
১৯৮৫ সালের ২৩ নভেম্বর ইজিপ্টএয়ার-এর বোয়িং ৭৩৭ ফ্লাইট ৬৪৮ গ্রিসের রাজধানী এথেন্স থেকে মিসরের রাজধানী কায়রোর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল। উড্ডয়নের প্রায় দশ মিনিটের মধ্যে সন্ধ্যা ৭টা ৩৫ মিনিটের দিকে সালেম চাকোর নামে এক ব্যক্তির নেতৃত্বে তিন ব্যক্তি অস্ত্র ও গ্রেনেড দেখিয়ে বিমানটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। ছিনতাই হওয়া বিমানে সর্বমোট ৯২ জন যাত্রী এবং ছয়জন ক্রু ছিলেন।
যাত্রী বেশে বিমানে অবস্থান করা ছিনতাইকারীদের মধ্যে ওমর মোহাম্মেদ আলি রেজাক জোর করে বিমানের ককপিটে প্রবেশ করে এবং বাকি দুই ছিনতাইকারীর মধ্যে সালেম চাকোর বিমানের সামনে এবং অপরজন নার আল-দিন বো সাঈদ বিমানের পেছনে অবস্থান নেয়। ছিনতাইকারীরা অস্ত্রের মুখে জিম্মি হওয়া যাত্রীদের পাসপোর্ট যাচাই-বাছাই শুরু করে।
তেমার আর্টজি এবং নিতজান ম্যান্ডেলসন নামক দুই ইসরায়েলি যাত্রীকে জোর করে বিমানের সামনের সারিতে বসিয়ে দেওয়া হয়। এরপর প্যাট্রিক স্কট বেকার, স্ক্যারলেট রোবেনক্যাম্প এবং জ্যাক নিঙ্ক ফ্লাগ নামে তিন মার্কিন যাত্রীকে ঐ দুই ইসরায়েলির ঠিক পেছনে বসানো হয়। বাকি যাত্রীদের পরবর্তী আসনগুলোতে বসানো হয়। বিমানে অবস্থান করা ১১ জন ফিলিস্তিনি যাত্রীকে বিমানের আরও পেছনে বসানো হয়, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। ধারণা করা হয়, ছিনতাইকারীরা আবু নিদাল অর্গানাইজেশন নামে একটি ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠনের সদস্য। আবু নিদাল অর্গানাইজেশন প্রথমে ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বাধীন প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) এর অন্তর্ভুক্ত থাকলেও পরবর্তী সময়ে উগ্রপন্থা এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার কারণে ১৯৭৪ সালে পিএলও থেকে আবু নিদাল অর্গানাইজেশনকে বহিষ্কার করা হয়।
বাকি যাত্রীদের মধ্যে মোস্তফা মেদহাত কামাল নামে একজন ছিলেন মিশরীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। ছিনতাইকারীদের কাছে শনাক্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে তিনি একপর্যায়ে ব্যাগ থেকে পিস্তল বের করে ছিনতাইকারীদের নেতা সালেম চাকোরের উদ্দেশ্যে গুলি শুরু করেন। গোলাগুলির একপর্যায়ে সালেম চাকোর নিহত হন, অপর ছিনতাইকারী নার আল-দিন বো সাঈদের গুলিতে মোস্তফা মেদহাত কামাল মুমূর্ষু অবস্থায় বিমানের ভেতর পড়ে ছিলেন। সালেম চাকোরের মৃত্যুর পরও ওমর মোহাম্মেদ আলি রেজাকের নেতৃত্বে ছিনতাইকারীরা বিমানের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখে। ছিনতাইকারীরা বিমান নিয়ে আলজেরিয়ায় অবতরণ করতে চায়, তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে লিবিয়াতে অবতরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু বিমানের ক্যাপ্টেন হানি গালাল পর্যাপ্ত জ্বালানি না থাকার বিষয়টি উল্লেখ করলে একপর্যায়ে ছিনতাইকারীরা মাল্টায় অবতরণের নির্দেশ দেয়।
মাল্টা সরকার প্রথমদিকে বিমানটি সেখানে অবতরণের অনুমতি প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়। এরপর বিমানের ক্যাপ্টেন হানি গালাল নিয়ন্ত্রণকক্ষের সাথে যোগাযোগ করে সার্বিক পরিস্থিতি বর্ণনা করে সেখানে অবতরণের অনুমতি দিতে অনুরোধ জানান। এরপর মাল্টা সরকার অনুমতি দেয়। বিমান অবতরণের সাথে সাথে দেশটির সামরিক বাহিনীর সদস্যরা একে ঘিরে অবস্থান নেয়।

এরপর দুই পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা শুরু হয়। এই মধ্যস্থতা প্রক্রিয়ায় মাল্টার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কারমেনু মিফসুদ বনিসি ছিনতাইকারীদের নেতা ওমর মোহাম্মেদ আলি রেজাকের সাথে কথা বলেন। আলি রেজাক জরুরি ভিত্তিতে খাবার এবং জ্বালানি সরবরাহের জন্য মাল্টা সরকারের কাছে অনুরোধ জানান। মাল্টা সরকার বিমানের নারী যাত্রীদের মুক্তি প্রদানের শর্তে জরুরি খাদ্য সরবরাহে রাজি হয়। এরপর আলি রেজাক নারী যাত্রীদের মুক্তি প্রদানে সম্মতি দিয়ে একজন চিকিৎসক কর্তৃক সালেম চাকোরের শারীরিক অবস্থা নিশ্চিতের দাবি জানায়। মাল্টা সরকার ভিক্টর বুহাজিয়ার নামে একজন চিকিৎসককে সেই বিমানে প্রেরণ করে। তিনি সালেম চাকোরের শারীরিক অবস্থার পরীক্ষা করে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর ঐ চিকিৎসক মোস্তফা মেদহাত কামালকে বিমান থেকে নামিয়ে আনেন। গুরুতর আহত হলেও সৌভাগ্যক্রমে তিনি তখনও বেঁচে ছিলেন।
আলি রেজাক মিশর এবং ফিলিপাইনের প্রায় ৩২ জন নারী যাত্রীকে জিম্মি দশা থেকে মুক্তি দেন। এরপর তিনি ইসরায়েলি নাগরিক তেমার আর্টজিকে ডেকে পিস্তল বের করে পেছন থেকে গুলি করেন এবং মৃত ভেবে তাকে বিমানের সিঁড়ি দিয়ে ফেলে দেন। ছিনতাইকারীরা নিয়ন্ত্রণ কক্ষে মাল্টার কর্তৃপক্ষকে জ্বালানি সরবরাহের জন্য চাপ দিতে থাকে এবং বিমানে জ্বালানি সরবরাহ না করা হলে, প্রতি পনেরো মিনিটে একজন করে যাত্রী মেরে ফেলার হুমকি দেয়।
পনেরো মিনিট পর আলি রেজাক অপর ইসরায়েলি নিতজান ম্যান্ডেলসনের মাথায় গুলি করে বিমান থেকে ফেলে দেয়। কিছুক্ষণ পরপর আরও কয়েকজন যাত্রীকে হত্যা করা হয়। এই পর্যায়ে এসে মাল্টা সরকারের হাতে পরিস্থিতির উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এমন ভয়াবহ বিমান ছিনতাই পরিস্থিতি সামাল দিতে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল হস্তক্ষেপ করার জন্য মাল্টা সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। তবে দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কারমেনু মিফসুদ বনিসি মাল্টার জোট নিরপেক্ষতার নীতি বজার রাখার জন্য সেই প্রস্তাবে রাজি হননি। তবে তিনি প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশিক্ষিত মিসরীয় কমান্ডো বাহিনী প্রেরণের ব্যাপারে অনুমতি দেন।

বিমান ছিনতাইয়ের প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা পর ২৪ নভেম্বর রাত আটটার দিকে বিমানের চারপাশের আলো নিভিয়ে বিমানের যাত্রীদের উদ্ধারে মিসরীয় কমান্ডো বাহিনী সামরিক অভিযান শুরু করে। সেই সময় প্রচণ্ড গোলাগুলি এবং তীব্র বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সেই সামরিক অভিযানে একজন ছিনতাইকারী নার আল-দিন বো সাঈদ ঘটনাস্থলে নিহত হন এবং অপর ছিনতাইকারী ওমর মোহাম্মেদ আলি রেজাক আহত অবস্থায় আটক হন। এছাড়াও মিসরীয় কমান্ডো বাহিনী বেশ কয়েকজন যাত্রীকে জীবিত উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনার অবসান ঘটে।

বিমান ছিনতাইয়ের এই ঘটনায় গ্রিসের বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। এই ঘটনায় সাধারণ যাত্রী ও ক্রুসহ মোট ৫৮ জন ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেন এবং তিন ছিনতাইকারীর মধ্যে দুজন নিহত হয়। অপর ছিনতাইকারী আলি রেজাক দীর্ঘসময় মাল্টার কারাগারে বন্দি থাকার পর বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন।