সন্দ্বীপের হার্মাদরা; বাংলার পর্তুগিজরা

ভাস্কো ডা গামা কালিকট বন্দরে পা রেখে ইউরোপীয়দের ভারতবর্ষে আগমনের রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছিলেন, তার দেখাদেখি একে একে এসেছে ওলন্দাজ, ইংরেজ, ফরাসি, অস্ট্রিয়ান, গ্রিক, ড্যানিশ, আর্মেনীয়রা। প্রথমে সবার লক্ষ্য ছিল একটাই: বাণিজ্য, বিশেষ করে মশলার বাণিজ্য হস্তগত করা। ব্যতিক্রম ছিল না পর্তুগিজরাও, মালাক্কা-ভারত থেকে ইউরোপ পর্যন্ত মশলার বাণিজ্য কিছু সময়ের জন্য পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করতো পর্তুগিজরা। আর সেই নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন ছিল শক্তিশালী ঘাঁটি। ঘাঁটির জন্য বঙ্গোপসাগরের চেয়ে ভালো আর কোনো জায়গা হতে পারে? 

বাংলায় তখন কোনো প্রভাবশালী শক্তি নেই, মুঘল সম্রাটদের মসনদ থেকে বহুদূরের বাংলায় তখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে স্বাধীন বারো ভূঁইয়ারা। আরাকানরাজের সাথে মাঝেমধ্যেই তাদের ছোটখাট সংঘর্ষ দেখা যায়। ভাগ্য ফেরানোর আশায় বাংলায় আসা পর্তুগিজ অনেক নাবিকই খুলে বসে ব্যবসা, উপরি আয়ের জন্য কেউ কেউ ভিড়ে যায় জলদস্যু দলে, কেউ কেউ ভাড়ায় খাটতে থাকে আরাকানরাজের সেনাদলে। আর এই সময়েই শুরু হয় টানাপোড়েন: লক্ষ্য সন্দ্বীপের দখল।

জে. জে. কাম্পোসের লেখা ‘হিস্টরি অফ দ্য পর্তুগিজ ইন বেঙ্গল’; Image Source: Maggs Bros

সন্দ্বীপে সংকট

সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে বাংলার পশ্চিমাংশ যখন মোগলদের দখলে, চট্টগ্রামের দখল তখন আরাকানদের হাতে। চট্টগ্রামে তখন বেশ কিছু পর্তুগিজ ঘোরাফেরা করছে, যারা গোয়াতে থাকা ভারতবর্ষের পর্তুগিজ ভাইসরয়ের অধীনে নয়। পর্তুগিজদের আনাগোনায় চট্টগ্রাম তখন বেশ সমৃদ্ধ, ফলে তাদের ওপর আরাকানরাজও বেশ খুশি। ১৬০৭ সালে চট্টগ্রাম ভ্রমণ করা লাভালের জবানিতে, “বাংলার উপকূলীয় বন্দরগুলোতে পর্তুগিজরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে। একেবারে স্থানীয়দের মতোই জীবনযাপন করে। তাদের পূর্বের অপরাধের জন্য তারা আর ভারতে ফিরতে চায় না, এখানেই তারা মানিয়ে নিয়েছে। অবশ্য তাদের মধ্যে কোনো পাদ্রী বা যাজক নেই।”

১৫৯০ সালে গোয়া থেকে আরাকানে পর্তুগিজ দূত হিসেবে আন্তোনিও দ্য সুসা গডিনহোকে পাঠানো হয়। অনেকের মতে, তাকে মূলত পাঠানো হয়েছিল বার্মার দক্ষিণে থাকা আরেক বন্দরশহর পেগুতে। যা-ই হোক, আরাকানের রাজার কাছ থেকে চট্টগ্রামের সামান্য দক্ষিণে থাকা দিয়াঙ্গাতে দুর্গ নির্মাণের অনুমতি নিয়ে নিজের অবস্থান শক্ত করে নেন গডিনহো।

মেঘনার মুখে থাকা সন্দ্বীপ তখন গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রতীরে যাওয়ার অন্যতম জলপথ, সেদিকে যেতে হলে এদিক থেকেই যেতে হবে। তাছাড়া জাহাজ মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠও সন্দ্বীপ থেকে সংগ্রহ করা যেত, ফলে বাংলার উপকূলে প্রভাব বিস্তারের জন্য সন্দ্বীপের অধিকার ছিল আবশ্যক। বাংলার লবণের জোগানও উৎপাদিত হতো এই সন্দ্বীপ থেকেই। ফলে অনেক পর্তুগিজই এই ব্যবসা দখলের জন্য সন্দ্বীপে ভিড়তে থাকে। গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও গডিনহো সন্দ্বীপ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাননি, কারণ মূল মশলার বাণিজ্য থেকে এ জায়গা বহু দূরে। এই জায়গায় পেছনে আলাদা করে দুর্গ নির্মাণ করা তার কাছে লোকবল আর অর্থের অপচয় ছাড়া বেশি কিছু মনে হয়নি।

পর্তুগালের জোয়াও ডি বারোসের আঁকা বাংলার মানচিত্র; Image Source: Mapping Bengal

সন্দ্বীপ প্রথম পর্তুগিজদের দখলে আসে ১৬০২ সালে, যখন সিরিপুরের রাজাকে হটিয়ে দিয়ে পর্তুগিজরা নিজেদের জন্যই ঘাঁটি করার পরিকল্পনা করে। সিরিপুরের রাজা মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য এক ভাড়াটে সৈন্যদলের ক্যাপ্টেন ডোমিংগোস কারভালহোর সাহায্য চায়। এমন সময়েই কারভালহো পরিকল্পনা করেন সন্দ্বীপের দখল নেওয়ার জন্য। দিয়াঙ্গার দুর্গের তৎকালীন প্রধান মানুয়েল দ্য মাত্তোস ৪০০ জনকে নিয়ে কারভালহোকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন, সহজেই সন্দ্বীপ দখল করে নেন তারা দুজনে মিলে।

এদিকে সন্দ্বীপ হারিয়ে সিরিপুরের রাজা আরাকানরাজ সেলিম শাহের সাহায্য চেয়ে পাঠান। দিয়াঙ্গা আর সন্দ্বীপ আক্রমণের জণ্য বিশাল বহর পাঠান সেলিম শাহ, সাথে সিরিপুরের রাজাও লোকবল পাঠিয়ে সাহায্য করেন। কিন্তু বিধিবাম! সামান্য লোকবল নিয়েই পুরো বহরকে থামিয়ে দেয় পর্তুগিজরা। তাদের সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হন সেলিম শাহ, অনুমতি দেন সন্দ্বীপ ও দিয়াঙ্গায় রাজত্ব করার।

চুক্তির পর কারভালহো আর মানুয়েল নিজেদের মধ্যে সন্দ্বীপকে ভাগ করে নেন। ১৬০৪ সালে কারভালহো লিসবনে চিঠি পাঠান রাজার কাছ থেকে গোলাবারুদ, জাহাজ আর লোকবল চেয়ে। এগুলো না পেলেও পর্তুগিজ রাজার কাছ থেকে পুরস্কার পাঠানো হয়। তবে তার আগেই কারভালহোকে দাওয়াত দিয়ে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করেন চণ্ডীকানের রাজা। ফলে মানুয়েলই সন্দ্বীপের একমাত্র নিয়ন্ত্রণকারী হয়ে ওঠেন। ফতেহ আলী খান নামক এক আফগানের সাহায্যে মানুয়েল মাত্তোস সন্দ্বীপ আর দিয়াঙ্গাকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন।

সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিলো ২-৩ বছর। তবে ১৬০৭ সালে আরাকান বাহিনী দুই জায়গাতেই আক্রমণ করে এবং প্রায় ৬০০ পর্তুগিজকে হত্যা করে। মানুয়েল দ্য মাত্তোসও মারা যান এই আক্রমণে। হাতেগোণা কয়েকজন পর্তুগিজ কোনোরকমে পালিয়ে আশ্রয় নেন পাশের বন-জঙ্গল-সমুদ্রে। তাদের মধ্যে একজনের নাম সেবাস্তিয়ান গঞ্জালেস তিবাউ।

তিবাউয়ের ত্রাসের রাজত্ব

লিসবনের পাশে থাকা এক ছোট্ট গ্রাম সান্তো আন্তোনিওতে জন্মেছিলেন তিবাউ। অভিজাত সমাজের কেউ না হওয়ায় তিবাউয়ের জন্মসাল এমনকি ১৬০৫ সালে ভারতে পা রাখার আগপর্যন্ত তার জীবন কেমন ছিল সেই সম্পর্কে জানা যায় না। গোয়াতে আসার পর তিবাউ কিছুদিন সৈনিক হিসেবে কাজ করেন। কাজ ভালো না লাগায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে সন্দ্বীপে চলে আসেন এবং লবণের ব্যবসা শুরু করেন। তখন লবণের বাজার জমজমাট, ফলে কিছুদিনের মধ্যেই ব্যবসার টাকা জমিয়ে একটি জাহাজ কিনে ফেলেন তিনি। আরাকান বাহিনী যখন আক্রমণ করে তখন তিবাউ আরও কয়েকজনের সাথে নিজেদের জাহাজে ছিলেন। ৮-১০টি বেঁচে যাওয়া জাহাজ নিয়ে তিবাউ তার বেঁচে থাকা সহযাত্রীদের নিয়ে মেঘনার মোহনায় আস্তানা গাঁড়লেন, বাকলার রাজার সাথে বন্ধুত্বপুর্ণ সম্পর্ক হওয়ায় তেমন কোনো ঝামেলার মুখে পড়তে হয়নি, এবং সেখান থেকেই শুরু হয় জলদস্যুনেতা হিসেবে তিবাউয়ের উত্থান।

মাত্তোসের মৃত্যুর পর ফতেহ খান স্থানীয় মুসলমানদের সমর্থনে নিজেকে সন্দ্বীপের রাজা হিসেবে ঘোষণা দেন। ১৬০৮ সালে তিনি জলদস্যুমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু যুদ্ধে মারা যান। ঠিক এই সময়েই আশেপাশের এলাকায় থাকা পর্তুগিজরা তিবাউয়ের জলদস্যু দলে ভেড়া শুরু করে। বাকলার রাজার সাহায্য নিয়ে ১৬০৯ সালে তিবাউ তার জলদস্যুদল নিয়ে সন্দ্বীপে আক্রমণ করে বসেন। ফতেহ আলী খানের ভাই তখন সন্দ্বীপের মুসলমানদের নেতৃত্ব দিছে। প্রায় দুই মাস ধরে সন্দ্বীপের দুর্গ অবরোধ করেও লাভ হচ্ছিল না, ইতোমধ্যেই তিবাউয়ের ভাঁড়ারে টান পড়েছে, গোলাবারুদ আর খাবার কমে এসেছে, এমন সময় দিয়াঙ্গায় এক স্প্যানিশ জাহাজের আগমন হয়। তাদের সাহায্যে সন্দ্বীপ দখল করে সন্দ্বীপের সকল মুসলমানকে হত্যা করে নিজেকে সন্দ্বীপের রাজা হিসেবে ঘোষণা দেন তিবাউ।

আরাকেনের মানচিত্র (দিয়াঙ্গা, চট্টগ্রাম, ম্রাউক-উ); Image Source: Rohingya News Agency

স্বাধীন অঞ্চল হিসেবে সন্দ্বীপ থেকে রাজত্ব চালাতে থাকেন তিবাউ। তার অধীনে তখন প্রায় এক হাজার পর্তুগিজ, দুই হাজার স্থানীয়, সাথে ২০০ ঘোড়া আর ৮টি জাহাজ। সন্দ্বীপ থেকে স্থানীয় ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন তিনি, অন্যদিকে বাকলার রাজাকে অগ্রাহ্য করে নিজের মতো শাসন চালিয়ে যেতে থাকেন। আশেপাশের অন্যান্য কিছু দ্বীপও দখল করে নেন তিনি। এমনকি আরাকানে আক্রমণ চালিয়েও সেলিম শাহকে শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য করেন।

এদিকে বাংলায় আবারো চোখ পড়েছে মুঘলদের। বাংলার মুঘল সুবাদার সন্দ্বীপের ঠিক পাশেই থাকা সিরিপুর আর ভুলুয়া দখল নেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন। মুঘল আক্রমণ হতে পারে ভেবে তিবাউ আরাকানের সাহায্য চান, আরাকানের রাজধানী ম্রাউক-উতে নিজের ভাতিজাসহ আরও বেশ কয়েকজন পর্তুগিজকে পাঠিয়ে দেন জিম্মি হিসেবে।

তবে ১৬১১ সালে যখন আরাকানীয়রা মুঘলদের সাথে যুদ্ধে নামে, তিবাউ তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেননি, আরাকানদের সাহায্য করতে বিরত থাকেন। এর কারণ হিসেবে অনেকে মনে করেন, হয় তাকে মোগলরা ঘুষ দিয়েছিল, অথবা দিয়াঙ্গায় পর্তুগিজহত্যার প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। সেলিম শাহের বাহিনী মোগলদের হাতে পরাজিত হলে তিনি ভুলুয়া থেকে চট্টগ্রামে পালিয়ে যান। এই সুযোগে তিবাউ তার সবগুলো জাহাজ জড়ো করে আরাকান নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেনদেরকে আমন্ত্রণ জানিয়ে হত্যা করে তাদের জাহাজ দখল করে নেন। তারপর আরাকানের উপকূলজুড়ে শুরু হয় তিবাউয়ের মুহুর্মুহু আক্রমণ। প্রতিশোধস্বরূপ তিবাউয়ের ভাতিজাসহ আরাকানে জিম্মি থাকা সকল পর্তুগিজকে হত্যা করা হলেও তিবাউ এসব নিয়ে ততটা চিন্তিত ছিলেন না।

আরাকানরাজ সেলিম শাহের মূর্তি; Image Source: Wikimedia Commons

১৬১২ সালে আরাকানরাজ সেলিম শাহ মারা যাওয়ার পর তার ছেলে মেং খামাউং ‘হুসেইন শাহ’ নামে সিংহাসনে বসেন। এদিকে চট্টগ্রামে থাকা সেলিম শাহের আরেক ছেলে আনাপোরাম সিংহাসনের দাবি করে বসেন এবং দুই রাজপুত্রের যুদ্ধ শুরু হয়। আনাপোরাম যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর তিবাউয়ের সাহায্য চাইতে সন্দ্বীপে আসেন। তিবাউ তাকে সাহায্য করতে রাজি হন এবং আনাপোরামের মেয়েকে বিয়ে করে সন্ধিতে আবদ্ধ হন। যদিও কিছুদিন পরেই আনাপোরাম মারা যান এবং তার সমস্ত সম্পত্তি তিবাউ দখল করে নেন। ধারণা করা হয়, তিবাউ বিষপ্রয়োগ করে রাজপুত্রকে হত্যা করেছিলেন।

হুসেইন শাহ প্রতিশোধ নেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলেও ত্রিপুরার রাজার সাথে যুদ্ধ শুরু হলে মনোযোগ ঐদিকে সরিয়ে নেন। এদিকে তিবাউ গোয়ার গভর্নরের কাছে চিঠি পাঠিয়ে জানান যে, দিয়াঙ্গার হত্যাযজ্ঞের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই তিনি এ কাজ করেছেন। সাহায্যের বিনিময়ে তিনি বাৎসরিক খাজনা পাঠাবেন লিসবনে। একইসাথে তিনি আরাকানে আক্রমণের প্রস্তাব করেন, কারণ এই মুহূর্তে আরাকানকে সহজেই দখল করা যাবে এবং এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া যাবে।

গোয়ার গভর্নর তিবাউয়ের প্রস্তাব অনুমোদন করেন এবং সন্দ্বীপের কার্যক্রমের জন্য তিবাউকে ‘অর্ডার অফ দ্য মেরিট অফ দ্য ক্রাইস্ট’-এ ভূষিত করার সিদ্ধান্ত নেন পর্তুগিজ রাজা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৬১৫ সালে গোয়ার গভর্নরের নির্দেশে ফ্রান্সিস্কো ডি মেনেসেস রোক্সোর নেতৃত্বে পর্তুগিজ জাহাজবহর হাজির হয় আরাকানে, ম্রাউক-উতে শুরু হয় আক্রমণ। কিন্তু এদিকে আরাকানীয়দের সহায়তার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয় ওলন্দাজরা। তাদের সহায়তায় পর্তুগিজদের হারিয়ে দেয় আরাকানীয়রা, মারা যান ডি মেনেসেস, তার জায়গায় নেতা হন লুই ডি আজেভেদো। বিধ্বস্ত পর্তুগিজরা সন্দ্বীপে আশ্রয় নেয় কিছুদিনের জন্য, উদ্দেশ্য গোয়ায় ফিরে যাওয়া। তিবাউ আজেভেদোকে অনুরোধ করেও লাভ হয়নি, সন্দ্বীপের বিরক্ত অনেক পর্তুগিজকে নিয়ে আজেভেদো গোয়ায় ফিরে যান।

পরের বছরই ওলন্দাজদেরকে সাথে নিয়ে সন্দ্বীপে আক্রমণ করেন আরাকানরাজ। এবার তিবাউকে হারিয়ে দেয় আরাকানীয়রা। তিবাউ আশ্রয় নেন বাংলার মূল ভূখণ্ডে এবং সেখানেই থেকে যান পরবর্তী জীবন। পর্তুগিজ রাজাকে তিবাউয়ের ব্যাপারে জানান গোয়ার গভর্নর, যে তিনি কেবল নিজ স্বার্থেই সন্দ্বীপকে ব্যবহার করেছেন, পর্তুগালের রাজার জন্য নয়। তিনি রাজার অনুগত ছিলেন না, স্বাধীন রাজা হিসেবেই সন্দ্বীপ শাসন করতেন। তবে এরপরও পর্তুগিজ রাজা অনুরোধ করেন তিবাউকে খুঁজে বের করে তার বীরত্বের জন্য সম্মান জানানোর জন্য। তবে ততদিনে দেরি হয়ে গেছে, তিবাউ হুগলিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।

মেজর জেমস রেনেলের আঁকা মানচিত্রে সন্দ্বীপ; Image Source: Wikimedia Commons

তিবাউয়ের পর

তিবাউ মারা গেলেও পর্তুগিজরা তখনো বঙ্গোপসাগর দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলো, আরাকানরা চায়নি পর্তুগিজদের দেশছাড়া করতে। এর পেছনে অবশ্য কারণও ছিল। ১৬১৭ সালে সন্দ্বীপ থেকে সকল পর্তুগিজকে দিয়াঙ্গায় নিয়ে যাওয়া হয়। আরাকানরাজ চাইছিলেন পর্তুগিজদেরকে মোগলদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে। মোগলরা তখন ক্রমশ বাংলা পেরিয়ে চট্টগ্রামের দিকে নজর দিচ্ছে। পর্তুগিজরা যে দক্ষ সৈনিক আর নাবিক তা ভালোমতোই টের পেয়েছিলেন হুসেইন শাহ; তাছাড়া পর্তুগিজদের গোলাবারুদ, অস্ত্রশস্ত্রও ছিল মোগলদের তুলনায় উন্নত। ফলে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আগাতে থাকা মুঘলদের থামানোর জন্য বাংলায় আক্রমণের অনুমতি দেওয়া হলো পর্তুগিজদেরকে। আরাকানদেরকে সাথে নিয়ে পর্তুগিজরা নতুন উদ্যমে শুরু করলো জলদস্যুতা।

চট্টগ্রাম আর দিয়াঙ্গাকে কেন্দ্র করে শুরু হলো আরাকান আর পর্তুগিজদের যৌথ জলদস্যুতা। লুটপাট সমান দুই ভাগে দুই পক্ষের মধ্যে ভাগ হয়ে যেত। দাস হিসেবে যাদেরকে ধরে আনা হতো, তাদের আরাকানরা কাজে লাগাতো আরাকানের কৃষিজমিতে, অন্যদিকে পর্তুগিজরা তাদেরকে যেকোনো বন্দরে বিক্রি করে দিতে পারতো। জলদস্যুতা এত ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছিয়ে গিয়েছিল যে, মোগল সুবাদারকে ঢাকাকে রক্ষার জন্য নদীর দুই পার থেকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়েছিল, যাতে অতর্কিত হামলায় পর্যুদস্ত না হতে হয়।

১৬২৮ সালে মানরিক যখন বাংলায় আসেন, তখন এই জলদস্যুতার কথা উল্লেখ করেন। হুগলি নদী তীরবর্তী হিজলির উল্টোপাশে থাকা দ্বীপটি দেখিয়ে তাকে জানানো হয়, দ্বীপটি আগে বেশ জনপূর্ণ ছিল। কিন্তু আরাকান-পর্তুগিজ জলদস্যুরা এত বেশি লুটপাট করেছে এবং লোকজনকে ধরে নিয়ে গিয়ে দাস হিসেবে বিক্রি করেছে যে, লোকজন ভয়ে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে গিয়েছে। ঘরবাড়ি ভর্তি জনশূন্য গ্রামটি হয়ে উঠেছে ভূতুড়ে।

পরের বছরই মানরিক দিয়াঙ্গা ভ্রমণ করেন। প্রায় ৭৫০ জন পর্তুগিজ তখন দিয়াঙ্গায় ঘর করছেন। আরাকানরাজ তাদের জন্য জমি ছেড়ে দিয়েছে। এই পর্তুগিজদের দিন কাটতো জলদস্যুতার পরিকল্পনা করে। বছরে তিন থেকে চারবার তারা বাংলায় আক্রমণ চালাতো। এবং মানরিকের ভাষ্যানুযায়ী, গোয়ার গভর্নরের অলিখিত সম্মতিও ছিল এর পেছনে। কারণ উপমহাদেশের ক্ষমতার টানাপোড়েনে মুঘলরা পর্তুগিজদের প্রতিদ্বন্দ্বী।

আরাকানের রাজধানী ম্রাউক-উতেও পর্তুগিজদের আস্তানা ছিল বলে জানিয়েছেন মানরিক। এই পর্তুগিজরা মূলত শহরের বাইরে আলাদাভাবে বসতি গেড়ে থাকতো, উদ্দেশ্য একটাই: ব্যবসা। ১৬৬০ সালের ওলন্দাজ বণিক উটার শ্যুটেনের বর্ণনাতেও এটি উঠে এসেছে। রাজধানী থেকে প্রায় ৩ মাইল দূরে ছিল এই গ্রাম, অনেকেই আরাকানের নারীদেরকে বিয়ে করতো, যারা ক্যাথলিক খ্রিস্টানে ধর্মান্তরিত হয়েছিল। অনেকেই আরাকানের সৈনিক এবং নাবিক হিসেবে কাজ করতো। ম্রাউক-উয়ের দুর্গ নির্মাণেও পর্তুগিজরা সাহায্য করেছিল বলে জানা যায়।

ম্রাউক-উ শহরের দেয়াল; Image Source: Wikimedia Commons

ঢাকার মোগল সুবাদার চট্টগ্রামের জলদস্যুদের দমনের জন্য পরিকল্পনা শুরু করেন। ১৬৫৬ সাল থেকে ১৬৬৪ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকবার পরিকল্পনা করা হলেও কার্যকর করা হয়নি। তবে ১৬৬৪ সালে যখন জলদস্যুরা মোগল নৌবাহিনীর ১৬০টি নৌকা-জাহাজ নিজেদের দখলে নেয়, তখন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য উঠেপড়ে লাগে মোগল প্রশাসন। একই বছর ভুষণা থেকে প্রায় তিন হাজার লোককে দাস হিসেবে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আর দেরি করা হয়নি।

শায়েস্তা খানকে নির্দেশ দেওয়া হয় নৌবাহিনী নতুনভাবে গোছানোর জন্য। ১৬৬৪ সালের মার্চ মাসে শায়েস্তা খান নির্দেশ দেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যত বেশি নৌকা তৈরি করা যায় তা করার জন্য। শায়েস্তা খান ইংরেজ আর ওলন্দাজদের কাছেও সাহায্য চান এই জলদস্যুদের দমনের জন্য। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালক পর্তুগিজদের দমনে উৎসাহী ছিলেন, তাই বাটাভিয়া (ইন্দোনেশিয়া) থেকে দুটো যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে দেন।

১৬৬৫ সাল। শায়েস্তা খান তার পুরো বাহিনী নিয়ে তৈরি জলদস্যু উৎখাতের জন্য। মেঘনা পেরিয়ে সন্দ্বীপ ছাড়িয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত চলে যায় মোগল বাহিনী। মগদের ১ হাজার ২৬টি কামান আর ১৩৫টি জাহাজ দখল করে নেওয়া হয়, প্রচুর সৈনিককে বন্দী হিসেবে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, বিক্রি করে দেওয়া হয় দাস হিসেবে, হত্যাও করা হয় প্রচুর জলদস্যুকে। শায়েস্তা খান চট্টগ্রামের দখল নিয়ে নতুন নামকরণ করেন ইসলামাবাদ হিসেবে, অন্তর্ভুক্ত করে নেন মোগল সাম্রাজ্যের বাংলা প্রদেশে।

মোগলরাও আরাকানদের মতো পর্তুগিজদেরকে পুরোপুরি উৎখাত করেনি, বরং একইভাবে নিজেদের কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করা হয়। চট্টগ্রামে থাকা পর্তুগিজ বণিকদের সেখানেই থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। ঢাকার কাছে থাকা পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের দিয়ে অনুরোধ করা হয় আরাকানে থাকা পর্তুগিজদের বাংলায় আসার জন্য, এখানে ব্যবসার জন্য। অনেককেই মোগল সেনাবাহিনীতে ঢোকার অনুমতিও দেওয়া হয়। তবে পর্তুগিজদের মনের তেমন পরিবর্তন হয়নি, সেখানে থেকেই চালিয়ে যেতে থাকে ব্যবসা।

This article is in Bengali language. It is about the Portuguese in Bengal before the colonial period.

Reference:
1. Rila Mukherjee - The struggle for the Bay: The life and times of Sandwip, an almost unknown Portuguese port in the Bay of Bengal in the Sixteenth and Seventeenth Centuries - Revista da Faculdade de Letras, Issue 3, Volume 9, 2008
2. Suthachai Yimprasert - The Portuguese in Arakan in the Sixteenth and Seventeenth Centuries

Related Articles

Exit mobile version