১৯১৫ সাল; নিউ সাউথ ওয়েলসের বিয়ারবঙের কোনো এক অঞ্চলে কুয়ার পাশে কাজ করছিলো একদল শ্রমিক। কাজের ফাঁকে বিশ্রামের মুহূর্তে কুয়া থেকে পানি তুলে পান করার পরই লাগলো খটকা, কুয়ার পানি যে স্বাভাবিকের তুলনায় উদ্ভট রকমের বিস্বাদ! কুয়ার গভীরে একজন শ্রমিক নামার পর পানির উদ্ভট স্বাদের রহস্য জানা গেলো, পাওয়া গেলো একজন হতভাগ্যের গলিত লাশ। পুলিশ এসে লাশ তোলার পর জানা গেলো প্রায় ৩ সপ্তাহ পুরনো মৃতদেহ। লাশটি ছিলো স্থানীয় এক শ্রমিকের। তদন্ত করে যতটুকু জানা যায় যে, হয়তো দুর্ঘটনাবশত কুয়া পড়ে গিয়ে মারা গিয়েছে লোকটি।
এমন শত শত ভয়ংকর ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে আছে অজস্র কুয়া। দুর্ভাগ্যবশত কুয়ার গভীরে পড়ে গিয়ে মৃত, কুয়ার গভীরে ফেলে হত্যা, হত্যার পর প্রমাণ ঢাকতে লাশ গুম করতে কুয়ায় ফেলে দেওয়া, হত্যার পর পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে আত্মহত্যা প্রমাণের চেষ্টা অথবা নিছকই অমীমাংসিত রহস্য, কুয়ার গভীর তলে মানুষের মৃত দেহ পাওয়ার মধ্যেই রয়েছে ভয়ংকর আতঙ্ক ও অস্বাভাবিকতা।
ঘটনা ১
ব্যবহৃত কুয়ার চেয়ে বেশি বিপজ্জনক পরিত্যক্ত কুয়া, যা শুধুমাত্র নিরীহ প্রাণীর জন্যই নয়, অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ ডেকে আনে মানুষের জীবনেও। তরুণ ক্লেম ম্যাকড্যানিয়েলস বাস করতো সাউথ ডাকোটায়। ম্যাকড্যানিয়েলস শস্য মাড়াই করতো। এই কাজের জন্য তার অনেক দূরেও যেতে হতো। তাই বেশ কয়েকদিন বাড়িতে অনুপস্থিত থাকলেও পরিবারের লোকজন তেমন একটি চিন্তা করতো না। ১৯১২ সালের রবিবার রাতে ক্লেম কাজের উদ্দেশ্যে বের হয়। কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার পথে বাড়ির অদূরে পাতা ও আবর্জনায় ঢাকা একটি পরিত্যক্ত কুয়ায় হঠাৎ করে পড়ে যায় তিনি।
ক্লেমের দুর্ভাগ্য। বাড়ির লোকেরা ভেবেছিলো সে দূরে কোথাও কাজ করে, আর সহকর্মীরা ভেবেছিলো হয়তো অসুস্থতার দরুন কাজে আসেননি তিনি। এভাবেই কেটে যায় বেশ কয়েকদিন। আসল ঘটনা উন্মোচিত হয় যখন একজন ক্লেমের খোজে তার বাড়িতে আসেন। অনুসন্ধান শুরুর পর ক্লেমকে পাওয়া যায় সেই পরিত্যক্ত কুয়ার তলে। পরিত্যক্ত কুয়ায় পড়ে যাওয়ার পরও ক্লেম বেশ কয়েকদিন বেঁচে ছিলো, কিন্তু শেষপর্যন্ত ঠাণ্ডার প্রকোপ, ক্ষুধার যন্ত্রণা এবং আহত হওয়ার কারণে মারা যায়। খুঁজে পাওয়ার মাত্র কিছুক্ষণ আগেই মারা গিয়েছিল হতভাগা এই তরুণ।
ঘটনা ২
যেসব অঞ্চলে কুয়া ব্যবহারের প্রচলন বেশি ছিলো, বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ঐ অঞ্চলগুলোতে শিশু নিখোঁজের হার হঠাৎ করে বেড়ে যায়। শেষপর্যন্ত বেশিরভাগ শিশুদের খুঁজে পাওয়া গেছে কুয়ার অন্ধকার গহ্বরে। জীবিত নয়, মৃত। এই তালিকায় ছিলো হামাগুড়ি দেওয়া শিশু থেকে শুরু করে হাঁটতে পারা শিশুরাও। দুর্ঘটনার পাশাপাশি আরও একটি ব্যাপার তখন প্রকট আকার ধারণ করেছিলো, অনাকাঙ্ক্ষিত শিশু ও ভ্রূণ হত্যা। এদের প্রায় সবার শেষ ঠিকানা হয়েছিলো ঠাণ্ডা পানির গভীর কুয়া।
নিউ সাউথ ওয়েলসের রেড রেঞ্জে ১৯৩১ সালের ঘটনা। স্কট নামের একজন কুয়ায় বালতি ফেলে পানি তুলতে গিয়ে মুখোমুখি হন ভয়ংকর এক সত্যের। পানির সাথে তার বালতিতে উঠে আসে গলে ও পচে যাওয়া ছোট্ট এক শিশুর দেহের কোনো একটি অংশ। ঘটনাস্থলে এসে পুলিশ একটি ব্যাগ উদ্ধার করে, যেখানে মেয়ে শিশুটির শরীরের বাকি অংশ পাওয়া যায়। এই ঘটনা সম্বন্ধে পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে পুলিশ বেশি দূর কিনারা পারেনি। সেই সময়ের অন্য আরও অনেক শিশু হত্যার ঘটনার মতই এটিও অমীমাংসিত থেকে যায়।
ঘটনা ৩
কুয়া ব্যবহারকারীদের মধ্যে যারা আত্মহত্যা করেছে, কিছু ক্ষেত্রে অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করা গেছে। তারা শুধু নিছক আত্মহত্যা করেনি, জন্ম দিয়েছে রহস্যের এবং অনেকে পুরো ব্যাপারটিকে শৈল্পিক রূপ দিয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এই সংক্রান্ত ঘটনার বেশ কিছু উল্লেখ পাওয়া যায় অস্ট্রেলিয়ার দৈনিকগুলোতে। ১৯২৭ সালে নিউ সাউথ ওয়েলসের ইয়াম্বায় ৫৫ বছর বয়সী থমাসকে যখন মৃত অবস্থায় কুয়ার শেষ প্রান্তে পাওয়া যায়, তখন তার দেহ কুয়ার রশিতে ঝুলছিল। রশিটির একপ্রান্ত বাঁধা ছিলো থমাসের পায়ের গোড়ালিতে এবং অন্য প্রান্ত কুয়ার উপরিভাগে একটি গাছের গুঁড়িতে। ঠিক কী ঘটেছিলো সুনির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব হয়নি।
থমাস ব্যক্তিজীবনে ভীষণ হতাশ ছিলেন। তাই পুলিশ ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করেন। থমাসের মাথা শুধু কুয়ার পানিতে ডুবানো, বাকি অংশ কুয়ার পানির উপরিভাগে ছিলো। বলা যায়, কুয়ার গভীরতা বেশ নিখুঁতভাবে পরিমাপ করেই আত্মহত্যার আয়োজন করেছিলেন থমাস।
নিউ সাউথ ওয়েলসেরই মেইটল্যান্ডের নিজ বাড়ির কুয়াতে পাওয়া যায় ৪৪ বছর বয়স্ক মিসেস হ্যারিয়েটের মৃতদেহ। একদিন হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে যায় হ্যারিয়েট। প্রায় ৬ ঘণ্টা পর খুঁজে পাওয়া যায় তার মৃতদেহ। লাশের গলায় যুক্ত ছিলো ভারী ওজন। ওজনের কারণে হ্যারিয়েটের লাশ কুয়ার বেশ গভীরে পাওয়া যায়। কুয়ার প্রায় ২০ ফুট পানি সেচে উদ্ধার করা হয় লাশটি।
ঘটনা ৪
বেন টাসকার ও বৃদ্ধ লান্ডের মধ্যে দারুণ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে পেশাগতভাবে, দুজনই ছিলো ঘোড়া চোর। বন্ধুত্বে ফাটল ধরতে অবশ্য বেশি সময়ও লাগেনি। লান্ড তার বন্ধু টাসকারকে কিছু টাকা ধার দিয়েছিলো, সময়মত টাকা ফেরত না দেওয়া থেকেই ঝামেলা শুরু। এই ঝামেলা শেষপর্যন্ত আদালতে গিয়ে গড়ায়। বন্ধুত্ব পরিণত হয় চরম শত্রুতায়। মামলার কার্যক্রম যখন প্রায় শেষের দিকে, তখন হঠাৎ উধাও হয়ে যায় বৃদ্ধ লান্ড। লান্ডের শেষ পরিণতি কী তখনো তা কেউ জানে না।
টাসকার অন্য আরেকটি মামলার দায়ে তখন জেলে। কোনো একজন কয়েদিকে দম্ভ করে টাসকার জানিয়েছিলো বৃদ্ধ লান্ডকে সে খুন করে লাশ কুয়ায় ফেলে দিয়েছে। লাপাত্তা হয়ে যাওয়ার পূর্বে লান্ডও তার কাছের বন্ধুদের বলেছিলো যে, টাসকার তাকে খুন করার হুমকি দিয়েছে। পাঁচ কান হয়ে কথা পুলিশের কাছে এসে পৌঁছায়। তারপর ১৮৭৬ সালে টাসকারকে গ্রেফতার করে পুলিশ। অবশেষে ইউতাহর বিংহামে প্রায় ৯০ ফুট গভীর কুয়ায় মাটি ও পাথর চাপা অবস্থায় পাওয়া যায় লান্ডের দেহাবশেষ। দেহাবশেষ দেখে লান্ডকে চিহ্নিত করার কোনো উপায়ই থাকতো না, যদি লান্ডের পরিহিত কাপড় সেখানে না পাওয়া যেত।
ঘটনা ৫
কৌতূহল সম্ভবত ততটুকুই ভালো, যতটুকুতে অহেতুক আপনার জীবন শঙ্কায় না পড়ে। ১৯৪০ সালের দিকে ওডফোর্ড আইল্যান্ডে কাউলিং তার ঘোড়াকে পানি পান করানোর জন্য নিকটস্থ খালের ধারে ছেড়ে দিয়ে এদিক ওদিক হাঁটছিলেন। কাছেই একটি কুয়া দেখতে পেয়ে এগিয়ে যান তিনি। এরপর যা দেখলেন তা এক কথায় রক্ত শীতল করা দৃশ্য। কুয়ার তলে একটি মৃত মানুষের দেহ জড়িয়ে ধরে আছে কালো একটি সাপ। লাশ উদ্ধার করে পুলিশ তদন্ত শুরু করে। তদন্তে উঠে আসে, এটি ছিলো নিছকই একটি দুর্ঘটনা। কারণ লাশের শরীরে কোনো আঘাত বা ধস্তাধস্তির চিহ্ন ছিলো না। পুলিশের ধারণা, কুয়ার তলে সাপ দেখে ঝুঁকে বেশি ভালো করে দেখতে গিয়ে সেখানে পরে যায় নিহত হয় লোকটি।
ঘটনা ৬
খুন করে লাশ গুম করার জন্য কুয়া আদর্শ না হলেও এটি খুব জনপ্রিয়। ১৭ বছর বয়সী ইসা ম্যাথিউস ওহাইওতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতো। প্রেমিক জোসেফ কেলচারের সাথে ঝগড়া করে আংটি ফেরত দিয়ে দেন ম্যাথিউস। নিজের জীবন থেকে ম্যাথিউসকে হারিয়ে উন্মাদ হয়ে উঠেন জোসেফ। ঘটনার কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন জোসেফকে দেখা গেলেও একদিন চিরতরে হারিয়ে যান তিনি। জোসেফের সাথে নিখোঁজ হয় তার সাবেক প্রেমিকা ম্যাথিউস। অবশেষে ম্যাথিউসের খোঁজ পাওয়া যায় স্থানীয় এক কুয়ার ভিতরে। হত্যার পর জোসেফ সেখানে লাশ ফেলে রেখে যায়। ধারণা করা হয়, ওহাইও নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন জোসেফ। জোসেফের রক্তমাখা কাপড় নদীতে পাওয়া গেলেও তার লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ফিচার ইমেজ- theastronauts.com