আজ থেকে প্রায় আশি বছর আগেকার কথা। ১৯৩৩ সালে রোমানিয়ার খিসিনাউয়ে এক ইহুদি পরিবারে জন্ম নেয় এক ছেলে, নাম তার এলিয়াহু ইৎজকোভিৎজ। বাচ্চা ছেলেটির পরিবারের আগে কেন তার ধর্মবিশ্বাসের কথা জুড়ে দিলাম সেটি বোঝা যাবে একটু পরেই। পৃথিবীর আলো-বাতাসে বাবা-মা আর তিন ভাইয়ের সংসারে একটু একটু করে বড় হচ্ছিলো আমাদের আজকের ইতিহাসের গল্পের নায়ক এলিয়াহু।
সুখের শৈশব বলতে যা বোঝায়, সেটি পাওয়ার সৌভাগ্য ছোট্ট এলিয়াহুর হয় নি। কারণ তার জন্মের মাত্র ছয় বছরের মাথায় শুরু হয়ে যায় ২য় বিশ্বযুদ্ধ। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গার ইহুদিদের মতো দুর্ভাগ্যের কালো ছায়া নেমে আসে এলিয়াহুর পরিবারের ভাগ্যাকাশেও। তাদের পরিবারের সবাইকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো স্থানীয় এক কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে।
বন্দী আরো অনেকের মতোই নিদারুণ নির্যাতনের যাতাকলে পিষ্ট হচ্ছিলো তাদের জীবন। একসময় কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিলো এলিয়াহুর পরিবারকে এ নির্যাতন থেকে মুক্তি দেয়ার। তাই একদিন বাবা-মা এবং তিন ভাইকে খুন হয়ে যেতে দেখলো বাচ্চা ছেলেটি। তার কান্নায় চারপাশ ভারি হয়ে উঠলেও সেদিকে চোখ ফেরানোর সময় যে কারো ছিলো না। ছোট্ট এলিয়াহুর চোখের জল একসময় শুকিয়ে গেলো, শুকালো না কেবল বুকের মাঝে তৈরি হওয়া গভীর ক্ষতটি। আফসোস, ছোট্ট এ ছেলেটিকে এমন নির্মম স্মৃতি নিয়েই কাটাতে হবে বাকিটা জীবন।
সেদিন নিজের পরিবারকে এভাবে শেষ হওয়ার কষ্ট যেমন ছেলেটি ভুলতে পারে নি, তেমনি সে ভুলে যেতে পারে নি তার পরিবারের হন্তারক লোকটিকেও, যে কিনা পাশবিক আনন্দ নিয়ে একে একে পাঁচটি জীবন শেষ করে দিয়েছিলো। খোঁজ নিয়ে এলিয়াহু জানতে পারলো যে, এ লোকটির বাড়ি রোমানিয়াতেই, নাম স্তানেস্কু। তার বাসা এলিয়াহুর শহর থেকে খুব একটা দূরে না। এমন এক খবর পেয়ে প্রতিশোধের নেশা পেয়ে বসলো তাকে। ছোট হলে কী হবে, প্রতিশোধের এক দৃঢ় প্রতিজ্ঞাই নিয়ে নিলো সেদিনের সেই ছোট্ট এলিয়াহু।
১৯৪৪ সালে সেই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি মেলে এলিয়াহুর। ততদিনে সে যেন এক জীবন্ত কঙ্কালে পরিণত হয়েছে। মুক্তি পেয়েই শুরু হয়ে যায় এলিয়াহুর মিশন। স্তানেস্কুকে শহরের অলিগলিতে তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াতে লাগলো সে। স্তানেস্কু বুঝতে পেরেছিলো যে, সে যেসব বন্দীর উপর অত্যাচার চালিয়েছিলো, তাদের আত্মীয়েরা হয়তো প্রতিশোধ নিতে তার সন্ধানে আসতে পারে। তাই যুদ্ধের পর নিজের শহরে সে আর ফিরে আসে নি। তবে স্তানেস্কুকে না পেলেও তার ছেলেকে ঠিকই পেয়ে যায় এলিয়াহু। ফলে তার উপরই নিজের মনের মাঝে পুষে রাখা ক্ষোভটা ঝাড়ে সে, ছুরিকাঘাত করে বসে স্তানেস্কুর সেই ছেলেকে। ভাগ্য মন্দ ছিলো বেচারা এলিয়াহুর, ধরা পড়ে যায় সে পুলিশের হাতে। ১৯৪৭ সালে রোমানিয়ার এক আদালত তাকে পাঁচ বছরের জন্য এক কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়। আচ্ছা, এলিয়াহু কি আসলেই সংশোধিত হতে পেরেছিলো? প্রশ্নের উত্তরটি পেতে চলুন এলিয়াহুর সাথেই এগিয়ে যাওয়া যাক।
১৯৫২ সালে মুক্তি মেলে এলিয়াহুর। ততদিনে সে ১৯ বছরের টগবগে এক তরুণ। মুক্তির পর সে কমিউনিস্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে চলে যায় ইসরায়েলে। ১৯৫৩ সালে ইসরায়েলী সেনাবাহিনীতে একজন প্যারাট্রুপার হিসেবে যোগ দেন তিনি। সেনাবাহিনীর কঠোর নিয়মকানুন আর প্রশিক্ষণের মাঝে নিজের দুঃখের বোঝাটা কিছুটা হলেও হালকা হয় তার। সেখানকার জীবনটা ছিলো একেবারেই আলাদা। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসা ইহুদীদের এক মিলনমেলায় যেন পরিণত হয়েছিলো প্রশিক্ষণ ক্যাম্পগুলো। এলিয়াহুও কিছু রোমানিয়ান বন্ধু জুটিয়ে নিয়েছিলেন। অবসর সময়ে তারা সবাই নিজেদের সুখ-দুঃখের আলাপ করতো। এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো যুবক এলিয়াহুর দিনগুলো।
এমনই এক গল্পের আসরে একদিন এমন এক ঘটনা ঘটে যা বদলে দেয় এলিয়াহুর জীবনের গতিপথ। ক্যাম্পে নতুন আসা একজন সেদিন জানায় যে, সে শুনেছে রাশিয়ানদের হাতে ধরা পড়ার আগেই স্তানেস্কু পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। সে আশ্রয় নিয়েছিলো পশ্চিম জার্মানিতে। এরপর সেখান থেকে অফেনবার্গে ফ্রেঞ্চ জোনে চলে যায় সে। সেখানে গিয়ে ফ্রেঞ্চ ফরেন লিজিয়নে নাম লেখায় স্তানেস্কু। এরপর সেখান থেকে ইন্দোচায়নায় ফ্রান্সের পক্ষে লড়াই করতে চলে যায় সে।
এখানে উল্লেখ্য, ফ্রেঞ্চ ফরেন লিজিয়ন হলো ফ্রান্সের সেনাবাহিনীরই একটি শাখা যেখানে বিদেশীরা যোগ দিয়ে ফরাসী সশস্ত্র বাহিনীতে কাজ করে থাকে। আর ইন্দোচায়না বলতে বর্তমান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে বোঝায়। এ অঞ্চলের মাঝে আছে মায়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম এবং মালয়শীয় কিছু উপদ্বীপ।
আগন্তুকের কাছ থেকে এমন তথ্য পেয়ে বুকের ভেতর ছাইচাপা আগুন যেন আবারো নতুন করে জ্বলে ওঠে এলিয়াহুর। পরদিনই নিজের লক্ষ্য স্থির করে ফেলেন তিনি। কমান্ডিং অফিসারকে গিয়ে জানান যে, তিনি ইসরায়েলী নৌবাহিনীতে যোগ দিতে চান। কিছুদিন পরই তার আবেদনটি মঞ্জুর হয়ে যায় এবং তিনি হাইফায় অবস্থিত রণতরীতে যোগ দিতে বেরিয়ে পড়েন। কয়েক মাস পর ইতালি থেকে কিছু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আনতে রওনা হয় তার জাহাজটি। জাহাজটি জেনোয়ায় পৌঁছলে এলিয়াহু কিছুক্ষণের জন্য ডাঙায় ঘুরে আসার অনুমতি চান। কিন্তু একবার নেমে আর পিছু ফিরে চান নি তিনি। বরং সেখান থেকে ট্রেনে চেপে সোজা চলে যান বোর্দিঘেরায় এবং তারপর যান ফ্রান্সের মেন্টনে। এর তিন দিন পর তিনি রওনা হয়ে যান আলজেরিয়াতে অবস্থিত ফ্রেঞ্চ ফরেন লিজিয়নের হেডকোয়ার্টারের উদ্দেশ্যে। সেখানে যোগ দেয়ার পর শুরু হয় বিভিন্ন প্রশিক্ষণ। এসব প্রশিক্ষণ শেষ করে তিন মাস পর এলিয়াহু যাত্রা করেন ইন্দোচায়নার উদ্দেশ্যে, যেখানে ছিলেন তার বাল্যশত্রু স্তানেস্কু!
একবার সেখানে পৌঁছাবার পর স্তানেস্কুকে খুঁজে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না তার। যদিও প্রতিটি ইউনিটই বিভিন্ন দেশের সৈন্যদের সমন্বয়ে গঠন করা হতো, তবে একটি ইউনিটে থাকা একই দেশের অধিবাসীরা সাধারণত ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে গল্পগুজব করতো। তাই ধৈর্য ধরে কিছুদিন খোঁজ করার পর ১৯৫৪ সালে স্তানেস্কুর খোঁজ পেয়ে যান এলিয়াহু, তিনি আছেন ৩য় ফরেন লিজিয়ন ইনফ্যান্ট্রিতে। কেউ যদি নিজের বন্ধুর সাথে থাকার জন্য নিজের অবস্থান পরিবর্তন করতে চাইতো, তাহলে কর্তৃপক্ষ থেকে কোনো আপত্তি তোলা হতো না। তাই এলিয়াহু যখন স্তানেস্কুর ব্যাটালিয়নে বদলীর জন্য আবেদন করলেন, তার সেই আবেদনও মঞ্জুর করা হলো।
দশ বছর পর নিজের পরিবারের হত্যাকারীকে দেখতে পেলে আপনি কী করতেন বলুন তো? সাথে সাথেই তাকে শেষ করে দেয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তেন কি? হয়তো হ্যাঁ, অথবা না। এলিয়াহু দ্বিতীয় পথটি ধরেছিলেন। তিনি বরং বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেন স্তানেস্কুর দিকে। নিজের পূর্ব সামরিক দক্ষতার বলে খুব সহজেই স্তানেস্কুর নজর কেড়ে নিতে সক্ষম হন যুবক এলিয়াহু। তাদের মাঝে বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ এক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
ওহ্, একটা কথা তো বলাই হয় নি। এলিয়াহু স্তানেস্কুকে এক দশকের ব্যবধানে চিনতে পারলেও স্তানেস্কু কিন্তু তাকে একেবারেই চিনতে পারেন নি…
এরপর একদিন এলো সেই সুবর্ণ সুযোগ। শত্রুপক্ষ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে রাস্তার পাশে ঝোপের আড়াল দিয়ে এগোচ্ছিলেন এলিয়াহু ও স্তানেস্কু। হঠাৎ করেই প্রায় একশ গজ দূর থেকে তাদের দিকে গুলি করে বসে শত্রুপক্ষ। সাথে সাথেই শুয়ে পড়েন দুজনই। তাদের থেকে কিছুটা দূরেই দলের অন্য সদস্যরা থাকায় কিছুটা নিশ্চিন্ত ছিলেন দুজনই। এলিয়াহু ছিলেন স্তানেস্কুর পেছনে। ফরেন লিজিয়নে এসে নিজের নাম পাল্টে ফেলেছিলেন স্তানেস্কু। তাই পেছন থেকে যখন এলিয়াহু হঠাৎ করে তাকে আগের নাম ধরে ডাক দিলেন, তখন তার বিস্ময়ের সীমা রইলো না। এলিয়াহু অবশ্য না থেমে রোমানিয়ান ভাষায় বলে যেতে লাগলেন, “তুমিই স্তানেস্কু, তাই না?”
“হ্যাঁ, কিন্তু…”, কোনোভাবেই যেন এলিয়াহুর কাছে এভাবে নিজের আসল পরিচয় প্রকাশ পেয়ে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছিলেন না স্তানেস্কু।
এবার ভরাট কণ্ঠে গর্জে উঠলেন এলিয়াহু ইৎজকোভিৎজ, “স্তানেস্কু, আমি খিসিনাউয়ের একজন ইহুদি”। এরপরই তার হাতে থাকা MAT-49 মডেলের টমি গানটি গর্জে উঠে ঝাঁজরা করে দেয় স্তানেস্কুর বুক। ঠান্ডা হয় এলিয়াহুর মনের গভীরে এতদিন ধরে জ্বলা আগুন, পূর্ণ হয় তার মিশন।
ফ্রেঞ্চ ফরেন লিজিয়নে বাকি দিনগুলো নির্বিঘ্নেই কাটান এলিয়াহু। সবাই ভেবেছিলো সেদিন প্রতিপক্ষের গুলিতেই মারা গেছেন স্তানেস্কু। এখানকার মেয়াদকাল শেষ করে এলিয়াহু সোজা চলে যান প্যারিসে অবস্থিত ইসরায়েলী দূতাবাসে। সেখানে অবস্থান করা সেনা কর্মকর্তার কাছে নিজের বাহিনী ছেড়ে চলে যাওয়ার অপরাধ স্বীকার করে আত্মসমর্পন করেন তিনি। তার দাবির সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার পর বিচারের জন্য তাকে পাঠানো হয় ইসরায়েলে। সেখানে বিচারে অপরাধী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত হন তিনি। তবে সশস্ত্র বাহিনী ছেড়ে যাবার পেছনে তার অতীত ইতিহাসের কথা বিবেচনা করে তাকে এক বছরের বন্দীত্বের সাজা দেয়া হয়।