জাপানিজ অ্যানিমেকে অনেকেই কার্টুন ভেবে ভুল করে থাকেন। আসলে এটি জাপানের বড় একটি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। গত প্রায় একশো বছরের বেশি সময় ধরে এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে বেরিয়েছে মন মাতানো সব অ্যানিমে সিরিজ। অ্যানিমেশন বলে অনেকে এই অ্যানিমেগুলোকে শিশুদের জন্য বানানো ভেবেও ভুল করে থাকেন। আসলে জাপানি অ্যানিমেশন এখন বয়স, লিঙ্গ, জাতির সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে সবার বিনোদনের উৎস হিসেবে। তবে অ্যানিমের নীরব উত্থানের গল্পটা সবাই জানে না। শত বছরের পথচলায় কত চড়াই-উৎরাই পার হয়ে অ্যানিমে আজ এই পর্যায়ে এসেছে, সেই গল্পই জানা যাক ধাপে ধাপে।
অ্যানিমের আবিষ্কার এবং পথচলার শুরু
১৯০০ সালের দিকে জাপানের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জন্মলগ্ন থেকে অ্যানিমের যাত্রা শুরু। গত একশো বছরের যাত্রায় অ্যানিমে জাপানের প্রধান একটি সাংস্কৃতিক শক্তি হিসেবে পরিণত হয়েছে। ১৯০৭ সালে তৈরি ৩ সেকেন্ডের কাতসুদু সাশিন (Katsudou Shashin) কে বলা হয় ইতিহাসের প্রথম অ্যানিমে। যদিও এই অ্যানিমে কে বানিয়েছিলেন, তা এখনো অজানাই রয়ে গেছে। সে সময়ে সেলুলয়েড অ্যানিমেশন (cel animation) প্রযুক্তি ছিল না। তাই চকবোর্ড ড্রইং, সরাসরি পেইন্টিং, পেপার কাটিং ও ড্রয়িং সহ বিভিন্ন রকম কৌশল অবলম্বন করে অ্যানিমে তৈরি হতো। কার্টুনিস্ট ওতেন শিমোকাওয়াকে বলা হয় জাপানি অ্যানিমের জনক। ১৯১১-১৯২০ সালের মধ্যে তিনি মুকুজো জেনকানবান নো মাকি (Mukuzo Genkanban no Maki) সহ মোট পাঁচটি অ্যানিমেটেড ফিল্ম তৈরি করেন। ওতেন ছাড়াও জুনিচি কৌইচি এবং সেন্তারো কিতায়ামা সেই সময়ে অ্যানিমে ফিল্মের আরো দুই অগ্রপথিক।
টোকিও ভূমিকম্প এবং ডিজনির হুমকি
জন্মের পর প্রথম দুই দশক নানান চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে অ্যানিমের যাত্রা চলমান থাকলেও ত্রিশের দশকেই আসে প্রথম ধাক্কা। ১৯২৩ সালে টোকিও ভূমিকম্পে অনেক অ্যানিমে স্টুডিও ধ্বংস হয়ে যায়। ঐ একই বছরে শিকাগোতে, দুই ভাই ওয়াল্ট ডিজনি এবং রয় ডিজনি মিলে প্রতিষ্ঠা করেন দি ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি। ডিজনির বড় বাজেট, উন্নত প্রযুক্তিতে তৈরী অ্যানিমেটেড সিনেমা আমেরিকা সহ সারা বিশ্বেই আধিপত্য বিস্তার করতে থাকলো। হিমশিম খেতে লাগলো জাপানি অ্যানিমেটররা। অল্প বাজেটে অ্যানিমে তৈরি করে, অল্প লাভের আশায় কম দামেই অ্যানিমে রিলিজ করে কোনোরকমে টিকে রইলো দুই দশক।
জাপানি অ্যানিমের এই অমানিশার দশকে, দুই অ্যানিমে নির্মাতা কেনজো মাসাওকা আর মিৎসুয়ো সেও বিশেষ অবদান রাখেন। মাসাকাও ১৯৩৩ সালে তৈরি করেন প্রথম সবাক অ্যানিমে চিকারাতো অন্না নো ইয়ো নো নাকা (Chikarato Onna no Yo no Naka)। জাপানি জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৩০ এর দিকে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ততটা জনপ্রিয় উঠতে পারেনি। যাও টুকটাক অ্যানিমে তৈরি হতো; তার একাংশ তৈরি হতো বাণিজ্যিক প্রচারের জন্য, আরেক অংশ তৈরি হতো রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর জন্য। কিছু অ্যানিমে জনস্বার্থেও তৈরি হয়েছিল। এরপর ১৯৩৯ সালে জাপানি চলচ্চিত্র আইন প্রণয়নের পর আবারো গড়ে উঠতে শুরু করলো অ্যানিমে স্টুডিও।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যুদ্ধ পরবর্তী সময়
১৯৩৯ সালে শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যুদ্ধ চলাকালীন জাপানি সেনাদের অর্থায়নে সিনেমা তৈরি হয়েছিল। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো এবং নিজ দেশের মানুষকে এই কঠিন সময় পার করার জন্য বিনোদন দিতে যুদ্ধভিত্তিক অ্যানিমে চলচ্চিত্র তৈরি করতে শুরু করে জাপান।
১৯৪৩ সালে মিতসুইও সেও জাপানি লোকগাথার সাথে চলমান যুদ্ধ আবহকে মিশিয়ে নির্মাণ করেন মোমোতারো’স সি ইগলস (Momotaro’s Sea Eagles) । দু বছর পর যুদ্ধের শেষ দিকে এই অ্যানিমের সিক্যুয়েল মেমেন্তো ডিভাইন (Mementos Devine) নির্মাণ করেন মিতসুইও সেও। যুদ্ধের ভয়াবহতা, প্রোপাগান্ডা আর যুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের মধ্যেও এই দুটো অ্যানিমে জাপানি সাধারণ জনগণকে দিয়েছে আশার আলো। ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর সৃজনশীলতা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে যুদ্ধের পরপরই জাপানি অ্যানিমে খুঁজে পেলো নতুন এক দিগন্ত। ১৯৪৮ সালে গঠিত হলো জাপানের ডিজনি খ্যাত তোয়েই অ্যানিমেশন। আর তোয়েই অ্যানিমেশনের হাত ধরে জাপানি অ্যানিমে ইতিহাসের মোড় ঘুরে যায়।
অ্যানিমের বিকাশে মাঙ্গা এবং টেলিসেবে
অ্যানিমের ইতিহাস বলতে গেলে জাপানি মাঙ্গা’র (Manga) প্রসঙ্গ অবধারিতভাবে চলে আসে। মাঙ্গা হচ্ছে গল্প এবং ছবির আদলে প্রকাশিত জাপানি কমিক। যুদ্ধের পর জাপানে মাঙ্গা জনপ্রিয় হওয়া শুরু করে। ১৯৪৭ সালের নতুন জাপানি সংবিধান থেকে তুলে দেয়া হয় সেন্সরশিপ। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত মার্কিন তত্ত্বাবধানে থাকার পরেও, জাপানি অ্যানিমেটররা মার্কিন কমিকগুলো অনুসরণ করার বদলে নিজেরদের সংস্কৃতির অংশ মাঙ্গাকে আঁকড়ে ধরলেন। তাই মাঙ্গাকে বলা হয় আধুনিক অ্যানিমের নিউক্লিয়াস।
জাপানি মাঙ্গার পিতৃতুল্য কার্টুনিস্ট ওসামু তেজুকা আঁকা শুরু করলেন জাপানের প্রথম সুপারহিরো মাঙ্গা তেতসুয়ান অ্যাটম (Tetsuan Atom/Mighty Atom)। তেতসুয়ান অ্যাটম থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে বিখ্যাত অ্যানিমে ফিল্ম অ্যাস্ট্রো বয় (Astro Boy) বানানো হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে গঠিত ‘জাপান অ্যানিমেটেড ফিল্ম’ স্টুডিওকে ১৯৫৬ সালে কিনে নেয় তোয়েই অ্যানিমেশন। দু বছরের মাথায় তারা জাপানের ইতিহাসে প্রথম রঙিন অ্যানিমেশন ফিল্ম, দ্য টেল অফ হোয়াইট সারপেন্ট (The Tale of the White Serpent) নির্মাণ করে। এটিকে প্রথম আধুনিক অ্যানিমে হিসেবেও অভিহিত করা হয়ে থাকে।
জাপানি অ্যানিমের এগিয়ে চলার পেছনে টেলিভিশনেরও বড় ভূমিকা ছিল। জাপানি মাঙ্গা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মিত, তোয়েই অ্যানিমেশনের প্রধান অ্যানিমেগুলো ষাটের দশকের প্রথম দিকে টিভিতে প্রচার হওয়া শুরু করে। মিতসুতেরু ইয়োকোয়ামা’র নির্মিত স্যালি দ্য উইচ (Sally the whitch) এবং কিড উইথ হিজ জায়ান্ট রোবট (kid with his giant robot) মাঙ্গা থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরী। সে সময়ের আরেকটি জনপ্রিয় মাঙ্গা সাইবর্গ ০০৯ (Cyborg 009) থেকে সৃষ্টি হয় অ্যানিমে ফ্রাঞ্চাইজ সাইবর্গ।
বিদেশে অ্যানিমে রপ্তানি এবং বিশ্ব জয়
ষাটের দশকের শেষ দিক পর্যন্ত জাপানের অ্যানিমে জাপানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, ইংরেজি ভাষাভাষী অঞ্চলের মানুষ জাপানি অ্যানিমে দেখতে শুরু করে সত্তরের দশকের শুরুর দিকে। বাণিজ্যিকভাবে মার্কিন মুলুকে জাপানি অ্যানিমেশনের যাত্রা শুরু করে ওশামু তেজুকার তেতসুয়ান অ্যাটম বা অ্যাস্ট্রো বয়-এর মাধ্যমে। ১৯৬৩ সালে ফ্রেড ল্যাডার নামক এক ব্যক্তির চেষ্টায় আমেরিকার NBC চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছিল অ্যাস্ট্রো বয়।
ফলে এর আসল নির্মাতার নাম তখনও জাপানের বাইরে অনেকের কাছে অজানাই থেকে যায়। এরপর তেজুকা তার নিজের লেখা মাঙ্গার উপর ভিত্তি করে তৈরি করেন মাস্টারপিস অ্যানিমে কিম্বা: দ্যা হোয়াইট লায়ন (Kimba: The White Lion)। এটিও সারা বিশ্বে ব্যাপক সাড়া ফেলে। এটি ছিল জাপানের অ্যানিমে ইতিহাসে ৫২ পর্বের প্রথম রঙিন অ্যানিমে সিরিজ। এটি পরবর্তীতে ফ্রেঞ্চ, ডাচ, ইতালিয়ান, কাতালান, স্প্যানিশ, জার্মান ভাষা সহ প্রায় অর্ধশতাধিক ভাষায় ডাবিং এবং রূপান্তর করা হয়েছে।
জাপানের আরেক অ্যানিমেশন স্টুডিও তাতসুনোকো একই পথে হাঁটে। তারা জাপানের জনপ্রিয় আরেকটি মাঙ্গা আকা মাচ গোগোগো’র (Aka Mach GoGoGo) গল্প অবলম্বনে তৈরি করে বিখ্যাত অ্যানিমে স্পিড রেসার (Speed Racer)। এটিও জাপানের বাইরে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। ১৯৬৮ সালে আমেরিকাতে স্পিড রেসার প্রচারের পেছনে সবচাইতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন পিটার ফার্নান্দেজ। জাপানের বাইরে জাপানি অ্যানিমে ছড়িয়ে দেয়ার পেছনে পিটারের অবদান পিতৃতুল্য।
অ্যানিমের বৈচিত্র্য
টেলিভিশন জাপানি অ্যানিমে ইন্ডাস্ট্রিকে প্রথমদিকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করলেও, সত্তরের দশকের শেষ দিকে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্তও করেছিল। টিভি অনুষ্ঠানের ব্যাপক চাহিদার কারণে অনেক অ্যানিমেটর অ্যানিমেশন ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে যোগ দেয়। এই সময়ে অ্যানিমের পথচলা একটু স্তিমিত হলেও, একেবারে থেমে যায়নি। তবে অ্যানিমে নিয়ে প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। অ্যানিমের শৈল্পিক সম্প্রসারও ঘটেছে।
সত্তরের দশকেই অ্যানিমের বিভিন্ন জঁনরা তৈরি হতে শুরু করে। জনপ্রিয় অ্যানিমে জনরা মেচা’র জন্ম এই সময়ে। বিশাল বিশাল দানবাকার রোবট এবং ভারি যানবাহন সমৃদ্ধ মেচা জঁনরার অ্যানিমে খুব দ্রুতই জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৬৩ সালে তেতসুজিন ৩৮-গো’র (tetsujin 28-go) মাধ্যমে শুরু হয় মেচা জঁনরার মাঙ্গা থেকে অ্যানিমে ফিল্ম তৈরি। তারপর জাপানের বিখ্যাত অ্যানিমেশন নির্মাতা গো নাগাই বানালেন এই জঁনরার এক মহাকাব্যিক অ্যানিমে মাজিঙ্গার জি (Mazinger Z)। গো নাগাইয়ের আরো দুটো উল্লেখযোগ্য মেচা অ্যানিমের নাম যথাক্রমে স্পেস ব্যাটলশিপ ইয়ামাতো (Space Battleship Yamato) এবং মোবাইল স্যুট গুন্ডাম (Mobile Suit Gundam)।
এই দশকেই জনপ্রিয় হেন্তাই (Hentai) জঁনরার জন্ম। আধুনিক অ্যানিমের জনক তেজুকা, আলাদীনের ধ্রুপদী কাহিনী অবলম্বনে ১৯৬৯ বানালেন অ্যা থাউজেন্ড অ্যান্ড ওয়ান নাইটস (A Thousand and One Nights)। শিল্পের পাশাপাশি যৌনতার ছোঁয়ায়, অ্যানিমে চলে গেলো জনপ্রিয়তার আরেক উচ্চতায়। আশির দশকে হেন্তাই জাপানের অ্যানিমেশন ইন্ডাস্ট্রিকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল বলা যায়। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ এবং ১৯৭৩ সালে যথাক্রমে বের হলো ক্লিওপেট্রা: দ্য কুইন অফ সেক্স (Cleopatra: Queen of Sex) এবং বেলাদোনা অফ স্যাডনেস (Belladonna of Sadness) নামের দুটো জনপ্রিয় এক্স/আর রেটেড অ্যানিমে বা হেন্তাই।
অ্যানিমে সিনেমায় বৈচিত্র্য আসার ফলে, জাপানের বাইরে অ্যানিমে সিনেমা আবারো সাফল্যের ধারায় আসতে শুরু করে। ইয়ামাতো (Yamato) এবং গাচম্যান (Gatchaman) এর হলিউড সংস্করণ যথাক্রমে স্টার ব্লেজারস (Star Blazers) এবং ব্যাটেল অফ দ্য প্লানেটস (Battle of the Planets) আমেরিকায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এছাড়াও হেইদি এবং গার্ল অফ দ্য আল্পস (Heidi, Girl of the Alps) অ্যানিমে দু’টি ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা এমনকি তুরস্কেও দর্শকের মন জয় করে নিয়েছিল।
আশির দশকে জাপানের অ্যানিমেশন ইন্ডাস্ট্রিতেও বেশ বড়সড় পরিবর্তন আসে। এই সময়ের মধ্যে জাপানে কিছু অ্যানিমেশন স্টুডিও প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, যাদেরকে জাপানি অ্যানিমে সংস্কৃতিকে যুগান্তকারী রূপ দান করার কারিগর বলা হয়ে থাকে। তোয়েই স্টুডিওর সাবেক অ্যানিমেটর হায়াকো মিয়াজাঁকি এবং তার সহকর্মী ইসাও তকাহাতা মিলে ১৯৮৪ সালে তৈরি করেন ন্যুসিকা: ভ্যালি অফ দ্য উইন্ড (Nausicaa: Valley of the Wind)। এই অ্যানিমেটি সাফল্যের মুখ দেখলে তারা ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন স্টুডিও ঘিবলি (Studio Ghibli)। জাইনাক্স (GAINAX) অ্যানিমেশন স্টুডিওর পথচলাও শুরু হয় ১৯৮৪ সালের দিকে। জাইনাক্স স্টুডিওতে বানানো প্রথম জনপ্রিয় অ্যানিমে ইভানজেলিয়ন (Evangelion)।
ভিডিও বিপ্লব এবং অ্যানিমের প্রসার
ষাট বা সত্তরের দশকে টেলিভিশন জাপানি অ্যানিমেকে যতটা প্রভাবিত করেছিল, তার চাইতেও বেশি প্রভাবিত করেছে হোম ভিডিও সিস্টেম। টেলিভিশনের একটি নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানমালার গণ্ডি থেকে মুক্ত হয়ে, অ্যানিমে ঢুকে গেল ভিসিআর, ভিডিপিতে। অ্যানিমের ভক্তরা একই অ্যানিমে নিজেদের ইচ্ছামতো যখন-তখন যেকোনো সময়ে বারবার দেখার সুযোগ পেলো। তৈরি হলো ওটাকু গোষ্ঠী। পাঁড় অ্যানিমে ভক্তদেরকে ‘ওটাকু’ বলা হয়। বাড়িতে বসে টিভি চ্যানেল ছাড়াই অ্যানিমে দেখার সুযোগ তৈরি হওয়ার ফলে এইসব ভিসিআরের জন্য বাজারে ছাড়া হল ওএভি (অরিজিনাল অ্যানিমেটেড ভিডিও)। এগুলো শুধুমাত্র হোম ভিডিও সিস্টেমের জন্য আলাদাভাবে বাজারজাত করা হয়েছিল। হেন্তাই জঁনরার অ্যানিমে ওএভি আকারে বাজারে আসার পর, তার জনপ্রিয়তা বাড়ে কয়েকগুণ।
এর পরই আসে লেজার ডিস্ক। নজরকাড়া ভিডিও কোয়ালিটি এবং শ্রুতিমাধুর্যের কারণে জাপানের অ্যানিমেপ্রেমী ওটাকুদের পছন্দের তালিকায় চলে আসে লেজার ডিস্ক। নব্বইয়ের দশকের যেসব ছেলেমেয়ের কাছে লেজার ডিস্কের সংগ্রহ থাকতো, বন্ধু্মহলে তার গুরুত্ব থাকতো বেশি। লেজার ডিস্কের সবচাইতে বড় সুবিধা ছিল একই ডিস্কে একই অ্যানিমের একাধিক ডাবিং ভার্সন রাখা যেতো। লেজার ডিস্কের সময়কালে বিখ্যাত অ্যানিমে ডিস্ট্রিবিউটর কোম্পানি হচ্ছে অ্যানিমিগো (AnimEigo-1988), স্ট্রিমলাইন পিকচার্স (Streamline Pictures-1989), সেন্ট্রাল পার্ক মিডিয়া (Central Park Media-1990)। লেজার ডিস্কে নিজের ইচ্ছেমতো সিনেমা কপি করে, সংরক্ষণ করা যায় বিধায় ছোট ছোট অ্যানিমে ক্লাব গঠন হতে শুরু করে। অন্যদিকে অ্যানিমের অবৈধ কপি এবং প্রদর্শন ঠেকানোর জন্য জাপানে অ্যানিমে লাইসেন্স ব্যবস্থা শুরু হয়। যদিও ডিভিডি আর ব্লু-রে ডিস্ক চলে আসায় লেজার ডিস্ক বেশিদিন টিকতে পারেনি।
লেট নাইট অ্যানিমে এবং ইন্টারনেটে অ্যানিমের পদচারণা
জাইনাক্সের অ্যানিমে নির্মাতা হাইদাকি অ্যানো ১৯৯৫ সালে নিয়ন জেনেসিস ইভানজেলিয়ন (Neon Genesis Evangelion) নামের একটি অ্যানিমে সিরিজ তৈরি করেন। এই সিরিজটি ওটাকুদের মধ্যে তো বটেই, সাধারণ এবং মূলধারার টিভি দর্শকদের মধ্যেও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। মেচা জঁনরার অ্যানিমে হলেও এর অ্যাডাল্ট থিম, উত্তেজক স্ক্রিপ্ট এবং মন মাতানো সমাপ্তির কারণে, হেইদাও’র দেখাদেখি অনন্য অ্যানিমেটররাও তাদের মেচা ঘরানার অ্যানিমের মধ্যে এসব বৈশিষ্ট্য তুলে আনার ঝুঁকি নিয়েছিলেন। এই অ্যানিমেগুলো হোম ভিডিও এবং মধ্যরাতের টিভি শো’র মাধ্যমে দর্শকদের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিল।
নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে জাপানি অ্যানিমের দর্শকের পরিমাণ আরো বেড়ে যাওয়ার পেছনে দু’টি প্রভাবক অনেক বেশি কাজ করেছিল। প্রথমটি হচ্ছে ইন্টারনেট। যদিও সে সময়ে ইন্টারনেট শুধু ডায়াল-আপ পর্যায়ে ব্যবহার হতো। ইন্টারনেট আসার পর থেকে বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে অ্যানিমে সম্পর্কিত যেকোনো তথ্য, মতামত প্রকাশ করার দিগন্ত উন্মোচিত হয়ে যায়।
আর দ্বিতীয় প্রভাব হচ্ছে ডিভিডি। ডিভিডির আবিষ্কারের ফলে ঘরে বসেই কম খরচে উন্নত মানের ভিডিও দেখা এবং সংরক্ষণের সুযোগ তৈরি হয়ে যায়। এতে করে পোয়াবারো ঘটে অনুমোদন প্রাপ্ত (লাইসেন্সর) অ্যানিমে নির্মাতাদের। তারা দর্শকের চাহিদা এবং রুচি অনুসারে বিভিন্ন অ্যানিমে সিরিজ দিয়ে নিজেদের ডিভিডি স্টোরগুলো ভরে ফেলতে থাকে। ডিভিডি প্রচলনের ফলে একজন দর্শক তার প্রিয় অ্যানিমের আনকাট অরিজিনাল ভার্সন দেখার সুযোগ পায়। পাশাপাশি যুক্ত হয় ইংরেজি ডাবিং এবং সাবটাইটেল যুক্ত অ্যানিমে।
জাপানে ডিভিডি তখনও বেশ ব্যয়বহুল। ডিভিডি বিক্রির বদলে ভাড়া দেয়া হতো। কিন্তু আমেরিকায় ততদিনে ডিভিডি ক্রয় করার মতো পণ্য হিসেবে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। ফলে অ্যানিমের ডিভিডি বিক্রি শুরু হলো আমেরিকায়। লাইসেন্সরদের পক্ষ থেকে আরো বেশি পরিমাণ অ্যানিমে বাজারে আসতে শুরু করলো। একসময় জাপানেও অ্যানিমের ডিভিডি পণ্য হয়ে গেল। বিক্রি হতে লাগলো দোকানে দোকানে। এর পাশাপাশি টিভিতেও ইংরেজি ডাবিং করা অ্যানিমে সম্প্রচার শুরু হওয়াতে, অ্যানিমে দেশ আর বয়সের সীমানা ভেঙে সারা বিশ্বের নানান বয়সের দর্শকের মধ্যে জায়গা করে নিলো। সেইলর মুন, ড্রাগন বল জি, পোকেমন অ্যানিমে তারই উদাহরণ। যে ব্যক্তি কোনোদিন অ্যানিমে দেখেনি, তার কান পর্যন্ত অন্তত পোকেমন অ্যানিমের নাম পৌঁছে গিয়েছে।
নতুন শতাব্দীর শুরু এবং প্রতিকূলতা
জাপানের সীমানা পেরিয়ে অ্যানিমে পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও প্রশংসা এবং জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করলেও, একবিংশ শতাব্দী বা মিলেনিয়ামের শুরুতেই জাপানে অ্যানিমে কিছুটা হুমকির মুখে পড়ে।
নব্বইয়ের দশকে জাপানের বাবল ইকোনমির কারণে জাপানের অ্যানিমে ইন্ডাস্ট্রিতে যে ক্ষতি হয়েছিল, তার প্রভাব নতুন মিলেনিয়াম বা একুশ শতকের শুরুতেও বিদ্যমান ছিল। অ্যানিমের বাজেট কমানো এবং অ্যানিমে থেকে প্রাপ্ত রাজস্বের পরিমাণ কমে যাওয়ার ফলে এর বিক্রয়ের নিশ্চয়তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তাই অ্যানিমে নিয়ে গবেষণা এবং ভিন্নধর্মী অ্যানিমে তৈরি বন্ধ হয়ে যায়। যদিও নারুতো, ওয়ান পিস, ব্লেচের মতো কিছু নিশ্চিত হিট অ্যানিমে সেই সময়ে বাজারে এসেছিল। অ্যানিমে নির্মাতারাও তাদের শ্রমের তুলনায় পরিমাণে কম বেতন পাওয়ার ফলে অ্যানিমে ইন্ডাস্ট্রি থেকে অব্যাহতি নেয়। প্রায় ৯০ শতাংশ অ্যানিমেটর ৩ বছরের বেশি এই ইন্ডাস্ট্রিতে টিকতেও পারতো না।
অ্যানিমে ইন্ডাস্ট্রিকে নাড়া দেয়ার পেছনে আরেকটা প্রভাবক হচ্ছে ডিজিটালাইজেশন এবং পাইরেসি। ইন্টারনেট ডায়াল আপ কানেকশন পরিবর্তিত হয়ে অধিক ব্যান্ডউইথ এবং স্টোরেজের ইন্টারনেট সুবিধার ফলে, এক সিজন বা একটা সিরিজ পুরোটাই এক জায়গায় বা এক মাধ্যমে সংরক্ষণ এবং বাজারে ছাড়া আরও বেশি সহজ হয়ে ওঠে। লাইসেন্স ছাড়াই অ্যানিমে পাইরেসি হয়ে যাওয়ায় অর্থনৈতিক মন্দার মুখে পড়ে অ্যানিমে ইন্ডাস্ট্রি।
এছাড়াও ২০০০ সালের শেষ দিকে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার প্রভবেও জাপানি অ্যানিমে ইন্ডাস্ট্রি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। জেনিওন, এডিএফ ফিল্মের মতো অ্যানিমে নির্মাতা কোম্পানি অর্থনৈতিক মন্দার বলি হয়েছিল। তবে ড্রাগন বল জি’র মতো অ্যানিমে ফ্র্যাঞ্চাইজও জন্মেছিল এই সময়েই।
তারপরেও টিকে যাওয়া
বছরের পর বছর এত চড়াই-উৎরাই পার করেও, এখনো অ্যানিমে টিকে আছে। শুধু যে টিকে আছে তা নয়, বেশ ভালোভাবেই টিকে আছে। এখনও এমন হয় যে, মাসে এক ডজন অ্যানিমে রিলিজ হয়। এর মধ্যে আবার হিটও হয়ে যায় কয়েকটি। যে ডিজিটালাইজেশন এবং প্রযুক্তির কারণে অ্যানিমে ইন্ডাস্ট্রি পাইরেসিতে মুখ থুবড়ে পড়তে বসেছিল, সে ডিজিটালাইজেশন আর প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে এখন অ্যানিমে আরো ভালো মানে এবং পরিমাণে ডিস্ট্রিবিউটরদের মাধ্যমে বাজারে এবং অনলাইনে রিলিজ হচ্ছে। আজ থেকে ৫/১০ বছর আগে, জাপানের বাইরে অ্যানিমে ভক্তদের যে ক্রেজ ছিল, এখন তার চাইতেও অনেক বেশি অ্যানিমে ক্রেজ তৈরি হয়েছে ভক্তদের মাঝে। কারণ এখনকার আধুনিক ইংরেজি ডাবিং, এবং বোনাস ফিচারের জন্য মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। অ্যানিমে নিয়ে আবারো এক্সপেরিমেন্টাল কাজ শুরু হয়েছে। নইতামিনার (Noitamina) মতো কোম্পানি নিরলস কাজ করে যাচ্ছে অ্যানিমেকে ভক্তদের মাঝে টিকিয়ে রাখার জন্য। আরো আশার কথা হচ্ছে, এখনো নিয়মিতভাবে নতুন নতুন অ্যানিমে শো সম্প্রচার হচ্ছে। মিলেনিয়ামের পর সবচাইতে জনপ্রিয় দুটি অ্যানিমে শো ডেথ নোট এবং ফুল মেটাল অ্যালকেমিস্ট।
গত এক শতক ধরে এত বাধা বিপত্তির সত্ত্বেও জাপানি অ্যানিমে এখনো ওটাকু এবং সিনেমাপ্রেমীদের একটি পছন্দের নাম। আগামী বছরগুলোতেও হয়তো আর অনেক বাধা-বিপত্তি আসতে পারে। তবে অ্যানিমে যেভাবে জাপানি সংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে, এটি একটি অনন্য বিনোদন মাধ্যম হিসেবে, কোটি কোটি ভক্তদের মাঝে বেঁচে থাকবে আরো শত শত বছর- এই আশা তো অ্যানিমেপ্রেমীরা করতেই পারেন!