘দ্য হিস্ট্রি অফ দ্য গ্রিক চার্চ ইন ক্যালকাটা’য় লিখে গিয়েছেন। ৩২ জনের মধ্যে ৪ জন কলকাতায়, ৮ জন বোম্বেতে, ২ জন দিল্লীতে, ৮ জন নেপালে এবং ১০ জন পাকিস্তানে ছিলেন। এছাড়াও প্রতি মাসে প্রায় ৫০টি করে গ্রিক জাহাজ কলকাতার বন্দরে ভিড়তো, যেগুলোর নাবিকগণ তার সাথে সময় কাটিয়ে যেতেন।
বাংলায় শেষ গ্রিক পাদ্রী হিসেবে যিনি এসেছিলেন তিনি হলেন ফাদার ভেলাডিওস। নয়াদিল্লীর গ্রিক দূতাবাসের সহায়তায় তিনি বাংলা ও ভারতবর্ষের অন্যান্য জায়গার গ্রিকদের রেখে যাওয়া প্রায় ৫০ হাজার ডকুমেন্ট সংগ্রহ করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রাচীন এই ডকুমেন্টগুলোর অধিকাংশই ছিল প্যাপিরাস পার্চমেন্টে লেখা। ফাদার ভেলাডিওস ও গ্রিক রাষ্ট্রদূত ড. ভ্যাসিলিস ডকুমেন্টসগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরে এগুলোকে অ্যাথেন্সে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন, যাতে ভারতের গ্রিকদের সম্পর্কে আরো গবেষণা করা যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেকটা অবহেলা এবং বাজে ব্যবস্থাপনার কারণেই ডকুমেন্টসগুলো পথিমধ্যে হারিয়ে যায়, যা আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। যদিও ফাদার ভেলাডিওস বেঁচে যাওয়া কিছু ডকুমেন্টস থেকে অ্যাথেনীয় জার্নালে বেশ কিছু ঘটনার কথা লিখে পাঠিয়েছিলেন, যেগুলোর মধ্যে ছিল বাংলায় রুশ রাজপুত্রের আগমন, ঢাকার গ্রিক স্থাপনাসহ আরো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস। কলকাতায় নিজের ৬ বছর কাটিয়ে বাংলার গ্রিকদের ব্যাপারে যা যা জেনেছেন তা লিপিবদ্ধ করেছেন ‘এলাডিওস’ ও ‘দ্য গ্রিকস অফ পন্টোস ইন ইন্ডিয়া’ বইদুটোয়।
বিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাংলায় গ্রিকদের উপস্থিতি একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। ষাটের দশকেই নারায়ণগঞ্জের পাটের কারখানা বিক্রি করে চলে যায় র্যালি ভাইয়েরা। টিএসসির স্মৃতিস্তম্ভ, কলকাতার নিও-ক্ল্যাসিকাল ঘরানার অর্থোডক্স গির্জা এবং একশরও বেশি সমাধিফলকে ঢাকা অর্থোডক্স গোরস্থানই বাংলার বুকে টিকে থাকা গ্রিক স্থাপনা। গোরস্থানটিতেও গ্রিকদের পাশাপাশি রুশ এবং বুলগেরিয়ানদের সমাধিও আছে। অন্যান্য দেশ থেকে আসা কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া নাবিকদেরও শেষ আশ্রয়স্থল হয়েছে এই গ্রিক কবরস্থান। ঢাকার কবরস্থান থেকে কিছু লাশও এনে এখানে দাফন করা হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে, বাংলায় গ্রিক ব্যবসায়ীদের গোড়াপত্তনকারী আলেক্সান্দ্রোস আরজিরিসের পঞ্চম প্রজন্ম পল বায়রন নরিস তার পূর্বসূরীদের ইতিহাস খুঁজে বের করতে গবেষণা চালিয়েছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি লিখেছেন ‘Ulysses in the Raj’ বইটি। ভারতবর্ষে গ্রিক ব্যবসায়ীদের গোড়া থেকে শুরু করে বাংলার গ্রিক অর্থোডক্স গির্জার ইতিহাস কিংবা সপ্তদশ শতাব্দী থেকে বাংলায় গ্রিকদের পদচারণা কেমন ছিল, তার বিস্তারিত বিবরণ খুবই চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন তিনি। একইসাথে উঠে এসেছে বাংলার প্রভাবশালী র্যালি, কর্ফিওটস এবং প্যানিওটিস গ্রিক পরিবারদের ইতিহাস। পূর্বপুরুষ আরজিরিস, ব্রাহ্মণ গ্যালানোস, গ্রিক মার্সেনারি আলেক্সান্ডার ঘিকা এবং ‘দেশপ্রেমিক জলদস্যু’ নিকোলাস কেফালাসের জীবনী নিয়েও বইয়ে আলাদা অধ্যায় রেখেছেন তিনি। ১৭৫০ থেকে ১৮৫৩ সাল পর্যন্ত বাংলার বিখ্যাত গ্রিক ব্যবসায়ীদেরও বিষদ বিবরণ আছে এ বইয়ে।
বাংলার গ্রিকদেরকে নিয়ে আরেকটি প্রকাশিত বই হলো ‘আ ক্রোনিকেল অব দ্য গ্রিকস ইন ইন্ডিয়া ১৭৫০-১৯৫০’। বাংলার গ্রিকদের বংশধর ডায়োন মার্কোস ডন্ডিস অবশ্য তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন অ্যাথেন্স ও কানাডায়। ভারত থেকে পরবর্তীতে অন্যান্য দেশে চলে যাওয়া গ্রিক ও তাদের সন্তানদের ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারের পাশাপাশি অনেক দুর্লভ ছবিও স্থান পেয়েছে এই বইটিতে।
বিশ্ববাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হওয়ায় বাংলা একসময় ছিল ইউরোপীয় বণিকদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। বণিকরা ভারতে পা রাখার আগেও ভারতবর্ষ ও মালাক্কার প্রয়োজনীয় রসদের যোগান দেওয়া হতো বাংলা থেকে। বাংলার সেই জৌলুস হারিয়ে গেছে অনেক আগেই, তবে ঔপনিবেশিক এই স্থাপনাগুলো এখনো জানান দেয় বাংলার গৌরবোজ্জ্বল অতীতের কথা। বাণিজ্যবিমুখতার কারণে বাংলার সেই গৌরব অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে। এই হারিয়ে যাওয়া গৌরবকেই হয়তো ব্যঙ্গ করা হয়েছে টিএসসির স্মৃতিস্তম্ভের ওপরের লেখাটির মাধ্যমে:
ΜΑΚΑΡΙΟΙ ΟΥΣ ΕΞΕΛΕΞΩ ΚΑΙ ΠΡΟΣΕΛΑΒΟΥ
Blessed are those whom You chose and took with You.