
কোরিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে পাহাড়বেষ্টিত একটি মেট্রোপলিটন শহর হলো গোয়াংজু। এটি ৩,৮৯৪ ফুট উচ্চতার মুদিউং পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত। প্রশাসনিকভাবে একটি প্রদেশের সমান মর্যাদা নিয়ে সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত হয়। প্রাচীনকাল থেকেই গোয়াংজু কোরীয় উপদ্বীপের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। জাপানি সাম্রাজ্যের (১৯১০-১৯৪৫) অধীনে থেকেই এর অধিবাসীদের আঞ্চলিক বঞ্চনা এবং সংগ্রামের ইতিহাস শুরু হয়।

আধুনিক দক্ষিণ কোরিয়ার গণতন্ত্রের ইতিহাসে গোয়াংজুর রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের কথা আজ কোরিয়াবাসী গর্বভরে স্মরণ করে। শুধু দক্ষিণ কোরিয়াতেই নয়, গোয়াংজুর ১৯৮০ সালের গণঅভ্যুত্থান পুরো পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতেই দারুণ প্রভাব বিস্তার করেছিল। এটি থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে দেশে দেশে সামরিক একনায়কদের বিরুদ্ধে ছাত্র ও জনগণ সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করেছিল। স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটেছিল বহু দেশে।
পূর্বাহ্নে
কোরিয়া প্রজাতন্ত্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন সিংগমান রে। আঠারো বছরের শাসনকালে তিনি বিশেষভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উপর এবং সার্বিকভাবে কোরিয়ার জনগণের উপর চরম নিপীড়ন চালান। ১৯৬০ এর দশকের শুরুর দিকে সে দেশের ছাত্ররা তার বিরুদ্ধে সংগঠিত গণবিক্ষোভে নেতৃত্ব দেয়। ১৯৬০ সালের এপ্রিল মাসে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। কয়েকমাসের জন্য সংসদীয় ব্যবস্থায় দেশ পরিচালিত হতে থাকে।
১৯৬১ সালের মে মাসে জেনারেল পার্ক চুং-হি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। পরের বছরে তিনি রাষ্ট্রপতি হন। পার্কও আঠারো বছর ধরে দক্ষিণ কোরিয়ার শাসনক্ষমতায় টিকে থাকেন। ১৯৭২ সালেন য়ুশিন সংবিধানে তিনি রাষ্ট্রপতিকে ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান করেন। সাংবিধানিকভাবে দক্ষিণ কোরিয়া কার্যত একনায়কতান্ত্রিক দেশে পরিণত হয়। পার্কের শাসনকালেও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষেরা দমন-পীড়নের শিকার হয়। জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ, সংবাদপত্র ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে পার্ক সরকার তার নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব বজায় রাখে। আমেরিকার সমর্থন নিয়েও তিনি শেষ পর্যন্ত ১৯৭৯ সালের ২৬শে অক্টোবর, সিউলের একটি গণিকালয়ে ভ্রমণকালে গুপ্তহত্যার শিকার হন। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক কিম জে-কিউ পার্ককে হত্যা করেছিলেন।
পরবর্তীকালে, ১৯৭৯ সালের ১৭ই মে তারিখে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল চুন দু-হোয়ান অভ্যন্তরীণ ক্যু ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। জেনারেল চুন পুরো দেশব্যাপী শাসরিক শাসন জারি করেন। গণতন্ত্রপন্থী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাদের বাড়িতে বাড়িতে পুলিশ বাহিনী পাঠিয়ে তাদেরকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। তার লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে ছিল গোয়াংজুর চোন্নাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংগঠনের নেতারাও।

১৯৮০ সালের মার্চ মাস। চোন্নাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন সেমিস্টার শুরু হয়েছে। পার্কের শাসনামলে রাজনৈতিক কারণে ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ ঘোষিত অধ্যাপক এবং ছাত্ররা ফিরতে শুরু করেছেন। এর মধ্যেই তারা রাজনৈতিক সংস্কারের ডাক দেন। তাদের দাবিগুলোর মধ্যে ছিল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, সামরিক আইনের অবসান এবং স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রবর্তন। ১৫ই মে তারিখে আনুমানিক ১ লক্ষ শিক্ষার্থী রাজনৈতিক সংস্কারের দাবিতে সিউল স্টেশনে পদযাত্রা করে। দু’দিন পর ১৭ই মে জেনারেল চুন সংবাদপত্রের অফিস এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ ঘোষণা করেন। কয়েকশ’ ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার করা হয়। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর ২৬ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যে গোয়াংজুর সন্তান কিম দে-জাংও ছিলেন।
বিক্ষোভের সূত্রপাত: ১৮ই মে
শুরুতে গোয়াংজুর চোন্নাম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গণতন্ত্রের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। সে সময় জেনারেল চুন দু-হোয়ান বিক্ষোভ চলমান থাকলে সহিংসতার মাধ্যমে বিক্ষোভ দমনের হুমকি দেন। পুরো দক্ষিণ কোরিয়া জুড়ে মানুষেরা সে সময় ভয়ে সন্ত্রস্ত ছিল। কোরিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর গোয়াংজু ছিল এর ব্যতিক্রম। তারা বিক্ষোভ চালিয়ে যায়। পার্কের মৃত্যুতে গোয়াংজুবাসী আশার আলো দেখতে পেয়েছিল। জিয়োল্লা প্রদেশের অধিবাসীরা পার্কের আঞ্চলিক বৈষম্যের ব্যাপারে ক্ষুব্ধ ছিল। পার্কের অঞ্চল জিয়োংসাংয়ের তুলনায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ জিয়োল্লা শিল্পায়নের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। তারা মনে-প্রাণে পার্কের পতন কামনা করেছিল।
এমতাবস্থায় জিয়োল্লা প্রদেশের গোয়াংজু শহরের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকেরা সামরিক আইন বাতিল এবং গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ক্ষমতাসীন জেনারেল চুন দু-হোয়ান কোরিয়ার অসামরিকীকৃত অঞ্চল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি নিয়ে দক্ষ প্যারাট্রুপারদের একটি দলকে গোয়াংজুতে পাঠান। সেনারা গোয়াংজুতে পৌঁছে শহরবাসীকে ব্যাপকভাবে আতঙ্কিত করে তোলে। প্রথম সংঘর্ষ শুরু হয় ১৮ই মে সকালবেলায়। পুলিশ এবং সেনারা নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর লাঠিচার্জ শুরু করে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ছাত্ররা পুনরায় নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একত্র হয়। আবারও তাদের উপর আক্রমণ করা হয়।
একদল সেনা প্রত্যেকটি ছাত্রকে একে একে পেটাতে থাকে। তারা পারলে সবগুলো ছাত্রের মাথা ফাটিয়ে ফেলে, পিঠ ক্ষতবিক্ষত করে, মুখে লাথি ছোঁড়ে। ফলে ছাত্রদেরকে মাংসের ভর্তার মধ্যে এক দলা কাপড়-চোপড়ের মিশ্রণ বলে মনে হয় (গোয়াংজু ডায়েরি: পৃ. ৪৬)।

হতাহত ছাত্রদের শরীরগুলো ট্রাকে তুলে স্তুপ করে রাখা হয়। সেখানেও সেনারা লাথি মারা অব্যাহত রাখে। রাতের বেলা সেনাবাহিনী কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আস্তানা তৈরি করে।
পরদিন ছাত্ররা রাজপথে প্রতিরোধ তৈরি করে। সেনারা বেয়নেট ব্যবহার করে। কয়েক ডজন ছাত্র-ছাত্রীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যে অনেককেই উলঙ্গ করে পাশবিক নির্যাতন করা হয়। সে সময় ধর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে বলে জানা যায়। পুরো শহরের মানুষ সেনাবাহিনীর এহেন চরম প্রতিক্রিয়ায় হতবাক হয়ে যায়। এমনও শোনা যায়, সেনাদের বর্বরতা ঠেকাতে এগিয়ে আসা স্থানীয় পুলিশের তথ্য বিভাগের একজন পরিচালককে তারা বেয়নেট দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছিল।

কয়েক দফা লাঠিচার্জ এবং কয়েকশ’ গ্রেফতারের পরেও ছাত্ররা পুনরায় একত্রিত হয়। তারা আবারও প্রতিরোধ তৈরি করে এবং পাল্টা আক্রমণ করে।
গোয়াংজুর টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। শহরে ঢোকার ও বেরোবার সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। স্থানীয় সকল প্রকার গণমাধ্যম অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বাইরের দুনিয়া থেকে গোয়াংজুকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। বাকি দেশবাসীকে গোয়াংজুর ঘটনা সম্পর্কে পুরোপুরি অন্ধকারে রাখা হয়।
সর্বাত্মক আন্দোলন: ১৯শে মে
পরদিন, ১৯শে মে গোয়াংজু শহরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বিক্ষোভে যোগ দেয়। সংখ্যায় তারা এত বেশি ছিল যে ছাত্ররাই তখন সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। সেনাবাহিনী আবারও চরম নিপীড়নের পথ বেছে নেয়। বিক্ষোভকারীদেরকে তারা নির্মমভাবে পেটায় এবং তাদের অঙ্গহানি ঘটাতে থাকে। স্থানীয় ট্রাক এবং ক্যাব চালকেরা হতাহত বিক্ষোভকারীদেরকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে আসে। সে সময় কতিপয় পুলিশ সদস্য গোপনে বন্দীদের মুক্তি দিয়েছিলেন। ধরা পড়ার পর তাদেরকেও বেয়নেট দিয়ে আঘাত করে রক্তাক্ত করা হয়। বহু দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য তাদের কাজে ইস্তফা দিয়ে নিজ বাসায় ফিরে যায়। পুলিশের প্রধান দায়িত্বরত কর্মকর্তা সেনাবাহিনীর জোরাজুরি উপেক্ষা করে তার বাহিনীকে বিক্ষোভকারীদের উপর গুলিবর্ষণের নির্দেশ প্রদান করা থেকে বিরত থাকেন।

পাল্টা আক্রমণ: ২০শে মে
বিক্ষোভকারীরা পাথর, ব্যাট, ছুরি, পাইপ, লোহার রড, হাতুড়ি এবং মলোটভ ককটেল নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করে। সে সময় ১৮,০০০ দাঙ্গা পুলিশ এবং ৩,০০০ প্যারাট্রুপার রাজপথের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য লড়ছিল। বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। তারপরেও গোয়াংজুকে নিস্তেজ করা যায়নি। ২০শে মে বিক্ষোভকারীদের পক্ষ থেকে প্রথমবারের মতো মিলিট্যান্টস্ বুলেটিন প্রকাশ করা হয়। সেখানে লড়াইয়ের হতাহত সম্পর্কে প্রচলিত গণমাধ্যমের মিথ্যা প্রচারণার পরিবর্তে প্রকৃত সংবাদ তুলে ধরা হয়। সে দিন বিকাল ৫টা ৫০ মিনিটে পাঁচ হাজার বিক্ষোভকারীর একটি দল পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে।
সেনাবাহিনী তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিলে তারা পুনরায় রাস্তায় এক হয়। সেখানে তারা একটি দল গঠন করে পুলিশ থেকে সেনাবাহিনীকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করতে থাকে। সন্ধ্যাবেলায় শহরের বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা বেড়ে ২ লক্ষে পৌঁছায়। সে সময় শহরের মোট জনসংখ্যাই ছিল ৭ লক্ষ। এই বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ছিল কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র এবং নানান শ্রেণি-পেশার মানুষ।
নয়টি বাস এবং দুই শতাধিক সংখ্যক ট্যাক্সি বিক্ষোভকারীর মিছিলকে নেতৃত্ব দিয়ে শহরের প্রাণকেন্দ্র কুমনাম এভিনিউয়ের দিকে নিয়ে আসে। আবারও সৈন্যরা মিছিলে আক্রমণ চালায়। এবার পুরো শহর সেই আক্রমণকে রুখে দেয়। সেই রাতে কার, জিপ, ট্যাক্সি এবং অন্যান্য যানবাহন পুড়িয়ে দেয়া হয়। শহরবাসী সেনাবাহিনীকে কোণঠাসা করে ফেলে। সেনা সদস্যদের উপর্যুপরি আক্রমণের পরেও শেষদিকে গণতন্ত্র চত্বরে অচলাবস্থা বিরাজ করে। স্থানীয় ট্রেন স্টেশনে বহু বিক্ষোভকারীকে হত্যা করা হয়।
গণতন্ত্র চত্বর সংলগ্ন প্রাদেশিক ভবনের সামনে সেনারা এম-সিক্সটিন রাইফেল দিয়ে জনতার উপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। সে সময়ে আরো অসংখ্য বিক্ষোভকারী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। গোয়াংজু সেন্ট্রাল হাই স্কুলে গুলি চালিয়ে ২০ জন ছাত্রীকে হত্যা করা হয়। অ্যাম্বুলেন্স এবং ট্যাক্সি ডাইভাররা আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলে তাদের উপরও গুলিবর্ষণ করা হয়। গোলাগুলির সময় পার্শ্ববর্তী ক্যাথলিক সেন্টারে ১০০ জন হাই স্কুল ছাত্র আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের সবাইকেই গুলি করে হত্যা করা হয়।

নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম এই হত্যাকাণ্ডের খবর পুরোপুরি চেপে যায়। উল্টোদিকে বিক্ষোভে ভাঙচুর এবং ছোটখাট পুলিশি পদক্ষেপের বানোয়াট খবর তারা প্রচার করতে থাকে। সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কোনো প্রতিবেদন প্রচার করা হয় না। পরের দিনও গণমাধ্যম গোয়াংজু পরিস্থিতি সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য কোনো খবর প্রচার করতে ব্যর্থ হয়। সে সময় কয়েক হাজার বিক্ষুব্ধ শহরবাসী এমবিসি গণমাধ্যম ভবন ঘেরাও করে। সেখানকার কর্তৃপক্ষ ও ভবনের প্রহরীরা পিছু হটে এবং জনতা ভবনের মধ্যে ঢুকে পড়ে। প্রচার কার্যক্রম বন্ধ দেখে তারা ভবনটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
সেদিন রাত ১টার দিকে জনতা রাজস্ব ভবনে ঘেরাও করে। সেখানকার আসবাবপত্র ভাঙচুর করে এবং সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর পেছনের কারণ হলো, যে রাজস্ব জনগণের কল্যাণে ব্যবহৃত হওয়ার কথা, সেগুলো ব্যয় করা হয় সেনাবাহিনীর পেছনে এবং অস্ত্র উৎপাদনের কাজে। যেগুলো দিয়ে আবার মানুষকে হত্যা এবং নির্যাতন করা হয়। খুবই অদ্ভুতভাবে সেদিন রাজস্বভবন এবং প্রচারকেন্দ্রগুলোতে আগুন দেওয়া হলেও স্থানীয় পুলিশের ঘাঁটি এবং অন্যান্য ভবনগুলো সুরক্ষিত রাখা হয়েছিল (দ্য মে এইটটিন গোয়াংজু ডেমোক্রেটিক আপরাইজিং: পৃ. ১৩৮)।
রাজস্ব ভবন এবং দুটি প্রচারকেন্দ্র ছাড়াও শ্রম পর্যবেক্ষণ দপ্তর, প্রাদেশিক ভবনের গাড়ির ডিপো এবং ষোলটি পুলিশের গাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেদিন রাত ৪টার দিকে স্থানীয় ট্রেন স্টেশনে সর্বশেষ একটি ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সেনারা আবারও এম-সিক্সটিন রাইফেল ব্যবহার করে জনতার উপর নির্বিচারে গুলি ছোঁড়ে। সামনের সারির অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়। অন্যরা তাদের লাশ অতিক্রম করে গিয়ে লড়াই চালিয়ে গিয়েছিল। দারুণ স্পর্ধার সাথে সে রাতে জনতার বিজয় হয়েছিল। সেনাবাহিনী দ্রুত পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল।
সশস্ত্র বিদ্রোহ: ২১শে মে
২১শে মে সকাল নয়টার দিকে প্রায় ১ লক্ষ মানুষ পুনরায় কুমনাম এভিনিউয়ে জড়ো হয়। সেখানে তারা সৈন্যদের মোকাবেলা করে। জনতার মধ্যে একটি ছোট দল চেঁচিয়ে বলে, তাদের এশিয়া মোটরর্সে (সেনাবাহিনীর একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান) গিয়ে সেনাযানগুলোর দখল নেয়া উচিত। একদল মানুষ সেখানে গিয়ে একে একে ৩৫০টি সাঁজোয়া যান জনতার দখলে নিয়ে আসে। বিক্ষোভকারীরা সাঁজোয় যানগুলো নিয়ে একটি বৃহৎ মিছিলের সাথে পুরো শহর প্রদক্ষিণ করে। শুধু তা-ই নয়, তারা প্রতিবেশী শহর এমনকি গ্রামগুলোতেও গিয়ে বিদ্রোহ ছড়িয়ে দেয়। কয়েকটি ট্রাক পার্শ্ববর্তী কোকা কোলা ফ্যাক্টরি থেকে রুটি এবং পানীয় নিয়ে আসে।
সেনাবাহিনীর সাথে সমঝোতায় আসার জন্য জনতা কয়েকজন প্রতিনিধি নির্বাচিত করে। তাদেরকে সেনাদের কাছেও পাঠানো হয়। হঠাৎ সে সময়ে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। শান্তিপূর্ণ সমঝোতার আশা সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায়। প্রায় দশ মিনিট ধরে সেনারা নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। সে সময়ে কয়েক ডজন মানুষ মারা যায় এবং পাঁচশ’ জনের মতো হতাহত হয়।

জনতা খুব দ্রুতই জবাব দেয়। গুলিবর্ষণের দু’ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে প্রথম পুলিশ ঘাঁটি থেকে অস্ত্র লুট করা হয়। জনতা কার্যনির্বাহী দল গঠন করে। পুলিশ ও জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র লুট করা হয়। তারা শহরের দুটি কেন্দ্রীয় এলাকায় জড়ো হয়। হোয়াসুনের কয়লাখনির শ্রমিকদের সাহায্য নিয়ে বিক্ষোভকারীরা বিপুল পরিমাণে ডিনামাইট এবং বিভিন্ন বিস্ফোরক দ্রব্য সংগ্রহ করে। সাতটি বাসভর্তি নারী পোশাক শ্রমিকেরা নাজু গিয়ে কয়েকশ’ রাইফেল এবং প্রচুর পরিমাণে গোলাবারুদ সংগ্রহ করে গোয়াংজুতে নিয়ে আসে।
চাঙসং, ইয়োগ্গওয়াং এবং তামইয়াং জেলাগুলোয় এ ধরনের অস্ত্রাগার লুটপাটের ঘটনা ঘটে। হোয়াসুন, নাজু, হাম্পইয়ুং, ইয়ংঙ্কওয়াং, কাঙজিন, মুয়ান, হায়নাম, মকপো- সকল এলাকায় এবং বিশেষত দক্ষিণ-পশ্চিম কোরিয়ার আরো ১৬টি অঞ্চলে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। চুনজু এবং সিউলে অভ্যুত্থান পৌঁছানোর তাগিদে বিক্ষোভকারীর একটি দল সেসব এলাকার উদ্দেশে রওয়ানা দেয়। সড়ক এবং রেলপথে পাহারারত সৈন্যরা তাদেরকে আটক করে। হোয়াসুন এবং ইয়োগ্গওয়াং জেলাগুলো থেকে গোয়াংজুতে প্রবেশের উদ্দেশ্যে আসা সশস্ত্র বিক্ষোভকারীদের বেশ কয়েকটি দলকে হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ করে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়।

সেনাবাহিনী যদি তৎকালীন গণমাধ্যমকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ না করত এবং গোয়াংজুকে অবরুদ্ধ না করত, তাহলে ধারণা করা হয়, পুরো দেশব্যাপী গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হতো।
গোয়াংজু পার্ক এবং ইয়ু-তং জংশনে আন্দোলনের যোদ্ধা দল এবং নেতৃত্ব সংগঠিত হয়। প্রাদেশিক ভবনে মেশিনগানগুলো নিয়ে আসা হয়। সেদিন বিকাল ৫টা ৩০ মিনিটে সেনাবাহিনী পিছু হটে। রাত ৮টা নাগাদ জনতা শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। চারিদিকে উৎফুল্ল জনতার মিছিল দেখা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত পুরোনো অনুন্নত অস্ত্রশস্ত্র নিয়েও জনতা আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীকে হারিয়ে দেয়।
মুক্তাঞ্চল: ২২-২৬শে মে
২২শে মে সকালবেলা জনতা সেনাবাহিনীকে শহর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করে। যাওয়ার সময় গোয়াংজুর চারিদিকে তারা বেষ্টনী তৈরি করে। ২২-২৬শে মে পাঁচদিন ধরে গোয়াংজু শহর দেশব্যাপী জারি করা সামরিক আইনের বাইরে গিয়ে মুক্তাঞ্চল হিসেবে বলবৎ থাকে। শহরবাসী নিজেদের মধ্যে পেশাদার এবং শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে বিভিন্ন দল গঠন করে। যেমন- একদল মানুষ আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে, একদল নিহতদের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের দায়িত্বভার নেয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে। শহরে লাশের সংখ্যা এত বেশি হয়ে গেছিল যে কফিন ফুরিয়ে গিয়েছিল। তারা আরো কফিন যোগাড় করার ব্যবস্থা করে। আরেকদল শিক্ষার্থী পুরো শহরবাসীর জন্য খাবার রান্নার দায়িত্ব নেয়।
পাঁচদিনব্যাপী জনতা সুসংগঠিত ও সুশৃঙ্খলভাবে পুরো শহরকে পরিচালিত করে। এ সময়ে নাগরিকদের মধ্যে এক অভূতপূর্ব সহযোগিতা এবং নির্ভরতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। যেকোনো প্রকার রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অনুপস্থিতিতে কোনো ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের খবর পাওয়া যায়নি। গোয়াংজুতে গণহত্যার খবর পুরো প্রদেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে পার্শ্ববর্তী শহরগুলোতেও বিক্ষোভ শুরু হয়। হায়নাম শহরের প্রতিবাদ মিছিলেও সেনাবাহিনী গুলিবর্ষণ করে।

গোয়াংজুর পতন: ২৭শে মে
২৬শে মে রাতের বেলা প্রাদেশিক পরিষদে পাহারারত আনুমানিক তিনশ’ থেকে চারশ’ বিক্ষোভকারীকে হত্যা করা হয়। ২৭শে মে ভোর ৪টার দিকে বেশ কিছু সংখ্যক ট্যাংক, আর্মার্ড পার্সোননেল ক্যারিয়ার এবং হেলিকপ্টার নিয়ে পাঁচ ডিভিশনের সশস্ত্র প্যারাট্রুপার সেনারা শহরের প্রাণকেন্দ্রে যায়। রাস্তায় শহরবাসী এবং ছাত্ররা শুয়ে পড়ে তাদের গতি থামাতে চায়। সশস্ত্র বিক্ষোভকারীরা নতুন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। দুই ঘণ্টার বাছবিচারহীন গুলিবর্ষণের এবং সর্বাত্মক সংঘর্ষের পর সেনাবাহিনী শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। গোয়াংজুর ছাত্র এবং শহরবাসীর প্রতিরোধ যুদ্ধের অবসান হয়।

পরবর্তী সাত বছর ধরে কোরিয়াবাসী গোয়াংজু অভ্যুত্থানের কথা উচ্চারণ করতেও ভয় পায়। জেনারেল চুন দু-হোয়ান অবশেষে দেশব্যাপী জনগণের চাপে ১৯৮৭ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন দেন। সংগ্রামের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ফিরে আসে।
জেনারেল চুন দু-হোয়ানকে ১৯৯৬ সালে দুর্নীতি, ষড়যন্ত্র এবং গোয়াংজু গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৯৭ সালে গোয়াংজু অভ্যুত্থানে উসকানি দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার এবং পরে নির্বাসিত নেতা কিম দে-জাং ক্ষমতায় এসে জেনারেল চুনকে ক্ষমা ঘোষণা করেন।

সরকারি হিসাবমতে, গোয়াংজু অভ্যুত্থানে মারা যায় ১৪৪ জন বেসামরিক ব্যক্তি, ২২ জন সামরিক বাহিনীর সদস্য এবং ৪ জন পুলিশ সদস্য। কিন্তু সর্বসম্মত বেসরকারি হিসাব মতে, প্রায় ২,০০০ নাগরিক এই অভ্যুত্থানে নিহত হন। কফিনের সারিগুলো জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। গোয়াংজু অভ্যুত্থানের স্মরণে ১৮ই মে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। গোয়াংজু গণহত্যায় নিহতদের গণকবরকে পরবর্তীকালে জাতীয় গোরস্থানে পরিণত করা হয়। পর্যটকদের ১৮ই এপ্রিলের অভ্যুত্থানের স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে গোয়াংজু জাদুঘর নির্মিত হয়। নিহতদের স্মরণে কোরিয়াবাসী গায় ‘প্রিয়তমের তরে পদযাত্রা’ গানটি।

পূর্ব এশিয়ায় গোয়াংজুর ঢেউ
১৯৮০ সালের বসন্তে দশ দিনব্যাপী সংঘটিত গোয়াংজু অভ্যুত্থান শুধু দক্ষিণ কোরিয়ার গণতন্ত্রের লড়াইকেই উৎসাহিত করেনি। সারা পূর্ব এশিয়া জুড়ে আশি ও নব্বইয়ের দশকব্যাপী দেশে দেশে স্বৈরশাসক এবং সামরিক একনায়কদের বিরুদ্ধে জনগণের লড়াইয়ে পথ দেখিয়েছিল এবং অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল।
গোয়াংজু অভ্যুত্থানের ছয় বছর পর ১৯৮৬ সালে ফিলিপাইনে ইমেলদো মার্কোসের স্বৈরশাসনের পতন ঘটেছিল।
১৯৮৭ সালে তাইওয়ানে সামরিক আইনবিরোধী আন্দোলন সফলতার মুখ দেখে।
১৯৮৮ সালের মার্চ মাসে বার্মার রেঙ্গুনে ছাত্র এবং সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষেরা রাজপথে নেমে আসে। আন্দোলনে ভয়াবহ নিপীড়ন চালিয়ে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি নি উইন ২৬ বছর পর ক্ষমতাচ্যুত হন। পরের বছরে চীনের ছাত্ররা গণতন্ত্রের দাবিতে একটি বিশাল ছাত্রসমাবেশ করে। তিয়ানানমেন স্কয়ারে সেদিন তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল, তা বিশ্ববাসী আজো অবাক বিস্ময়ে স্মরণ করে।
১৯৯০ সালের এপ্রিল মাসে শুরু হওয়া সাত সপ্তাহব্যাপী আন্দোলনে নেপালের তৎকালীন রাজা রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন।
১৯৯২ সালের মে মাসে থাইল্যান্ডের রাজপথের গণআন্দোলনে সেনাবাহিনী গুলি চালিয়ে কয়েক ডজন আন্দোলনকারীকে হত্যা করে। এই নৃশংসতার জন্য জেনারেল সুচিন্দা ক্রাপায়ুনকে শাসন ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা হয়।
১৯৯৮ সালের ইন্দোনেশিয়ায় ছাত্ররা গণঅভ্যুত্থানের ডাক দেয়। সে সময় স্বৈরশাসক সুহার্তোকে তারা ক্ষমতাচ্যুত করতে সক্ষম হয়। এভাবে গোয়াংজু এবং তিয়ানমেন সাময়িকভাবে ব্যর্থ হলেও পূর্ব এশিয়া এবং বিশ্বব্যাপী আরো বহু গণআন্দোলনের সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছিল। এ অঞ্চলকে স্থায়ীভাবে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের লড়াইয়ে অনেকদূর এগিয়ে দিয়েছে। স্বাধীন, মানবিক ও জনবান্ধব সমাজ-রাষ্ট্র নির্মাণের লড়াইয়ে গোয়াংজু অভ্যুত্থান একটি স্মারক হয়ে আছে।