১৯৪১ সাল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা তখন পুরোদমে বাজছে।
জাপান একের পর এক প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জগুলো দখল করে নিচ্ছে দেখে যুক্তরাষ্ট্র তাদের তেলের সরবরাহ বন্ধ করে দিল। যুক্তরাষ্ট্র তখন মিত্র ব্রিটেনকে সাহায্য করলেও যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়নি। জাপান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শান্তি আলোচনা চালিয়ে নিলেও হঠাৎ করে ৭ ডিসেম্বর প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের অন্যতম নৌ-ঘাঁটি পার্ল হারবারে আক্রমণ করে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে। একইসাথে মিডওয়ে, গুয়াম, ওয়েক আইল্যান্ড মালয়েশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, সাংহাইয়ে আক্রমণ করা হয়। ফলে পরদিনই যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৪১ এর ১৫ ডিসেম্বর একটি জাপানী বাণিজ্যিক জাহাজ ও ২৭ জানুয়ারি, ১৯৪২ সালে জাপানের একটি সাবমেরিন ডুবিয়ে দেয় আমেরিকা।
এরপর ১ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ (CV-6) ও ইয়র্কটাউন (CV-5) থেকে উড্ডয়ন করা যুদ্ধবিমান প্রথমবারের মতো গিলবার্ট এবং মার্শাল দ্বীপে জাপানি সেনাদের উপর হামলা করে তিনটি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। সেই বছরের মে মাসের আগপর্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে দুই দেশের নৌ ও বিমানবাহিনীর যুদ্ধ হয়েছিল। তবে বড় ধরনের নৌ-যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ব্যাটল অফ কোরাল সি এর মাধ্যমে। এরপর একে একে সংগঠিত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসের বাক বদলে দেয়া ব্যাটল অফ মিডওয়ে, আজ অবধি হওয়া সবচেয়ে বড় নৌ-যুদ্ধ ব্যাটল অফ লেইতে গালফ, দু’পক্ষের ২৪টি এয়ারক্রাফট নিয়ে হওয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্যারিয়ার বনাম ক্যারিয়ার যুদ্ধ ‘ব্যাটল অফ ফিলিপাইন সি’, দেড় লক্ষ মানুষের মৃত্যুর মাধ্যমে সংগঠিত হওয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ‘ব্যাটল অফ ওকিনওয়া’। সব মিলিয়ে ৫টি প্রধান নৌযুদ্ধসহ অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৌ-যুদ্ধে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়েছিল জাপান-যুক্তরাষ্ট্র।
আজকের লেখাটি ব্যাটল অফ কোরাল সি নিয়ে। বাকি যুদ্ধগুলো নিয়েও আর্টিকেল পেতে চোখ রাখুন রোর বাংলায়।
যুদ্ধের কারণ
আগেই বলা হয়েছে, জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকেই Greater East Asia Co-Prosperity Sphere (大東亜共栄圏, Dai-tō-a Kyōeiken) নীতির আলোকে শক্তিশালী নৌবাহিনীর জোরে একটু একটু করে পুরো প্যাসিফিক অঞ্চল দখল করে নিচ্ছিল। চীনে আক্রমণের পাশাপাশি ফিলিপাইন, ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া (বর্তমান ইন্দোনেশিয়া), ওয়েক আইল্যান্ড, গিলবার্ট আইল্যান্ড, গুয়াম আইল্যান্ড, নিউ ব্রিটেন (পাপুয়া নিউগিনির অন্তর্গত) দখল করে নেয়াসহ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া (ভারতবর্ষ) করায়ত্বের পরিকল্পনা করেছিল!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই জাপানের নেভাল জেনারেল স্টাফ ব্রিটিশরা যেন তাদের মিত্রের সহায়তা না পায় সেই ব্যবস্থার অংশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় অভিযান চালানোর মত দিয়েছিলেন। কিন্তু এত দূরে গিয়ে একবারে সৈন্য পরিবহন করে যুদ্ধ করা সম্ভব না বিধায় তার বিরোধিতা করেন আর্মি জেনারেলগণ। একই সময়ে জাপানের প্যাসিফিক অঞ্চলের ফোর্থ ফ্লিটের কমান্ডার ভাইস এডমিরাল শিগিওসি ইনোয়ি বিকল্প প্রস্তাব দেন। তিনি সলোমন দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত তুলাগি এবং নিউ গুয়েনার পোর্ট মোর্শবি দখল করার কৌশলগত সুবিধা নিয়ে আলোচনা করেন। অস্ট্রেলিয়া দখল না করে দেশটির সাথে মিত্রবাহিনীর সাপ্লাই লাইন (সামুদ্রিক জাহাজ চলাচল রুট) কেটে দিতে পারলে জাপানের জন্য ‘সাপ মরবে কিন্তু লাঠি ভাঙবে না’।
তাই শেষ পর্যন্ত তুলাগি এবং পোর্ট মোর্শবি দখল করার সিদ্ধান্ত হয় এর নাম দেয়া হয় Operation Mo। ১০ মে এই অপারেশনের পরপরই ১৫ মে নাউরু ও ওসেন আইল্যান্ড দখল করার জন্য Operation RY এবং পরের মাসে ফিজি, সামোয়া ও নিউ ক্যালিডোনিয়া দখল করার জন্য Operation FS এর পরিকল্পনা করা হয়। এডমিরাল ইনোয়ি চাচ্ছিলেন এডমিরাল ইয়ামামোতোর আসন্ন মিডওয়ে আইল্যান্ড অপারেশনের আগেই যেন তার অপারেশনগুলো শেষ হয়।
১৯৪২ এর এপ্রিলে সেনাদের ল্যান্ডিং করার স্থান নির্বাচন করতে গোপন মিশনে সাবমেরিন RO-33 ও RO-34 কে পাঠানো হয়। দ্বিতীয় সাবমেরিনের নাম কি পরিচিত মনে হচ্ছে? জ্বী, এই সাবমেরিনটিকে আলু মেরে ডুবিয়ে দিয়েছিল মার্কিন নাবিকরা। যা-ই হোক, জাপান আক্রমণ করতে যাচ্ছে- এই মর্মে খবর পায় যুক্তরাষ্ট্রের নৌ গোয়েন্দারা। মার্কিন কোডব্রেকারগণ পার্ল হারবার আক্রমনের পর জাপানীদের রেডিও ডিক্রিপশন কোডবুকের ৮৫% কোডের অর্থ উদ্ধার করে ফেলেছিল!
দুটো দ্বীপই যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রবাহিনীর জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে জাপান বিমানঘাঁটি করলে আশেপাশের কয়েকশো কিলোমিটারের মধ্যে থাকা মার্কিন নৌ ও বিমানঘাঁটিগুলো তাদের হামলার আওতাভুক্ত হয়ে যাবে। একইসঙ্গে অস্ট্রেলিয়াতেও দরকার হলে হামলা করা জাপানের লংরেঞ্জ বোম্বারের জন্য সহজ হয়ে যাবে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিট কমান্ডার চেস্টার নিমিটজ জাপানি এডমিরাল শিগিওসি ইনোয়ির পরিকল্পনা বানচাল করে দিতে পাল্টা নৌবহর প্রেরণের সিধান্ত নেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগ দেয় অস্ট্রেলিয়ার নৌ ও বিমানবাহিনী। কিন্তু ৩-৪ মে, ১৯৪২ সালে জাপানের ইনভেশন ফোর্স সলোমন দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত তুলাগি অঞ্চলে অবতরণ করে। যুক্তরাষ্ট্র তাতে বাধা দিয়েও ব্যর্থ হয়।
ব্যাটল ফর্মেশন
মূল যুদ্ধের ঘটনায় যাওয়ার আগে কার শক্তি কেমন ছিল সেটি নিয়ে আগেই বলে নেয়া উত্তম। পাঠক হিসেবে আপনি যেন এই যুদ্ধের গুরুত্ব ও ভয়াবহতা ও দুই পক্ষের শক্তির তারতম্য অনুধাবন করতে পারেন সেজন্য এই আয়োজন।
জাপান
দ্বীপরাষ্ট্র জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠনের দিকে মনোযোগ দেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান নিজেদের নৌ-শক্তি আরো বৃদ্ধি করে। এই যুদ্ধে জাপানের ‘শকাকু’ এবং ‘যুইকাকু’ নামের দুটি ফ্লিট ক্যারিয়ারের নেতৃত্বে মূল স্ট্রাইক ফোর্স ও ‘শহো’ একটি লাইট ক্যারিয়ার ইনভেশন ফোর্সের জন্য এয়ার সাপোর্ট প্রদান করে। ফ্লিট ক্যারিয়ার, লাইট ক্যারিয়ার ইত্যাদি শ্রেণীর যুদ্ধজাহাজ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে ‘এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার: আধুনিক নৌবাহিনীর তুরুপের তাস (পর্ব-১)‘ শিরোনামের লেখাটিতে।
জাপানিদের তিনটি ক্যারিয়ার মিলিয়ে মোট ১৩৯টি বিমান ছিল। ১২টি সৈন্য পরিবহনকারী জাহাজকে প্রটেকশন ও ভূমিতে হামলার জন্য ৯টি ক্রুজার ও ১৫টি ডেস্ট্রয়ার শ্রেণীর যুদ্ধজাহাজ বহরে যোগ দেয়। এছাড়া নেভাল মাইন অপসারণের জন্য ৫টি মাইন সুইপার, শত্রুর জন্য মাইনের ফাঁদ পাততে ২টি মাইন লেয়ার, শত্রুর সাবমেরিন ধাওয়া ও ধ্বংস করতে দুটি সাবমেরিন চেজার, মাঝসাগরে যুদ্ধজাহাজে প্রয়োজনীয় তেল সাপ্লাই দিতে একটি অয়েল ট্যাংকার ও শত্রু জাহাজের উপর গোয়েন্দাগিরি করতে একটি লংরেঞ্জ সি-প্লেন ক্যারিয়ার (এসব বিমান পানিতে ল্যান্ড করতে পারে) জাপানি বহরে যোগ দেয়। সুতরাং বুঝতেই পারছেন যে প্রশান্ত মহাসাগরের রাজা রাজার বেশেই হামলা করতে এসেছিল কোরাল সাগরে। তাদের কমান্ডার ছিল যথাক্রমে রিয়ার এডমিরাল তাকেও তাকাগি ও রিয়ার এডমিরাল চুইচি হারা।
যুক্তরাষ্ট্র
পার্ল হারবার আক্রমণে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ৫টি ব্যাটলশিপসহ ১৮টি যুদ্ধজাহাজ হারিয়ে অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তাই তারা ১২৮টি যুদ্ধবিমান বহনকারী দুটি বিশাল আকারের ফ্লিট ক্যারিয়ারের প্রটেকশনের জন্য ৮টি ক্রুজার ও ১৪টি ডেস্ট্রয়ার শ্রেণীর যুদ্ধজাহাজ নিয়ে এসেছিল। এছাড়া জরুরি তেল সরবরাহের জন্য দুটি ট্যাংকার জাহাজ মার্কিন বহরে ছিল।
ঐ সময়ে প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫টি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ছিল। ভাইস এডমিরাল হ্যালসির অধীনে থাকা ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ ও ইউএসএস হরনেট নামের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার দুটো কেবলমাত্র জাপানের মেইনল্যান্ডে বোম্বিং মিশন শেষ করে ঘাঁটিতে ফিরেছে বিধায় তড়িঘড়ি করে আবার যুদ্ধে পাঠানো সম্ভব ছিল না। তাছাড়া সারাটোগা নামের আরেকটি ক্যারিয়ার কিছুদিন আগেই জাপানী সাবমেরিনের টর্পেডো হামলার শিকার হয়ে এখন যুক্তরাষ্ট্রে মেরামত করতে পাঠানো হয়েছে। তাই ইউএসএস ইয়র্কটাউন ও লেক্সিংটন নামের দুটো ফ্লিট ক্যারিয়ার পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। তাদের কমান্ডার ছিল যথাক্রমে রিয়ার এডমিরাল ফ্যাংক জে. ফ্লেচার ও রিয়ার এডমিরাল অব্রে ফিচ।
প্রিয় পাঠক, লেখার এই পর্যায়ে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারগুলো ও তাদের কমান্ডারদের নামগুলোর দিকে আবার খেয়াল করার অনুরোধ করছি। কেননা পরবর্তীতে কাহিনী বর্ণনার সুবিধার্থে এই নামগুলো বারবার আপনার সামনে উপস্থাপন করা হবে।
রিকনসিস মিশন
আগেই যেন মার্কিন ক্যারিয়ারের উপস্থিতির কথা জানা যায় সেজন্য জাপান ৪টি বাড়তি সাবমেরিন I-22, I-24, I-28 ও I-29 কে মোতায়েন করে। এরা ৮৩০ কিলোমিটার এরিয়া স্কাউটিং করার কথা ছিল। কিন্তু মার্কিন ক্যারিয়ার টাস্কফোর্স যে আগেই ঐ এলাকা পাড়ি দিয়ে ফেলেছে তা কে জানতো! এমনকি ঐ অঞ্চলে আগে থেকেই থাকা I-21 সাবমেরিন (যে কিনা নতুন ৪টিকে নেতৃত্ব দেয়ার কথা ছিল ) ২ মে ইয়র্কটাউনের একটি বিমান থেকে হামলার শিকার হয়। কিন্তু সে নিজেও জানতো না যে হামলাটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার থেকে হয়েছে। তাই কোরাল সি এর যুদ্ধে সাবমেরিনের কোনো ভূমিকা ছিল না। অন্যথায় জাপানিরা আগেই যদি টের পেত জার্মান ইউবোটের ন্যায় সম্মিলিত হাঙ্গরের ন্যায় এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো।
এরই মধ্যে ৩ মে টাস্কফোর্স ১১ (ইউএসএস লেক্সিংটন) ও টাস্কফোর্স ১৭ (ইউএসএস ইয়র্কটাউন) নিউ ক্যালিডোনিয়া দ্বীপের উত্তর-পশ্চিমে একত্রিত হয়। লেক্সিংটনের রিফুয়েলিং শেষ না হওয়ায় তাকে অস্ট্রেলিয়ান নেভির টাস্কফোর্স ৪৪ এর সাথে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেন এডমিরাল ফ্লেচার। ইতিমধ্যে রয়্যাল অস্ট্রেলিয়ান এয়ারফোর্সের একদল কমান্ডো তুলাগিতে ল্যান্ড করে এবং জাপানি ইনভেশন ফোর্স আক্রমণ করা মাত্রই তারা পূর্বনির্দেশ মোতাবেক পিছু হটে। খবরটি প্যাসিফিক হেডকোয়ার্টারে এডমিরাল নিমিটজের কাছে পৌঁছে গেলেও তিনি রেডিও সাইলেন্স না ভাঙার কারণে ইয়র্কটাউনের রিয়ার এডমিরাল ফ্লেচারকে সেটি দিতে পারছিলেন না। অর্থাৎ নির্ধারিত সময়ের চেয়ে একদিন পিছিয়ে আছে মার্কিন বাহিনী!
ফলে তিনি টাস্কফোর্স ১১ তথা রিয়ার এডমিরাল অব্রে ফিচের ক্যারিয়ার লেক্সিংটনের এর আশায় বসে না থেকে কোর্স পরিবর্তন করে গুয়াডালক্যানেল দ্বীপ এলাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন যেন পরদিন সকালে তিনি একাই তুলাগি ইনভেশন ফোর্সের উপর হামলা করতে পারেন!
মূল যুদ্ধ – প্রথম দিন
একটা সময় নৌযুদ্ধ বলতে কেবলমাত্র দুই দেশের শক্তিশালী জাহাজ পরস্পরকে নিজেদের ভারী ভারী কামানের রেঞ্জে এনে গোলাবর্ষণ করাকে বোঝাতো। কিন্তু ‘ব্যাটল অফ কোরাল সি’-তে এসে নতুন যুগের নৌযুদ্ধের সূচনা হয়। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দুই দেশের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের মধ্যে যুদ্ধ হয়। দুই দেশের বিমানবাহী রণতরীগুলো পরস্পরের ১৩০ কিলোমিটারের মধ্যে এসে পড়ে। তখনকার দিনে আজকের মতো এত উন্নত রাডার ছিল না। তাই শত্রু জাহাজ না দেখেই নেভি শিপের কমান্ডার আক্রমণ করছেন- এমন যুদ্ধের প্রথাও ছিল নতুন।
অপারেশন পরিকল্পনায় যুক্তরাষ্ট্র জাপানের চেয়ে একদিন পিছিয়ে ছিল। ১৯৪২ সালে ৩-৪ মে তারিখে জাপান সফলভাবে তুলাগিতে সৈন্য অবতরণ করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে প্রথম হামলা করা হয়। ইউএসএস ইয়র্কটাউন থেকে ৪ মে সকালে লঞ্চ করা ৬০টি বিমানের সারপ্রাইজ এয়ার অ্যাটাকে তুলাগি ইনভেশন ফোর্সের ডেস্ট্রয়ার ‘কিকিজুকি’সহ ৩টি মাইন সুইপার জাহাজ ডুবিয়ে দেয় এবং আরো ৪টি ক্ষতিগ্রস্ত করে। ব্যাপক হামলার মুখেও ইনভেশন ফোর্স তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখে এবং দ্রুতগতিতে তুলাগিতে সি-প্লেন বেজ নির্মাণের কাজ শুরু করে। ৬ মে এই ঘাঁটি থেকে প্রথম রিকনসিস বিমান উড্ডয়ন করে।
এদিকে ভাইস এডমিরাল তাকেও তাকাগির ক্যারিয়ার স্ট্রাইক ফোর্স অপারেশন এম-ও এর টাইমটেবিল গড়বড় হয়ে যাবে দেখে রাবাউল ঘাঁটিতে ৯টি বাড়তি জিরো ফাইটারের ডেলিভারি দেয়ার মিশন বাতিল করে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার যুইকাকুর রিফুয়েলিং শুরু করেন। তিনি মূলত খারাপ আবহাওয়ার কারণে দুবার চেষ্টা করেও ফাইটারগুলোর ডেলিভারি দিতে পারেননি। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি শিডিউল থেকে দেড় দিন পিছিয়ে পড়েন। তা না হলে মার্কিন হামলার সময় তিনি তুলাগির একদম কাছেই থাকতেন। ইয়র্কটাউনের হামলার কথা শুনে রিফুয়েলিং বাতিল করে তুলাগির ৬৫০ কিলোমিটার উত্তরে থাকা ক্যারিয়ার স্ট্রাইক ফোর্স নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার যুইকাকুর স্কাউট বিমানগুলো এডমিরাল ফ্লেচারের ইয়র্কটাউনকে খুঁজে পায়নি। আর পাবেই বা কীভাবে? তিনি তো টাস্কফোর্স ১১ ও ৪৪ এর সাথে মিলিত হতে গুয়াডালক্যানেলের দক্ষিণে আরো ৫৯০ কিলোমিটার দূরে সরে গেছেন।
তবে জাপানিরা তার অবস্থান অনুমান করে ফেলতে সক্ষম হয়। কারণ জাপান অধিকৃত শর্টল্যান্ড আইল্যান্ড থেকে আসা একটি রিকনসিস বিমান দুটো মার্কিন ক্যারিয়ার গ্রুপের সাথে অস্ট্রেলিয়ান টাস্কফোর্সকে দেখে ফেলে বিধায় একে শুটডাউন করা হয়। নির্দিষ্ট সময় পর এটি খবর না পাঠানোয় এবং বেজে ফেরত না আসায় ধরে নেয়া হয় এটি মার্কিন ক্যারিয়ারের কোনো বিমানের হাতে ভূপাতিত হয়েছে। এরই মধ্যে পার্ল হারবার থেকে খবর আসে যে পোর্ট মোর্শবিতে আক্রমণ করা হবে ১০ মে।
প্রত্যাশিত স্থানে জাপানি ক্যারিয়ারকে না পেয়ে পুনরায় রিফুয়েলিং শেষে বুগেনভাইল দ্বীপাঞ্চলে দিকে রওনা দেন ফ্লেচার। কেননা ইনভেশন ফোর্সের সাপোর্ট হিসেবে সেখানে অবশ্যই জাপানি ক্যারিয়ার থাকবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু এডমিরালের ফ্লেচারের অনুমান ছিল ভুল। পরদিন মার্কিনীদের পাশাপাশি জাপানিরাও এমন সব ভুল করতে শুরু করে যা ইতিহাসে কোরাল সি যুদ্ধকে ‘Most confused battle in world history’-তে পরিণত করেছে।
(চলবে)