
আমাদের দেশের আকাশপথে উড়োজাহাজের উড্ডয়নের ইতিহাস জানার আগ্রহ যে কারো মনে জন্মাতেই পারে। রাইট ভাইয়েরা এরোপ্লেন আবিস্কার করেছেন ১৯০৩ সালে। কিন্তু করলে কী হবে, ইউরোপ ও আমেরিকায় ব্যাপকভাবে এরোপ্লেন নিয়ে আকাশপথের অভিযান শুরু হয় ১৯০৮ সালে। আমাদের উপমহাদেশে প্রথমবার আকাশে উড়োজাহাজের প্রদর্শনী হয় ১৯১১ সালে। আমাদের দেশে বিমানের অগ্রযাত্রার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
১৯১১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পিকে নামে ফরাসি একজন পাইলট এলাহাবাদ থেকে ছয় মাইল দূরের ছোট্ট শহর নৈনিতালে এক ব্যাগ সরকারি চিঠি এরোপ্লেনে বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন। এরপর প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে সম্ভবত ভারতবর্ষের কোথাও আর এরোপ্লেন নিয়ে আকাশযাত্রার ঘটনা ঘটেনি। আর যদিও বা ঘটে থাকে, তাহলে তা সীমাবদ্ধ ছিল বিদেশি পাইলটদের মধ্যে। তাই ওসব কিছু আমাদের উপমহাদেশের বিমান চলাচলের ইতিহাসের অংশ হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়নি।

রাইট ভ্রাতৃদ্বয় আবিস্কৃত উড়োজাহাজ; Source: oneonta.edu
আকাশে ওড়ার সঙ্গে ভারতীয় যে ব্যক্তিটির নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, তিনি একজন বাঙালি এবং আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশেরই বরিশাল জেলার সন্তান। তার সাহস, বিক্রম এবং ফ্লাইং দক্ষতা বিবেচনায় এই উপমহাদেশের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ পাইলটদের একজন তিনি। বাঙালি এই পাইলটের নাম ইন্দ্রলাল রায়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে ১৯২০ সালে সর্বপ্রথম করাচি ও বোম্বাই (বর্তমান মুম্বাই) শহর দুটোর মধ্যে বিমান চলাচল শুরু হয়। এই উদ্যোগের পেছনে মূল অবদান ছিল ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্সের। বস্তুত এটাই ছিল সরকারি উদ্যোগে ভারতের বিভিন্ন শহরের মধ্যে বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রাথমিক প্রচেষ্টা। ঐ উদ্যোগের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ছয় সপ্তাহ। প্রায় একই সময়ে লন্ডন থেকে কায়রো হয়ে করাচি পর্যন্ত পরীক্ষামূলকভাবে দুয়েকটি ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়েছিল। ১৯২৭ সালে ভারতে প্রথম বেসামরিক বিমান অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এয়ারলাইন্সের তত্ত্বাবধানে বিমান চলাচলের জন্য লাইসেন্স প্রদানের কাজও শুরু হয়।
১৯২৯ সালে ব্রিটেনের ইম্পেরিয়াল এয়ারওয়েজ লন্ডন ও করাচির মধ্যে সপ্তাহে নিয়মিতভাবে একটি ফ্লাইট চালু করে। ভারত সরকার তখন ইম্পেরিয়াল এয়ারওয়েজের সঙ্গে ঐ একই ফ্লাইট করাচি থেকে দিল্লী পর্যন্ত বর্ধিত বা সম্প্রসারিত করার জন্য চুক্তি করে। চার্টার্ড ফ্লাইট হিসেবে এই বর্ধিত অংশের জন্য ভারত সরকার অর্থায়নের ব্যবস্থা করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত ডাকোটা বিমান; Source: airliners.net
১৯৩৩ সালে ‘ট্রান্স কন্টিনেন্টাল এয়ারওয়েজ’ নাম দিয়ে আরেকটি এয়ারলাইন প্রতিষ্ঠিত হয়। ইম্পেরিয়াল এয়ারওয়েজের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে নতুন এই এয়ারলাইন করাচি-দিল্লী-কলকাতা ও রেঙ্গুন হয়ে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত সপ্তাহে অন্তত একটি ফ্লাইট পরিচালনা করতে শুরু করে। ঐ একই বছর ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল এয়ারওয়েজ’ নামে অন্য আরও একটি এয়ারলাইন চালু করা হয়। এই এয়ারলাইন দেড় থেকে দু’বছর পর্যন্ত ঢাকা ও কলকাতার মধ্যে বিমান চলাচল অব্যাহত রাখে। শুধু ঢাকা ও কলকাতাই নয়, কলকাতা এবং আসামের মধ্যেও তারা ফ্লাইট চালু করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পর্যাপ্ত যাত্রীর অভাবে কলকাতা ও ঢাকা এবং কলকাতা ও আসামের মধ্যকার উভয় ফ্লাইটই বন্ধ করে দিতে হয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ভারতে অনেকগুলো এয়ারলাইনস প্রতিষ্ঠিত হয়। যুদ্ধ শেষে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনী এবং মার্কিন বিমান বাহিনীতে ব্যবহৃত প্লেনগুলো একেবারে নামমাত্র মূল্যে পাওয়া যাচ্ছিল। হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্যাল লিমিটেড সেগুলোকে সহজেই যাত্রী বহনের উপযোগী করে তোলে। যুদ্ধের সময় বেশ কিছু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফার মুখ দেখে এবং আর্থিকভাবে ফুলেফেঁপে ওঠে। এসব নব্যধনী সুলভ মূল্যে ডাকোটা প্লেন কিনে এয়ারলাইনস ব্যবসায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাতারাতি ১২-১৩টি এয়ারলাইন চালু হয়ে যায় উপমহাদেশে। এসবের মধ্যে টাটা এয়ারলাইন, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল এয়ারওয়েজ, জামএয়ার ও ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ প্রতিযোগিতায় টিকে যায়। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো বিপুল লোকসানের দায় মাথায় নিয়ে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়। পরবর্তীকালে টাটা এয়ারলাইন রুপান্তরিত হয় বর্তমানের এয়ার ইন্ডিয়ায় এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল এয়ারওয়েজ হয় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনস।
১৯৪৭ সালে অখণ্ড ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার কিছুদিন পর ঐ দেশের দুই অংশের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস (পিআইএ) গঠিত হয়। পিআইএ করাচি-ঢাকা, করাচি-লাহোর, লাহোর-ঢাকা এবং পাকিস্তানের সঙ্গে লন্ডনের যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য লকহিড কোম্পানির তৈরি তিনটি সুপার কনটিলেশন এরোপ্লেন সংগ্রহ করে। এই প্লেনগুলো ককপিট এবং কেবিন ক্রু ছাড়াও ৮০ থেকে ৯০ জন যাত্রী বহন করতে পারতো। দূরত্ব অতিক্রম করতে পারতো প্রায় দুই হাজার মাইলেরও বেশি।

১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ বিমানের হালহকিকত; Source: stampmall.com
পাকিস্তানের পর ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ কলকাতা থেকে তাদের হেড অফিস স্থানান্তরিত করে করাচি শহরে। ঐ এয়ারলাইন তার সমুদয় প্লেন সমেত সবকিছু পাকিস্তানে নিয়ে আসে এবং পাকিস্তানের উভয় অংশের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পরিচালনায় প্লেনগুলো নিয়োজিত করে। ১৯৫৪ সালে ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ পিআইএর সঙ্গে একীভূত হয়ে কর্পোরেশন হিসেবে ঘোষিত হয়। এই কর্পোরেশনের শতকরা ৫১ ভাগ শেয়ার পাকিস্তান সরকার তার নিজের হাতে রেখে ৪৯ ভাগ শেয়ার প্রাইভেট সেক্টরে ছেড়ে দেয়। পিআইএ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক সংযোগ রক্ষার ক্ষেত্রে বেশ সুনামের সাথে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবেই পরিচালিত হচ্ছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পিআইএর অধীনে ছিল বোয়িং ৭০৭, বোয়িং ৭২০, বোয়িং ৭৩৭ এবং ফকার ফ্রেন্ডশিপ ২৯ প্লেনগুলো।
পিআইএর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রায় পুরোটাই সীমাবদ্ধ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের জন্য প্রথমদিকে ছিল কেবল ডাকোটা প্লেন। পরে ডাকোটার স্থলাভিষিক্ত হয় তিনটি ফকার ২৭ প্লেন আর দুটি টুইন অটার প্লেন। এক সময় দুটো হেলিকপ্টার দিয়েও পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরের সঙ্গে প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। ১৯৬৫ সালে ঐ হেলিকপ্টার দুটোর একটি ফরিদপুরের কাছে যাত্রীসহ বিধ্বস্ত হলে পুরো হেলিকপ্টার অপারেশনই বন্ধ করে দেয়া হয়।

বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং ৭৭৭; Source: wikimedia.org
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, আত্মসমর্পণ করার পূর্ব মুহূর্তে ঢাকায় অবস্থিত তিনটি ফকার ২৭ এবং একটি টুইন অটার প্লেন পাক হানাদার বাহিনী মায়ানমার হয়ে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। চালকের অভাবে অন্য অটার প্লেনটি তারা নিয়ে যেতে পারেনি। তবে সেটি পুরোপুরি ধ্বংস করে রেখে যায়। এসব কারণে আমাদের জাতীয় এয়ারলাইনস বাংলাদেশ বিমানকে একেবারে শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করতে হয়েছিল। তবে উড়োজাহাজ না পেলেও বাংলাদেশের বেশ কিছু সংখ্যক অভিজ্ঞ পাইলট, মেকানিক, ইঞ্জিনিয়ার এবং অন্যান্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেয়েছিল যারা পিআইতেই চাকরি করতেন। এছাড়া আমরা পেয়েছিলাম বেশ কিছু অভিজ্ঞ এয়ার ট্র্যাফিক কনট্রোলার এবং বেসামরিক বিভাগের কর্মকর্তাদের।
বাংলাদেশ বিমান তার যাত্রা শুরু করেছিল মাত্র একটি ডাকোটা প্লেন নিয়ে। একাত্তর সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতের নাগাল্যান্ড রাজ্যের রাজধানী ডিমাপুরে গঠিত হয়েছিল মুক্তিবাহিনী এয়ারফোর্স। এর অধীনে ছিল মাত্র একটি ডাকোটা এরোপ্লেন, একটি সিঙ্গেল ইঞ্জিনবিশিষ্ট অটার প্লেন এবং একটি এলিউভেট হেলিকপ্টার। ডাকোটা প্লেনটি মুক্তিবাহিনী এয়ারফোর্সকে দিয়েছিলেন ভারতের যোধপুর রাজ্যের মহারাজা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই ঐ প্লেন তিনটির মালিক হয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনী। বাংলাদেশ বিমান আবার আমাদের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট শুরু করার জন্য বিমান বাহিনীর কাছ থেকে লাভ করে সবেধন নীলমণি ডাকোটা প্লেনটি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর একটি দলের সাথে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একাংশ; Source: wikimedia.org
১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ডাকোটা প্লেন নিয়ে বাংলাদেশ বিমান ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে শুরু করে যাত্রী বহনের কাজ। মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্যাপ্টেন খালেক, ক্যাপ্টেন মুকিত, ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন এবং ক্যাপ্টেন আলমগির সাত্তার প্লেনটি চালাতেন। মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য তারা চারজনই বীরত্বের খেতাব অর্জন করেন। বাংলাদেশ বিমানের উদ্বোধনী ফ্লাইটে এই চারজনের মধ্যে শাহাবুদ্দিন ছাড়া বাকি তিনজনই উপস্থিত ছিলেন। শাহাবুদ্দিন তখন বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার ফ্লাইট নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-সিলেটের মধ্যে মাত্র কয়েকটি ফ্লাইট পরিচালনার পর ১০ ফেব্রুয়ারি তারিখে ট্রেনিং ফ্লাইট গিয়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরের উপর প্লেনটি বিধ্বস্ত হয়। ঐ ট্রেনিং ফ্লাইটে পাঁচজন পাইলট ছিলেন। তারা সবাই নিহত হন।
১৯৭২ সালের মার্চ মাসে ভারত সরকার বাংলাদেশকে অনুদান হিসেবে দেয় দুটি ফকার ফ্রেন্ডশিপ ২৭ এরোপ্লেন, আর তাই দিয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স আবারও তার অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট শুরু করে। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ বিমান নিজের অর্থে হল্যান্ড থেকে কেনে দুটি ফকার ফ্রেন্ডশিপ ২৭ প্লেন। ঐ বছর অস্ট্রেলীয় সরকারও আমাদের দুটো ফকার ফ্রেন্ডশিপ ২৭ প্লেন অনুদান দেয়। ফলে ১৯৭৩ সালের আগস্ট মাস নাগাদ অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট সহ কলকাতা এবং কাঠমান্ডু ফ্লাইট অপারেট করার জন্য বিমানের মোট এরোপ্লেনের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬টি।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার; Source: youtube.com
আন্তর্জাতিক ফ্লাইট করতে ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস একটি বোয়িং ৭০৭ প্লেন ভাড়া করে। ১৯৭৪ সালে সংস্থাটি নিজের খরচে কেনে একটি বোয়িং ৭০৭ এরোপ্লেন এবং ভাড়া করা বিমানটি বিদায় করে দেয়। এ সময় বিমানের আন্তর্জাতিক রুট বলতে ছিল ঢাকা থেকে লন্ডন এবং সপ্তাহে দুদিন তা অপারেট করা হতো। ঐ ফ্লাইট মাঝপথে বাহরাইনে টেকনিক্যাল ল্যান্ডিং করতো আর বদল করতো ক্রু। এছাড়া ১৯৭৪ সালেই বিমান ঢাকা থেকে ব্যাংকক পর্যন্ত সপ্তাহে দুটো ফ্লাইটও অপারেট করতে শুরু করে। এভাবে একটি-দুটি করে বাড়তে থাকে বাংলাদেশ বিমানের উড়োজাহাজ আর ফ্লাইটের সংখ্যা। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ছাড়াও বর্তমানে বেশ কয়েকটি বেসরকারি এয়ারলাইনস কর্মরত আছে দেশের আকাশপথে যাত্রা সুগম করতে।
তথ্যসূত্র: সাত্তার, আলমগির; বেলুন থেকে বিমান; পৃষ্ঠা নং: ১৬৭-১৭০; সাহিত্য প্রকাশ (১৯৯৪)।