Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভিনসেন্ট কোলম্যান: যার আত্মাহুতি বাঁচিয়েছিল হাজারও মানুষের প্রাণ

ভয়ঙ্কর এক বিস্ফোরণ ঘটতে যাচ্ছে কয়েক মুহূর্ত পরেই। বেঁচে থাকার প্রবল আকাঙ্ক্ষায় দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছুটছে মানুষ। আর অন্যপাশ থেকে সেই বিস্ফোরণের দিকে ছুটে আসছে একটি যাত্রীবাহী ট্রেন। বাঁচা-মরার প্রশ্নের ফায়সালা হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই হতে যাচ্ছে। এমন সময়, ৪৫ বছর বয়সী একজন মানুষ ভাবলেন, বাঁচবার আগে বাঁচাতে হবে। তিনি ছুটে গেলেন না আর সবার মত। আর সেই বিস্ফোরণের মধ্যে আত্মাহুতি দিয়ে সেই মানুষটি বাঁচিয়ে গেলেন শত মানুষের প্রাণ। তার নাম প্যাট্রিক ভিনসেন্ট কোলম্যান। কানাডার সেই মহত্তম হৃদয়ের আখ্যান থাকছে আজকের লেখায়।

প্যাট্রিক ভিনসেন্ট কোলম্যান ছিলেন একজন ট্রেন ডিসপ্যাচার। কানাডার রেলওয়েতে কাজ করতেন তিনি। কানাডার নোভা স্কটিয়ার হ্যালিফেক্সে রিচমন্ড রেল ইয়ার্ডের ছোট্ট একটা কাঠের স্টেশনটাই ছিল কোলম্যানের অফিস। হ্যালিফ্যাক্সের পোতাশ্রয়ের ৬ নম্বর জেটির একেবারে পাশেই এই ডিপো স্টেশনটি। সেখান থেকে হ্যালিফেক্সের প্রধান রেল লাইনের ট্রেনগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হত। অর্থ্যাৎ কোন ট্রেন কখন আসবে যাবে সব খবর নিয়ে সে অনুযায়ী সমন্বয় করে ট্রেনগুলোকে ছাড়ার বা থামার জন্য নির্দেশ দেয়াই ছিলো এই স্টেশনের প্রধান কাজ। এর দায়িত্বে ছিল চিফ ক্লার্ক উইলিয়াম লভেট ও ট্রেন ডিসপ্যাচার ভিনসেন্ট কোলম্যান। মূলত টেলিগ্রাফে বার্তা পাঠানোর মাধ্যমে ট্রেনগুলোকে নির্দেশনা দেয়ার কাজটাই করতেন কোলম্যান।

Vince_coleman-face-pre1917

ভিনসেন্ট কোলম্যান

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে তখন। কোলম্যানের দিন কাটত অগণিত ট্রেনের আসা যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে করতে। কোনো ট্রেন আসছে মালামাল বোঝাই হয়ে, হ্যালিফেক্সের জেটিতে নোঙর করা জাহাজে ওঠানো হচ্ছে সেগুলো। কোনোটা যাত্রী নিয়ে পার হচ্ছে রিচমন্ড স্টেশন। বিশেষ ট্রেনে করে আসছে যাচ্ছে সৈন্যরা। আবার কোনো ট্রেন যাচ্ছে আহত সৈন্যদের নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে।

১৯১৬ সালে ‘কানাডিয়ান গভর্মেন্ট রেলওয়ে’ নাম দেয়ার আগ পর্যন্ত এর নাম ছিল ‘ইন্টারকলোনিয়াল রেলওয়ে’। ডিসপ্যাচারের দায়িত্বে থাকা কোলম্যানের পদ ছিল সাধারণ টেলিগ্রাফ অপারেটরদের চেয়ে এক ধাপ উপরে। দায়িত্ব পালনে দক্ষতার জন্য কোলম্যানের সুখ্যাতি ছিল। রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়নেও সে ছিল সক্রিয়।

৬ ডিসেম্বর, ১৯১৭। হ্যালিফেক্সের রিচমন্ডেই অফিস মাত্র পাঁচ ব্লক দূরে কোলম্যানের বাসা। স্ত্রী ফ্রান্সেস আর দু’বছরের ছোট্ট মেয়ে ইলিনকে বিদায় জানিয়ে সকালে কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। অফিসে এসে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন প্রতিদিনের মত।

এদিকে হ্যালিফিক্সের জাহাজ ঘাটেও তখন চলছিল নিয়মিত দিনের মত জাহাজের আসা যাওয়া। যুদ্ধকালীন বাণিজ্যের জন্য ওই অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জেটি ছিল সেটা। ঘাটে নোঙর করা নরওয়ের জাহাজ এসএস ইমো নেদারল্যান্ড থেকে ছেড়ে নিউইয়র্কের দিকে যাচ্ছিল, উদ্দেশ্য ছিল বেলজিয়ামের জন্য রিলিফ সাহায্য নিয়ে যাবে। আগের দিন ৫ ডিসেম্বর এটির হ্যালিফেক্স ছেড়ে যাবার কথা থাকলেও প্রয়োজনীয় জ্বালানী আসতে দেরি হওয়ায় জাহাজ ছাড়ার সময় ঠিক হয়েছিল পরদিন সকাল।

অন্যদিকে ফরাসি কার্গো জাহাজ এসএস মন্ট-ব্ল্যাঙ্ক হ্যালিফেক্স এসেছিল নিউইয়র্ক থেকে। এতে ছিল কার্গো ভর্তি বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক যার মধ্যে ছিল টিএনটি, পিকরিক এসিড, গানকটন আর বেনজোল নামক অত্যন্ত দাহ্য এক ধরনের জ্বালানী। ইউরোপগামী একটি নৌবহরে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে এসেছিল জাহাজটি।

সেদিন সকালে রওনা হল ইমো। দেরি হবার কারণে তাড়া ছিল জাহাজটির ক্যাপ্টেনের। হ্যালিফেক্স ছাড়ার সময় নির্ধারিত সীমার চেয়ে বেশি গতিতে জাহাজ ছাড়লেন তিনি। ওদিকে ইমোর যাবার পথেই বিপরীত দিক থেকে তখন রওনা হয়েছে মন্ট-ব্ল্যাঙ্ক, ধীর গতিতে। সেটাকে পাশ কাটিয়ে সাবধানে পার হতে হবে ইমো’র। কিন্তু ব্যর্থ হলেন ইমো’র ক্যাপ্টেন। মন্ট-ব্ল্যাঙ্কে অবস্থানরত হারবার পাইলট ফ্রান্সিস ম্যাকি যখন ইমো’র ছুটে আসা খেয়াল করলেন তখন সেটা মাত্র সোয়া কিলোমিটার দূরে। বেশ কয়েকবার সতর্ক বার্তা দেবার পরেও সংঘর্ষ এড়াতে পারল না ইমো। আনুমানিক সকাল ৮ টা ৪৫ মিনিটের দিকে সংঘর্ষ ঘটল দুটো জাহাজের মধ্যে।

মন্ট-ব্ল্যাঙ্ক কিন্তু খুব একটা আঘাত পায় নি। তবে বিপদ হয়ে গেল তখন, যখন ইমোর ধাক্কায় মন্ট-ব্ল্যাঙ্কে রাখা বেনজোলের কয়েকটা ব্যারেল পড়ে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ল জাহাজের ডেকে। আগেই বলেছি, বেনজোল অত্যন্ত দাহ্য জ্বালানী। ইমো যখন মন্ট-ব্ল্যাঙ্ক থেকে সরে যাচ্ছিল তখন যে অল্প স্পার্ক হল সেটাতেই পানির উপরিতলে আগুন ধরে গেল বেনজোলে।  দ্রুত সে আগুন উঠে এল উপরে, ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল।

কালো ধোঁয়া উঠতে শুরু করে সাথে সাথে। আগুন নিয়ন্ত্রণ আর সম্ভব নয় ঐ মুহূর্তে। তখন ক্যাপ্টেন ক্রুদের নির্দেশ দিলেন জাহাজ ত্যাগ করার জন্য। জেটির পাশেই রাস্তায় তখন অনেক মানুষ ভীড় করেছে জাহাজের আগুন লাগার ঘটনা দেখার জন্য। আশেপাশের সব ভবনের জানালাতেও জড়ো হয়েছে মানুষ। এদিকে জাহাজটির ক্রুরা দুটো লাইফবোটে করে আসতে আসতে চিৎকার করছিল এই বলে যে জাহাজ বিস্ফোরিত হতে যাচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যে। কিন্তু তাদের আওয়াজ ঠিকমত বুঝতে পারছিল না তীরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন। এদিকে ঢেউয়ের ধাক্কায় মন্ট-ব্ল্যাঙ্ক এসে আটকাল ৬ নম্বর জেটিতে, রিচমন্ডের রাস্তার একেবারে পাশেই।

vlcsnap-2017-01-25-14h46m35s019

জাহাজে আগুন লাগার ঘটনা দেখছে লোকজন। (হেরিটেজ মিনিটস এর চলচ্চিত্রের ভিডিও থেকে নেয়া)

ভীড় করে থাকা লোকজন যখন জানতে পারল কী ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটতে যাচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যে তখন আর খুব একটা সময় নেই। আতঙ্কে ছুটতে শুরু করল তারা। দ্রুত সে জায়গা ছেড়ে যেতে লাগল সবাই। পাশেই রেল স্টেশন। খবরটা পেয়ে স্টেশনের চিফ ক্লার্ক উইলিয়াম লভেটের সাথে কোলম্যানও বের হয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময়, কিছু একটা মনে পরে গেল কোলম্যানের। হঠাৎ করেই অফিসের দিকে ফিরে যেতে শুরু করলেন তিনি। মৃত্যু ধেয়ে আসছে, জান হাতে নিয়ে পালানোর সময়টুকুও প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। এমন একটা মুহূর্তে অফিসে ঢুকে টেলিগ্রাফের বার্তা পাঠানোর যন্ত্রটায় হাত দিলেন কোলম্যান।

আগের রাতে নিউ ব্রুনসউইক এর সেইন্ট জন ছেড়ে আসা ১০ নম্বর যাত্রীবাহী ট্রেনটি রিচমন্ডে পৌঁছানোর কথা ছিল সকাল ৮টা ৫৫ মিনিটে। আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেটি এসে পড়ল বলে। ৩০০ জনের মত যাত্রী ছিল সে ট্রেনে। বাঁচার তাগিদে স্টেশন ছেড়ে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে কোলম্যানের মনে পড়েছিল তাদের কথা। যে ট্রেনগুলো এই মুহূর্তে হ্যালিফ্যাক্সের দিকে আসছে সেগুলোও তো বিপদে পড়বে। ১০ নম্বর ট্রেনটা তো নিশ্চিত বিস্ফোরণের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। এই ভেবে কোলম্যান টেলিগ্রাফে বার্তা পাঠানো শুরু করলেন হ্যালিফেক্সগামী ট্রেনগুলো থামানোর জন্য।

vlcsnap-2017-01-25-14h49m14s711

বার্তা পাঠাচ্ছেন কোলম্যান। (চলচ্চিত্রের ভিডিও থেকে নেয়া ছবি)

জীবনের অন্তিম মুহূর্তে পৌঁছে টেলিগ্রাফে বার্তা লিখলেন কোলম্যান-  “ট্রেন থামাও। ৬ নম্বর জেটির কাছে গোলাবারুদ ভর্তি জাহাজে আগুন ধরেছে এবং এখনই বিস্ফোরিত হবে। হয়ত এটাই হতে যাচ্ছে আমার পাঠানো শেষ মেসেজ। বিদায় বন্ধুরা।”

রিচমন্ডের আগের স্টেশন রকিংহাম থেকে বেডফোর্ড, উইন্ডসর জংশন, এলমসডেল, স্টিওয়েক, তুরো পর্যন্ত মেসেজ পাঠাতে সক্ষম হলেন কোলম্যান। এরপর নিস্তব্ধ হয়ে গেল তার হাত দুটো। ৯ টা ৫ মিনিটের কয়েক সেকেন্ড আগে বিস্ফোরিত হল মন্ট-ব্ল্যাঙ্কের কার্গো।

গোটা জাহাজ খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেল সাথে সাথে। বিস্ফোরণ কেন্দ্রের তাপমাত্রা হল পাঁচ হাজার ডিগ্রী সেলসিয়াস। সেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণে জাহাজের সামনে স্থাপিত বন্দুকের একটি ব্যারেল সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরে ডার্টমাউথে গিয়ে পড়েছিল। আর আধা টন ওজনের নোঙরটি উড়ে গিয়ে পড়েছিল সোয়া তিন কিলোমিটার দূরে, আর্মডেলে।

Halifax_Explosion_blast_cloud_restored

বিস্ফোরণের পর উঠছে ধোঁয়ার কুণ্ডলী

সাথে সাথেই আগুন ধরে গিয়েছিল ৬ নম্বর জেটিতে। সারি সারি বক্সকার পুড়ে ছাই হয়ে গেল চোখের পলকে। বিস্ফোরণের কেন্দ্র থেকে সাড়ে সাতশ ফুট দূরে কোলম্যানের স্টেশন, সেটা গুঁড়িয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। কোলম্যান তার টেলিগ্রাফ যন্ত্রের পাশে তখনই নিহত হলেন, নিশ্চিতভাবেই বলা যায় সেটা।

প্রায় ১২,০০০ ফুট উপর পর্যন্ত উঠেছিল কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী। বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট শক ওয়েভ অনুভূত হয়েছিল ২০৭ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত। ঘটনার মুহূর্তে একটা সুনামি সৃষ্টি হয় পানিতে, যার কারণে ৬০ ফুট উঁচু ঢেউ আছড়ে পড়ে হ্যালিফ্যাক্সের তীরে। সেই সুনামিতে ডার্টমাউথে গিয়ে আটকায় ইমো জাহাজটি। মন্ট-ব্ল্যাঙ্কের ক্রুদের একজন বাদে মারা যায় সবাই।

imo1

ডার্টমাউথে আটকে পরা জাহাজ ইমো

বিস্ফোরণের সাথে সাথে নিহত হয় ১,৬০০ জনের বেশি মানুষ। আহত হয় প্রায় ৯,০০০ জন, তাদের মধ্যে ৩০০ জন মারা যায় পরবর্তীতে। বিস্ফোরণের আড়াই কিলোমিটারের মধ্যে যতগুলো দালান ছিল প্রতিটিতে আঘাত লাগে সেই ধাক্কার। ১২,০০০ এর বেশি ভবন হয়ে গুঁড়িয়ে যায় না হয় অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধ্বসে পড়ে হ্যালিফেক্সের জেটির কাছেই অবস্থিত চিনিকল ও কটন মিল।

অন্তত ছয় হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে, বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরও পঁচিশ হাজার জনের। যারা বাড়ির জানালার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছিল অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তাদের মধ্যে জীবিতদের প্রায় সবাই, ৪১ জন, অন্ধ হয়ে যায় বিস্ফোরণে কাঁচ ভেঙে যাওয়ার কারণে। আর সব মিলিয়ে চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ছয় হাজার মানুষের।

c019953

বিস্ফোরণের পর হ্যালিফেক্সের জেটি

এই দূর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল আজকের হিসেবে প্রায় ৫৭ কোটি মার্কিন ডলার। ঘটনাস্থলের কাছেই ছিল আদিবাসী মিকম্যাকদের বসতি। বিস্ফোরণে গুঁড়িয়ে গিয়েছিল এর পুরোটাই। কোলম্যানের বাড়িটি ছিল ঘটনাস্থল থেকে মাত্র দুহাজার ফুট দূরে। সেটার গোঠা কাঠামো ভেঙে পড়ে আগুন ধরে গিয়েছিল। রান্নাঘরের সিংক ভেঙে পড়েছিল কোলম্যানের দুই বছর বয়সী শিশু এলিনের গায়ের উপর। তার স্ত্রী ফ্রান্সেস মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিল। তাদের অন্য দুই সন্তান তখন ছিল স্কুলে। সে দুজন স্কুল থেকে ফিরে মা আর বোনকে নিয়ে গিয়েছিল হাসপাতালে।

এদিকে রিচমন্ড থেকে রকিংহাম হয়ে তুরো পর্যন্ত পৌঁছে গেছে কোলম্যানের মেসেজ। প্রতিটি স্টেশনে থামিয়ে দেয়া হল হ্যালিফিক্সগামী ট্রেনগুলোকে। আর যার কথা ভেবে বাঁচার চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছিলেন কোলম্যান, সেই ১০ নম্বর ট্রেনটির কাছে পৌছুতে পেরেছিল তার মেসেজ। বিস্ফোরণের ঠিক আগ মুহূর্তে ট্রেনটি থামানো হয় রকিংহামে, রিচমন্ড থেকে মাত্র ৪ মাইল দূরে।

25_25_carbin408

এখানে ছিল একটি স্কুল

দূর্ঘটনার পরপরই গোটা কানাডায় এর খবর ছড়িয়ে পড়ে, কারণ কোলম্যানের বার্তা পৌঁছে গিয়েছিল স্টেশন থেকে স্টেশনে। সে বার্তার কারণে সাড়া পড়ে গেল গোটা রেলওয়ের মধ্যে। এর মধ্যে সাহায্য চেয়ে আরও টেলিগ্রাফ আসতে লাগল কেন্দ্রে। রেলওয়ে থেকে অগ্নিনির্বাপণ কর্মী, ডাক্তার, নার্স, উদ্ধারকর্মী সহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ভর্তি ছয়টি ট্রেন পাঠানোর ব্যবস্থা হল সাথে সাথে। পরের দিন দূর্ঘটনায় আরও মাত্রা যুক্ত করেছিল ভয়াবহ তুষারপাত, যার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও দূর্বল হয়ে পড়েছিল। প্রথম দিনেই যদি সাহায্য নিয়ে ট্রেন আসতে না পারত তাহলে নিশ্চিতভাবেই হারাতে হত আরও অনেকগুলো প্রাণ।

Panoramic_view_of_damage_to_Halifax_waterfront_after_Halifax_Explosion,_1917

বিস্ফোরণের পর ধ্বংসাবশেষের একটি প্যানারোমা ছবি

অবাক করা ব্যাপার হল, এমন প্রশ্নও উঠেছিল তখন যে, সত্যিই কি কোলম্যানের কারণেই থেমে গিয়েছিল ১০ নম্বর ট্রেনটি? সত্যিই কি সেই ট্রেনের ৩০০ মানুষের জীবন বেঁচেছিল কোলম্যানের বার্তা পেয়ে? তাদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেন ১০ নম্বর ট্রেনের কনডাক্টর গিলেস্পি, যা ছাপা হয়েছিল কানাডার মঙ্কটোনের একটি পত্রিকায়, দূর্ঘটনার পরের দিনই। সেখানে লেখা হয়েছিল, “গিলেস্পি অল্পের জন্য মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরলেন মঙ্কটোনে। তিনি জানিয়েছেন, ১০ নম্বর ট্রেনটি ঠিক সময়েই পৌঁছানোর কথা ছিল। কিন্তু রকিংহামের ডিসপ্যাচার ট্রেনটি থামিয়ে দেন। ৪ মাইল দূরের হ্যালিফেক্সের বিস্ফোরণ উড়িয়ে দেয় তার ট্রেনের জানালা।” কোলম্যানের টেলিগ্রাফ মেসেজ পেয়েই যে রকিংহামে ট্রেনটি থেমে গিয়েছিল, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

শুধু দশ নম্বর নয়, হ্যালিফেক্সের দিকে আসতে থাকা সবগুলো ট্রেন থেমেছিল কোলম্যানের বার্তা পেয়ে। ট্রেন থামানো তো বটেই, দূর্ঘটনার পরপর আহতদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়েছিল শুধুমাত্র কোলম্যানের ভূমিকার কারণে। বিস্ফোরণের সাথে সাথে এর আশপাশ থেকে অনেকখানি পর্যন্ত ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হওয়ার বাদ পড়েনি টেলিগ্রাফের লাইনগুলোও। কোলম্যান যদি সেই মুহূর্তে মেসেজটা পাঠাতে না পারতেন তাহলে ট্রেনের উপরে আঘাত তো আসতই, একই সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লেগে যেত কেবল হ্যালিফেক্সে কী কারণে দূর্ঘটনা ঘটে সব আটকে গেল সেটা জানতে জানতেই। কোলম্যানের বার্তা পেয়েই রেলের তড়িৎ পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়েছিল, তা না হলে ঘটনাস্থলের হাজারও আহত মানুষের প্রাণ বাঁচানো হয়ত সম্ভব হত না।

2.thecollision2

বিস্ফোরণের পর হ্যালিফেক্স

বিস্ফোরণে সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে গিয়েছিল রিচমন্ড রেল ইয়ার্ড। দূর্ঘটনার কয়েক দিন পর এর ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধার করা হয় কোলম্যানের মৃতদেহ। যেটার সাহায্যে সতর্কবার্তা পৌঁছে দিয়েছিল কোলম্যান সেই ‘টেলিগ্রাফ কি’ আর তার ঘড়ি, কলম ও মানিব্যাগ পাওয়া গিয়েছিল সেখানে। যাদুঘরে সংরক্ষিত সেই মানিব্যাগে এখনও দেখা যাবে পানির দাগ। এর ভেতরে পাওয়া যায় কয়েকটা লটারির টিকেট আর কদিন পরেই মন্ট্রিলে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া শ্রমিক ইউনিয়নের সভার বিষয়ে একটা খবরের ক্লিপিং। তার ঘড়িটার কাঁচ কিংবা কাঁটা কিছুই ছিল না। এর পেছন দিকটা দেখে মনে হচ্ছিল কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়েছে। এগুলো দেয়া হয়েছিল তার পরিবারের কাছে। পরবর্তীতে তারা সেগুলো আবার নোভা স্কটিয়ার পাবলিক আর্কাইভে দান করেন প্রদর্শনীর জন্য। ২০০৫ সালে এগুলোকে আনা হয় মেরিটাইম মিউজিয়াম অব আটলান্টিকে। সেখানেই হ্যালিফেক্স দূর্ঘটনার স্মারক হিসেবে রাখা আছে কোলম্যানের শেষ স্মৃতিগুলো।

vince_coleman_wallet_pen_telegraph_key

কোলম্যানের মানিব্যাগ, কলম, ঘড়ি আর ‘টেলিগ্রাফ কি’

কানাডার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো ধরে রাখার জন্য নির্মিত ‘হেরিটেজ মিনিট’ নামক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রগুলোর একটি নির্মাণ হয়েছে কোলম্যানের বীরোচিত ভূমিকা নিয়ে। তার নামে বিভিন্ন স্থাপনার নামকরণ সহ কানাডিয়ান রেলওয়ের ‘হল অব ফেইম’-এও সম্মানিত করা হয়েছে কোলম্যানকে।

ইতিহাস নির্মাণের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকে মানুষ। দশ নম্বর ট্রেনের তিনশ যাত্রী আর অসংখ্য আহত মানুষের জীবন বাঁচিয়ে ইতিহাস গড়েছিলেন প্যাট্রিক ভিনসেন্ট কোলম্যান। চোখের সামনে মৃত্যু দেখেও দায়িত্ব পালনে ভুল করেন নি তিনি। আত্মাহুতি দিয়েও তাই বেঁচে আছেন কোলম্যান, পৃথিবীর মানুষের স্মৃতিতে।

 

This article is in Bangla Language. It's about the happening of self-immolation of Vince Coleman.

 

References

1. maritimemuseum.novascotia.ca/what-see-do/halifax-explosion/vincent-coleman-and-halifax-explosion

2. en.wikipedia.org/wiki/Vince_Coleman_(train_dispatcher)

3. en.wikipedia.org/wiki/Halifax_Explosion

4. en.wikipedia.org/wiki/Heritage_Minutes

 

Featured Image: 1917halifaxexplosion.weebly.com

Related Articles