ড্রাগন বা ইউনিকর্নের মতো ডাইনোসর রূপকথার রঙিন জগত থেকে উঠে আসা কোনো প্রাণী নয়। আজ থেকে চব্বিশ কোটি বছর পূর্বে আবির্ভূত হওয়া দৈত্যাকৃতির এই জীব প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবীকে একচ্ছত্রভাবে চার কোটি বছর যাবত শাসন করেছে। আধুনিক বিজ্ঞানের কারসাজিতে সেলুলয়েডের পর্দায় ডাইনোসরের অনুমিত প্রতিচ্ছবি দেখলে যারপরনাই অবাক হতে হয়। অনেক প্রজাতির ডাইনোসর লম্বায় ৪০ ফুট এবং ওজনে প্রায় ৯ টন পর্যন্ত হতো। তাদেরকে টেক্কা দেওয়ার সাধ্য কার? তবে আদিম পৃথিবীতে ডাইনোসর বাদেও এমন কিছু প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল, যারা ডাইনোসরকে খেয়ে ফেলার ক্ষমতা রাখত। প্রাগৈতিহাসিক কালের এমন বিচিত্র সব প্রাণীর সমাহার নিয়েই আজকের এই আয়োজন।
ডেইনোসুকাস
৭৫-৮২ মিলিয়ন বছর পূর্বে জল ও স্থলভাগ দাপিয়ে বেড়ানো ৩৫ ফুট লম্বা প্রাগৈতিহাসিক এই কুমির প্রজাতি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গড়পড়তায় প্রায় ৪,০০০ কেজি ওজনের এই হিংস্র প্রাণীর বসবাস ছিল মূলত উত্তর আমেরিকায়। তৃণভোজী যেসব ডাইনোসর নদীর কূলে ঘেঁষত, তাদের বেশিরভাগের সম্ভাবনা ছিল ডেইনোসুকাসের পেটে চালান হওয়ার।
ডেইনোসুকাসের দাঁতে হার্ডোসরদের হাড়ের চিহ্নের সন্ধান পেয়েছেন জীবাশ্মবিদেরা। তবে, দানবাকৃতির কুমিরগুলো সরাসরিই হার্ডোসরদের খেয়ে ফেলত, না-কি হার্ডোসরদের মৃত্যুর পর তাদের হাড় চিবিয়ে খেত, সে বিষয়টি বিজ্ঞানীদের নিকট এখনো অজানা। তবে ডেইনোসুকাসেরা পূর্ণবয়স্ক টায়রানোসোরদের আক্রমণ করত বলে জীবাশ্মবিদদের কাছে প্রমাণ রয়েছে। ডেইনোসুকাস যদি প্রাচীনকালে ডাইনোসর শিকার করেও থাকত, তবে তাদের শিকার পদ্ধতি আজকের কুমিরদের মতো হবার সম্ভাবনাই বেশি। প্রথমে শিকারকে টেনে জলে নিয়ে যাওয়া, এরপর শিকারকে জলে ডুবিয়ে শ্বাস রোধ করে হত্যা করা।
রেপেনোম্যামাস
আজ থেকে প্রায় ১৩০ মিলিয়ন বছর পূর্বে, প্রাক-ক্রিটেশিয়াস যুগে ছিল রেপেনোম্যামাসদের বিচরণ। সেসময় দুই প্রকার প্রাক-ক্রিটেশিয়াস স্তন্যপায়ী প্রজাতি যথাক্রমে ‘R. robustus‘ এবং ‘R. giganticus‘ এর ওজন হতো প্রায় ২৫-৩০ পাউন্ডের কাছাকাছি। মজার ব্যাপার হলো, সর্বভুক এই স্তন্যপায়ীদের খাদ্যতালিকায় ছিল বাচ্চা ডাইনোসরও। ২০০৫ সালে ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত এক পেপারে দেখা যায়, চীনে পাওয়া এক ‘R. robustus‘ এর জীবাশ্ম বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সেটি একটি সিটাকোসোরাস ভক্ষণ করেছিল। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, তাদের খাদ্য তালিকায় ছোটখাট স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ, মাছ, অমেরুদণ্ডী ছাড়াও ডাইনোসর অন্তর্ভুক্ত ছিল।
কোয়েট্জআলকোটলাস
ক্রিটেশিয়াস যুগের শেষভাগে পৃথিবীতে বিচরণ করা টেরোসর কোয়েট্জআলকোটলাসদের অস্তিত্ব ছিল ৭০-৬৬ মিলিয়ন বছর পূর্বে। পৃথিবীর ইতিহাসে আকাশের বুকে ডানা মেলে উড়ে বেড়ানো প্রাণীদের মধ্যে কোয়েট্জআলকোটলাস ছিল আকারে অন্যতম বৃহৎ। তাদের ডানা লম্বায় ছিল প্রায় ৩৩-৩৬ ফুট, যার সাথে আজকের যুগের কোনো পাখি বা বাঁদুরের তুলনা-ই চলে না। লম্বা দাঁত-বিহীন চঞ্চু তাদেরকে দক্ষ শিকারি হিসেবে অনন্যভাবে গড়ে তুলেছিল।
প্রায় ৫০০-৬০০ পাউন্ড ওজনের এই টেরোসররা সত্যি সত্যি ডাইনোসর ভক্ষণের সাথে জড়িত ছিল কি-না, তা নিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। যেহেতু তারা ছিল মাংসাশী প্রাণী, তাই তাদের আহার তালিকায় মাছ, সরীসৃপ, এবং প্রাণীদের সাথে ছোটখাট ডাইনোসর থাকলেও থাকতে পারে। পৃথিবীতে যখন লেট ক্রিটেসাস পিরিয়ড চলমান, তখন পৃথিবীতে ছিল বৃহৎ ডাইনোসরদের আধিক্য। সুতরাং, ছোটখাট আকারের জীবিত ডাইনোসর অথবা বৃহৎ হলেও মৃত ডাইনোসরকে পেটে চালান দিত কোয়েট্জআলকোটলাস।
ক্রিটোক্সিরিনা
কোয়েট্জআলকোটলাসের মতো এই ক্রিটোক্সিরিনাও লেট ক্রিটেশিয়াস যুগের প্রাণী। ১০০ মিলিয়ন থেকে ৮২ মিলিয়ন পূর্বে ছিল পৃথিবীতে এদের বসবাস। অতি ধারালো ও তীক্ষ্ণ দাঁত দিয়ে তারা তাদেরকে শিকারকে পিষে ফেলতে পারত নিমিষেই। পরিপূর্ণ ফসিল পাওয়া যায়নি বলে এদের আয়তন সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা একেবারে নিখুঁত তথ্য প্রদান করতে পারেননি। তবে বর্তমান কালের হাঙর এবং এদের দাঁতের জীবাশ্ম থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে জীবাশ্মবিদেরা অনুমান করেছেন, এরা লম্বায় ২৬ ফুট এবং ২-৩ টন ওজনের হতে পারত। এদের খাদ্য তালিকার সাধারণ কিছু জিনিস হলো কচ্ছপ, মাছ, ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী। যেহেতু ডাইনোসর ছিল স্থলজ প্রাণী, তাই এমন কোনো জীবাশ্মভিত্তিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি যেখানে উঠে এসেছে ক্রিটোক্সিরিনার ডাইনোসর ভক্ষণের কেচ্ছা। তবে দেহের আকার ও মুখের গড়ন অনুযায়ী সে ছোট কিংবা মাঝারি ধরণের ডাইনোসরকে সে খেয়ে ফেলার ক্ষমতা রাখত।
সানাজেহ
এই তালিকায় স্থান পাওয়া সর্পকুল থেকে একমাত্র প্রতিনিধি হচ্ছে সানাজেহ। হয়তো টাইটানোবোয়ার মতো প্রাগৈতিহাসিক আলোচনায় তারা চূড়ান্ত স্থান দখল করে নিতে পারেনি, কিন্তু কিছু বৈশিষ্ট্য তাদেরকে বানিয়েছে অনন্য। ৬৭ মিলিয়ন বছর পূর্বে লেট ক্রিটেসাস যুগে নিজের আঁকাবাঁকা চিহ্ন পৃথিবীর মাটিতে রেখে গেছে সানাজেহ নামক সাপের এই গণ। ৩ মিটার লম্বা এই সাপের জীবাশ্ম উদ্ধার করা হয়েছে ভারত থেকে। তারা খুঁজে খুঁজে টাইটানোসরের বাসা বের করত, যেগুলোতে ডাইনোসরের ডিম পাওয়া যাবে। তারপর ডিম থেকে ডাইনোসরের বাচ্চা বের হওয়া মাত্রই তাদের খপ করে মুখে পুরে দিত।
ডিডেলফোডন
আজ থেকে প্রায় ৬৬ মিলিয়ন বছর পূর্বে পৃথিবীতে অস্তিত্ব ছিল ডিডেলফোডন নামক মাংসাশী স্তন্যপায়ীর। তারা ছিল মেটাথেরিয়ান নামক এক স্তন্যপায়ী দলের অংশবিশেষ, যারা আজকের মারসুপিয়ালদের (ক্যাঙারু) পূর্বপুরুষ। তীক্ষ্ণ- ধারালো দাঁত দিয়ে তারা ছোট ও মাঝারি আকারের মেরুদণ্ডী প্রাণীদের চিবিয়ে ফেলত। যদিও তাদের ডাইনোসর ভক্ষণের কোনো জীবাশ্মভিত্তিক প্রমাণ নেই, তবুও যুক্তি দিয়ে উপসংহারে আসা যায় তারা সদ্য জন্মানো ডাইনোসর ছানাকে খেয়ে ফেলতে পারত।
মোসাসোরাস
৭০-৬৬ মিলিয়ন বছর পূর্বের দানবাকৃতির এই সামুদ্রিক প্রাণী মোসাসোরাস ৫০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারত। সুঠাম দেহ, শক্তিশালী চোয়াল, এবং ধারালো দাঁত থাকার ফলে তাদেরকে সমুদ্রের বহু প্রাণীই এড়িয়ে চলত। জল দাপিয়ে বেড়ানোর কারণে ডাইনোসরের সাথে এদের সরাসরি সাক্ষাৎ হতো না। কিন্তু ঝড়, বন্যা, কিংবা পরিযানের সময় কোনো ডাইনোসর জলের সংস্পর্শে এলেই মোসাসোরাস ছিল ডাইনোসরের নিকট এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম।
ফিতাকৃমি
ডাইনোসর যে শুধু তার চেয়ে আকারে বড় কোনো প্রাণীর হাতে শিকারে পরিণত হত, বিষয়টা সবসময় এমন নয়। এর বিপরীত কিছু ঘটনাও দেখা যেত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রাগৈতিহাসিক ফিতাকৃমির কথা। সম্প্রতি মাংসাশী এক ডাইনোসর গণের জীবাশ্ম হয়ে যাওয়া মল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তাদের পাকস্থলীতে নেমাটোড, ট্রেমাটোড অর্থাৎ শত ফুট লম্বা ফিতাকৃমির অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। তবে এই ফিতাকৃমি ডাইনোসরকে বাহক হিসেবে ব্যবহার করে তাকে অসুস্থ করে দিত, নাকি তার সাথে মিথোজীবী হিসেবে বাস করত, সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না।
গুবরে পোকা
অন্যান্য সকল প্রাণীর মতো ডাইনোসরও মৃত্যুর পর ব্যাকটেরিয়া, কৃমি, পোকা ইত্যাদির সাহায্য মাটিতে বিয়োজিত হতো। এদের মধ্যে পরিচিত এক পোকা হলো ‘বোন-বোরিং বিটল‘ নামে এক হাড়খেকো গুবরে পোকা।
এই পোকারা মাংসের চেয়ে হাড়ের প্রতি আকৃষ্ট হয় বেশি। প্রথমে তারা মৃত ডাইনোসরের হাড়ের ছিদ্রে ডিম পাড়ত, তারপর এগুলো থেকে লার্ভা বের হয়ে তা হাড়ের পুষ্টি সমৃদ্ধ হাড়ের মজ্জা খাওয়া শুরু করত। ফলে অল্প সময়ে হাড় ভেঙে মাটির সাথে অতি সহজেই মিশে যেত।