ভিল্যেনুভের দ্বিতীয় অভিযান
৩০ মার্চ, ১৮০৫।
দ্বিতীয়বারের মতো ব্রিটিশদের ফাঁকি দিয়ে সাগরে বেরিয়ে পড়লেন ভিল্যেনুভ। নেলসন তখন ছিলেন দক্ষিণ সার্ডিনিয়াতে। কিন্তু ভিল্যেনুভ মনে করছিলেন নেলসন আছেন বার্সেলোনা। ফরাসিদের অনুসরণ করতে থাকে দুটি ব্রিটিশ ফ্রিগেট। ভিল্যেনুভ যে পথ ধরে যাচ্ছিলেন তাতে নেলসনের সাথে দেখা হওয়া ছিল অবশ্যম্ভাবি। ফ্রিগেট দুটিও এই আশাই করছিল। কিন্তু এক বাণিজ্য জাহাজের থেকে নেলসনের সঠিক অবস্থানের খবরে ভিল্যেনুভ দ্রুত রাস্তা পরিবর্তন করেন। ৭ এপ্রিল তার সাথে ক্যাপ্টেন অ্যালসেডোর নেতৃত্বে স্প্যানিশ একদল যুদ্ধজাহাজের দেখা হয়। ভিল্যেনুভ তাকে সঙ্গী হবার আহ্বান জানালেও সেরকম নির্দেশ উপরওয়ালাদের থেকে অ্যালসেডো পাননি। তাই তাকে বাদ দিয়ে ভিল্যেনুভ একাই আটলান্টিকে প্রবেশ করেন। গন্তব্য কাদিজ।
এদিকে অর্ডে ভিল্যেনুভের অভিযানের সংবাদ পেয়ে দ্রুত ব্রেশটের দিকে পিছিয়ে যান, সেখানে অসুস্থ অ্যাডমিরাল কর্নওয়ালিসকে ইতোমধ্যে প্রতিস্থাপন করেছেন স্যার কটন। তার হাতে ফরাসিদের মোকাবেলা করার মতো যথেষ্ট জাহাজ নেই। এদিকে ৭ এপ্রিল কাদিজের কাছেই ভিল্যেনুভ অবস্থান নেন। ৯ এপ্রিল গ্র্যাভিনা স্প্যানিশদের নিয়ে নোঙর তুললেন। দুই বাহিনী রওনা দিল আটলান্টিকের উদ্দেশ্যে। নেপোলিয়নের ইংল্যান্ড আক্রমণের পরিকল্পনা সফল হবার সম্ভাবনা দেখা দিল।
ফরাসি আর স্প্যানিশ নৌবহরের একত্রিত হবার সংবাদে ইংল্যান্ড উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। ১৯ এপ্রিল অ্যাডমিরাল নাইট ব্রিটিশ এক্সপিডিশনারি ফোর্স নিয়ে মাল্টার দিকে পাড়ি জমিয়েছেন। মাল্টা হয়ে তাদের যাবার কথা সিসিলি, সেখানে ফরাসি হামলার আশঙ্কা দিন দিন বাড়ছে। ব্রিটিশ কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছিলেন নাইট ফরাসি এবং স্প্যানিশ বহরের আক্রমণের শিকার হতে পারেন। এদিকে রয়্যাল নেভির হাই কম্যান্ডে চলছে বিশৃঙ্খলা। তহবিল তসরুপের দায়ে নেভির সর্বাধিনায়ক লর্ড মেলভিল পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। তার জায়গায় সাময়িক দায়িত্ব নিতে আনা হয়েছে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা চার্লস মিডলটনকে।
নেলসনের ধাওয়া
এতকিছু ঘটে গেছে, কিন্তু নেলসন তখনও বেখবর। তখন তো আর এখনকার মত রেডিও বা ফোন ছিল না। ১৮ এপ্রিল অবশেষে নেলসন খবর পেলেন ত্যুঁলো থেকে পাখি উড়ে গেছে। তিনি কালবিলম্ব না করে ভিল্যেনুভের পিছু ধাওয়া করলেন। তার কাছে খবর ছিল প্রায় দশদিন আগেই ভিল্যেনুভ জিব্রাল্টার পার হয়ে গেছেন, কাজেই তিনিও একই দিকে পাল খাটান। কিন্তু বাতাস অনুকূলে না থাকায় এক মাস লেগে গেল জিব্রাল্টার পৌঁছতে। এর মধ্যে তিনি একশ কামান সন্নিবেশিত রয়্যাল সভারেইন জাহাজও নিজ বহরে যুক্ত করে নেন।
কাদিজের কাছাকাছি ট্রাফালগার অন্তরীপের কাছে থাকতেই নেলসন খবর পেলেন স্প্যানিশ আর ফরাসি নৌবহর রওনা হয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দিকে। সুতরাং তিনিও দৌড় লাগালেন ভিল্যেনুভের পিছে পিছে। ওদিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজে অপেক্ষা করতে করতে হয়রান মিসিয়েসি ততদিনে বাধ্য হয়েছেন রশোফাঁ ফিরে যেতে। কাজেই ভিল্যেনুভ সেখানে গিয়ে তাকে পেলেন না। হতাশ ফরাসি কম্যান্ডার মার্টিনিক দ্বিপের নিকটবর্তী ছোট্ট ব্রিটিশ সেনাঘাঁটি ডায়মন্ড রক দখল করেন। কিন্তু এতে ধারণার চেয়ে বেশি সময় লেগে যায়। ততদিনে নেলসন খুব কাছে চলে এসেছেন।
৪ জুন নেলসন গেলেন বার্বাডোসে। সেখানে ব্রিটিশ জেনারেল রবার্ট ব্রেরেটন ত্রিনিদাদের দক্ষিণে ২৮টি ফরাসি জাহাজ দেখা যাবার খবর জানালেন। নেলসন তৎক্ষণাৎ সেদিকে পাল তুললেন। ৯ তারিখে গ্রেনাডা পৌঁছে তিনি পাকা খবর পেলেন যে ভিল্যেনুভ উত্তরে যাত্রা করেছেন। একই দিন ফরাসি রিয়ার অ্যাডমিরাল ম্যাগন দুটি জাহাজ নিয়ে ভিল্যেনুভের সাথে যোগ দেন।
তখন অবধি ভিল্যেনুভ জানতেন না নেলসন তাকে ধাওয়া করছেন। তিনি গুয়াডালুপের ব্রিটিশ উপনিবেশের পাশ দিয়ে ইউরোপের পথ ধরলেন। কেবল তখনই তিনি জানতে পারেন নেলসনের কথা। নেলসন পিছু পিছু আসতে থাকলেন। ১৮ জুলাই তিনি কাদিজের কাছে ব্রিটিশ কমান্ডার কলিংউডের নৌবহরের সাথে মিলিত হন। কোথাও ভিল্যেনুভের চিহ্ন দেখতে না পেয়ে জিব্রাল্টারে যাত্রাবিরতি করেন তিনি।
ভিল্যেনুভ ওদিকে স্পেনের পশ্চিম উপকূলে ফেনেস্টার অন্তরীপে এসে পৌঁছেছেন। এখানে দেখা হয়ে গেল ফেরল অবরোধ করে বসে থাকা ব্রিটিশ অ্যাডমিরাল ক্যাল্ডারের সাথে। অমীমাংসিত এক লড়াই শেষে ক্যাল্ডার দুটি স্প্যানিশ জাহাজ কব্জা করতে পারলেও হাই কমান্ডের রণকৌশলের বাইরে যাওয়ার কারণে তার কপালে জুটল আনুষ্ঠানিক তিরস্কার।
ভিল্যেনুভ ১লা আগস্ট ফেরলে নোঙর ফেলেন। ব্রেশটে যেতে চাইলেও চারদিকে ব্রিটিশ জাহাজ দেখে সেই পরিকল্পনা ত্যাগ করে এখান থেকে চলে যান কাদিজ। ফলে ব্রেশটের বহরের সাথে যোগ দিয়ে ইংলিশ চ্যানেলে প্রবেশ করবার পরিকল্পনা আপাতত ভেস্তে যায়। নেলসন ফিরে এলেন দেশে। তিনি যখন পরিবারের সাথে সময় কাটাচ্ছিলেন তখন ২রা সেপ্টেম্বর খবর এলো ভিল্যেনুভ ফেরলের কাছে ৩০টি জাহাজ নিয়ে অবস্থান নিয়েছেন। কাজেই ব্রেশটের নৌবহরের সাথে মিলে ইংল্যান্ডে আগ্রাসনের সম্ভাবনা আরো কমে যায়। শীঘ্রই নেপোলিয়ন ইংল্যান্ড আগ্রাসনের উদ্দেশ্যে জড়ো করা সৈনিকদের ডেকে পাঠান অস্ট্রিয়া আর রাশিয়ার মোকাবেলা করতে। ফলে ইংল্যান্ডে সরাসরি ফরাসি হামলার ঝুঁকি শুন্যের কোঠায় নেমে আসে। তবে সম্মিলিত ফরাসি আর স্প্যানিশ নৌবহরে নতুন নতুন জাহাজ যুক্ত হওয়া অব্যাহত থাকে, ফলে সাগরে ব্রিটিশ আধিপত্য হুমকির সম্মুখিন হয়।
নেলসনের নতুন সমুদ্রযাত্রা
১৪ সেপ্টেম্বর, ১৮০৫।
পোর্টসমাউথের জাহাজঘাটে শত শত মানুষের করতালির মধ্য দিয়ে নৌকায় উঠলেন হোরাশিও নেলসন। ইংলিশ চ্যানেলে নোঙর করে থাকা পতাকাবাহী জাহাজ ভিক্টরি তার লক্ষ্য। এবারের অভিযান অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, এবং নেলসন ফিরে আসার আশা করছেন না। বাড়ি ত্যাগ করার পূর্বে নিজের কফিন প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দিয়ে এসেছেন তিনি।ব্যাটল অফ নাইলে বিধস্ত ফরাসি পতাকাবাহী জাহাজের মাস্তুলের কাঠ দিয়ে সেই কফিন বানানো হয়েছিল আগেই।
ইংলিশ চ্যানেলের পানি চিরে ছুটে চলল ভিক্টরি, সঙ্গী ফ্রিগেট ইউরাইলাস। ১৭ তারিখে অ্যাজাক্স আর থান্ডারার নামে আরো দুটি জাহাজ তাদের সাথে যোগ দেয়। ছয়দিন পর নেলসন পৌঁছলেন ফেনেস্টার অন্তরীপে। ২৮ তারিখে কাদিজের অনতিদূরে সাগরে অবস্থান করা কম্যান্ডার কলিংউডের বহরের সাথে মিলিত হন তিনি। এখানে ২২টি জাহাজের ভার বুঝে নিলেন নেলসন।
নেলসনের রণকৌশল
পালের জাহাজের যুগে নৌযুদ্ধের জন্য সবাই নিজেদের জাহাজ বহরকে সাধারণত একটি লম্বা লাইনে সাজাত। একে বলা হয় লাইন অফ ব্যাটল। এর ছিল তিনটি মূল ভাগ: মধ্যভাগ বা সেন্টার, ভ্যান বা সম্মুখভাগ আর পশ্চাৎভাগ বা রিয়ার। এই রণসজ্জার ফলে প্রতিটি জাহাজ শত্রুপক্ষের দিকে ঘুরে গিয়ে তাদের একপাশে সজ্জিত কামান ছুড়তে পারত (broadside)। এতে করে নিজেদের জাহাজ ফ্রেন্ডলি ফায়ারে ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা কম থাকত।
আরেকটি কারণ ছিল- তখন তো আর বেতার যোগাযোগ ছিল না, ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে কমান্ডারদের আদেশ দেয়ার জন্য নির্ভর করতে হতো চোখের দেখার উপর। পতাকাবাহী জাহাজে থাকতেন বহরের অধিনায়ক, তিনি বিভিন্ন রকমের পতাকা মাস্তুলে তুলে বাহিনীকে প্রয়োজনমত নির্দেশনা দিতেন এবং রণকৌশল জানাতেন। জাহাজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলে তার পক্ষে এ কাজ যেমন কঠিন হত, তেমনি তার ক্যাপ্টেনরাও অধিনায়কের ইঙ্গিত বুঝতে পারতেন না। যুদ্ধের সময় দু’পক্ষেই তাই এক সারিতে নিজেদের জাহাজ সাজিয়ে একে অপরের মুখোমুখি হতো।
ট্রাফালগারের যুদ্ধে তৎকালীন প্রচলিত নিয়ম উল্টে দিয়েছিলেন হোরাশিও নেলসন। তার উদ্দেশ্য সবসময়ই ছিল সম্মুখযুদ্ধে ফরাসি ও স্প্যানিশ নৌবহরকে বাধ্য করা। কিন্তু ভিল্যেনুভ বারে বারে ফস্কে যাচ্ছিলেন। এবার নেলসন তাকে সুযোগ দিতে রাজি ছিলেন না। ১০ অক্টোবর তিনি তার ক্যাপ্টেনদের কাছে গোপন বার্তা পাঠিয়ে তার কৌশলের ধারণা দেন।
নিজের বহরকে তিন ভাগে ভাগ করেন নেলসন। একভাগ রিজার্ভে রেখে বাকি দুই ভাগ একে অপরের সমান্তরালে একটির পরিবর্তে দুটি লাইনে সাজানোর পরিকল্পনা করেন তিনি। এই দুই সারি ঠিক ৯০ ডিগ্রি কোণে আঘাত করবে শত্রুর সেন্টার আর রিয়ারে। ফলে প্রতিপক্ষের সারি ভেঙে তাদের ভ্যান হয়ে পড়বে নিষ্ক্রিয়। আলাদা আলাদাভাবে এরপর সেন্টার আর রিয়ারের জাহাজগুলোর ব্যবস্থা করা হবে। ভ্যানের জাহাজগুলো যদি ঘাপলা করতে চায়, তাদের জন্য থাকবে রিজার্ভ বহর।
মোটকথা, নেলসন চাচ্ছিলেন ফরাসি-স্প্যানিশ বহরে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে, যাতে পতাকাবাহী জাহাজের দেয়া সংকেত ব্যাহত করে তাদের প্রতিটি জাহাজকে আলাদা আলাদাভাবে লড়াইতে জড়ানো যায়। এর কারণ ছিল ভিল্যেনুভের ফরাসি-স্প্যানিশ বহরের সংখ্যাধিক্য। প্রচলিত কৌশলে গেলে খুবই স্বাভাবিক যে তারা তাদের অধিক সংখ্যক জাহাজ দিয়ে সম্মিলিতভাবে নেলসনকে চুরমার করে দিতে পারবে। কিন্তু একজনের বিরুদ্ধে একজনের লড়াইয়ে ব্রিটিশ নাবিকদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতায় বিজয়ের পাল্লা তাদের দিকেই হেলে থাকবে।
নেলসনের পরিকল্পনার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল- যখন তার দুই সারি শত্রু বিন্যাসের দিকে অগ্রসর হবে, তারা কামান ছোড়ার অবস্থানে থাকবে না। ফলে শত্রুরা সম্মুখভাগের জাহাজগুলোর উপর অবিরাম গোলাবর্ষণের সুযোগ পেয়ে যাবে। কিন্তু তাদের সারি ভেদ করবার আগপর্যন্ত এর জবাব দেবার ক্ষমতা থাকবে না। নেলসন ঝুঁকি নেয়ারই সিদ্ধান্ত নিলেন।
ফরাসি-স্প্যানিশ বহরের অবস্থান
২১ আগস্ট, ১৮০৫।
কাদিজের বন্দরে ফরাসি-স্প্যানিশ বহর নোঙর করেছে। জাহাজে রসদ ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে নাবিকদের অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। ওদিকে ভিল্যেনুভ আর গ্র্যাভিনার মন কষাকষি ছড়িয়ে পড়েছে তাদের নিজ নিজ বাহিনীর ভেতরেও। ক্যাল্ডারের সাথে সংঘর্ষে স্প্যানিশ জাহাজ হারানোকে গ্র্যাভিনা ফরাসিদের দায় দেখছিলেন। এই মনোভাব অন্য স্প্যানিশ নাবিকদেরও ছিল।
সেপ্টেম্বরের শেষে নেপোলিয়ন ভিল্যেনুভকে সরানোর তোড়জোড় শুরু করলেন। অ্যাডমিরাল রসিলিকে তার জায়গায় দায়িত্ব দেয়া হলো। তবে কাদিজে তখন রসিলি না থাকায় অন্তর্বর্তী অধিনায়ক হিসেবে ভিল্যেনুভই কাজ চালাচ্ছিলেন। নেপোলিয়ন তাকে আদেশ দিলেন নেপলস হয়ে ত্যুঁলোর দিকে যেতে। তার ধারণা ছিল- ব্রিটিশ জাহাজ বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, কাজেই এই ফাঁকে সহজেই ভিল্যেনুভ ত্যুঁলোতে গিয়ে অন্যান্য ফরাসি জাহাজের দল ভারি করতে পারবে। কলিংউড আর নেলসন যে একত্র হয়েছে সে বিষয়ে সম্রাটের কাছে কোনো তথ্যই ছিল না। ভিল্যেনুভ সন্দেহ করেছিলেন, কিন্তু নেপোলিয়নের উপরে কথা বলার মতো বুকের পাটা তার ছিল না।
২ অক্টোবর ব্রিটিশ জাহাজ কাদিজের দোরগোড়ায় উপস্থিত হলে ভিল্যেনুভের সন্দেহ সত্যি প্রমাণিত হলো। ৭ অক্টোবর তিনি পাল তোলার চেষ্টা করলেও প্রতিকূল আবহাওয়া তার যাত্রা ভেস্তে দেয়। ব্রিটিশ জাহাজগুলোও এই সময় নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়, শত্রুদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য রেখে যায় কয়েকটি ফ্রিগেট।
এদিকে কাদিজে গ্র্যাভিনা ও ভিল্যেনুভের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এলো। ভিল্যেনুভ চাচ্ছিলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাদিজ ছাড়তে। অন্যদিকে স্প্যানিশরা এখানেই বসে থাকার পক্ষপাতী। উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় শেষে ভোটে সিদ্ধান্ত হলো অপেক্ষা করবার। অপেক্ষার দুটি ফলাফল চিন্তা করা হলো। প্রথম চিন্তা ছিল ঝড়ো হাওয়ায় ব্রিটিশ সব জাহাজই সরে যেতে বাধ্য হলে তারা বন্দর ছেড়ে বের হবেন। দ্বিতীয় চিন্তা ছিল ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ করা ব্রিটিশ বাণিজ্য জাহাজের উপর ফরাসি আক্রমণের আশঙ্কায় নেলসন তার বহর থেকে জাহাজ সেদিকে প্রেরণ করলে তার শক্তি কমে যাবে, তখন ফরাসি-স্প্যানিশ নৌবহর বুক ফুলিয়ে সাগরে বের হতে পারবে।
কাদিজ থেকে ভিল্যেনুভের প্রস্থান
কম্যান্ডার ব্ল্যাকউড নেলসনের বহরের কয়েকটি জাহাজ নিয়ে কাদিজের আশেপাশে পাহারা দিচ্ছিলেন। ১৮ অক্টোবর ভিল্যেনুভ অ্যাডমিরাল ম্যাগনকে পাঠালেন এদের ব্যবস্থা করতে। কিন্তু বন্দর থেকে বের হয়ে কিছুদূর যেতে না যেতেই বাতাস পড়ে গেল। ম্যাগন অসহায়ভাবে ফাঁকা সাগরে বসে রইলেন। ব্রিটিশরা আক্রমণ করলে তিনি সহজ শিকারে পরিণত হবেন এই ভেবে ভিল্যেনুভ পুরো বহর নিয়েই ম্যাগনের দিকে এগিয়ে এলেন। ২০ অক্টোবর সকাল সাতটার সময় অনুকূল বাতাসে কাদিজ ছেড়ে ৩৩টি জাহাজের এই বহর দক্ষিণ দিকে যাত্রা করল।
অদূরে ব্রিটিশ ফ্রিগেট সিরিয়াস সবই দেখছিল। তাদের থেকে ইউরাইলাস, ফিবি আর মার্স জাহাজ হয়ে কাদিজের ৫০ মাইল পশ্চিমে ভিক্টরি’তে নেলসনের কাছে খবর পৌঁছে গেল। নেলসনের বহর পুরো শক্তির নয়, কয়েকটি জাহাজ তিনি জিব্রাল্টারে পাঠিয়েছেন রসদপত্র আনতে। ফলে ভিল্যেনুভের মোকাবেলা করার মতো প্রয়োজনীয় সংখ্যক জাহাজের ঘাটতি রয়েছে। নেলসন দমলেন না। খর্বশক্তির বাহিনী নিয়েই ফরাসিদের উচিত শিক্ষা দেবার প্রতিজ্ঞা করলেন। তিনি চাইছিলেন শত্রুরা কাদিজ থেকে যতটা সম্ভব দূরে সরে যাক, যাতে পরাজিত হবার চিহ্ন দেখলে লেজ গুটিয়ে কাদিজের বন্দরে ফিরে যেতে না পারে। নিজের বিজয় সম্পর্কে নেলসন ছিলেন নিশ্চিত। তবে জাহাজের স্বল্পতার জন্য আগের পরিকল্পনা মোতাবেক রিজার্ভ রাখার চিন্তা বাদ দিতে হলো তাকে।
ভিল্যেনুভ নেলসনের ব্যাপারে ভাল করেই জানতেন। তিনি আঁচ করেছিলেন ধুরন্ধর ব্রিটিশ অ্যাডমিরাল প্রচলিত নিয়মে খেলবেন না। তিনি হয়তো তার রনবিন্যাস ভেঙে ফেলতে চাইবেন। কাজেই ভিল্যেনুভ তার জাহাজগুলো তিন কলামে সাজানোর কথা ভাবলেন। সমস্যা হলো- তার নাবিকেরা বেশিরভাগই আনকোরা। অনেককে সেনাবাহিনী থেকে এনে জাহাজে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। খাবারদাবারের অভাবে তাদের শারীরিক অবস্থাও সুবিধার না। সবচেয়ে বড় কথা- তাদের দক্ষতা ও শৃঙ্খলা তৈরি করবার জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যায়নি। ফলে টেনেটুনে একটি লাইনেই তার জাহাজগুলো চলতে থাকল। ভিল্যেনুভ নিজের দুর্বলতার বিষয়ে সচেতন হয়ে সরাসরি সংঘর্ষ এড়িয়ে জিব্রাল্টারে চলে যেতে চাইছিলেন, কিন্তু বাতাস কমে যাওয়ায় সে চেষ্টা ব্যাহত হলো। এরই মধ্যে ২০ অক্টোবর রাত সাড়ে আটটার সময় দিগন্তে ভেসে উঠল ব্রিটিশ পতাকা।