সুদূর অতীতে প্লেগের আক্রমণে বিশ্ব তছনছ হয়ে যাওয়ার নজির আছে। চতুর্দশ শতাব্দীর ভয়ানক বিউবোনিক প্লেগে কোটি মানুষের ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছিল। এই বিউবোনিক প্লেগের বাহক ছিল ইঁদুরেরা। যা-ই হোক, প্লেগের আতংক আজকের বিশ্বে আর আগের মতো নেই। কিন্তু ইঁদুরের সাথে মানবজাতির যুদ্ধ দৃশ্যত অব্যাহত আছে। এই ইঁদুর ও মানুষের টানাপোড়েনের এক অদ্ভূত নাটক মঞ্চস্থ হয় ভারতের মিজোরাম রাজ্যে, প্রায় পঞ্চাশ বছর পর পর। ইঁদুরের কারণে সৃষ্ট ভয়ানক দুর্ভিক্ষ তথা সেই মাওতাম নিয়েই আজ আলাপ হবে।
সংক্ষেপে মিজোরাম আর তার অধিবাসীরা
ভারতের প্রত্যন্ততম প্রদেশগুলোর অন্যতম মিজোরাম। মিয়ানমার আর বাংলাদেশ প্রদেশটিকে ঘিরে আছে দু’পাশ থেকে। মিজোরাম মূলত পার্বত্য অঞ্চল। কয়েক শত বছর আগে পূর্ব এশিয়া থেকে অসংখ্য গোষ্ঠী এসে এখানে বসতি স্থাপন করে। কুকি-চিন-লুসাইসহ নানা গোত্র-উপগোত্রে বিভক্ত এই জাতিসমষ্টিকে একত্রে মিজো বলে সম্বোধন করা হয়। মিজো শব্দের অর্থ হচ্ছে পাহাড়ী মানুষ। মিজোরাম অর্থ পাহাড়ী মানুষের অঞ্চল ।
মিজোরামের সিংহভাগ মানুষ কৃষিজীবি। বনাঞ্চলে ছাওয়া প্রদেশটিতে তারা জুম চাষ করে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে মিজোরাম ছিল ভারতের সবথেকে অনুন্নত অঞ্চলগুলোর একটি। এখানকার অধিবাসীরা ব্রিটিশ মিশনারীদের প্রভাবে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করলেও অত্যন্ত স্বাধীনচেতা ও দুর্দান্ত স্বভাবের। বিশেষ করে লুসাই গোত্র যুদ্ধে বিশেষ দক্ষ ছিল। ব্রিটিশ ভারতে মিজোরামের অধিকাংশ জনগণ অসংখ্য স্বায়ত্বশাসিত সর্দারের অধীনে বাস করতো। এই প্রথাগত সর্দারতন্ত্রের বিরুদ্ধে আবার শহরের শিক্ষিত মিজোদের বিশেষ ক্ষোভ ছিল। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর আসামের সরকার আর মিজোরামের এই শিক্ষিত অংশটি বংশপরম্পরায় চলে আসা সর্দার প্রথা বিলোপ করে দেয়।
বাশেঁর গল্প
ব্রক্ষ্মপুত্রের দক্ষিণের পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে, অর্থাৎ ত্রিপুরা, পার্বত্য চট্টগ্রাম, আসাম বা মিজোরামে প্রাকৃতিকভাবে প্রচুর বাঁশ জন্মে। এদের মধ্যে অন্যতম প্রজাতিটি হচ্ছে মেলোক্কানা ব্যাক্সিফেরা বা চিটাগং ফরেস্ট ব্যাম্বু। মিজোরাম প্রদেশের প্রায় ত্রিশ শতাংশই বাঁশবনে আবৃত। এর ৯৫ শতাংশই হচ্ছে এই চিটাগাং ফরেস্ট ব্যাম্বু। সেখানে বাড়ি বানানো থেকে শুরু করে খাদ্য হিসেবেও বাঁশের ব্যবহার ব্যাপক। গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেই আসলে বাঁশ জনজীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
বাঁশ প্রতি দিন গড়ে দশ সেন্টিমিটার করে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বাঁশগাছ যতই দ্রুত বাড়ুক না কেন, তাতে ফুল আসে অনেক লম্বা সময় পর পর। প্রজাতিভেদে চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাট বা একশো বছরের বেশি সময় বিরতি দিয়ে বাঁশগাছে ফুল আসে। আর মজার কথা হলো, একটি প্রজাতির সব বাঁশগাছে ফুল আসে প্রায় একই সময়ে।
কাজেই ফুল ফোটার সময় সমস্ত বাঁশবনেই অসংখ্য ফুল ও বাঁশ ফল উৎপন্ন হয়। মিজোরাম অঞ্চলে যে প্রজাতির বাঁশ জন্মে, সেই চিটাগং ফরেস্ট ব্যাম্বুতে ফুল আসে ৪৮-৫০ বছর পর পর। বাঁশগাছে ফুল আসার অর্থ হচ্ছে বাঁশ মারা যাবে। কাজেই বলা যায়, প্রতি ৪৮-৫০ বছর পর পর মিজোরামের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বাঁশবনগুলো বিপুল ফুল ও ফলের যোগান দিয়ে দ্রুত মৃত্যুমুখে পতিত হয়। বাঁশের এই অদ্ভুত আচরণ নিয়ে নানা মতবাদ আছে। কারো ধারণা, ফল জন্ম দেওয়াটা বাঁশগাছের জন্য এত কষ্টসাধ্য ব্যাপার যে সে আর বেঁচে থাকে না। জঙ্গলের তীক্ষ্ণদন্তী প্রাণীদের কাছে এই বাঁশফল এবং ফুল খুবই উপাদেয় খাবার।
কালো ইঁদুরের মচ্ছব
ব্ল্যাক ডেথের জন্য দায়ী কালো ইঁদুরের উৎপত্তি হয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে, খুব সম্ভবত মালয়েশিয়ায়। এই কালো ইঁদুর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জঙ্গলগুলোতে প্রচুর পরিমাণে বাস করে। স্বাভাবিকভাবেই বনে ছাওয়া মিজোরামেও তারা যথেষ্ঠ পরিমাণে আছে। বাঁশফল এই প্রজাতির ইঁদুরের অত্যন্ত প্রিয় খাদ্য। বাঁশগাছে ফল ধরলে মিজোরামের বাঁশবনগুলো এসব ক্ষুদ্র প্রাণীতে ছেয়ে যায় আর ওদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে অস্বাভাবিকভাবে। প্রকৃতির এক অদ্ভুত নিয়ম কাজ করে এখানে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, ইঁদুরের প্রজনন ক্ষমতার সাথে বাঁশের ফুলের একটা সংযোগ আছে। বাঁশ ফুল খেলে ইঁদুরের বাচ্চা জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা অসম্ভব বৃদ্ধি পায়। সুতরাং পঞ্চাশ বছর পর পর হঠাৎ আলোচিত অঞ্চলে কালো ইঁদুরের মাত্রাতিরিক্ত সংখ্যাবৃদ্ধি দেখা দেয়। বনের স্বাভাবিক শিকারীরা আর তাদের সংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না।
মাওতাম
স্বাভাবিক নিয়মেই ইঁদুরের জন্মহার অত্যন্ত বেশি। বাঁশফলের মৌসুমে তাদের মধ্যে রীতিমতো জনবিস্ফোরণ ঘটে। জঙ্গলের জন্য এটা শুভ। কারণ বাঁশফল শেষ হয়ে গেলে এই বিরাট ইঁদুরের পালের আর খাওয়ার কিছু থাকে না। ফলে না খেতে পেয়ে অসংখ্য ইঁদুর মারা পড়ে এবং ইঁদুরের সংখ্যাও একটা সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আজকালকার ইঁদুরদেরকে খাদ্যের জন্য বেশি খোঁজাখুঁজি হয় না। মানব বসতি আছে সব জায়গায়। মিজোরামের বাঁশফল খেয়ে শেষ করে তখন এই ইঁদুরেরা হানা দেয় গ্রামেগঞ্জে, ক্ষেতে-খামারে, গোলা ঘরে আর শস্য গুদামে।
ইদুঁরের বন্যায় ছয়লাপ হয়ে যাওয়ার কারণেই টনের পর টন খাদ্যশস্য আর কৃষিজমি নষ্ট হয়ে যায়। গোটা অঞ্চলে নেমে আসে দুর্ভিক্ষ। মিজোরামের মাটি এমনিতেই চাষাবাদের উপযোগী নয়। অত্যন্ত দুর্গম হওয়ায় যাতায়াত ব্যবস্থাও নাজুক। ইঁদুরের আক্রমণে তাই গোটা প্রদেশ মারাত্মক খাদ্যসংকটের মুখে পড়ে। এই দুর্ভিক্ষকেই মিজোরা বলে মাওতাম। মিজো ভাষায় মাও অর্থ বাশঁ এবং তাম অর্থ মৃত্যু।
যেহেতু বাঁশগাছে ফুল একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর আসে, কাজেই ইঁদুরের বন্যাও একটা ধরাবাধা নিয়ম মেনে চলে। দীর্ঘদিন ধরে মিজো ভাষার কোনো লেখ্য রূপ না থাকায় বেশি অতীতের কথা জানা যায় না। তবে ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া হিসাবমতে, ১৮৬২ আর ১৯১১ সালে গোটা প্রদেশ দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়েছিল। ১৯৫৮-১৯৫৯ এবং ২০০৬-২০০৮ সালেও যথানিয়মে পাহাড় ছেয়ে যায় কালো ইঁদুরে, দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় গোটা প্রদেশে। ১৯৫৮-১৯৫৯ এর সময় আসাম সরকার প্রতিটি ইঁদুর মারার বিনিময়ে সত্তর পয়সা করে দিত। মৃত ইঁদুরের লেজখানা কেটে আনলেই ইনাম মিলতো। অন্তত বিশ লক্ষ ইঁদুর মারা হয়েছিল মিজোরামে, তবু তাতে দুর্ভিক্ষ ঠেকানো যায়নি। বেহাল সড়কব্যবস্থার কারণে ত্রাণ পাঠাতেও অনেক দেরি হয়। পঞ্চাশের দশকের এই মাওতামে প্রায় শতাধিক লোক খাদ্যাভাবে মারা পড়ে। ইঁদুরের কারণে ছড়িয়ে পড়ে রোগজীবাণু আর অসুখ।
মিজো বিদ্রোহ
মিজোরা তাদের ওপরে আসামের নিয়ন্ত্রণ খুব একটা ভাল চোখে দেখতো না। মিজো বর্ষীয়ানরা আসন্ন ইদুঁরের আক্রমণের ব্যাপারে আসাম সরকারকে পঞ্চাশের দশকে বারবার সাবধান করেছিল। তবে সরকার গোটা ব্যাপারটাকেই লোকগাঁথা হিসেবে উড়িয়ে দেয়। এরপর যখন ইঁদুরের কারণে দুর্ভিক্ষ হানা দিল, তখন মিজোরা গেল ক্ষেপে। পাহাড়ে রাস্তাঘাট বিশেষ না থাকায় সরকার ত্রাণও পাঠাতে পারছিল না সময়মতো। প্রায় শতাধিক মানুষ এ সময় খাদ্যাভাবে মারা পড়ে। ফলে ১৯৬১ সালে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট (এমএনএফ) গঠিত হয়।
এরা দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে সাহায্য করার পাশাপাশি পাকিস্তানের সাথে যোগাযোগ করে। পূর্ব পাকিস্তানে এদেরকে প্রশিক্ষণ আর অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া হয়, যদিও নীতি-আদর্শের দিক থেকে এমএনএফ বামপন্থী ঘরানার ছিল। মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের যুবারা দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে। তখন এমএনএফ নেতা পু লালডেঙ্গা স্বাধীনতার ছক কষতে শুরু করলেন। আটটি ব্যাটালিয়ন গঠন করা হয় মিজো বীরদের নামকরণে। প্রায় দুই হাজার যোদ্ধার পাশাপাশি দুই হাজার স্বেচ্ছাসেবক যোগ দেয় এমএনএফ-এ। অসমীয়া ভাষাকে মিজো অঞ্চলের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলে মিজো জনতা আরো ক্ষুব্ধ হয়।
১৯৬৬ সালের মার্চে এমএনএফ এর সদস্যরা আসাম রাইফেলস এর ঘাঁটিগুলো আক্রমণ করতে থাকে। আইজল বাদে বাদবাকি অঞ্চলে মিজো যোদ্ধারা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। কিন্তু আইজলের ঘাঁটিটি কিছুতেই দখল করা সম্ভব হচ্ছিলো না। এদিকে ভারত সরকার বসে ছিল না। পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান স্যাম মানেকশের আদেশে ভারতীয় বিমানবাহিনী আইজলে আক্রমণ চালায়। নিজের দেশের সীমানার ভেতরে এটাই ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রথম এবং এখন পর্যন্ত শেষ হামলা। এরপর সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়া মিজোদেরকে হটিয়ে আইজল পুনরুদ্ধার করে।
মিজো যোদ্ধারা বনে-জঙ্গলে পালিয়ে যায়, তবে বিদ্রোহ অব্যহত থাকে। খুব সম্ভবত তাদের সদর দফতর পরে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। যা-ই হোক, ১৯৭২ সালে মিজোরামকে ইউনিয়ন টেরিটরি এবং ১৯৮৬ সালে প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এমএনএফ রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। লালডেঙ্গা মিজোরামের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এমএনএফ পরেও মিজোরামে সরকার গঠন করেছে।
বর্তমান অবস্থা
২০০৬ সালে আবার মিজোরামের বাঁশগাছে ফুল দেখা দেয়। মিজোরা বুঝতে পারে, ঘনিয়ে আসছে মাওতাম। তবে মিজো সরকার এবারে কিছুটা প্রস্তুত ছিল, তাদের নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক গেরিলা জোরামথাঙ্গা। ব্যাপক সংখ্যায় ইঁদুর নিধনের পাশাপাশি মিজোরাম সরকার ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্যে প্রচুর ত্রাণ পাঠায় ২০০৬-০৮ সালের মাওতামের সময়। তবে তারপরেও অনেক অঞ্চলেই খাদ্যসংকট ঠেকানো যায়নি। প্রচুর বিষ প্রয়োগের পরেও যথাসময়ে অসংখ্য ইঁদুর নেমে আসে গ্রামের ওপরে। প্রতিবেশী মিয়ানমারের অনুন্নত চিন প্রদেশেও মাওতাম হানা দেয়। সেখানকার অন্তত ২০ শতাংশ মানুষ ভয়ানক খাদ্য সংকটের মুখে পড়ে। বাংলাদেশের পাহাড়গুলোতেও অল্পবিস্তর খাদ্যসংকট সৃষ্টি হয়। বিজ্ঞানীদের কাছে এই বাঁশ, ইঁদুর আর মাওতাম এখনো বিপুল রহস্যের আধার।
ফিচার ইমেজ – trekearth