কীর্তিগাথা মেসোপটেমীয় সভ্যতা প্রাচীন বিশ্বের এক অপার বিস্ময়। পৃথিবীর সকল সুপ্রাচীন সভ্যতার তালিকা তৈরি করলে এ সভ্যতা শীর্ষে স্থান দখল করে নেবে। এ যেন সভ্যতার মোড়কে ঘনীভূত এক ইতিহাস, জীব-জীবনের জানা-অজানা কথা, মানব ইতিহাসের উত্থান-পতনের এক মহাকাব্য। বিভিন্ন কারণেই সভ্যতাটির কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়েছে ইতিহাসের পাতায়। আজও তা নিয়ে মানুষের অনুসন্ধিৎসু মনের জানার আগ্রহে একটুও ভাঁটা পড়েনি। হাজার বছর পূর্বে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার ভূমিতে শাসন করে গেছেন অনেক রাজা-বাদশাহ, তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ে আছেন ইতিহাসে অমর। মেসোপটেমীয় এমন ইতিহাস বিখ্যাত কয়েকজন শাসককে নিয়েই আজকের এই আয়োজন।
হাম্মুরাবি
মেসোপটেমিয়ার ইতিহাসে সম্রাট হাম্মুরাবি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। খ্রিস্টপূর্ব ১৮১০ অব্দে মেসোপটেমিয়ায় জন্ম নেওয়া হাম্মুরাবি ছিলেন ব্যাবিলনিয়ার প্রথম রাজবংশের ষষ্ঠ রাজা। তিনি আদর্শবাদী রাজা বলেও সুপরিচিত। খ্রি.পূ. ১৭৬৩ অব্দে লারসা শহর দখলের পর কালক্রমে তিনি ব্যাবিলনিয়াকে পরিণত করেন শক্তিশালী এক সাম্রাজ্যে। ব্যাবিলনিয়ার প্রধান নগরী ব্যাবিলনিকে কেন্দ্র করে পত্তন ঘটে বিশাল ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য ও সভ্যতার। খ্রি.পূ. ১৭৯২ অব্দ থেকে খ্রি.পূ. ১৭৫২ অব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ চার দশকের রাজত্বকালে তিনি রাজনৈতিক-সামাজিক ঐক্য, শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মেসোপটেমিয়ার ব্যাবিলনীয় অংশকে সুশৃঙ্খল সাম্রাজ্যে পরিণত করেন। ব্যাবিলনীয় প্রভূত উন্নতি সাধনের ফলে তার শাসনামলকে ‘ব্যাবিলনের স্বর্ণযুগ’ বলে অভিহিত করা হয়।
তবে হাম্মুরাবি ইতিহাসে পাতায় অমলিন হয়ে আছেন তার প্রণীত আইন হাম্মুরাবি কোডের জন্য। এটি বিশ্বের সর্বপ্রাচীন আইন না হলেও, প্রাচীন পৃথিবীতে এই আইন সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিল। রাজা হাম্মুরাবির ২৮২টি নীতিমালা একটি বিশাল কালো পাথর খণ্ডে খোঁদাই করেছিলেন। হাজার বছর পরও এটি অক্ষত রয়ে গেছে। গবেষকদের মতে, হাম্মুরাবির আইন পরবর্তীতে বিশ্বের বহু জাতি-গোষ্ঠীকে প্রভাবিত করেছে।
সার্গন দ্য গ্রেট
আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর পূর্বে সুমেরীয় অঞ্চলের রাজা ছিলেন উর-জাবাবা। সেসময় বুকভরা সাহস আর অদম্য স্পৃহা নিয়ে মসনদে আসীন হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন সুমেরের এক ফলচাষী। নিজ প্রচেষ্টায় তিনি ফলচাষী থেকে উর-জাবাবার ভৃত্য তালিকায় জায়গা করে নেন। একসময় উর-জাবাবাকে হটিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন সুমেরের অধিকর্তা। তার হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয় প্রাচীন আক্কাদীয় সাম্রাজ্য। ইতিহাসে এই ফলচাষী আক্কাদের সার্গন বা সার্গন দ্য গ্রেট নামেই সুপরিচিত।
আক্কাদীয় সাম্রাজ্য ছিল বিশ্বের প্রথম সভ্যতাগুলোর একটি, যারা নিজ সাম্রাজ্যে আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রয়োগ করেছিল। সার্গনের পূর্বে মেসোপটেমিয়ার সমাজগুলো ছিল রাজতন্ত্র শাসিত। সার্গন তার নতুন ব্যবস্থার অধীনে ধর্মীয় পুরোহিতদের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দিলেও অনেক বিষয়ে তাদের হস্তক্ষেপ সীমিত করে দেন। মেসোপটেমিয়ায় সরকারব্যবস্থা এবং ধর্মীয় রীতিনীতি সংস্কারের পাশাপাশি, তিনি রাজ্যের স্থাপত্য ও কাঠামোগত দিকের প্রতি বিশেষ নজর দিয়েছিলেন। তার অধীনে থাকা সকল অঞ্চলের মধ্যে তিনি পরস্পর সংযুক্ত একটি সুগঠিত বাণিজ্যিক কাঠামো গড়ে তুলেছিলেন। আক্কাদীয় সাম্রাজ্য কৃষিতে সমৃদ্ধ থাকলেও, অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ, যেমন- ধাতু এবং কাঠের অভাব ছিল সেখানে। সেজন্য তিনি লেবানন থেকে ধাতু এবং কাঠ এনে এসবের চাহিদা মিটিয়েছিলেন।
এভাবে বিস্তৃত বাণিজ্যিক অন্তর্জালের মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন জিনিস বিনিময়ের অনুমতি দিয়েছিলেন। এই ব্যবস্থাকে আরও সহজ করার লক্ষ্যে তিনি কৃষিব্যবস্থা, যোগাযোগব্যবস্থা এবং সেচ-খাল নির্মাণে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেন। এছাড়াও মানব ইতিহাসে প্রথম ডাক-ব্যবস্থা এবং স্থায়ী সেনাবাহিনী গঠনের মূল কারিগর ধরা হয় তাকেই। খ্রিস্টপূর্ব ২২৭৯ অব্দে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। সার্গন মেসোপটেমীয় সভ্যতায় নিজের এক স্থায়ী এবং শাশ্বত প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হন। বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী হওয়ায় তাকে প্রাচীন মেসোপোটেমীয় গ্রন্থগুলোতে ‘মহাবিশ্বের অধিপতি’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
নারাম-সিন
মানিশতুশুর ঘরে জন্ম নেওয়া সার্গন দ্য গ্রেটের দৌহিত্র নারাম-সিন ছিলেন আক্কাদীয় সাম্রাজ্যের একজন প্রভাবশালী শাসক। এছাড়াও তার অন্য পরিচয় হলো তিনি সম্রাট রিমুশের এবং বিশ্বের প্রথম মহিলা কবি এনহেদুয়ানার ভাগ্নে। তার রাজত্বকালের আক্কাদীয় সাম্রাজ্য খ্যাতি ও সমৃদ্ধি সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহণ করেছিল। খ্রি.পূ. ২২৫৪ অব্দ থেকে খ্রি.পূ. ২২১৮ অব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৬ বছর রাজত্বকালে তিনি মাগানের মানিয়াম, উত্তরের বিভিন্ন পার্বত্য উপজাতি জাগরুস, তাওরুস, এলাম, আরমানাম, এবলাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন। এর ফলে তিনি বিস্তৃত করতে পেরেছেন তার শাসনের অধীনে থাকা সাম্রাজ্যকে।
প্রথম মেসোপটেমীয় সম্রাট হিসেবে তিনি দেবতাদের সাথে তুলনা করে নিজেকে ‘আক্কাদের দেবতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এছাড়াও তিনি নিজেকে ‘ত্রিভূবনের সম্রাট’, ‘মহাবিশ্বের সম্রাট’ হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন। এনলিল যেমন নিপ্পুর শহরের পৃষ্ঠপোষক দেবতা ছিলেন, তেমনি আক্কাদের পৃষ্ঠপোষক দেবতা হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করেছিলেন নারাম-সিন।
আশুরবানিপাল
বলা হয়ে থাকে, অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক হচ্ছেন আশুরবানিপাল। ৬৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নব্য-অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের সম্রাট এসারহাডন এবং রানি ইশারা হাম্মাতের কোল আলো করে জন্ম নেন আশুরবানিপাল। তার শাসনামলে অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্য আয়তনে সবচেয়ে বেশি বিস্তৃতি পায়, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল ব্যাবিলনিয়া, পারস্য, সিরিয়া এবং মিশরের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোও। একজন ন্যায্য ও জনপ্রিয় শাসক হিসেবে প্রজাদের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি। তবে, প্রজাদের নিকট তিনি যতটা কোমল, যুদ্ধে পরাজিতদের ক্ষেত্রে ছিলেন ততটাই নিষ্ঠুর ও বজ্রকঠোর।
আশুরবানিপাল ছিলেন আপাদমস্তক একজন সাহিত্যানুরাগী মানুষ। সম্রাট আশুরবানিপালের শাসনামলে (খ্রিষ্টপূর্ব ৬৬৮ অব্দ – খ্রিস্টপূর্ব ৬২৭ অব্দ) নিনেভাতে সম্পূর্ণ নতুন এক প্রাসাদ নির্মিত হয়, এবং তিনি মেসোপটেমিয়ার ইতিহাস ও উপকথায় বর্ণিত সমস্ত কাহিনি সংগ্রহ ও তালিকাভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করেন। প্রাচীন পৃথিবীর বিখ্যাত কতক জিনিসের মাঝে সম্রাট আশুরবানিপালের প্রাচীন রাজকীয় গ্রন্থাগার অন্যতম। জৌলুশপূর্ণ শহর নিনেভার প্রাসাদে নির্মিত এই গ্রন্থাগারের নির্মাণকাল সঠিকভাবে জানা যায় না। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন পুঁথিশালা না হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে এখানেই প্রথম শ্রেণীবিভাগ অনুসারে বই সাজানো শুরু হয়।
বিদ্যার প্রতি বিশেষ অনুরাগ ছিল আশুরবানিপালের। তিনি প্রাচীন সুমেরীয় এবং আক্কাদীয় ভাষায় লিখতে পারতেন। রাজত্বকালের পুরোটা জুড়েই গ্রন্থাগারে সাহিত্যকর্মের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি করে গেছেন, সমৃদ্ধ করেছেন নিজস্ব সংগ্রহশালা। তখনকার যুগে লেখার জন্য কোনো কাগজ-কলমের ব্যবস্থা ছিল না। তাই বিভিন্ন জিনিস লিখে রাখা হতো চারকোণা বিশিষ্ট মাটির ফলক বা ট্যাবলেটে। পৃথিবীর প্রাচীনতম মহাকাব্য গিলগামেশ, ব্যাবিলনীয় সৃষ্টিতত্ত্ব, সুমেরীয় মহাপ্লাবনের কাহিনিগুলো উদ্ধার করা হয়েছে এই ট্যাবলেট থেকেই। তার গ্রন্থাগারে চিকিৎসাবিজ্ঞান, ব্যাকরণ, উপকথা, ইতিহাস, জ্যোতির্বিদ্যা এবং ধর্মীয় গ্রন্থের উপর বিভিন্ন রকমের নথি সংগ্রহ করা ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৬২৯ সাল নাগাদ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং পুত্র আশুর-এতেল-ইলানির হাতে সাম্রাজ্যের ভার বুঝিয়ে দিয়ে নিনেভা ছেড়ে উত্তরে হারান শহরে চলে যান। খ্রিস্টপূর্ব ৬৩০ অব্দের দিকে আশুরবানিপালের মৃত্যুবরণ করেন।
নাবোপোলাসার
খ্রি.পূ. ৬৩০ অব্দে আশুরবানিপালের মৃত্যুর পর শুরু হয় সাম্রাজ্য দখলের পায়তারা। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে ব্যাবিলনিয়ার সম্পূর্ণ এলাকা দখল করে ক্যালডীয়রা। খ্রি.পূ. ৬২৬ অব্দে নাবোপোলাসার নামে এক সম্রাটের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় ক্যালডীয় রাজবংশ। মৃত্যুর আগপর্যন্ত (খ্রি.পূ. ৬০৫ অব্দ) শাসন করে গেছেন তিনি। হাম্মুরাবির পর সুদীর্ঘ প্রায় হাজার বছর ধরে বিভিন্ন সমস্যা, সংকট, ও অরাজকতায় ভুগে অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল ব্যাবিলনভূমি। পঙ্কিলতায় আচ্ছন্ন সেই ব্যাবিলনকে আলোর পথ দেখান সম্রাট নাবোপোলাসার। সকল প্রকার বিশৃঙ্খলা ও জঞ্জাল সাফ করে এক নতুন যুগের সূচনা ঘটান তিনি। ইতিহাসে এই যুগ নব্য-ব্যাবিলনীয় সভ্যতার যুগ বলে বিবেচিত।
নাবোপোলাসারের রাজত্বকালের সংস্কার ও স্থাপত্যশিল্পে ব্যাপক উন্নতি ঘটে। শহর ও নগরীর সৌন্দর্যবর্ধনে পূর্ণ মনোযোগ দেন তিনি। শহরের প্রাচীর, মন্দির, জিগুরাত ইত্যাদি তিনি পুনরায় সংস্কার করেছিলেন। সেনাপ্রধান হিসেবে তিনি ছিলেন দারুণ যুদ্ধকুশলী। শক্তিশালী সেনাবাহিনী নিয়ে যেদিকেই গেছেন, সেদিকই করেছেন লণ্ডভণ্ড। এলাম, ফেনিসিয়া, এবং জুডাহ অঞ্চলে সেনা প্রচারাভিযান চালিয়ে সেগুলো দখলের মাধ্যমে বিস্তৃত করেন নব্য-ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের মানচিত্র। ব্যাবিলনের বাণিজ্যিক গুরুত্ব বুঝতে পেরে তিনি একে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থলে রূপান্তরিত করেন। সেজন্য ব্যাবিলনের শাসকদের ইতিহাস পাঠে বার বার নাবোপোলাসারের নাম উঠে আসে। খ্রি.পূ. ৬০৫ অব্দে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার
নাবোপোলাসারের মৃত্যুর পর সিংহাসনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তার সন্তান দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার। ব্যাবিলনের ইতিহাসের তিনি জড়িয়ে আছেন অঙ্গাঙ্গীভাবে। নেবুচাদনেজার দ্য গ্রেট নামে খ্যাত এই রাজা ছিলেন নব্য-ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট। খ্রি.পূ. ৬০৫ অব্দে প্রাচীন শহর কারকেমিশের নিকটে নব্য-ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য ও মিশরীয় বাহিনীর মাঝে সংঘটিত হয় কারকেমিশের বিখ্যাত যুদ্ধ। সম্রাট নেবুচাদনেজারের বিপক্ষে মিশরীয়দের হয়ে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ফারাও দ্বিতীয় নেকো। ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র লেভান্ত দখল নিয়েই বেধেছিল এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। ওই যুদ্ধে জয়লাভের পর মিশরীয়দের সিরিয়া থেকে বিতাড়িত করার পাশাপাশি হিব্রু রাজ্য জুডা দখল করে নেন তিনি। এতে করে জুডার অধিবাসীদের গর্জনে ফেটে পড়ে জুডা রাজ্য। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৫৮৭ অব্দে তিনি পুরো জেরুজালেমে দখলে নিয়ে জুডার বিপুল সংখ্যক ইহুদিকে ব্যাবিলনে বন্দী করে নিয়ে আসেন। ইতিহাসে এই কাহিনী ‘ব্যাবিলনীয় বন্দিদশা’ হিসেবে পরিচিত। প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম সপ্তাশ্চর্য ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান ও বিখ্যাত ইশতার তোরণ নির্মাণ করেছিলেন এই দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার। খ্রি.পূ. ৫৬২ অব্দে ৮০ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
গিলগামেশ
গিলগামেশ কি উপকথার এক চরিত্র না বাস্তব দুনিয়ার একজন সম্রাট- তা নিয়ে বিতর্ক রয়েই গেছে। তবে অধিকাংশ ইতিহাসবেত্তার মতে, গিলগামেশ বাস্তবিক অর্থেই পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে জন্ম নিয়েছিলেন। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, খ্রি.পূ. ২৭০০ অব্দের দিকে গিলগামেশ ছিলেন প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার শহর উরুকের একজন রাজা। পৃথিবীতে যে কয়টা শহরে সর্বপ্রথম সরকারব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল, তার মধ্যে উরুক অন্যতম।
মেসোপোটেমীয় পুরাণে গিলগামেশ হলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্র। পৃথিবীর প্রথম মহাকাব্য, ‘গিলগামেশ মহাকাব্য’ রচিত হয়েছিল খ্রি.পূ. ২০০০ অব্দে, কিউনিফর্ম লিপিতে। ওখানে গিলগামেশের দুঃসাহসিক স্বর্গাভিযানের কাহিনি বর্ণনা করা ছিল। সম্রাট আশুরবানিপাল ৩ হাজার চরণের এই মহাকাব্যকে সযত্নে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন তার রাজকীয় গ্রন্থাগারে। প্রাচীন মেসোপটেমীয়দের ধর্ম ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ও পূজনীয় এক চরিত্রের আসন দখল করে রেখেছিলেন গিলগামেশ।
প্রথম শাম্শি-আদাদ
আমোরাইট নেতা প্রথম শাম্শি-আদাদ ছিলেন প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার একজন জনপ্রিয় শাসক। বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে তিনি অভিযান চালিয়ে জয় করে নিয়েছেন সিরিয়া, আনাতোলিয়া, এবং ঊর্ধ্ব মেসোপোটেমিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। উল্লেখ্য, দখলে নেওয়া এলাকাগুলোতে তিনি ওই স্থানের বাসিন্দাদের নিজস্ব ধর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তিনি নিনেভা নগরীতে দেবী ইশতারের মন্দিরকে সম্পূর্ণরূপে পুনর্নির্মাণও করেছিলেন। অ্যাসিরীয় রাজাদের তালিকা অনুসারে, তার রাজত্বকাল স্থায়ী ছিল খ্রি.পূ. ১৮০৯ অব্দ থেকে খ্রি.পূ. ১৭৭৬ অব্দ পর্যন্ত। পিতা ইলা-কাবকাবু থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষমতা পেয়েছিলেন শাম্শি-আদাদ। খ্রি.পূ. ১৭৭৬ অব্দে সুবাত-এনলিল নামক শহরের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
সাইরাস দ্য গ্রেট
প্রাচীন গ্রিকদের মতে, দ্বিতীয় সাইরাস (সাইরাস দ্য এল্ডার) ছিলেন প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার একজন শাসক, যার হাত ধরে হয়েছিল পারস্য সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন। অনেক ইতিহাসবিদের কাছে তিনি সাইরাস দ্য গ্রেট নামে পরিচিত। উত্তরাধিকারসূত্রে পিতা ক্যাম্বাইসেসের পর খ্রি.পূ. ৫৫৯ অব্দে আনশানের সিংহাসনে বসেন সাইরাস। পিতার সাম্রাজ্য বহুবছর ধরে ছিল মেডিয়ান শাসকদের অধীনে। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মেডিয়ান রাজা আশতাইয়াগেজের (সাইরাসের নানা) সাথে সাইরাসের মতবিরোধ দেখা দিলে, সাইরাস একসময় বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত নেন। ৩ বছর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর খ্রি.পূ. ৫৫০ অব্দে জয়ের মুখ দেখেন সাইরাস।
দয়াপরবশ হয়ে তিনি তার যুদ্ধ পরাজিত নানাকে প্রাণভিক্ষা দেন। এরপর আশতাইয়াগেজের সেনাপতির সাহায্যে তিনি পারস্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। আশতাইয়াগেজের মিত্র লিডিয়ার সম্রাট ক্রিসাস চেয়েছিলেন সাইরাসকে হারিয়ে বন্ধুর হারের বদলা নিতে। কিন্তু তাকেও সাইরাসের নিকট খ্রি.পূ. ৫৪৭ অব্দে পরাজয় বরণ করে নিতে হয়। খ্রি.পূ. ৫৩৯ অব্দে তিনি ব্যাবিলন দখল করে সেখান থেকে ইহুদিদের ইসরায়েলে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।