এক টুকরো চকলেট মুখের ভেতরে, আর পুরো পৃথিবীকে পেছনে ফেলে আপনি যেন হারিয়ে যাচ্ছেন স্বাদ ও আনন্দের এক অন্য জগতে- চকলেটপ্রেমীদের জন্য এই অনুভূতি নতুন কিছু নয়। যারা সত্যিই চকলেট ভালোবাসেন তাদের কাছে এর স্বাদ ও গন্ধের সাথে কোনো কিছুরই যেন তুলনা করা চলে না। এটি যেন তাদের কাছে ঝলমলে মোড়কে মোড়ানো আনন্দের একটি ছোট্ট টুকরো। আবার অনেক চকলেটপ্রেমীর কাছে এটি স্রষ্টার এমনই এক আশীর্বাদ, যেটি দুশ্চিন্তা আর বিষণ্নতা ভুলিয়ে দিতে পারে। অনেকের কাছে এটি প্রেমাস্পদের রাগ ভাঙানোর এক মাধ্যম, আর অনেকের কাছে কোনো প্রিয়জনকে দেওয়া খুশি আর আনন্দের টুকরো।
এখন হাজারোভাবে প্রক্রিয়াজাত চকলেট পাওয়া যায় হাজারো মোড়কে। সারাবিশ্বে আকাশচুম্বী জনপ্রিয় এই খাবারের বাজারও কিন্তু বিশাল, চকলেটের ব্যবসাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান। এর অতুলনীয় স্বাদের জন্য আবিষ্কারের পর থেকে বহু বছর পর্যন্ত চকলেটকে স্বর্গীয় খাবার ও মানুষকে দেবতার দান ভাবা হতো। আজ আমরা জানবো চকলেটের প্রথম প্রচলন ও দূরদেশের এর ধীরে ধীরে সকলের হাতের নাগালে চলে আসার গল্প।
চকলেটের পথচলা শুরু হয় আজ থেকে বহু বছর আগে, খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ১৯০০ অব্দে, লাতিন আমেরিকার ঘরে আর খাবারের দোকানগুলোতে। মধ্য-আমেরিকার আদিম জনগোষ্ঠীর কাছেই চকলেট প্রথম খাদ্য উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ওমেক, মায়ান ও অ্যাজটেক জাতির মধ্যে চকলেটকে পানীয় হিসেবে গ্রহণের প্রথা চালু ছিলো। মায়ান অধিবাসীরা খ্রিস্টপূর্ব ২০০-৯০০ অব্দের সময় মেক্সিকোর দক্ষিণের কিছু কিছু অঞ্চলে বসবাস করতো। মায়ান সভ্যতায় কোকো গাছ ও বীজ এত গুরুত্বপূর্ণ ছিলো যে, তারা এর জন্য পৃথক দেবতার পূজা করতো এবং শাসক, যোদ্ধা, পুরোহিত ও সমাজের সবচেয়ে উঁচুস্তরের লোকেদের জন্য কোকো বীজ জমা করা হতো। তবুও শ্রেণী, বিভাগ নির্বিশেষে সকল মায়ান সদস্যই চকলেটের স্বাদ ও আনন্দ গ্রহণ করতে পারতো।
মায়ানরা চকলেটকে শক্তিপ্রদানকারী অমিষ্ট পানীয় হিসেবে গ্রহণ করতো। তারা মনে করতো, এটি হলো দেবতাদের গ্রহণকৃত খাবারের মধ্যে একটি। তাদের ধর্মীয় ও বিয়ের অনুষ্ঠানে এর উপস্থিতি ছিলো বেশ জরুরি। মায়ানরা প্রথমে কোকো গাছের চাষ করে বীজ সংগ্রহ করে শুকাতো। শুকনো বীজ সিদ্ধ করে খোসা ছাড়িয়ে কেবল ভিতরের দানা দিয়ে তৈরি করতো চকলেটের উষ্ণ পানীয়। তাতে গুঁড়া মরিচ, ভ্যানিলা, লবণ সহ তাদের স্থানীয় অনেক মসলার মিশ্রণ যোগ করতো। অমিষ্ট হলেও সেগুলো এতে এনে দিত অতুলনীয় স্বাদ।
অ্যাজটেকরা যখন মায়ানদের পরাজিত করে মেক্সিকোর বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের প্রভাব বিস্তার করে, তখন মায়ানরা তাদের কর দিতে বাধ্য হয়। মায়ানরা কর হিসেবে কোকো বীজ অ্যাজটেকদের কাছে সরবরাহ করত। কোকোর বীজ সেই সময় এত মূল্যবান হয়ে ওঠে যে, এটি মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার হওয়া শুরু হয়। মাত্র ১০টি কোকোর বীজ দিয়ে ছোট ভেড়ার ছানা বা একটি খরগোশ কেনা সম্ভব ছিল। এমনকি সমপরিমাণ কোকো বীজ দিয়ে এক রাতের জন্য কোনো নিশিকন্যারও ব্যবস্থা করা যেত।
অ্যাজটেকরা বিশ্বাস করত যে, জ্ঞানের দেবতা কুয়েটজাকোল স্বর্গের উপাদান কোকো বীজ মানুষকে উপহার হিসেবে দেন। আর সেজন্য তাকে ভোগ করতে হয়েছে চিরকালের জন্য অন্যান্য দেবতাদের দেওয়া শাস্তি। কোকো বীজ ব্যবহার করেই অ্যাজটেকদের মধ্যে দেবতাদের উদ্দেশ্যে যেকোনো দান দেওয়ার বা মন্দিরে দানের মূল্য পরিশোধ করার প্রচলন ছিলো। এ যেন পকেটভর্তি কোকো বীজ, পকেটভর্তি টাকার নামান্তর হয়ে ‘টাকা গাছে ধরে’ প্রবাদেরই বাস্তবিক রূপ। উত্তর আমেরিকার ওমেক গোষ্ঠীর অধিবাসীদের মধ্যেও পানীয় হিসেবে চকলেটের প্রায় একইরকম ব্যবহারের প্রচলন ছিল বলে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা দাবি করেছেন। এক্ষেত্রে মায়ান না ওমেক- কারা চকলেটকে পানীয় হিসেবে প্রথম ব্যবহারকারী তা নিয়ে আলোচনা ও তর্ক কিন্তু বেশ জমজমাট।
এবার আসা যাক আমেরিকার কিছু অংশ থেকে চকলেটের সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ার কথায়। প্রায় ষোড়শ শতাব্দীতেও মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার এই পানীয় ইউরোপের অন্যান্য অংশের মানুষের কাছে অপরিচিত ছিলো। ১৫০২ সালের ১৫ই অগাস্ট ক্রিস্টোফার কলম্বাস যখন চতুর্থবারের মতো আমেরিকা আসেন, তিনি ও তার নাবিকেরা স্থানীয় লোকদের বেশ বড়সড় একটা নৌকা জব্দ করেন, যা ছিল ভালো মানের কোকো বীজে পূর্ণ। এই অঞ্চলের লোকেদের কাছে কোকো বীজ কত মূল্যবান ছিল, তা কলম্বাসপুত্র ফার্দিনান্দের বর্ণনা থেকে জানা যায়। তিনি বলেন, “তারা যখন তাদের মালামালগুলো অন্য জাহাজে নিয়ে যাচ্ছিলো, এই বাদামের মতো বস্তুগুলোর কোনোটা পড়ে যাচ্ছিল, আমি খেয়াল করছিলাম যে, তারা এমনভাবে সেগুলো তুলে নিচ্ছিলো যেন তাদের একটা চোখই খুলে পড়ে গেছে।” ফেরার পথে কলম্বাস চকলেট নিজের সাথে স্পেনে নিয়ে আসেন।
এরপরে স্পেন অ্যাজটেকদের পরাস্ত করলে কোকো বীজ ইউরোপে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আমদানি হতে শুরু করে। এটা হয়ে ওঠে রাজদরবারের বিশেষ পানীয়। সেই থেকে চকলেট ছড়িয়ে পড়তে থাকে ইউরোপের অন্যন্য অংশে। প্রথমদিকে কোকো বীজের এই পানীয় তেমন সাড়া না ফেললেও স্প্যানিশরা যখন তিক্তভাব কমানোর জন্য এর সাথে মধু বা চিনি, বাদাম ও অন্যান্য উপাদান যোগ করে, তারপরের একশ বছরের মধ্যে এটি পানীয়ের জগতে এক মাইলফলক স্থাপন করে। মায়ানদের সময় থেকে স্পেনে চকলেটের প্রচলন চালু হওয়া পর্যন্ত এটি কেবল পানীয় হিসেবে ব্যবহার করা হতো। প্রথমদিকে চকলেটের সরবরাহের জন্য ইউরোপীয়রা প্রধানত স্পেনের ওপর নির্ভর করলেও আস্তে আস্তে ব্রিটিশ, ডাচ ও ফরাসিরা নিজেদের অধিকৃত অঞ্চল শ্রীলঙ্কা, ভেনেজুয়েলা, জাভা, সুমাত্রা ইত্যাদি এলাকায় কোকোর উৎপাদন শুরু করে।
১৭ শতকের শুরু থেকে এ পর্যন্ত চকলেট খাবার বাজারের বিশাল একটি অংশ দখল করে আছে। ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভিন্ন ভিন্ন রূপে চকলেটকে উপস্থাপন করে প্রতিদিন নতুনভাবে চকলেটপ্রেমীদের মুগ্ধ করে যাচ্ছে। ১৭৬০ সালে ফ্রান্সে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম চকলেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ‘চকলেটারি লোমবার্ট’। শিল্প বিপ্লবের সাথে চকলেট উৎপাদন ও প্রস্তুত প্রণালীতে নতুন পদ্ধতি যোগ হয়। ১৮২৮ সালে একজন ডাচ রসায়নবিদ তরল চকলেট থেকে প্রাকৃতিক চর্বি বাদ দেওয়ার পদ্ধতি আবিস্কার করলে তা সকল বয়সী ও শ্রেণীর মানুষের কাছে চকলেটকে আরো সহজলভ্য করে তোলে। ১৮৫০ সালে জোসেফ ফ্রাই নামের এক ইংরেজ ভদ্রলোক কোকো গুড়া ও চিনিতে অনেক পরিমাণে কোকোর মাখন যোগ করে প্রথমবারের মতো ঘন, কঠিন চকলেট তৈরি করেন। এই আবিষ্কারের ফলেই এখন কেবল তরল নয়, কঠিন পদার্থের রূপেও চকলেট পাওয়া সম্ভব হচ্ছে।
বর্তমানে সারা পৃথিবীতে প্রাপ্ত কোকো বীজের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ উৎপাদিত হয় আফ্রিকার পশ্চিম অঞ্চলে। ঘানা, নাইজেরিয়া ও ক্যামেরুন পৃথিবীর প্রথম পাঁচটি কোকো উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে তিনটি। তবুও দুঃখের সাথে বলতে হয়, এখনো পৃথিবীর অধিকাংশ চকলেট যে কোকো শ্রমিক ও শিশু শ্রমিকরা উৎপাদন করে তাদের অবস্থা মধ্যযুগীয় দাসদের থেকে খুব একটা ভালো নয়। তবুও প্রযুক্তির সাথে আগের তুলনায় বিভিন্ন অঞ্চলে কোকোর চাষ ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে।
এভাবেই আমাদের অতি প্রিয় চকলেট দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে অনেক রূপ পরিবর্তন করে আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়। এখন আমাদের সবচেয়ে কাছের খাবারের দোকানেই বেশ স্বল্প মূল্যেই আমরা উপভোগ করতে পারি এর অতুলনীয় স্বাদ। আর যারা সত্যিকার অর্থে চকলেটকে ভালোবাসেন তাদের কাছে তো চিরকালই এ এক প্যাকেটে মোড়ানো দেবতার অসাধারণ আশীর্বাদ।
ফিচার ইমেজ: foodnetwork.com