
বর্তমান যুগে বিজ্ঞাপন আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই যেন যুক্ত হয়ে গিয়েছে। তবে এই বিজ্ঞাপন কখনও কখনও ভুল তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে ভোক্তাদের জন্য তৈরি করে নানা ধরনের ভোগান্তি, এর মাধ্যমে কখনও তারা শিকার হন বিভিন্ন প্রতারণার। অনেক সময় এই বিজ্ঞাপন আমাদের জীবনে এমনভাবে প্রবেশ করে, যার কারণে আমরা অনেক মিথ্যাকেই সত্য বলে ধরে নিয়ে থাকি। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমের ছড়ানো এরকম কিছু অপপ্রচার আপনাদের সামনে তুলে ধরার জন্য এই নতুন সিরিজের সূচনা- বিজ্ঞাপন বিভ্রান্তি।

হীরার আংটি; Source: pexels.com
“A Diamond is forever” এই কথাটি একবারের জন্য হলেও শোনেননি, এমন মানুষ খুব কমই আছেন হয়তোবা। এই একটি উক্তির উপর ভিত্তি করে বর্তমানে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাল্টি বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা। অথচ “হীরা পৃথিবীর এক শাশ্বত সৌন্দর্য” এই স্লোগানটি শুরুই হয়েছিল ১৯৪৭ সালে। খুব সম্ভবত এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন প্রতারণা। অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন, অন্য সব অলঙ্কারের মতো এটিও একটি ভালো বিনিয়োগ। কিন্তু এমনটি আদৌ না, আপনি হীরার যেকোনো অলঙ্কার কেনার পরে সেটির দাম প্রায় ৫০ শতাংশেরও বেশি হ্রাস পায়!

হীরা ব্যবসার পুরোধা প্রতিষ্ঠান ডি বিয়ারসের একটি শো-রুম; Source: Times Square Hong Kong
এংগেজমেন্টের সময় একটি হীরার আংটি পরানোর নিয়ম অনেক পুরনো রীতি, এমনটাই ভাবেন অনেকে, তাই না? কিন্তু আসলেই কি তা-ই? ১৯৩৮ সালের আগে হীরার অলঙ্কার কেবল উচ্চবিত্তদের কাছেই শোভা পেত। এর আগে বাগদানের সময় হীরার আংটি পরানোর রীতি খুব একটা প্রচলিত ছিল না। এন. ডাব্লিউ. আয়ার নামক এক বিজ্ঞাপন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের বুদ্ধিদীপ্ত পরিকল্পনার মাধ্যমেই আজ এই অবস্থানে এসেছে হীরকের ব্যবসা।
সবকিছু যেভাবে শুরু হলো
১৮৭০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় হীরার খনি আবিষ্কৃত হবার পরে হীরা আর দুর্লভ থাকেনি। এই খনির সন্ধান পাওয়ার পরে ব্রিটিশ বিনিয়োগকারীরা বুঝতে পারেন যে, তারা কোনো পদক্ষেপ না নিলে হীরার বাজার সম্পৃক্ত হয়ে দাম কমে যাবে। এছাড়া সেসময়ে অর্থনৈতিক মন্দার পাশাপাশি ইউরোপের ওপরে ছিল যুদ্ধের আশঙ্কা। হীরার বিক্রি প্রায় ৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে। ব্যবসায়ীরা তখন দুটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেন-
১) হীরার দামের উপরে একাধিপত্য তৈরি করা: তারা এটি অর্জন করেন একটি কোম্পানি তৈরির মাধ্যমে, যার নাম ‘ডি বিয়ারস কনসোলিডেটেড মাইনস লিমিটেড’। কোম্পানিটি বিশ্বের হীরার বাজার এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে।
২) বাজার স্থিতিশীল করা: এই অবস্থানে আসার জন্য ডি বিয়ারস কোম্পানির এমন কিছু চিন্তা করতে হয়েছিল, যার মাধ্যমে তারা বিশ্বব্যাপী হীরার চাহিদা এবং সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এজন্য তাদের সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায় বিজ্ঞাপন সংস্থা এন. ডাব্লিউ. আয়ার।

হীরার খনিতে কাজ চলছে; Source: Lynsey Addario for TIME
একটি নতুন যুগের সূচনা
১৯৩০ এর দশকে এন. ডব্লিউ. আয়ার বাজার যাচাই করে যা বুঝতে পারে তা হলো, খুব উচ্চবিত্ত পরিবারের মানুষ বাদে আর কেউ বিলাসবহুল এই পণ্যটি নিয়ে খুব একটা আগ্রহী নন। কিন্তু আমেরিকার সাধারণ মানুষ তখনও গাড়ি বা অন্য সামগ্রীর জন্য ঠিকই টাকা খরচ করছে। এ থেকে তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, বিক্রি বাড়ানোর জন্য তাদের বৃহত্তর পরিসরে চিন্তা করা লাগবে, যাতে সাধারণ মানুষ হীরা শুধুমাত্র কিনতে নয়, বরং তা সংরক্ষণেও আগ্রহী হয়ে ওঠে।
তারা ভাবতে থাকে, কীসের ওপরে ভর করলে, বিভিন্ন আয়ের মানুষ তার এই পণ্য কিনতে আগ্রহী হবে এবং এর পাশাপাশি সেটি বিক্রি করতেও দ্বিধান্বিত হবে। এর উত্তর হয়ে দাঁড়ায় ভালোবাসা এবং বিয়ে! মিডলসেক্স ইউনিভার্সিটির মার্কেটিংয়ের অধ্যাপক টি. সি. মেলওয়ারের মতে, এটি ছিল সকল বিজ্ঞাপনের মধ্যে সফলতার শিখরে।

সালভাদর দালি ও পাবলো পিকাসোর আঁকা ছবি ব্যবহার করে ডি. বিয়ারসের বিজ্ঞাপন; Source: Quartz
নিউইয়র্ক টাইমসের এক রিপোর্ট অনুসারে, এন. ডব্লিউ. আয়ারের চিন্তা এমন ছিল, যাতে প্রতিটি মানুষ তার বিয়ের প্রস্তাবের সময় হীরার আংটি কিনতে উদ্বুদ্ধ হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে এংগেজমেন্ট রিংয়ের শতকরা শুধুমাত্র ১০ শতাংশ থাকত হীরার আংটি। বর্তমান বিংশ শতাব্দীতে এসে এই পরিমাণটি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮০ শতাংশে! এর সবই সম্ভব হয়েছিল কারণ, আয়ার তরুণ-তরুণীদের বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয়েছিল যে, হীরার আংটি ভালোবাসার অন্যতম প্রমাণ। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তেই যেন হীরার আবেদন প্রসার পাচ্ছিল। ২০১৩ সালের একটি প্রতিবেদনের চিত্র নিচে তুলে ধরা হলো-

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে হীরার ব্যবহার; Source: bain.com
হুজুগ তৈরির জন্য আয়ার তৎকালীন গণমাধ্যমের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেন। বেশ কিছু চলচ্চিত্রে এমন কিছু অংশ রাখা হয়, যেখানে হীরার আংটি কেনাকাটা করে সিনেমার শিল্পীরা। আবার এমন দৃশ্য ধারণ করা হয়, যেখানে একজন লোক তার ভালোবাসা প্রকাশ করছেন হীরার আংটি উপহার দেওয়ার মাধ্যমে। ডি বিয়ারস বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের অর্থের বিনিময়ে তাদের প্রচার কাজে ব্যবহার করতে থাকে। ফ্যাশন ডিজাইনারদের মাধ্যমে হীরাকে এমনভাবে উপস্থাপন করায় যেন তা হাল ফ্যাশনেরই অংশ। তারা স্কুলগুলোতে তাদের প্রতিনিধি পাঠায় এবং তাদেরকে হীরার মূল্য সম্পর্কে অবহিত করে। এভাবে তারা মানুষকে ধীরে ধীরে বুঁদ করে তোলে এক মিথ্যা স্বপ্নের মধ্যে।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে খবরের কাগজ এবং রেডিওর মাধ্যমে তারা তাদের প্রচার কাজ চালায়। একাধিপত্যের কারণে যেহেতু একাধিক কোম্পানির মাঝে প্রতিযোগিতা করে প্রচার করা লাগছিল না, তাই আয়ার কিছু বিনোদনমূলক এবং শিক্ষামূলক বিজ্ঞাপনও তৈরি করে। এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সকলের মধ্যে শুধু একটি ধারণা প্রচার করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য, তা হলো হীরার মাহাত্ম্য।

ডান হাতে হীরার আংটি পরাকে নারীর ক্ষমতায়নের প্রকাশ বলে তুলে ধরা হচ্ছে বিজ্ঞাপনে; Source: Pendulum In Action
এই বিজ্ঞাপনগুলোতে মানুষের আবেগ কীভাবে ব্যবসার কাজে ব্যবহার করা সম্ভব, তার দারুণ উদাহরণ পাওয়া যায়। যেমন- একটি বিজ্ঞাপন এমন ছিল যে, এংগেজমেন্ট রিং এমন হওয়া উচিত, যেন তা অন্তত দুই মাসের বেতন দিয়ে কেনা হয়! বাগদত্তাকে ভবিষ্যতে কেমন রাখা হবে, তা নাকি এর মাধ্যমে বোঝানো সম্ভব। যদিও দুই মাসের বেতনের এই তুলনাটি ডি বিয়ারসের প্রচারণা থেকে শুরু হয়েছিল, এখনও আমেরিকার অনেক মানুষ এটিকে নিয়ম বলে মেনে চলেন। এমন দুটি বিজ্ঞাপন দেখুন এবার-

Source: Catalyst Wedding Co

Source: Advertisement Gallery
তবে এমন নয় যে, ডি বিয়ারস শুধুমাত্র নববিবাহিতদের জন্য তাদের প্রচারণা সীমাবদ্ধ রেখেছিল। তারা বয়স্ক দম্পতিদের জন্যও ব্যবস্থা করে ‘ইটার্নিটি অ্যানিভার্সারি রিং’ নামে অন্য একটি প্রকল্প। এই প্রকল্পে আংটিতে ২৫টি পর্যন্ত ছোট হীরকখণ্ড যুক্ত করা হয়। এই প্রকল্পের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়, এরকম আংটি প্রদানের মাধ্যমে পুরনো দিনের ভালবাসাকে জাগিয়ে তোলা হবে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, এই প্রকল্পটির কাজ ছিল মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের হীরার বাজারের চাহিদা মেটানো।
তবে বর্তমানে হীরার বাজারে ডি বিয়ারস কোম্পানির একাধিপত্য বজায় নেই বললেই চলে, যার কারণ হলো নতুন খনির আবিষ্কার এবং সিনথেটিক হীরা তৈরি। তবুও ধারণা করা হয়, কোম্পানিটির কাছে এখনও ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমমূল্যের হীরা মজুদ করা আছে।

পুরুষদের জন্য হীরার আংটির বিজ্ঞাপন; Source: Advertising Is Good For You – Typepad
সূচনাটা আমেরিকা দিয়ে হলেও, বর্তমানে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তেই হীরার ব্যবসা আজ অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেই কীভাবে যুগের পর যুগ মানুষকে বুঁদ করে রাখা যায় কোনো পণ্যের গুণমুগ্ধতায়, তার উজ্জ্বল প্রমাণ এই হীরার বিজ্ঞাপন। সিরিজের পরবর্তী পর্বে থাকছে মানুষের এমনই আরও কিছু বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্ত হবার গল্প।
ফিচার ইমেজ: Arabia Weddings