ব্যাটল অভ দ্য আয়রনক্ল্যাডস: ইতিহাসের বিখ্যাত এক নৌযুদ্ধ

আমেরিকার গৃহযুদ্ধের প্রধান নৌযুদ্ধ হিসেবে বিখ্যাত ব্যাটল অভ দ্য হ্যাম্পটন রোড, যা ব্যাটল অভ দ্য আয়রনক্ল্যাডস নামে সুপরিচিত। পৃথিবীর ইতিহাসে এ যুদ্ধ আলাদাভাবে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ- এ যুদ্ধেই প্রথমবারের মতো লৌহপাতে মোড়ানো দুটি যুদ্ধজাহাজ বা আয়রনক্ল্যাড, পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল। এর আগে নৌবাহিনীর জাহাজ ছিল কাঠের, যা গৃহযুদ্ধের সময় উত্তর ও দক্ষিণ দু পক্ষই ব্যবহার করেছিল। তবে ব্যাটল অভ দ্য আয়রনক্ল্যাডসের পথ ধরে এ চিত্র সম্পূর্ণভাবে পাল্টে যায়।

আমেরিকা ছাড়াও অন্যান্য দেশের নৌবাহিনী অনুধাবন করে যে, কাঠের জাহাজ আয়রনক্ল্যাড যুদ্ধজাহাজের কাছে কতটা অসহায়। একারণে সব নৌবাহিনী ধীরে ধীরে তাদের বহর থেকে কাঠের জাহাজ অপসারণ করে আয়রনক্ল্যাড যুক্ত করতে শুরু করে। তাই ব্যাটল অভ দ্য আয়রনক্ল্যাডস স্বল্পস্থায়ী হলেও এর প্রভাবে পৃথিবী জুড়ে নৌযুদ্ধের ধরনে পরিবর্তন আসতে থাকে।

আয়রনক্ল্যাড যুদ্ধজাহাজ; Image Source: www.history.navy.mil

লৌহপাতে আবৃত জাহাজ প্রধানত ঊনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ইউরোপ ও আমেরিকাতে তৈরি শুরু হলেও জাহাজগুলোর ধারণা এসেছিলে এর আগেই। যদিও তখন পর্যন্ত নৌবাহিনীর ব্যবহৃত জাহাজ সবই ছিল কাঠের, তবু আয়রনক্ল্যাড নিয়ে অন্যান্য নৌবাহিনী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিল। ১৮৫৩-৫৬ সাল পর্যন্ত চলা ক্রিমিয়ান যুদ্ধে ব্রিটিশ ও ফরাসি সেনাবাহিনী কামানবাহী কাঠের পাটাতন ব্যবহার করে, যা তারা পানিতে ভাসিয়ে জাহাজের সাহায্যে রাশিয়ান বাহিনীর কাছাকাছি নিয়ে গোলাবর্ষণ করেছিল।

সে সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে ফরাসিরা প্রথম যুদ্ধজাহাজে লোহার আবরণ ব্যবহার করা শুরু করে এবং ১৮৫৯ সালে প্রথম ‘গ্লইর’ নামে এরকম একটি জাহাজ এবং পরবর্তী সময়ে কুইরন নামে আরেকটি জাহাজ তাদের বহরে অন্তর্ভুক্ত করে। ব্রিটিশরাও তখন বসে ছিল না। ‘ব্ল্যাক প্রিন্স’ ও ‘ওয়ারিওর’ নামে দু’টি আয়রনক্ল্যাড ১৮৬১ ও ১৮৬২ সালে ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীর বহরে যুক্ত হয়। এর মধ্যেই আমেরিকার গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং ইতিহাসে প্রথমবার আয়রনক্ল্যাড জাহাজের সরাসরি সংঘর্ষ হয়।

গ্লইর”  (Gloire)
আয়রনক্ল্যাড; Image Source: www.britannica.com

পটভূমি

গৃহযুদ্ধটি আমেরিকার ইতিহাসে ১৮৬১-১৮৬৫ সাল পর্যন্ত স্থায়ী রক্তক্ষয়ী সংঘাত, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ অংশের রাজ্যগুলো (কনফেডারেট) বিভিন্ন কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে চাইছিল। এর সূত্র ধরে উত্তরের রাজ্যগুলোর (ইউনিয়ন) সাথে, যারা যুক্তরাষ্ট্রের অখণ্ডতা বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল, দক্ষিণের মনোমালিন্য শেষপর্যন্ত সশস্ত্র লড়াইয়ে রূপ নেয়।

ব্যাটল অভ দ্য হ্যাম্পটন রোড সংঘটিত হয়েছিল হ্যাম্পটন রোড প্রণালীতে। দক্ষিণপূর্ব ভার্জিনিয়াতে অবস্থিত এই প্রণালী ১২ মাইল (১৯ কিলোমিটার) দীর্ঘ ও ৪৫ ফুট (১৩ মিটার) গভীর। মূলত জেমস নদী থেকে উৎপত্তি হলেও এর সাথে ন্যান্সমন্ড ও এলিজাবেথ নদীর অংশ মিশে ছিল। হ্যাম্পটন রোড একদিকে চেসাপেক উপসাগর ও অন্যদিকে উত্তর ক্যারোলিনার সমুদ্র উপকুলের সাথে যুক্ত ছিল। এর কাছাকাছি নরফোক, সাফোক, ইয়র্কটাউনের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহর ও বন্দর থাকায় গৃহযুদ্ধের শুরুতে ইউনিয়ন সেনারা ভার্জিনিয়া ও নরফোক অবরোধ করে।

কনফেডারেট সমরবিদেরা হ্যাম্পটন রোড ব্যবহার করে ইউনিয়ন বাহিনীকে আক্রমণ করে অবরোধ তুলে নিতে বাধ্য করার পরিকল্পনা করেন। এই উদ্দেশ্যে হ্যাম্পটন রোডে অবস্থান করে ইউনিয়ন নৌবাহিনীকে পর্যুদস্ত করার জন্য তারা তখন পর্যন্ত কনফেডারেটদের হাতে থাকা একমাত্র আয়রনক্ল্যাড- সিএসএস ভার্জিনিয়া’র নেতৃত্বে একটি নৌবহর পাঠান। এই বহরে সিএসএস ভার্জিনিয়া’র সঙ্গী হয় ‘সিএসএস র‍্যালেই’ ও ‘সিএসএস বিউফোরট’ নামে কাঠের দু’টি ফ্রিগেট।

হ্যাম্পটন রোড
Source: www.britannica.com

সিএসএস ভার্জিনিয়া তৈরি করা হয়েছিল ভার্জিনিয়ার ‘গসপোর্ট’ নেভি শিপইয়ার্ডে, ইউনিয়ন নৌবাহিনীর কাছ থেকে দখল করা জাহাজ মেরিম্যাকের কাঠামোর ওপর। কনফেডারেট বাহিনীর আঘাতে ডুবে যাওয়া মেরিম্যাককে পানি থেকে তুলে একে মেরামত করার পর এর দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ২৬২ ফুটের কিছু বেশি। এরপর এর মূল কাঠামোকে ১৭০ ফুট লম্বা ওক ও পাইন কাঠের ২৪ ইঞ্চি পুরু আস্তরণ দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়, যার উপর বসানো হয় দু ইঞ্চি পুরু ও ছ’ ইঞ্চি চওড়া দুই স্তরের লোহার পাত। ছ’টি ৯ ইঞ্চি ‘ডাহ্লগ্রীন’ কামান ও ৬.৪ ইঞ্চি দুটি ‘ব্রক’ রাইফেল দিয়ে পুরো জাহাজকে সজ্জিত করা হয়। এর সম্মুখভাগে যুক্ত করা হয় ১৫০০ পাউন্ডের লোহার ‘র‍্যাম’, যার উদ্দেশ্য ছিল সজোরে ধাক্কা দিয়ে অন্য জাহাজকে ভেঙে বা গুঁড়িয়ে দেওয়া।

নৌবাহিনীর অন্যান্য জাহাজের মতো সিএসএস ভার্জিনিয়া’র চালিকাশক্তি ছিল বাষ্প ইঞ্জিন। তখনকার সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্ভেদ্য হলেও এর কিছু দুর্বলতা ছিল। মেরিম্যাক জাহাজের পুরনো ইঞ্জিন কোনো রদবদল ছাড়াই ব্যবহার করা হয়, যার আগে থেকেই কিছু সমস্যা ছিল। এছাড়া, এর গতিবেগ ছিল খুব কম, পাঁচ নটের কিছু বেশি। বিশাল আকার এবং ওজনের কারণে যুদ্ধক্ষেত্রে তড়িৎ দিক বা স্থান পরিবর্তনের ক্ষমতাও ছিল সীমিত। তারপরও অবরোধ ভাঙা এবং ইউনিয়নের জাহাজ ধ্বংস করার জন্য কনফেডারেটদের কাছে এর কোনো বিকল্প ছিল না। এসব দিক মাথায় রেখে জাহাজের নেতৃত্ব তুলে দেওয়া হয় অভিজ্ঞ এবং আগ্রাসী মনোভাবের ফ্ল্যাগ অফিসার ফ্রাঙ্কলিন বুচ্যানানের হাতে।

ইউনিয়ন বাহিনীর অবরোধ ভেদ করার মানসে ১৮৬২ সালের ৮ মার্চ তিনি তার সাথের অন্যান্য জাহাজ নিয়ে এলিজাবেথ নদী ধরে হ্যাম্পটন রোডে প্রবেশ করেন। সেখানে অপেক্ষা করছিল ইউনিয়ন নেভির পাঁচটি ফ্রিগেট- কাম্বারল্যান্ড, কংগ্রেস, সেন্ট লওরেন্স, মিনেসোটা এবং রোয়ানোক।

নৌ-যুদ্ধের প্রথম দিন: ৮ মার্চ

‘সিএসএস বিউফোরট’ কামান দাগার মাধ্যমে যুদ্ধের সূচনা করে। ইউনিয়ন জাহাজ থেকে এর জবাব দেয়া হয়। সিএসএস ভার্জিনিয়া কামানের গোলার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। ইউনিয়ন বাহিনীর কোনো আঘাতই এর লোহার আবরণ ভেদ করতে সমর্থ হচ্ছিল না, বরং সিএসএস ভার্জিনিয়ার গোলায় কাম্বারল্যান্ড ও কংগ্রেস খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সিএসএস ভার্জিনিয়া সোজা এগিয়ে গিয়ে তার অগ্রভাগের লোহার ‘র‍্যাম’ দিয়ে কাম্বারল্যান্ডকে আঘাত করলে ইউনিয়ন বাহিনীর ফ্রিগেট ডুবে যেতে থাকে। তবে এ পরিস্থিতিতেও কাম্বারল্যান্ডের ক্রুরা গোলাবর্ষণ চালিয়ে যেতে থাকে। এমনকি তাদের শত্রুরা পর্যন্ত তাদের এই সাহসিকতায় আশ্চর্য না হয়ে পারেনি।

কাম্বারল্যান্ড ডুবে গেলে ভার্জিনিয়া নজর দেয় কংগ্রেসের দিকে। এর মধ্যে কংগ্রেস অনেকখানি তীরের দিকে চলে গিয়েছিল। নতুনভাবে গোলাবর্ষণ শুরু হলে এটি আত্মসমর্পণের সাদা পতাকা উত্তোলন করে। আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া চলাকালে তীরে অবস্থানকারী ইউনিয়ন সেনারা গুলি ছুঁড়তে আরম্ভ করলে বুচ্যানানের উরুতে আঘাত লাগে। তার নির্দেশে উপর্যুপরি গোলাবর্ষণ করে কংগ্রেসকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। এরপর ভার্জিনিয়া  মিনেসোটার দিকে মনোযোগ দেয়।

কিন্তু, এরই মধ্যে মিনেসোটার ক্যাপ্টেন জ্যাকুইস ভ্যান বার্নট তার জাহাজকে তীরে উঠিয়ে দেন। তীরের কাছাকাছি অগভীর পানিতে যাওয়ার ঝুঁকি ভার্জিনিয়া নিতে চায়নি। তদুপরি, ইউনিয়ন বাহিনীর গোলা একদম ব্যর্থ হয়নি, ভার্জিনিয়ার কিছু অংশ বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এসব চিন্তা করে সেদিনের মতো যুদ্ধ স্থগিত করে ভার্জিনিয়া এবং তার সহকারী ফ্রিগেটগুলো ফিরে যায়, পরের দিন অসমাপ্ত কাজ শেষ করবে ভেবে।

ডুবন্ত কাম্বারল্যান্ড জাহাজ
Source: www.history.navy.mil

নৌবাহিনীর বিপর্যয়ের খবর রাজধানী ওয়াশিংটনে পৌঁছলে ইউনিয়ন নেতারা বিচলিত হয়ে পড়েন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ৮ মার্চের পরাজয়ই ছিল যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনীর সবথেকে বড় পরাজয়। ভার্জিনিয়ার তাণ্ডব ঠেকাতে ইউনিয়ন বাহিনীর নিজস্ব আয়রনক্ল্যাড ‘মনিটর’ নিউ ইয়র্ক থেকে যাত্রা শুরু করে রাতের বেলা হ্যাম্পটন রোডে পৌঁছায়। জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন জন লরিমার ওয়রডেন। তার ওপর নির্দেশ ছিল যেকোনোভাবে মিনেসোটাকে রক্ষা করা

সিএসএস ভার্জিনিয়া যেখানে পুরনো জাহাজের কাঠামোর উপর তৈরি করা হয়েছিল, সেখানে মনিটর ছিল নৌস্থাপত্যের এক অনবদ্য সৃষ্টি। সুইডিশ-আমেরিকান প্রকৌশলী জন এরিকসনের পেটেন্ট করে ডিজাইনের ভিত্তিতে তৈরী মনিটর ছিল ১৭৩ ফুট দীর্ঘ, ওজনে ৭৭৬ টন। এর ডেকের ওপর ছিল পাইলট হাউজ এবং দু’টি ১১ ইঞ্চি ‘ডাহ্লগ্রীন’ কামান সম্বলিত ঘূর্ণায়মান একটি গান টারেট। আকারে ছোট হলেও ভার্জিনিয়ার তুলনায় এর গতি ছিল অনেক বেশি এবং যুদ্ধক্ষেত্রে দ্রুত জায়গা পরিবর্তনের ক্ষমতা ছিল, যা একে ভার্জিনিয়ার থেকে এগিয়ে রেখেছিল।

নৌ-যুদ্ধের দ্বিতীয় দিন: ৯ মার্চ

সকাল ছ’টার দিকে সিএসএস ভার্জিনিয়া ও সহকারী জাহাজ প্যাট্রিক হেনরি, জেমসটাউন ও টিজার যাত্রা শুরু করে আটটার দিকে যুদ্ধ ক্ষেত্রে পৌঁছায়। বুচ্যানান আহত থাকায় তিনি জাহাজে ছিলেন না, তার পরিবর্তে জাহাজ পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত হয় লেফটেন্যান্ট কেইটসবি জোন্সের উপর। মনিটরের আগমন সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা ছিল না। তাই এটি দেখতে পেয়ে তারা হতভম্ব হয়ে যান।

মিনেসোটার ক্রুরা সারারাত চেষ্টার পরেও জাহাজ পানিতে ভাসাতে ব্যর্থ হয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে ওয়রডেন তাদের আশ্বস্ত করেন যে তাদের রক্ষার জন্য তার সামর্থ্যের সবটুকু দিয়েই চেষ্টা করবেন। নিজের জাহাজ নিয়ে তিনি মিনেসোটা ও ভার্জিনিয়ার মধ্যে অবস্থান নেন।

যুদ্ধ শুরু হয় এবং উভয় পক্ষই গোলা ছুঁড়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। কয়েক ঘণ্টা চলা যুদ্ধে খুব কাছাকাছি থেকে মনিটর ও ভার্জিনিয়া পরস্পরের দিকে গোলা ছুঁড়তে থাকে। কিন্তু কোনো পক্ষই অপর পক্ষের লোহার বর্ম ভেদ করতে পারেনি। ভার্জিনিয়ার তুলনায় মনিটরের গোলা ছোঁড়ার হার ছিল অনেক কম, প্রতি ছ’-সাত মিনিটে একটি। কিন্তু তার তুলনামূলক অধিক গতি ও দিক পরিবর্তনের ক্ষমতার কারণে ভার্জিনিয়া তাকে কোনোভাবেই ঘায়েল করতে পারছিল না। দু ঘণ্টা পর কামানের গোলা ফুরিয়ে গেলে মনিটর কিছুটা পেছনে সরে অগভীর পানিতে চলে যায়, যেখানে ভার্জিনিয়ার পক্ষে এটিকে অনুসরণ করা সম্ভব হয়নি।

এসময় ভার্জিনিয়া মিনেসোটার দিকে এগিয়ে যেতে চাইলে এর ইঞ্জিন হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়। এই সুযোগে মিনেসোটা প্রায় ঘণ্টাখানেক গোলাবর্ষণ করে। অনেকক্ষণ চেষ্টার পর ভার্জিনিয়ার ইঞ্জিন চালু করা সম্ভব হয়, কিন্তু এ সময়ের মধ্যে মনিটর পুনরায় গোলাবারুদ সংগ্রহ করে ফিরে এলে এর পক্ষে আর মিনেসোটার উপর আক্রমণ করা সম্ভব হয়নি। আবারো দু’টি আয়রনক্ল্যাডের মধ্যে যুদ্ধ আরম্ভ হয়। এক পর্যায়ে ওয়রডেন তার জাহাজ নিয়ে ভার্জিনিয়াকে সরাসরি আঘাতের জন্য অগ্রসর হন, কিন্তু অল্প ব্যবধানের জন্য তাতে ব্যর্থ হন। এই সময় খুব কাছে থেকে ভার্জিনিয়ার লেফটেন্যান্ট জন টেইলর উড ব্রুক রাইফেল ছুঁড়লে পাইলট হাউজে থাকা ওয়রডেন কিছুটা আঘাত পান।

এ পরিস্থিতিতে জাহাজের কোয়ারটারমাস্টার পিটার উইলিয়ামস নিরাপদ স্থানে মনিটরকে সরিয়ে নেন। তার এই কাজের জন্য পরে তিনি মেডেল অভ অনার পদক লাভ করেন। ওয়রডেন চিকিৎসার জন্য কেবিনে চলে যান এবং জাহাজের ভার তুলে দেন তার এক্সিকিউটিভ অফিসার স্যামুয়েল গ্রিনের উপর।

ব্যাটল অফ দ্যা আয়রনক্ল্যাডস
 যুদ্ধরত আয়রনক্ল্যাড; Source: www.history.navy.mil

এদিকে মনিটরকে সরে যেতে দেখে ভার্জিনিয়া ধরে নেয়, ইউনিয়নের আয়রনক্ল্যাড পালিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং তারা এ যুদ্ধে নিজেদের বিজয়ী মনে করে মিনেসোটাকে পুনরায় আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু জাহাজের চালকরা জোন্সকে ভাঁটা আসছে বলে সতর্ক করে দেয়। ভাঁটার সময় পানি কমে গেলে ভার্জিনিয়া অগভীর পানিতে আটকে যাওয়ার ঝুঁকি ছিল, তাই জোন্স দ্রুত জাহাজ সরিয়ে নেন। গ্রিন যখন জাহাজের ভার নিয়ে ফিরে আসেন, ততক্ষণে ভার্জিনিয়া সে স্থান ত্যাগ করেছে। ভার্জিনিয়াকে দেখতে না পেয়ে মনিটর নিজেদের বিজয়ী মনে করে ওয়াশিংটনে সে খবর পৌঁছে দেয়।

যুদ্ধের ফলাফল

ভুল বোঝাবুঝির জন্য দু পক্ষই আলাদা আলাদাভাবে নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করলেও আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এই নৌযুদ্ধকে অমীমাংসিত, বা ‘ড্র’ বলে বিচার করেন। একদিক থেকে চিন্তা করলে, এটি ছিল ইউনিয়ন বাহিনীর কৌশলগত বিজয়, কারণ ভার্জিনিয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল ইউনিয়ন বাহিনীকে অবরোধ তুলে নিতে বাধ্য করা, যা তারা করতে পারেনি। অন্যদিকে, এই যুদ্ধের ফলে হ্যাম্পটন রোড এবং তার আশেপাশের নৌপথে কনফেডারেট নৌবাহিনীর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং মেজর জেনারেল মাকক্ল্যানের পরিকল্পিত হামলাকে দেরি করিয়ে দেয়। এর ফলে পরবর্তী সময়ে তার আক্রমণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

আয়রনক্ল্যাডের পরিণতি

ভার্জিনিয়া ও মনিটরের মধ্যকার সংঘর্ষের কথা ছড়িয়ে পড়লে ব্রিটিশ নৌবাহিনী তাদের সমস্ত কাঠের যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ স্থগিত করে, সম্পূর্ণভাবে লৌহ আচ্ছাদিত জাহাজ সজ্জিত নৌবহর তৈরি করতে তদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে। অন্যান্য নৌবাহিনীও তাদের পথ অনুসরণ করে। ইউনিয়ন ও কনফেডারেট বাহিনীও পরে তাদের নৌবহরে আরও আয়রনক্ল্যাড যুক্ত করেছিল। তবে ভার্জিনিয়া ও মনিটরের শেষ পরিণতি খুব ভাল হয়নি।

দুটি জাহাজ আর একবারই পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল। এপ্রিল ১১, ১৮৬২ সালের সেই দেখায় কেউই সংঘর্ষে লিপ্ত হয়নি। দুটি জাহাজই চেষ্টা করেছিল একে অপরকে সুবিধাজনক অবস্থায় পাওয়ার। মনিটরের উদ্দেশ্য ছিল ভার্জিনিয়াকে খোলা পানিতে নিয়ে আসা, অন্যদিকে ভার্জিনিয়ার উদ্দেশ্য ছিল মনিটরকে হ্যাম্পটন রোডের ভেতরে টেনে নিয়ে আসা। কেউই কারো উদ্দেশ্যে সফল হয়নি।

ইউনিয়ন বাহিনীর হাতে নরফোকের পতন ঘটলে ১৮৬২ সালের ৯ মে, কনফেডারেট বাহিনী নিজেরাই ভার্জিনিয়াকে ডুবিয়ে দেয়, যাতে ইউনিয়ন সেনারা একে দখল করে নিতে না পারে। অন্যদিকে সে বছরই ৩১ ডিসেম্বরে, এক ভয়াবহ ঝড়ে ১৬ জন নাবিক সহ মনিটর নর্থ ক্যারোলিনার কেপ হ্যাটেরাসে ডুবে যায়। ১৮৭৩ সালে এর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার হয় এবং ২০০২ সালে তা পানি থেকে তুলে আনা হয়।

পরিণতি যা-ই হোক না কেন, একথা অনস্বীকার্য যে, এই দুই আয়রনক্ল্যাডের ফলেই পৃথিবীব্যাপী নৌবাহিনীতে ব্যাপক পরিবর্তন এবং আধুনিকীকরণ ঘটে।

ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/

This Bengali article is about a naval battle. The battle of Hampton Road is known as The Battle Of Ironclads. This was an important naval battle of the American Civil War.

Featured Image: marinersmuseum.org

 

Related Articles

Exit mobile version