যেকোনো যুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। সাধারণভাবে আমরা দেখে থাকি- যুদ্ধে একপক্ষ আরেক পক্ষের উপর আক্রমণ করছে। কখনও হারানো জায়গা ফিরিয়ে আনার জন্য আক্রমণ করা হয়, কখনও বা নতুন কোনো জায়গা নিজেদের অধীনে নিয়ে আসার জন্য আক্রমণ করা হয়। প্রতিটি আক্রমণের পেছনে যে বিশাল পরিকল্পনা রয়েছে, এগুলো কিন্তু আমাদের চোখের আড়ালেই থেকে যায়। প্রতিটি যুদ্ধে যেকোনো আক্রমণের আগে গুপ্তচরবৃত্তির মাধ্যমে প্রতিপক্ষের অবস্থান, সামরিক শক্তিমত্তা ইত্যাদি গোপন তথ্য জেনে তার উপর ভিত্তি করে পরিকল্পনা সাজানো হয়। কিন্তু গুপ্তচরবৃত্তির মতো স্পর্শকাতর কাজ খুব গোপনে সম্পন্ন করা হয়, তাই এসব বিষয় সম্পর্কে সামরিক বাহিনীর গন্ডির বাইরের মানুষের ধারণা কমই থাকে। শুধু যুদ্ধাবস্থাতেই নয়, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও প্রতিটি রাষ্ট্র নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে প্রতিটি মুহুর্তে নিজেদের চৌকষ গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে গুপ্তচরবৃত্তি পরিচালনা করে, যাতে করে বাইরের কোনো দেশ রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য হাতিয়ে নিতে না পারে।
ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যখন আমেরিকার তেরটি উপনিবেশ স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়, তখন ব্রিটিশ বনাম আমেরিকানদের সামরিক সংঘর্ষ অনিবার্য ছিল। কিন্তু স্থানীয় আমেরিকানদের বিপদ ছিল অন্য জায়গায়। ব্রিটিশদের ছিল সুসংগঠিত সেনাবাহিনী এবং তাদের গোয়েন্দা ইউনিট ছিল পৃথিবীর অন্যতম সেরা। অপরদিকে আমেরিকানদের সেনাবাহিনী থাকলেও স্বীকৃত কোনো গোয়েন্দা বাহিনী ছিল না। আগেই বলা হয়েছে, শত্রুর বিরুদ্ধে যেকোনো আক্রমণ পরিচালনা করতে গেলে গুপ্তচরবৃত্তির মাধ্যমে যদি আগে থেকে তথ্য সংগ্রহ করা না যায়, তাহলে আক্রমণে ব্যর্থতার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। জর্জ ওয়াশিংটন যেহেতু ছিলেন আমেরিকার সেনাপতি, তিনি ভালো করেই জানতেন যে গোয়েন্দা ইউনিট না থাকলে ব্রিটিশদের সাথে পেরে ওঠা কষ্টকর হবে। তাই বিপ্লবের সময়ই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, একটি গোয়েন্দা ইউনিট তৈরি করা হবে। মজার বিষয় হচ্ছে, বিপ্লবের সময় আমেরিকান সেনাবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে যে গোয়েন্দা ইউনিট তৈরি করা হয়েছিল, এবং তারা যেসব কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ ও আদান-প্রদান করতো, সেসব কৌশল আজও ব্যবহার করা হচ্ছে।
ব্রিটিশরা আমেরিকার নিউ ইয়র্কে শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল। জর্জ ওয়াশিংটন স্বীকৃত গোয়েন্দাবাহিনীর অভাবে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হচ্ছিলেন। আমেরিকান সেনাবাহিনীর কমান্ডার চার্লস স্কটের উপর প্রাথমিক দায়িত্ব দেয়া হয়, এবং পরবর্তীতে তিনি সেই দায়িত্ব অর্পণ করেন তরুণ অফিসার বেঞ্জামিন টলমেজের উপর। ‘কালপার স্পাই রিং‘ নামটি এসেছিল স্বয়ং জর্জ ওয়াশিংটনের কাছ থেকে, এবং এই গোয়েন্দা ইউনিটের দুজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নিজেদের ছদ্মনামে কালপার (Culper) শব্দটি রেখেছিলেন। তবে জর্জ ওয়াশিংটন কিংবা চার্লস স্কট নন, কালপার স্পাই রিংয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বেঞ্জামিন টলমেজ। তিনি বেছে বেছে তার ছোটকালের বন্ধুদের মধ্য থেকে বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়েছিলেন। ব্রিটিশদের গোপন তথ্য সংগ্রহ ও সেগুলো নিরাপদে লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সেই সময় অনুযায়ী সবচেয়ে আধুনিক পদ্ধতির প্রবর্তন করেছিলেন বেঞ্জামিন টলমেজ। কালপার স্পাই রিংয়ের পাঁচ বছরের সময়ে একবারও কোনো গুপ্তচর ব্রিটিশদের হাতে ধরা পড়েনি কিংবা কখনও কেউ ‘ডাবল এজেন্ট’ হিসেবে তথ্য পাচার করেনি– এসব সাফল্যের সিংহভাগ কৃতিত্বও তার।
কোনো গোয়েন্দা ইউনিট গঠন করার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্নটি সামনে আসে, সেটি হলো- “কাদের নিয়োগ দেয়া হবে?“। ইতিহাসে এরকম অনেকবার দেখা গিয়েছে যে অর্থ কিংবা অন্য অনেক কিছুর লোভে ইউনিটের কোনো ব্যক্তি প্রতিপক্ষের কাছে স্পর্শকাতর তথ্য পাচার করে দিয়েছে। কালপার স্পাই রিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা বেঞ্জামিন টলমেজ এই বিষয়টি খুব ভালো করে জানতেন যে যদি বিশ্বস্ত ও ন্যূনতম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোকদের যদি ইউনিটে নিয়োগ দেয়া না হয়, তাহলে যে উদ্দেশ্যে ইউনিট গঠন করা হচ্ছে, সেটি ব্যাহত হবে। তিনি সবার প্রথমে নিয়োগ দেন তার শৈশবের দুই বন্ধু আব্রাহাম উডহাল এবং ক্যালেব ব্রিউস্টারকে। তাদের তিনি খুব ভালো করে চিনতেন, পাশাপাশি এই দুজনের সামরিক বাহিনীতে আগে কাজের অভিজ্ঞতা ছিল। এই দুজন আবার পেশাগত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য নিজেদের পরিচিত বেশ কয়েকজন ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে গুপ্তচরবৃত্তির কাজ সুচারুভাবে পালনের সক্ষমতা ছিল। যেমন- কালপার স্পাই রিংয়ের একজন বিখ্যাত নারী গুপ্তচর আন্না স্মিথ স্ট্রংয়ের কথা বলা যায়। তিনি ছিলেন স্থানীয় আমেরিকার স্বাধীনতাপন্থী এক বিচারকের স্ত্রী।
আব্রাহাম উডহালসহ কালপার স্পাই রিংয়ের যেসব ব্যক্তি সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহ করতেন, তারা নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে রাখতেন। আব্রাহাম উডহালের বাবাও ছিলেন একজন মার্কিন স্বাধীনতাপন্থী বিচারক। উডহালের বোন থাকতো নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে এবং নিজের বোনকে দেখার অযুহাতে আব্রাহাম উডহাল নিউ ইয়র্কে গমন করতেন। তবে বারবার গেলে নিউ ইয়র্কে শক্ত ঘাঁটি গেড়ে থাকা ব্রিটিশদের কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স গোয়েন্দাদের হাতে আটক হওয়ার একটা সম্ভাবনা ছিল, তাই তিনি তার পরিচিত রবার্ট টাউনসেন্ডকে তথ্য সংগ্রহের জন্য নিয়োগ দেন। রবার্ট টাউনসেন্ডের বাবাও ছিলেন স্বাধীনতাকামী বিচারক। টাউনসেন্ড ছিলেন পেশায় একজন ব্যবসায়ী। তিনি একইসাথে তার পৈতৃক এবং নিজস্ব ব্যবসা– দুটোই দেখাশোনা করতেন। সুতরাং ব্যবসায়িকভাবে নিউ ইয়র্কে অবস্থান করা তার জন্য যুক্তিসঙ্গত ছিল, যা আব্রাহাম উডহালের ক্ষেত্রে ছিল না। উডহাল ‘স্যামুয়েল কালপার সিনিয়র’ (Samuel Culper Sr.) ও রবার্ট টাউনসেন্ড ‘স্যামুয়েল কালপার জুনিয়র’ (Samuel Culper Jr.) নামে নিজেদের মধ্যে পত্র আদান-প্রদান করতেন।
মার্কিন সেনাপতি জর্জ ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে আরও বেশি করে তথ্য সংগ্রহের চাপ আসায় জোনাস হকিন্স এবং অস্টিন রো– আরও দুজন নিউ ইয়র্কবাসীকে কালপার স্পাই রিংয়ে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। সরেজমিনে যত ধরনের তথ্য সংগ্রহ করা হতো, সেগুলো আব্রাহাম উডহালের কাছে পাঠানো হতো। তবে উডহাল নিজেও অনেকবার ছদ্মবেশে নিউ ইয়র্কে গিয়ে ব্রিটিশদের নৌঘাঁটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন এবং সাধ্যমতো তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বিভিন্ন সোর্সের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যগুলোর মধ্যে যেগুলো জর্জ ওয়াশিংটনের কাছে পাঠানোর উপযুক্ত, সেগুলো বাছাই করতেন। এরপর সেসব ক্যালেব ব্রিউস্টারকে পাঠানো হতো, এবং তার দায়িত্ব ছিল সেগুলো নিরাপদে বেঞ্জামিন টলমেজের কাছে পাঠানো। এরপর টলমেজ সেগুলো ওয়াশিংটনের কাছে পাঠাতেন। তথ্যগুলো পরিবহনের জন্য অনেক সময় সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করা হতো, আবার কখনও এমন কালি ব্যবহার করা হতো যেগুলো খালি চোখে দেখা যায় না।
কালপার স্পাই রিংয়ের সাফল্য ও ব্যর্থতার হিসেব নিয়ে কথা বলা যাক। এই গুপ্তচর নেটওয়ার্ক যে শুধু তথ্য সংগ্রহ করতো, বিষয়টা এমন নয়। আমেরিকার সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে কেউ ব্রিটিশদের কাছে তথ্য পাচার করছে কিনা– এটা দেখার দায়িত্বও তাদের উপরে ছিল। আমেরিকান সেনাবাহিনীর এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মেজর জন আন্দ্রে ও মেজর আর্নল্ড ব্রিটিশদের কাছে তথ্য পাচার করছেন– এই ধরনের তথ্য কালপার স্পাই রিংয়ের মাধ্যমে জর্জ ওয়াশিংটনের কাছে পৌঁছালে তদন্তের ভিত্তিতে তথ্যের সত্যতা প্রমাণিত হয়েছিল। এছাড়া আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামে ফরাসিরা সহায়তা করতে এলে তাদের উপর আকস্মিক হামলার পরিকল্পনা করেছিল ব্রিটিশরা। এই পরিকল্পনার কথা কালপার স্পাই রিংয়ের হাতে পৌঁছায় এবং সময়মতো ফরাসিদের সতর্ক করে দেয়া হয়। কালপার স্পাই রিং ছিল আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ের এমন একটি গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক, যার উপর জর্জ ওয়াশিংটন নির্দ্বিধায় ভরসা রাখতে পারতেন। তবে কারিগরি ও অন্যান্য কারণে অনেক সময় যতটুকু তথ্য সংগ্রহ প্রয়োজন ততটুকু করা সম্ভব হয়নি। তারপরও ব্রিটিশদের উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের বিভিন্ন গোপন তথ্য সংগ্রহে কালপার স্পাই রিংয়ের গোয়েন্দারা এতটাই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন যে তখনকার সময়ে সেটি প্রায় অবিশ্বাস্য ছিল।