১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে জাপান আমেরিকার পার্ল হারবারে আক্রমণ চালায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জাপানের এই আক্রমণটি যুদ্ধকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল। এছাড়াও হামলার পরের কয়েক মাস সবকিছুই জাপানের পক্ষে ছিল। যদিও দু’পক্ষের মধ্যকার চলমান দ্বন্দ্ব প্রথমবার আনুষ্ঠানিক যুদ্ধে রূপ নেয় ১৯৪২ সালের মে মাসে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কর্তৃত্ব নিয়ে মার্কিনীদের সঙ্গে জাপানী বাহিনীর ঐ যুদ্ধটি ব্যাটল অব মিডওয়ে নামে পরিচিত।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জলসীমা এবং আকাশসীমায় সমান কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাপানী নৌবাহিনী শেষপর্যন্ত নিউ গিনি উপকূল অবধি পৌঁছাতে পেরেছিল। মার্কিন নৌবাহিনী কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় এডমিরাল ইসারকু ইয়ামামোতো পিছু না হটে সম্মুখ যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন। পার্ল হারবারে সফলতা পাওয়ায় সেবারও বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন তিনি। জাপানীরা মিডওয়ে দ্বীপের মিত্র ঘাঁটিতে আক্রমণের পরিকল্পনা করে। দ্বীপটি আমেরিকা এবং জাপানের মাঝামাঝি জলসীমায় অবস্থিত। আর এই কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এটি ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘাঁটি। জাপানীরা ভালো করেই জানতো সেখানে মিত্রবাহিনী এবং মার্কিন বিমান ঘাঁটি অবস্থিত।
এডমিরাল ইয়ামামাতো নৌপথে আক্রমণের পাশাপাশি আকাশপথে বিমান হামলা চালানোর নির্দেশ দেন। তিনি ভেবেছিলেন, পার্ল হারাবারের কৌশল কাজে লাগিয়ে মিডওয়ে দখল করবে তার বাহিনী। অন্যদিকে, এরই মধ্যে মিত্র বাহিনী নিয়ন্ত্রিত পূর্বাঞ্চল, মিয়ানমার উপকূল, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, গুয়াম এবং ওয়েক আইল্যান্ডে হামলা চালিয়ে দখল করে জাপানি বাহিনী। এতগুলো সফলতার খবর একসঙ্গে পেয়ে দ্বিগুণ আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে সেনারা।
পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও এবারের অভিযানে সফল হতে পারেনি জাপানী নৌ এবং বিমানবাহিনী। ১৯৪২ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে মার্কিন বাহিনীর নিকট পরাজয় বরণ করে পিছু হটে তারা। মিডওয়ে যুদ্ধে জাপানের পরাজয়ে কারণগুলো একসময় অস্পষ্ট ছিল। পরবর্তীতে এই যুদ্ধ নিয়ে জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিন্ন ভিন্ন মতামত দিলেও গবেষকরা ঠিকই এই সম্পর্কিত সত্য ঘটনাগুলো উদঘাটন করেছেন। তবে এটি সত্য যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার ক্ষেত্রে মিডওয়ে ঘাঁটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আজ মিডওয়ে যুদ্ধের ৫টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো। মূলত পর্দার আড়ালে থাকা এই ঘটনাগুলোতেই লুকিয়ে রয়েছে যুদ্ধে জাপানীদের পরাজয় এবং মার্কিন নৌবাহিনীর সফলতার অজানা কারণসমূহ।
রাডার মার্কিন বাহিনীকে বাড়তি সুবিধা দেয়
জাপানীরা অতর্কিত আক্রমণের পরিকল্পনা করলেও এই খবরটি মার্কিন শিবিরে পৌঁছাতে তেমন দেরি হয়নি। এডমিরাল চেস্টার নিমিটজ মার্কিন বাহিনীকে সতর্ক করেন এবং জাপানীদের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানান। মিডওয়ে যুদ্ধে মার্কিন বাহিনীর জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে রাডার। প্রযুক্তিগত এই আবিষ্কারটি মার্কিন নৌবাহিনীতে সংযোজন করা হয় পার্ল হারবারে হামলার পরেই। তবে এর পূর্বে ১৯৩৮ সালে মার্কিন নৌবাহিনীর গবেষণাগারে এটি স্থাপন করা হয়।
মিডওয়েতে সর্বমোট ৩টি যুদ্ধজাহাজে রাডার স্থাপন করেছিল মার্কিন নৌবাহিনী। সেগুলোর মাধ্যমে তারা জাপানি যুদ্ধবিমানের গতিবিধি অনেক আগে থেকেই পর্যবেক্ষণ করে। এতে করে আক্রমণ মোকাবেলায় পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ পেয়েছিল মার্কিন বাহিনী। অপরদিকে, জাপানি যুদ্ধ জাহাজগুলো শুধুমাত্র সেনা সদস্যদের দিয়ে লক্ষ্যবস্তু পর্যবেক্ষণ করতো। এতে করে তারা যেমন মার্কিন বাহিনীর প্রস্তুতি বুঝতে পারেনি তেমনিভাবে মার্কিন বোমা বহনকারী ডুবুরিদের অবস্থানও নির্ণয় করতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে চরম মূল্য দিয়েই প্রশান্ত মহাসাগর ছেড়ে যায় জাপানিরা।
বিমান বাহক জাহাজগুলো পার্থক্য গড়ে দেয়
দুর্ভাগ্যবশত পার্ল হারবারে হামলার সময় মার্কিন নৌবাহিনীর বিমানবাহী জাহাজগুলো মাঝ সমুদ্রে অনুসন্ধান কাজে ব্যস্ত ছিল। একসঙ্গে তিনটি জাহাজের অনুপস্থিতি নানারকম সমালোচনা সৃষ্টি করলেও সেবারের ভুল থেকে বড় ধরনের শিক্ষা পেয়েছিল মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ। তবে মিডওয়ের যুদ্ধেও একইভাবে বিপাকে পড়তে পারতো মার্কিনরা। কারণ একই সময় দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় নিউ গিনি অঞ্চলে কোরাল সাগর যুদ্ধে মুখোমুখি হয়েছিল জাপানি এবং মার্কিন যুদ্ধ জাহাজগুলো। এটি ছিল ইতিহাসের প্রথম নৌযুদ্ধ যেখানে জাহাজগুলো পরস্পর গুলি চালায়নি।
মিডওয়ে বিমানবাহী জাহাজগুলোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন দায়িত্বরত এডমিরাল নিমিটজ। তার নির্দেশে নিউ গিনি উপকূল থেকে ছুটে আসে ৩টি জাহাজ। এন্টারপ্রাইজ ও হর্নেট সরাসরি মিডওয়েতে পৌঁছালেও অন্য যুদ্ধজাহাজ ইয়র্কটাউন মেরামতের উদ্দেশ্যে পার্ল হারবার নৌঘাঁটির দিকে যাত্রা করে। অপরদিকে, জাপানের দুটি অত্যাধুনিক বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ শোকাকু এবং জুইকাকু কিছুদিন আগেই যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যার ফলে মিডওয়ে যুদ্ধে বিমানবাহী জাহাজ ছাড়াই অংশগ্রহণ করে জাপান। আর এখানেই মার্কিন বাহিনীর থেকে অনেকটা পিছিয়ে পড়ে তারা।
যুদ্ধের ১ সপ্তাহ আগে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ মেরামত করেছিল মার্কিন নৌবাহিনী
১৯৪২ সালের মে মাসের শেষেরদিকে পার্ল হারবারের নৌঘাঁটিতে পৌঁছায় যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইয়র্কটাউন। কোরাল যুদ্ধে একপ্রকার ধ্বংস হয়ে যাওয়া জাহাজটি প্রায় ৩,০০০ মাইল পাড়ি দিয়ে পার্ল হারবারে পৌঁছায়। অথচ জাপানিরা ধরেই নিয়েছিল যুদ্ধে তারা মার্কিন এই রণতরীটি পুরোদমে ধ্বংস করে দিয়েছে। কারণ কোরাল সমুদ্রে যুদ্ধ চলাকালীন এর উপর ৫৫১ পাউন্ডের বোমা নিক্ষেপ করেছিল জাপানিরা। পার্ল হারবার নৌঘাঁটির এক নম্বর ড্রাইডেকে প্রায় ১,৪০০ শ্রমিক একটানা ৪৮ ঘন্টা কাজ করে জাহাজটিকে পুনরায় যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত করেছিল।
মার্কিন নৌবাহিনীর অন্য দুটো বিমানবাহী জাহাজ ততক্ষণে মিডওয়েতে পৌঁছালেও ইয়র্কটাউন তখনো এডমিরাল নিমিটজের অনুমতির অপেক্ষায় পার্ল হারবারে অপেক্ষা করছিল। অতঃপর ছাড়পত্র পেয়ে ইয়র্কটাউন যখন উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে ছুঁটে চলে তখন জাপানিরা একপ্রকার বিস্মিত হয়। যদিও মিডওয়ে যুদ্ধ চলাকালে ৭ জুন জাপানি সেনারা বোমা হামলা চালিয়ে ইয়র্কটাউন জাহাজটিকে ধ্বংস করে দেয়। যদিও এটি মূলত একটি ফাঁদ হিসেবে কাজ করে। জাপানিরা এই জাহাজটি নিয়ে ব্যস্ত থাকাকালে তাদের উপর অতর্কিত হামলা চালায় মার্কিনীরা। অতঃপর ১৯৯২ সালে রবার্ট ব্যালার্ডের নেতৃত্বে একদল অনুসন্ধানকারী দল প্রশান্ত মহাসাগরের ১৬,৬৫০ ফুট নিচে ইয়র্কটাউনের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করে। এই দলটি পরবর্তীতে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষও খুঁজে বের করে।
হলিউডের একজন পরিচালক যুদ্ধের ছবি সংগ্রহ করেন!
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, মিডওয়ে যুদ্ধ চলাকালে এর উপর নির্মিত সিনেমার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়। পরিচালক জন ফোর্ড পেশাগতভাবে মার্কিন নৌবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। এডমিরাল নিমিটজের নির্দেশে তিনি মিডওয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। অনুমতিক্রমে তিনি সে সময় অসাধারণ কিছু ফুটেজ নেন। যদিও বোমার আঘাতে তিনি আহত হয়েছিলেন, তবে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যেতে অপারগতা প্রকাশ করেন। মার্কিন নৌবাহিনীর নথি অনুযায়ী আহত অবস্থায় ফোর্ড যুদ্ধের ফুটেজ সংগ্রহ করেছিলেন।
ফোর্ডের ধারণকৃত ফুটেজ এবং ইউএস বি-১৭ এর কার্যকলাপ পরবর্তীতে তার নির্মিত সিনেমা ‘দ্য ব্যাটল অব মিডওয়ে’তে সংযোজন করা হয়। একই বছর সিনেমাটি অস্কার জেতে। যদিও এই যুদ্ধ নিয়ে পরবর্তীতে একাধিক সিনেমা নির্মিত হয়েছিল। হলিউড বরাবরই আমেরিকানদের কৃতিত্ব তুলে ধরেই সিনেমাগুলো নির্মাণ করেছে। সেক্ষেত্রে ফোর্ড আহত হওয়ার পর সত্যিই সেখানে ছিলেন কি না সে খবরটির সত্যতা নিয়েও বিতর্ক আছে। আর একে সত্য প্রমাণ করতে অন্য কোনো সূত্রও কাজে লাগানোর উপায় নেই। কারণ প্রশান্ত মহাসাগরে যুদ্ধ চলাকালে সেখানে কোনো সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন না। তাই মার্কিন নৌবাহিনীর নথিপত্রকেই সত্য হিসেবে মেনে নিতে হবে। অতঃপর যুদ্ধ শেষে সরাসরি সিআইএ-তে নিয়োগ পান ফোর্ড। সেখানকার অফিস অব স্ট্র্যাটেজিক সার্ভিসেস এর নেতৃত্ব দিতেন তিনি।
যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি
পার্ল হারবারে হামলার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে জাপানের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘাতের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধের শুরুরদিকে ভালো অবস্থানে থাকা জাপান নিজেদের দখলকৃত অঞ্চলের পরিধি বৃদ্ধি করতে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে বেছে নেয়। অন্যদিকে, মিত্র বাহিনীর জন্যও এই জলসীমা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, পার্ল হারবারে হামলার ছয় মাসের মাথায় মিডওয়ের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া জাপানের জন্য ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। অবশ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের ভূমিকা পর্যালোচনা করলে এমনটা মনে হওয়ার কথা না।
লাগামহীনভাবে উঁড়তে থাকা জাপান চেয়েছিল যেকোনো মূল্যে মিডওয়ে দখল করে ঐ অঞ্চলে ঘাঁটি গড়া। কিন্তু যখন তারা বুঝতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পরাজিত করা অসম্ভব তখন তারাও নিজেদের গুটিয়ে নেয়। ইতোমধ্যেই আমরা জেনেছি, জাপানের বড় দুটি বিমানবাহী জাহাজ কোরাল যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মিডওয়েতে অংশগ্রহণ করেনি। কিন্তু কোনো কোনো গবেষকের ধারণা, পুরোদমে ধ্বংস হওয়ার ভয়ে এডমিরাল ইয়ামামোটো সেগুলোকে ডাকেননি। হয়তো তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই যুদ্ধে জয়লাভ করা অসম্ভব।
যুদ্ধে মার্কিন বাহিনীর হামলায় বড়সড় ক্ষতির সম্মুখীন হয় জাপান। তাদের ২০০ জন অভিজ্ঞ পাইলটসহ সর্বমোট ৩,০০০ যোদ্ধা নিহত হয়। এছাড়াও ৩০০টি যুদ্ধবিমান, ১টি ভারী ক্রুজার এবং ৪টি ছোট বিমানবাহী জাহাজ ধ্বংস হয়ে যায়। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৪৫টি যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে জাপানিরা। নিহত হন ৩৬০ জন যোদ্ধা। এছাড়াও ইয়র্কটাউন এবং হ্যাম্যান চিরতরে অকেজো হয়ে যায়। কিন্তু এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দুই দেশের চলমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা শেষ হয়নি। বরঞ্চ ঐ বছরের অক্টোবরে সান্তা ক্রুজ যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি বহর নিয়ে অপেক্ষায় ছিল জাপান।
ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
২য় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ
১) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধা এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে গল্প সংকলন
২) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ