প্রায়ই খবরের শিরোনামে দেখা প্রিয় কোনো অভিনেতা, রাজনীতিবিদ বা বিখ্যাত কোনো ব্যক্তির মৃত্যুসংবাদ আমাদের ব্যথিত করে। সেই সংবাদটি আরও দুঃখজনক হয়ে দাঁড়ায় তখন, যখন আমরা দেখি যে, আমাদের প্রিয় সেই ব্যক্তিটির মৃত্যু হয়েছে তার নিজের হাতে। বিখ্যাত ব্যক্তিদের এ ধরনের আত্মহত্যার ঘটনা অহরহই ঘটে চলেছে এই দুনিয়ায়। এরকমই পাঁচটি বিখ্যাত আত্মহত্যার ঘটনা নিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের এই লেখা।
১. রবার্ট বাড ডয়ার
রাজনীতিবিদ রবার্ট বাড ডয়ারের মৃত্যুই সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত আত্মহত্যা। তার আত্মহত্যার দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করে রাখা হয় এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল তা ফলাও করে প্রচার করে। এখনো ইন্টারনেটে সেই ভয়াবহ দৃশ্যটি খুঁজে পাওয়া যায়।
আমেরিকার পেনসিলভানিয়া রাজ্যের একসময়ের সিনেটর ডয়ার ১৯৮০ সালে রাজ্যের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৮৪ সালে সেখানে তিনি পুনর্নির্বাচিত হন।
ট্রেজারির প্রধান থাকাকালীন সময়ে তার বিরুদ্ধে ঘুষ নেয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ ওঠে। তদন্তকারী কর্মকর্তারা সেই অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পায়। অভিযোগ কোর্টে প্রমাণিত হলে ডয়ারের বেশ ক’বছরের কারাদণ্ড হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
ডয়ার তখন তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ পুরোপুরি নাকচ করে দেন। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তারা তা মানতে রাজি ছিলেন না। তারা ডয়ারকে প্রস্তাব করেন, তিনি যদি নিজের দোষ স্বীকার করে নিজের পদ থেকে ইস্তফা দেন এবং তদন্তে সাহায্য করেন, তাহলে তাকে মাত্র পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। তা না হলে তার জন্য অপেক্ষা করছে বিশাল দুর্ভোগ ।
তারপরও ডয়ার তদন্ত কর্মকর্তাদের প্রস্তাবে রাজি হননি। তিনি নিজের নিষ্কলুষতার ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত ছিলেন। কিন্তু কোর্টে শেষ পর্যন্ত তিনি দোষী সাব্যস্ত হন। তাকে ৫৫ বছরের কারাদণ্ড এবং তিন লক্ষ ডলারের জরিমানা করা হয়।
তার দণ্ড শুরু হওয়ার কথা ছিল ১৯৮৭ সালের ২৩ জানুয়ারি থেকে। কিন্তু ডয়ারের মনে ছিল অন্য পরিকল্পনা। দণ্ড শুরুর একদিন পূর্বে তিনি একটি প্রেস কনফারেন্স ডাকেন। সেখানে অনেক সাংবাদিক ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তারা।
সেই কনফারেন্সে তিনি পুনরায় নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেন এবং তার মৃত্যুকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে রেখে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এরপরই একটি হলুদ খামের ভেতর থেকে আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে তিনি একটি .৩৫৭ ম্যাগনাম রিভলভার বের করেন। এ সময় উপস্থিত সবাই চিৎকার করে ডয়ারকে এই কাজ থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছিল। তাদের উদ্দেশ্যে ডয়ার বলেন,
‘তোমাদের যদি এই দৃশ্য দেখতে ভালো না লাগে, তাহলে প্লিজ এই রুম থেকে চলে যাও।’
এর পরপরই তিনি ট্রিগার টেনে দেন এবং সাথে সাথেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এই ঘটনার প্রায় দুই দশক পরে প্রমাণিত হয় যে, ডয়ার আসলেই নিরপরাধ ছিলেন, যা তার মৃত্যুকে বিশ্ববাসীর নিকট আরও দুঃখজনক করে তোলে।
২. রবিন উইলিয়ামস
রবিন উইলিয়ামসের আত্মহত্যা শুধুমাত্র ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত আত্মহত্যাই নয়, বরং তা ছিল পৃথিবীবাসীর জন্য এক বিরাট ধাক্কা। ২০১৪ সালে বিখ্যাত এই কমেডিয়ানের মৃত্যু সবাইকে হতবুদ্ধি করে দিয়েছিল।
১৯৫১ সালের ২১ জুলাই জন্মগ্রহণ করা রবিন উইলিয়ামস তার ক্যারিয়ার শুরু করেন একজন স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান হিসেবে। পরবর্তীতে তিনি টেলিভিশনে কাজ করা শুরু করেন। ১৯৭০ সালে প্রচারিত ‘Mork & Mindy’ নামের একটি জনপ্রিয় টেলিভিশন শো-এর মাধ্যমে তিনি তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। আমেরিকার প্রতিটি ঘরে ঘরে আলোচিত হতে থাকে তার নাম।
ক্যারিয়ার জুড়ে বেশ কিছু বিখ্যাত মুভির আইকনিক চরিত্রে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল তার। এসবের মধ্য Mrs. Doubtfire, Good Will Hunting, Dead Poets Society উল্লেখযোগ্য। এত সাফল্যমণ্ডিত ক্যারিয়ার থাকার পরও তীব্র বিষণ্ণতায় ভুগতেন তিনি। আর ড্রাগ-আসক্তি তো ছিলই।
ড্রাগ-আসক্তি, বিষণ্ণতা এবং ক্রমশ নিম্নমুখী ক্যারিয়ারের সাথে শেষদিকে তার শরীরে ধরা পড়ে পারকিনসন রোগ। সব মিলিয়ে বিপর্যস্ত রবিন উইলিয়ামস ২০১৪ সালের ১১ই আগস্ট সবাইকে কাঁদিয়ে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেন।
৩. এভিলিন ম্যাকহেল
এভিলিন ম্যাকহেল বিখ্যাত কোন ব্যক্তি ছিলেন না। তারপরও তার মৃত্যু ঠাঁই করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। তার মৃত্যুকে বলা হয়ে থাকে ‘ইতিহাসের সুন্দরতম আত্মহত্যা’।
ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলি শহরে জন্মগ্রহণ করা এভিলিন কাজ করতেন নিউইয়র্ক শহরের একটি বইয়ের দোকানে। নিউইয়র্কেই এভিলিনের পরিচয় হয় ব্যারি রোডসের সাথে, যাকে পরবর্তীতে বিয়ে করার কথা ছিল তার। কিন্তু তা আর শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি, বিয়ের এক মাস পূর্বে আত্মহত্যা করে বসেন এভিলিন।
১৯৪৭ সালের ১ মে এভিলিন নিউইয়র্ক শহরের এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং-এর ৮৬তম ফ্লোরে পৌঁছান। সেখানে থাকা পর্যবেক্ষণ ডেকে গিয়ে তিনি পরনের কোট খুলে ফেলেন এবং তা সুন্দরভাবে রেলিংয়ে ঝুলিয়ে দেন। এরপর ছোট্ট করে একটি সুইসাইড নোট লিখে ঝাঁপিয়ে পড়েন ৮৬ তলা থেকে!
এভিলিনের শেষ ইচ্ছা ছিল, কেউ যেন তার মৃতদেহ না দেখে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার শেষ ইচ্ছাটি পূরণ হয়নি, বরং হয়েছে তার উল্টো।
৮৬ তলা থেকে নিচে জাতিসংঘের একটি লিমুজিনের ওপর পড়ার চার মিনিট পর ফটোগ্রাফির একজন ছাত্র রবার্ট উইলস এভিলিনের মৃতদেহটির একটি ছবি তুলে রাখে। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যায় সেই ছবি।
ছবিটিতে দেখা যায় লিমুজেনের ওপর শান্তভাবে শুয়ে আছেন এভিলিন। তার স্নিগ্ধ চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল যেন মাত্রই ঘুমিয়ে পড়েছেন তিনি। তার পা দুটো মার্জিতভাবে একটির ওপর আরেকটি ওঠানো ছিল। গ্লাভসপরা একটি হাত আলতো করে রাখা ছিল বুকের ওপর, এবং সে হাতে শক্ত করে তিনি ধরে ছিলেন একটি মুক্তার নেকলেস।
এভিলিনের মৃতদেহের এই ছবিটিকে টাইম ম্যাগাজিন ‘ইতিহাসের সুন্দরতম আত্মহত্যা’ হিসেবে উল্লেখ করে। তবে কী কারণে এভিলিন আত্মহত্যা করেছিলেন, তার সঠিক কারণ জানা যায়নি।
৪. মেরিলিন মনরো
১৯২৬ সালের ১ জুন তারিখে জন্মগ্রহণ করা মেরিলিন মনরোর শৈশব মোটেও সুখকর ছিল না। নিজের বাবাকে কখনোই না দেখা মনরোর মা-ও বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় জর্জরিত ছিলেন। যে এতিমখানায় তার শৈশবের বেশিরভাগ সময় কেটেছিল, সেখানেও বেশ কয়েকবার যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়েছিল মনরোকে।
অল্প বয়সেই জীবনের কঠিনতম দিক দেখে ফেলা মনরো বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিয়ে একসময় হলিউড তারকা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। শুরুর দিকে অপেক্ষাকৃত ছোট চরিত্রে কাজ করতে হয়েছিল তাকে। পরবর্তীতে নিজের যোগ্যতা ও চোখ-ধাঁধানো সৌন্দর্য দিয়ে বড় বড় সিনেমার মূল চরিত্রে জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি, এবং উপহার দিয়েছিলেন ‘The Seven Year Itch’ এবং ‘Gentlemen Prefer Blondes’ এর মতো সুপারহিট সব মুভি।
রূপালি পর্দায় দু’হাত ভরা সাফল্য পেলেও ব্যক্তিগত জীবনে মনরো বিষণ্ণতাসহ বেশ কিছু মানসিক সমস্যায় ভুগতেন। সে কারণে তাকে নিয়মিত সাইকিয়াট্রিস্টের নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকতে হতো।
১৯৬২ সালের ৫ আগস্ট মনরোর গৃহকর্মী অনেক ডাকাডাকির পরও তার শোবার ঘর থেকে কোনো সাড়া-শব্দ না পেয়ে সাইকিয়াট্রিস্টকে খবর দেন। সাইকিয়াট্রিস্ট শোবার ঘরের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকেন, এবং বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকা মনরোর নিথর দেহটি দেখতে পান। এ সময় মনরোর এক হাতে ছিল একটি টেলিফোন, এবং বিষণ্ণতা দূর করার জন্য দেয়া সেডাটিভের একটি শূন্য বোতল।
সংক্ষিপ্ত তদন্ত শেষে পুলিশ মেরিলিন মনরোর মৃত্যুকে অতিরিক্ত ড্রাগ গ্রহণের মাধ্যমে আত্মহত্যা বলে ঘোষণা করে। যদিও অতিরিক্ত ড্রাগ গ্রহণ তার ইচ্ছাকৃত ছিল, নাকি সেটি ছিল একটি নিছক দুর্ঘটনা, তা আজ পর্যন্ত ধোঁয়াশাই থেকে গেছে।
৫. কার্ট কোবেইন
কার্ট কোবেইন ছিলেন নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় ব্যান্ড দল নির্ভানার ভোকালিস্ট। সাফল্যের চরম শিখরে থেকেও অনিয়ন্ত্রিত জীবন এবং চরম হিরোইন আসক্তির কারণে খুব অল্প বয়সেই তাকে বেছে নিতে হয়েছিল আত্মহত্যার পথ।
১৯৬৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করা কোবেইন ও তার ব্যান্ড দল নির্ভানা তাদের দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘Nevermind’ এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে যায়। ওই অ্যালবামের একটি গান ‘Smell Like Teen Sprit’ রীতিমতো গানের দুনিয়ায় বিপ্লব ঘটিয়ে দেয়, এবং তাদের গ্রাঞ্জ ঘরানার গান বিশ্বব্যাপী সঙ্গীতপ্রেমীদের মধ্যে আলোড়নের সৃষ্টি করে। কোবেইন পরিণত হন একজন আন্তর্জাতিক তারকায়।
কিন্তু এই বিপুল খ্যাতি তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়, এবং এর সাথে তীব্র হিরোইন আসক্তি তার জীবনকে বিষিয়ে তোলে।
১৯৯৪ সালের শুরুর দিকে কোবেইনের হিরোইন আসক্তি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, এবং ওই বছরের ৪ এপ্রিল মাত্র ২৭ বছর বয়সে পৃথিবীকে চিরতরে বিদায় জানান তিনি।
২ এপ্রিল থেকেই কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না কোবেইনের। পরবর্তীতে ঐ মাসের ৮ তারিখে একজন ইলেক্ট্রিশিয়ান কোবেইনের সিয়াটলের বাড়িতে তার নিথর দেহ আবিষ্কার করেন। শটগান দিয়ে নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করেছিলেন কোবেইন।