১৮৫০ সালের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভসের সদস্যরা দাসপ্রথার ইস্যুতে দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিলেন। দাসপ্রথা নির্মূল করার আন্দোলন দিন দিন জোরদার হওয়ার সাথে সাথে এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে অসংখ্য বিতর্কও জন্ম নিচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুক্ত হওয়া নব্য রাষ্ট্রগুলো দাসত্বকে বৈধ ঘোষণা করবে কি না, তা নিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়ে আরও হাওয়া লাগাতে সহিংসতা চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছে যায়।
‘চার্লস সামনারের কোন্দল’ বা ‘ব্রুকস-সামনার কাণ্ড’ নামে পরিচিত ঐতিহাসিক ঘটনাটি ঘটে ১৮৫৬ সালের ২২ মে। এ ঘটনার ঠিক ২ দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে দাস অধিকারীদের তীব্র কটাক্ষ করে এক বক্তৃতা দেন সিনেটর চার্লস সামনার। তিনি ছিলেন গোঁড়া দাসপ্রথা বিরোধী। সেই বক্তৃতায় সিনেটের প্রতিনিধি প্রিস্টন ব্রুকসের দাস মালিক এক আত্মীয়কেও ছাড়েননি সামনার। এই কথা যখন ব্রুকসের কানে যায়, স্বভাবতই তিনি রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে যান। তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিল একটি বেতের লাঠি, এর উপরে ভর করে চলতে হতো তাকে। ক্ষুব্ধ ব্রুকস প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত হয়ে ঐ লাঠি দিয়েই আঘাত করা শুরু করে সামনারকে।
পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটে যে সামনারকে মৃতপ্রায় করে ছাড়ে ব্রুকস। ঘটনাটি আমেরিকান জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। মেরুকরণ ঘটে যায় গোটা জাতির মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথা বলবত থাকবে কি না তা নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড বেঁধে যায়। ব্রুকস-সামনারের এই কোন্দলকে বিবেচনা করা হয় ‘সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভাঙন’ হিসেবে, যার পরিপ্রেক্ষিতে দাসপ্রথা রদ থেকে আমেরিকার গৃহযুদ্ধ পর্যন্ত শুরু হয়ে যায়।
প্রেক্ষাপট
১৮৫৬ সালে চলছিল ‘রক্তাক্ত কানসাস’ সংকট। ১৮৫৪ সালের কানসাস-নেব্রাস্কা আইনে রাজ্যের অধিবাসীদের দাসপ্রথা সম্পর্কে নিজস্ব মতামত অনুসারে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়। এই আইনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৫৫ সালে কানসাসে রক্তক্ষয়ী সহিংস লড়াই শুরু হয়ে যায়। কানসাসের রক্তপাত নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত জনগণের উপর আরেক দফা আঘাত হানে সিনেটের এই কোন্দল। ১৮৫৬ সালে কানসাস সংকট চলমান সময়ে সামনার প্রকাশ্যে কানসাস-নেব্রাস্কা আইনের তীব্র ভর্ৎসনা করেন।
সে বছর মে মাসের ১৯ এবং ২০ তারিখে ‘কানসাস বিরোধী অপরাধ’ শীর্ষক দীর্ঘ এক বক্তৃতায় নিজের মতামত জানান তিনি। তিনি কানসাসকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়ার দাবী জানানোর পাশাপাশি ‘ক্রীতদাসের মালিকানা’র বিষয়টিকে অবৈধ ও অমানবিক বলে অভিহিত করেন। রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে দাসমালিকেরা তাদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালাতে পারে, তা নিয়ে সংশয় ছিল সামনারের মনে।
ক্ষমতা দখলের নগ্ন উল্লাসের বশবর্তী হয়ে ইতিহাসে ঘটে যাওয়া ট্র্যাজেডির সংখ্যা কম নয়। কানসাসে বলবৎ এই আইনকে সামনার কুমারী ধর্ষণের সাথে তুলনা দেন। দাস মালিকানার অপব্যবহার করে দাসপ্রথা টিকিয়ে রেখে মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষের সাথে জন্তুর মতো আচরণ করার এই জঘন্য নিয়মকে ভেঙেচুরে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। তার বক্তব্য থেকে এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, তিনি কানসাসকে দাসদের জন্য স্বাধীন একটি রাষ্ট্র হিসেবে উপহার দেয়ার পাঁয়তারা করছিলেন। দাসদের সন্তানরা যেন কারো গোলাম হয়ে না থাকে, সরকার গঠন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সব কাজে যেন তারাও সমানভাবে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায়- সেই লক্ষ্যেই কাজ করছিলেন সামনার।
বক্তৃতার একপর্যায়ে এই আইনের প্রণেতাকে আক্রমণ করে বসেন তিনি। ইলিনয়ের সিনেটর স্টিফেন এ ডগলাস এবং দক্ষিণ ক্যারোলিনার সিনেটর অ্যান্ড্রু বাটলার লিখেছিলেন এই আইন। সামনার তাদের কটাক্ষ করে বলেন, দক্ষিণ ক্যারোলিনার সিনেটর ছোটবেলা থেকে নাইট সম্প্রদায়ের উপর অসংখ্য বই পড়েছিলেন বলে মনে হচ্ছে। এসব বই পড়তে পড়তে নিজেকেও তিনি শৌর্য-বীর্য মণ্ডিত এক সম্মানিত নাইট বলেই ভেবে বসেছেন, যার রক্তে মিশে আছে দুঃসাহস আর সম্ভ্রমের ছটা মিশ্রিত আবেগ-অনুভূতি। অবশ্যই তিনি নিজের জন্য এমন একজন মিস্ট্রেস বা উপপত্নী বেছে নিয়েছেন যে বাকিদের কাছে কুৎসিত হলেও তার কাছে প্রেম ও সৌন্দর্যের দেবীর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। বাইরের দুনিয়ার কাছে যে ঘৃণ্য হলেও তার নয়নে যে সতী-গণিকাদের কথা বলছি আমি, দাসীদের কথা বলছি।
সেই দাসীদের জন্য তার রয়েছে অসীম ভালোবাসা। কিন্তু কামের লালসা মিটে যাওয়ার পর তাদেরকে লাথি মেরে তাড়িয়ে দিতেও কার্পণ্যবোধ করেন না তিনি। আমরা বরং মেয়েটাকেই দোষারোপ করি। তার চপলতা, কামুকতাই তো মতিভ্রষ্ট করেছে মাননীয় সিনেটরের। চারিত্রিক কোনো সংযমই নেই মেয়েটার। অমন দাবী নিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ালে আমাদের সিনেটর নিজেকে রুখবেন কেমন করে?
তার এই বক্তব্যে সামনার পরোক্ষভাবে বাটলারকে দাসপ্রথার ডন কুইক্সোট (স্পেনিশ রোমান্সের নায়ক) বলে অভিহিত করেছেন। তার উপর বাটলারের কথা বলার ক্ষমতা আর বাচনভঙ্গি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন সামনার, হৃদযন্ত্রের সাম্প্রতিক অসুবিধার জন্য কথা আটকে যেত তার। একটি কথাও বানিয়ে বলেননি সামনার, বিকৃত করেননি কোনো বিষয়। নীতিতে ছিলেন অটল, তুলে ধরেছেন অকাট্য সত্য। পুরো বক্তৃতায় সপ্রতিভ সামনারকে কেউ রুখতে পারেনি, কিন্তু বক্তৃতা দিয়ে বেরোনোর পর টের পেলেন তার জন্য অপেক্ষা করছে সাংঘাতিক এক পরিস্থিতি।
মনীষা সিনহার (২০১৩) ভাষ্যমতে, ডগলাস এবং বাটলার দুজনই খুব জঘন্যভাবে সামনারকে আক্রমণ করেন। তাদের তীর্যক বক্তব্য, উপেক্ষা আর উপহাসের বাণী ছিল মর্মান্তিক। পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাস বিরোধী আইন, কানসাস-নেব্রাস্কা আইন উভয়ক্ষেত্রেই সামনারের বিপক্ষে অবস্থানের বিষয়টিকে ভালোভাবে নেননি তারা কেউ। কিন্তু সামনার যখন কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের সাথে বাটলারের শারীরিক সম্পর্কের কথা প্রকাশ্যে তুলে ধরেন, তখন আর এই আক্রমণ ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের পর্যায়ে থাকে না। সে সময় অনেক দাস মালিকই নারী ক্রীতদাসদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতো, কিন্তু তাদের বিয়ে করতো না বা যথাযথ মর্যাদা দিতো না। দাসপ্রথা বিরোধীরা তাই ক্রীতদাসপ্রথা বিলোপের পাশাপাশি ভুক্তভোগী দাসীদের সাথে দাস মালিকদের আন্তঃবর্ণ বিয়ের ব্যবস্থা করতে বলেন। সামনার নিজেও এই ব্যবস্থার পক্ষপাতী ছিলেন।
এদিকে হফার (২০১০) বলেন, “এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, যৌনক্রিয়ার যে দৃশ্যকল্প এখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তাতে দুর্ঘটনাবশত বা জোরপূর্বক করা হচ্ছে এমন কিছু বলা হয়নি। দাসপ্রথা বিরোধীরা বারংবার দাস মালিকদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন। তাদের কথা অনুযায়ী দাসপ্রথা টিকিয়ে রাখার পেছনে অন্যতম প্রধান একটি কারণ তাদের যৌনকর্মে যথেচ্ছ ব্যবহার করার সুযোগ পাওয়া। সামনারের এই বক্তব্য শুনে ডগলাস মন্তব্য করেন, “এই গাধাটার উল্টোপাল্টা কথা শুনে কোনোদিন ওর মতোই এক বেকুব ওকে খুন করে বসবে””।
জনপ্রতিনিধি প্রিস্টন ব্রুকস ছিলেন বাটলারের কাজিন। প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত ব্রুকস পরবর্তীতে সামনারকে ডুয়েল লড়াইয়ের আমন্ত্রণ জানানোর পরিকল্পনা করেন। সহকর্মী ও দক্ষিণ ক্যারোলিনার প্রতিনিধি লরেন্স এম কেটের সাথে দ্বিপাক্ষিক এই লড়াইয়ের শিষ্টাচার বিষয়ক শলাপরামর্শ করেন। লরেন্স তাকে বলেন, ডুয়েলিং হলো ভদ্রলোকের লড়াই, কেবলমাত্র সমমর্যাদা সম্পন্ন দুজন মানুষের মধ্যেই এটি সম্ভব। সামনার তো পাঁড় মাতাল, বক্তৃতায় যেসব কথা সে বলেছে, তারপর এ বিষয়ে কারো আর কোনো দ্বিমত নেই। ব্রুকস জানান, সামনারকে যেহেতু ভদ্রলোকের পর্যায়ে ফেলা যাচ্ছে না, এত সম্মানের সাথে ডুয়েলে অংশগ্রহণ করা তাকে মানায় না। তার চেয়ে বরং ভরা মজলিশে বেতের লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার করলে তার ভালো একটা শিক্ষা হবে।
আক্রমণের দিন
এর ঠিক দুই দিন পর অর্থাৎ ২২ মের বিকেলে কিট এবং আরেক মিত্র কংগ্রেসম্যান হেনরি এ. এডমান্ডসনকে সাথে নিয়ে সিনেট চেম্বারে প্রবেশ করেন ব্রুকস। গ্যালারি খালি হওয়ার অপেক্ষা করছিল তারা, বিশেষত কোনো নারী যেন ব্রুকসের এই কুকর্মের সময় সেখানে উপস্থিত না থাকে তার জন্য জোরদার ব্যবস্থা নেয়া হয়। প্রায় জনশূন্য সিনেট চেম্বারে সামনারের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় ব্রুকস।
“আপনার বক্তব্য দুবার পড়লাম, মি. সামনার, বেশ মন দিয়েই পড়লাম। দক্ষিণ ক্যারোলিনার জনপ্রতিনিধি বাটলার সাহেবকে একদম ধুয়ে দিয়েছেন দেখছি। উনি কিন্তু আমার আত্মীয় হন,” নিচু গলায়, শান্ত স্বরে, ঘোষণার সুরে কথাগুলো বলল ব্রুকস। সামনার উঠে দাঁড়াতে যাবেন, এমন সময় হাতের লাঠিটি দিয়ে তার মাথায় উপর্যুপরি আঘাত করতে থাকে ব্রুকস। সামনারকে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর সুযোগও দেয়নি সে। সোনালি মাথার বেতের লাঠির আচমকা আঘাতে হতবিহ্বল সামনার কিছুক্ষণের জন্য দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
“চোখের সামনে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। না আমার সহকারীকে, না অন্য মানুষকে না, না কোনো জিনিসকে- কিছুই চিনতে পারছিলাম না। এরপর যা করেছি পুরোটাই অবচেতনভাবে করেছি, আত্মরক্ষার খাতিরেই করেছি,” পরবর্তীতে সেদিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে এভাবেই নিজের অবস্থান জানিয়েছেন সামনার।
মেঝেতে পড়ে গিয়ে ভারি ডেস্কের নিচে আটকে যান তিনি, মেঝের সাথে স্থায়ীভাবে আটকান সেই ডেস্কের ফাঁকফোকর থেকে বের হওয়ার রাস্তাও খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ডেস্কের পাশেই ছিল তার চেয়ার, ধাক্কা লেগে সামনে-পেছনে দুলছে ওটা। এমনিতেই বের হতে পারছিলেন না, তার উপর চেয়ারটা এমনভাবে পথ আটকে ছিল যে তিনি খুবই অসহায়বোধ করতে লাগলেন। কোনোমতে টালমাটাল পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই আবার মার শুরু করল ব্রুকস। গায়ের সব শক্তি একত্রিত করে এক টানে ডেস্কটাকে মেঝে থেকে আলাদা করে ফেললেন তিনি। ব্রুকসের সামনে ঢাল হিসেবে রাখার চেষ্টা করলেন ওটাকে, কিন্তু মাথা থেকে দরদর করে ঝরে পড়া রক্তে চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না।
দুই হাত বাড়িয়ে নিজেকে রক্ষার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি। ভাবছিলেন এবার যদি ব্রুকস তাকে নিস্তার দেয়। কিন্তু তার হিসেবে ভুল ছিল। এতে বরং ব্রুকসের সহজ শিকারে পরিণত হলেন তিনি। সর্বশক্তিতে তার মাথা, মুখ আর কাঁধে ক্রমাগত আঘাত করে যাচ্ছিল লোকটা, পৈশাচিক আনন্দে উদ্ভাসিত তার চোখমুখ। মারতে মারতে একসময় কট করে আওয়াজ তুলে ভেঙে গেল তার লাঠি। তাতেও নিরস্ত হলো না সে, হাতে ধরা থাকা সোনালি মাথাওয়ালা অংশটুকু দিয়েই মারতে লাগল সামনারকে। থর থর করে কাঁপছিলেন সামনার, খিঁচুনি উঠে যাচ্ছিল যেন। ‘ওহ ঈশ্বর!’ হাঁপাতে লাগলেন তিনি। আক্রমণের শেষপর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়েন। এক হাত দিয়ে তাকে চেপে ধরে আরেক হাত দিয়ে মারতে থাকে ব্রুকস, শয়তান ভর করেছে যেন তার উপর।
উপস্থিত বেশ কয়েকজন সিনেটর এবং প্রতিনিধি সামনারকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসতে চায়, কিন্তু তাদের পথরোধ করে দাঁড়ায় এডমান্ডসন। দর্শকদের উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বলে, ব্রুকস এবং সামনারকে যেন একা ছেড়ে দেয়া হয়। ব্রুকসের আরেক সঙ্গী কিট, এক হাতে নিজের ছড়ি আর আরেক হাতে পিস্তল উঁচিয়ে তারস্বরে আস্ফালন করতে থাকে। দুজন মিলে সবাইকে শাসায়, কেউ যেন সামনে আসার দুঃসাহস না দেখায়, অন্যথায় তাদের পিস্তলের সদ্ব্যবহার করতে হবে।
সিনেটর জন জে ক্রিটেন্ডেন মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেন। হাত জোড় করে ব্রুকসের কাছে অনুনয় করেন সামনারকে যেন মেরে না ফেলে। ক্রিটেন্ডেনের হয়ে কথা বলেন সিনেটর রবার্ট টুম্বস। কিটকে বলেন এই দুই গ্রুপের সাথে জড়িত নয় এমন কারো গায়ে যেন একটা আঁচড়ও না লাগে। টুম্বস অবশ্য পরে নিজের মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, সামনারকে নিয়ে তার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না। তিনি শুধু পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করতে এগিয়ে গিয়েছিলেন।
প্রতিনিধিদের মধ্যে অ্যামব্রস এস ম্যুরে এবং এডউইন বি. মরগ্যান শেষপর্যন্ত হস্তক্ষেপ করে ব্রুকসকে সামনারের কাছ থেকে আলাদা করে। চুপচাপ চেম্বার থেকে বিদায় নেয় ব্রুকস। তৎক্ষণাৎ সার্জেন্টকে ডেকে সামনারের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বলেন ম্যুরে। জ্ঞান ফেরার পর তাকে ধরে ধরে বিশ্রাম কক্ষে নিয়ে যায় বাকিরা। ভালো মতো চিকিৎসা চলে সামনারের, বেশ কয়েকটি সেলাই দিতে হয় মাথায়। স্পিকার নাথাল এবং সিনেটর হেনরি উইলসনের গাড়িতে করে বাড়িতে ফেরেন তিনি, সেখানেই চলে বাদবাকি চিকিৎসা।
ক্যাপিটল ত্যাগ করার আগে আরেক দফা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয় তাকে। চোখে ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছিলেন না বিধায় দরজার কোণায় ধাক্কা খেয়ে ডান চোখে আবারও আঘাত পান তিনি। এই পুরো ঘটনার জন্য গ্রেপ্তার করা হয় ব্রুকসকে। যে লাঠির সাহায্যে সামনারকে মেরেছিল ব্রুকস, সেটা খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়। সিনেট চেম্বারের মেঝেতে পড়ে ছিল সামনারের রক্ত লেগে থাকা সেই খণ্ডিত অংশগুলো। লাঠির সেই সোনালি মাথাসহ আরও কিছু অংশ এডমন্ডসনের কাছে ছিল, ওগুলো সার্জেন্ট অ্যাডাম জনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। লাঠির সোনালি মাথাটি পরে বোস্টনের ‘ওল্ড স্টেট হাউজ মিউজিয়ামে’ জায়গা পায়। এডমন্ডসনসহ ব্রুকসের পক্ষের কয়েকজন তার সাথে একাত্মতা জানাতে লাঠির ভাঙা অংশ দিয়ে লকেট বানিয়ে পরতো।
পরিণতি
আমেরিকা যে কত খণ্ডে বিভক্ত হয়ে গেছে তারই একটি প্রমাণ এই কোন্দল। উত্তরাঞ্চলের জনগণের কাছে সামনার হয়ে গেলেন বীরত্বের প্রতীক, দক্ষিণাঞ্চলে এই উপাধি পেল ব্রুকস। সিনসিনাটি গ্যাজেটে প্রকাশিত একটি সংবাদ অনুযায়ী, ‘দক্ষিণীয়রা কোথাও বাকস্বাধীনতা সহ্য করতে পারতো না। ওদের পক্ষে সম্ভব হলে ওয়াশিংটনে রামদা-পিস্তল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তো, যেমনটা করছে কানসাসে। ওদের নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ আর লুটতরাজে জ্বলছে কানসাস’।
নিউ ইয়র্ক ইভনিং পোস্টের সম্পাদকীয়তে আসা এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘দক্ষিণাঞ্চলের দাস মালিকরা তাহলে দাসপ্রথার বিরুদ্ধে যারা কথা বলে তাদেরও দাসের মতোই মনে করবে? তাদের গায়ে যেমন যখন তখন হাত তোলা যায়, দাসপ্রথা বিরোধীদেরও সেই কাতারেই ফেলবে? তাদের সন্তুষ্ট করার জন্য কি এখন ন্যায়ের পক্ষে কথা বলা বন্ধ করে দিতে হবে?’
বোস্টন, অ্যালবেনি, ডেট্রয়েট, নিউ হ্যাভেন, নিউ ইয়র্ক এবং অন্যান্য প্রদেশে সামনারের পক্ষ নিয়ে লাখো জনতা একত্রিত হয়, র্যালি বের করে। সামনারের বক্তৃতার লাখ লাখ কপি বিক্রি হয়। মারামারির এই ঘটনার দুই সপ্তাহ পরে, রালফ ওয়াল্ড এমারসন পুরো ঘটনাটি এভাবে বিবৃত করেন- “আমি বুঝতে পারছি না একটি সভ্য সম্প্রদায় আর আরেকটি অসভ্য সম্প্রদায় কীভাবে এক রাজ্যে অবস্থান করবে? হয় আমাদের দাসপ্রথা বন্ধ করতে হবে, নাহলে নিজেদের স্বাধীন জাতি হিসেবে পরিচয় দেয়ার কোনো অধিকার আমাদের নেই।”
উল্টোদিকে ব্রুকসের পক্ষ নিয়ে প্রশংসার বানে ভাসতে থাকে দক্ষিণাঞ্চলের পত্রিকাগুলো। ‘দ্য রিচমন্ড এনকোয়ারার’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়, সামনারকে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা এভাবে পেটানো উচিত। আক্রমণটিকে ধারণাগত দিক থেকে ভালো, উপস্থাপনের দিক থেকে আরও ভালো এবং তাৎপর্যের দিক থেকে সর্বোৎকৃষ্ট হিসেবে ঘোষণা দেয় তারা। দক্ষিণ থেকে শত শত লাঠি উপহার হিসেবে পাঠানো হয় ব্রুকসের বাড়িতে। সাথে ছিল একটি সংক্ষিপ্ত চিরকুট- ‘আবার মারো ওকে’।
এবার জনপ্রতিনিধি অ্যানসন বার্লিঙ্গেম জনসম্মুখে ব্রুকসকে অপমান করে। বুমেরাংয়ের মতো ডুয়েল চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় তার দিকে। সামনারকে ঘায়েল করার জন্য ব্রুকস যেমন ডুয়েলের পরিকল্পনা করেছিল, তার জন্য এবার ঠিক একই পদ্ধতি খুঁজে বের করে বার্লিঙ্গেম। কানাডার নায়াগ্রা জলপ্রপাতের পাশে এই ডুয়েলের আয়োজন করে সে। মাথা গরম মানুষ হিসেবে কুখ্যাত বার্লিঙ্গেমের সাথে ডুয়েল লড়াইয়ে যাওয়ার সাহস ব্রুকসের ছিল না। কাজেই যুক্তরাষ্ট্রের ডুয়েল বিরোধী আইনের দোহাই দিয়ে সে যাত্রা বার্লিঙ্গেমের প্রস্তাব নাকচ করে দেয় সে।
সিনেটর হেনরি উইলসনকে রীতিমতো হুমকি দেয় ব্রুকস, ম্যাসাচুসেটসে সামনারের সহকর্মী ছিলেন হেনরি। তিনি ব্রুকসের এই কাণ্ডকে ‘পাশবিক, খুনে এবং কাপুরুষোচিত’ বলে আখ্যা দেন। তার প্রতিবাদে হেনরিকে এবার ডুয়েলের চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসে ব্রুকস। হেনরিও তেমনি আইনের কথা বলে পাশ কাটিয়ে যায় ব্রুকসকে। তাছাড়া ব্যক্তিগতভাবে এমন ছোটলোকের সাথে ডুয়েল কেন, তার চেহারা দেখারও কোনো আগ্রহ নেই বলে সাফ জানিয়ে দেন। ব্রুকসের লাগাতার হুমকি উপেক্ষা করে দিব্যি সিনেটে নিজের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি।
এক রিপাবলিকান পার্টিকে ছোট ছোট দলে বিভক্ত করতে ব্রুকসের এই জঘন্য কাণ্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল বলে জানান ইতিহাসবেত্তা উইলিয়াম জিনেপ। দক্ষিণীরা সামনারকে নিয়ে নানা রকম বিদ্রূপ করতে থাকে। তারা বলে বেড়ায় সামনার নাকি আহত হওয়ার অভিনয় করছে। এদিকে মস্তিষ্কে গুরুতর আঘাত পাওয়া সামনারের যাবতীয় ট্রমা কাটিয়ে উঠতে লেগে যায় প্রায় ৩ বছর। বছর তিনেক পরে সিনেটে ফিরে আসেন তিনি। এদিকে ব্রুকস দাবী করে, সামনারকে হত্যা করার কোনো উদ্দেশ্য তার ছিল না, নাহলে লাঠি নিয়ে কেন তাকে আক্রমণ করবে সে, ছুরি-রামদা নিয়েই তো আসতে পারতো। কলোম্বিয়ার আদালতে ব্রুকসের এসব কোনো কথা ধোপে টেকেনি, তাকে ৩০০ ডলার জরিমানা করা হয়।
জুলাইয়ের ১৫ তারিখে সিনেট থেকে পদত্যাগ করে ব্রুকস। এর কিছুদিন পরেই ১৮৫৬ সালের ১ আগস্টে বিশেষ এক নির্বাচনের মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিনিধিরা ব্রুকসকে আবার সিনেটে ফিরিয়ে আনে। কিন্তু নতুন মেয়াদে সিনেটে যোগদান করার আগেই ক্রুপ নামক শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় সে। তার সঙ্গী কিটকে হাউজ থেকে বাজেয়াপ্ত করা হয়। ১৮৫৬ সালের নির্বাচনে ‘রক্তাক্ত কানসাস’ এবং ‘রক্তাক্ত সামনার’ নামক ক্যাম্পেইন বের করে রিপাবলিকান পার্টির দাসপ্রথা বিরোধী অংশ। ১৮৫৯ সালে জন ব্রাউনও কানসাসে দাসপ্রথার সপক্ষে অবস্থান নিয়ে ব্রুকসের মতো সমালোচনার শিকার হন। দাসপ্রথার পক্ষে-বিপক্ষের এই তর্ক-বিতর্ক শেষ পর্যন্ত গৃহযুদ্ধের দিকে গড়ায়।