“নুন খায় যার গুণ গায় তার”- সেই ছোটবেলা থেকেই এই প্রবাদটির সাথে আমরা কম বেশি সবাই পরিচিত। কথায় কথায় এই উক্তি কতবার যে আমরা ব্যবহার করেছি তার কোন ইয়ত্তা নেই। সাথে আছে এক রাজার সেই তিন মেয়ের গল্প। যে গল্পে রাজার ছোট মেয়ে রাজাকে ‘নুনের’ মত ভালবাসে শুনে রাজ্য থেকে বিতাড়িত করে দেন। পরবর্তীতে এক বনের মধ্যে ক্ষুধার্ত রাজা নিজের মেয়ের হাতের বানানো খাবার খেয়ে পুনরায় পুত্রিকে বুকে জড়িয়ে নেয়ার গল্প আজ আর কারও অজানা নয়। আরব্য রজনী ‘আলি বাবা আর চল্লিশ চোরে’ও লবণ নিয়ে আছে এক গল্প। চল্লিশ ডাকাতের সর্দার যখন কারও বাড়িতে ডাকাতি করতে যেত, তখন সে নাকি ঐ বাড়ির বাড়তি নুন খেতে অস্বীকার করত। কারণ নুন খেলে নাকি সে আর নেমক হারামি (বিশ্বাসঘাতকতা) করতে পারবে না। এই দেখেই আলিবাবার পরিচারিকা মর্জিনা ধরে ফেলেছিল যে সে আসলে অতিথি বেশে ডাকাত।
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে লবণের ব্যবহার। মাঝে মাঝেই খেয়ালের ভুলে মনে প্রশ্ন জাগে, কোথা হতে এলো এই লবণ? কবে থেকেই বা মানুষ শিখল এই লবণের ব্যবহার?
প্রশ্নের উত্তর খুজতে গিয়ে দেখা যায়, হাজার হাজার বছর আগে থেকে মানুষ খাওয়ারে লবণের ব্যবহার শুরু করে। তবে তখনকার এই লবণ আজকের যুগের সাগরের পানি পরিশুদ্ধ প্রক্রিয়াজতকৃত লবণ নয়। তখন লবণ সংগ্রহ করা হতো খনি থেকে। সেই সময়ের লোকেরা নিজস্ব উপায়ে খনি থেকে লবণ উত্তোলনের প্রক্রিয়া শিখে নিয়েছিল। চীনের সানশি প্রদেশের ইয়নচুনে এরকম এক খনির কথা জানা যায়। এটাই এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচাইতে প্রাচীন খনি যেখান থেকে মানুষ মাটি খুঁড়ে লবণ বের করতে পারতো।
বর্তমানে পোল্যান্ড, তুরস্ক, বলিভিয়াসহ আরও কিছু দেশে এখনও লবণের খনির দেখা মেলে। আস্ট্রিয়ার একটি এলাকার নাম সালজবুর্গ যার মানে হলো লবণের শহর। এই এলাকাটি সতেরো কিলোমিটার জায়গা জুড়ে রয়েছে একটি লবণের খনি। তেমনি সেল্টিক বা স্কটলেন্ড, গ্রীক এবং মিশরের বিভিন্ন এলাকার নাম হয়েছে এই লবণের কারণে। ইতালির দক্ষিণাঞ্চলে সিসিলিতে অপরূপ ডোরাকাটা লবণের একটি লবণের খনি দেখতে পাওয়া যায়। খনিটি প্রায় ২০ কিলোমিটার জায়গা দখল করে আছে। আজ থেকে প্রায় ৫০ লক্ষ বছর আগে ভূমধ্যসাগর আংশিক বা সম্পুর্ণ শুকিয়ে যাওয়ার সময় এই অসাধারণ প্যাটার্নটি তৈরি হয়। পানির বাষ্পীভবনের ফলে পড়ে থাকা লবণই কালক্রমে কালোর মাঝে সাদা ও গোলাকার ডোরা তৈরির মূল কারণ।
ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৩০০ ফুট নীচে ৫ হাজার বছর আগের লবণ খনির খোঁজ পাওয়া গেছে সম্প্রতি তুরস্কে। ধারণা করা হচ্ছে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে বানানো হয়েছিলো এই লবণ খনি যা আজও ব্যবহারযোগ্য। খনির আসল মালিক ছিলো হিটিসরা, যারা প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলো, এবং তারা নিজেদের হাতকেই খনি থেকে লবণ তোলার কাজে ব্যবহার করতো। ধারণা করা হচ্ছে এখানে এখনও ১ বিলিয়ন টন লবণ জমা রয়েছে। এখন এখান থেকে প্রতিদিন ৫০০ টন লবণ সংগ্রহ করা হচ্ছে।
খিস্টের জন্মের ৬০০০ হাজার বছর আগেও মানুষ খনি থেকে লবণ তুলতে পারত। আমরা খাওয়ার জন্য যে লবণ ব্যবহার করি তার বেশির ভাগই আসে সমুদ্রের লবণ থেকে। সাধারণ লবণ দেখতে সাদা হলেও খনি থেকে তোলা লবণ বিভিন্ন রঙের হতে পারে। সাদা লবণ মূলত সমুদ্রের পরিশোধিত লবণ। পৃথিবীর অনেক জায়গায় কালো লবণ পাওয়া যায়। এর বেশির ভাগ পাওয়া যায় ভারতে। ওখানে এই লবণকে কালা নাম্মক বলা হয়। এটি মূলত খনির লবণ। এর মধ্যে রয়েছে সোডিয়াম ক্লোরাইড, আয়রন, সালফার কম্পাউন্ড। রান্নার স্বাদ বাড়াতে অনেক সময় এই ব্ল্যাক বা কালো লবণ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
সমুদ্র থেকে যে লবণ আনা হয় তা একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিশোধন করা হয়। জোয়ারের সময় সমুদ্রের পানি জমা করে রাখে বড় বড় জমিতে। তারপর সেই জমির চারপাশ বাধ দিয়ে পানি আটকে ফেলা হয়। তারপর সুর্যের আলোতে সেই পানি বাষ্প হয়ে গেলে তার নিচে লবণ পড়ে থাকে। পড়ে আবার সেই লবণ পরিষ্কার করে বাজারে বিক্রয় করা হয়। ইংরেজিতে একে টেবিল সল্টও বলা হয়। আর এই লবনের সাথে আয়োডিন মিশিয়ে তৈরি করা হয় আয়োডাইজ সল্ট বা আয়োডিন লবণ।
খাওয়ার পাশাপাশি আরও বিভিন্ন কাজে লবণের ব্যবহার শুরু হয়ে আসছে অনেক বছর আগে থেকেই। হাজার হাজার বছর আগে প্রাচীন মিশরীয়রা লবণকে পবিত্র বলে মনে করত। তাই তারা কবরে লবণ রাখত। মৃতদেহ লবণ দিয়ে মাখালে তা টিকে থাকে অনেকদিন। তাই তারা মৃত মানুষের কবর দেবার সময় লবণ রেখে দিত। লবণের অন্য ধরনের ব্যবহারও তখন থেকে চালু হয়ে আসছে। লবণ মাখিয়ে খাবার সংরক্ষণ করার উপায় বের করেছিলেন মিশরীয়রাই। মিশরীয়রা মাছে লবণ মাখিয়ে বিক্রি করতো ফিনিশিয়দের কাছে। লবণের নানান ধরনের ব্যবহারের ফলে লবণের ব্যবসা অনেক জমজমাট হয়ে ওঠে। লবণ বিক্রির জন্য আফ্রিকায় একটি আলাদা রাস্তা তৈরি হয়েছিল। সেই রাস্তা আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির মধ্যে দিয়ে গেছে। এই রাস্তা দিয়ে টুয়ারেগ নামের এক জাতি বছরে প্রায় ১৫০০০ টন লবণ নিয়ে যেত।
লবণের ইতিহাস কিন্তু শুধু খাওয়ায় লবণের ব্যবহার বা লবণ নিয়ে বাণিজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। প্রাচীন রোমে সৈন্যদের বেতন দেয়া হতো এই লবণ দিয়ে। ইংরেজিতে ‘সোলজার’ মানে হলো সৈন্য আর সেলারি মানে বেতন। এই দুটি শব্দ এসেছে ‘সল্ট’ থেকে। আজ আমরা যে সালাদ খায় সে শব্দটিও এসেছে সল্ট থেকে সল্টেড হয়ে।
লবণ নিয়ে রীতিমত একটা আন্দোলন হয়েছিল যেটিকে লবণ আইন অভিযান বা লবণ সত্যাগ্রহ বলা হয়। ইংরেজিতে একে সল্ট মার্চ বলে অবিহিত করা হয়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই আন্দোলনের বিশেষ মর্যাদা ছিল। আর এই লং মার্চের আহবায়ক ছিলেন স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী। লবণের উপর ব্রিটিশ সরকার যে কর আরোপ করে তারই প্রতিবাদে এই যাত্রার আয়োজন করা হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই দিন গান্ধীজির যাত্রায় সঙ্গী হয়েছিলেন। ভাবা যায়? লবণের জন্য রীতিমত লং মার্চ।
অনেক ধর্মে লবণ খুব পবিত্র ব্যাপার। জাপানের শিন্টোরায় যে কোন মানুষ বা স্থানকে পরিশুদ্ধ করতে লবণ ছিটিয়ে দেয়া হয়। এ জন্য সুমো কুস্তীগিরদের উপর লবণ ছিটিয়ে দেয়া হয়।
লবণ যে শুধু মানুষের জীবনে কল্যাণ বয়ে এনেছে তা কিন্তু নয়। অনেক যুদ্ধও কিন্তু এই লবণের কারণে হয়েছিল। ইতালির ভেনিস শহরের সাথে জেনোয়া নামের আরেকটি শহরের লড়াই ঘটেছিল শুধুমাত্র লবণকে কেন্দ্র করে। এই লবণ নিয়ে আরও একটি মজার ঘটনা আছে। ১৮০০ সালের দিকে ইংল্যান্ডের এক জায়গায় লবণ পাওয়া যায়। এই লবণ সরবরাহ করতে গিয়েই লিভারপুল নামে এক বিশাল বন্দর গড়ে ওঠে।
জীবনের জন্য লবণের গুরুত্ব অপরিসীম। লবণে আছে বিপুল পরিমাণ সোডিয়াম। সোডিয়াম শরীরের জন্য দরকারি ইলেক্ট্রোলাইট। জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল ইলেক্ট্রোলাইট, সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং ক্যালসিয়াম অপরিশোধিত লবনে পাওয়া যায়। শরীরে লবণ বেড়ে যাওয়া বা লবণের পরিমাণ কমে যাওয়া দুটিই দেহের জন্য বিপদজনক। তাই লবণের সাথে বন্ধুত্ব রাখার ব্যাপারটি বেশ সতর্কতার সাথে করা উচিত তা বলাই বাহুল্য।