প্রথম ফ্রেডেরিক উইলিয়াম প্রায় ২৭ বছর ধরে প্রুশিয়ার রাজার দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সময় সেনাবাহিনীতে সৈন্যসংখ্যা তিনি ৩৮ হাজার থেকে প্রায় ৮৩ হাজারে উন্নীত করেন, যার ফলে তিনি ‘সোলজার কিং’ হিসেবেও খ্যাতি পান। তবে, উইলিয়ামের ব্যক্তিগত এক বিশেষ সেনাদল ছিল, যাতে ভর্তি করা হতো কেবলমাত্র আকৃতিতে লম্বা মানুষদেরই। বিশেষ এই সেনাদল নিয়ে কিছু বলতেই এই লেখা।
রাজা উইলিয়ামের বিশেষ এই সেনাদলের অফিসিয়াল নাম ছিল ‘দ্য গ্র্যান্ড গ্রেনেডিয়ার্স অফ পটসড্যাম’। তবে মানুষের অত কঠিন নামে ডাকতে বয়েই গিয়েছিল। তারা একে ডাকত ‘দ্য পটসড্যাম জায়ান্টস’ নাম ধরে। তো, এই জায়ান্ট তথা দানবদের (আসলে তো মানুষ!) কতটা লম্বা হওয়া লাগত? ৬ ফুটের বেশি লম্বা হলে যে কেউ উইলিয়ামের এই বিশেষ সেনাদলে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারত। এছাড়া আর কোনো যোগ্যতা বা দক্ষতার প্রমাণেরই দরকার ছিল না।
ইতিহাস বলে, এই দানবেরা সেনাবাহিনীতে বেশ আরাম-আয়েশেই দিন কাটাত। পুষ্টিকর খাবার, আরামদায়ক বাসস্থান, ভাল বেতন, রাজার সুদৃষ্টি- সবই ছিল তাদের জন্য বরাদ্দ। চমৎকার এক নীলরঙা ইউনিফর্ম দেয়া হত তাদের, সাথে মাথার উপর থাকত ৪৫ সেন্টিমিটার লম্বা টুপি, যার ফলে এমনিতেই লম্বা এই মানুষগুলোকে আরও লম্বা দেখাত। সৈন্যদের বেতন নির্ভর করত তাদের উচ্চতার উপর। যে যত লম্বা, তার বেতন তত বেশি।
এটুকু পড়ে যদি আপনার মনে হয়, পটসড্যামের এই দানবেরা বেশ সুখেই ছিল, তবে আপনি ভুল ভাবছেন। আসলে, এই বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত সৈন্যদের এক বিরাট অংশ এই জীবনে আসতেই চায়নি। তাদেরকে কখনও জোর করে পাঠিয়ে দেয়া হতো, কখনও আবার অপহরণ করেও নিয়ে আসা হতো! সেই সাথে রাজার বিচিত্র সব আদেশ পালনের বিষয়টি তো ছিলই।
অতিরিক্ত লম্বা কোনো ছেলে যদি রাজার কোনো লোকের নজরে পড়ত, তাহলে তার বাবাকে অর্থ দিয়ে তিনি ছেলেটিকে নিয়ে আসতেন। যদি কোনো জমিদারের অধীনস্থ কোনো প্রজাও বেশি লম্বা হতো, তাহলে জমিদারকে অর্থ দিয়ে সেই প্রজাকে ধরে আনা হতো। এমনকি, বাবা-মায়ের উচ্চতা বেশি হিসেব করে কোনো সন্তান ভবিষ্যতে বেশি লম্বা হতে পারে, এমন ধারণা হলে সেই নবজাতক সন্তানের কপালেও উজ্জ্বল লাল রঙের শনাক্তকরণ চিহ্ন দিয়ে আসা হতো। আশেপাশের রাজ্যের রাজারাও উইলিয়ামের বিচিত্র খেয়াল সম্পর্কে জানতেন। ফলে তারাও মাঝে মাঝেই নিজেদের রাজ্যের লম্বা প্রজাদেরকে একপ্রকার জোর করেই উইলিয়ামের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। কেন? সম্পর্ক ভাল রাখার জন্য!
রাজা কিংবা তার অনুচরেরা কাউকে বিশেষ এই বাহিনীর জন্য পছন্দ করলে তার আসলে এই বাহিনীতে যুক্ত না হয়ে কোনো উপায় ছিল না, সেটা স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়। অনিচ্ছায় হলে সেই লোকটিকে অপহরণ করে এখানে নিয়ে আসা হতো। একবার তো এক অস্ট্রিয়ান কূটনীতিবিদকে রাজার এতটাই মনে ধরে যায় যে তাকেও এই বাহিনীতে যুক্ত করার জন্য অপহরণের ব্যবস্থা করেন তিনি।
পটসড্যামের দানবদের মাঝে বিখ্যাত একজন হলেন জেমস কার্কল্যান্ড। ৭ ফুট ১ ইঞ্চি লম্বা এই আইরিশকে পেতেও বেশ জলঘোলা করেন রাজা। লন্ডনে নিযুক্ত প্রুশিয়ান রাষ্ট্রদূত ব্যারন বর্কের জন্য পাইক হিসেবে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু এটা ছিল আসলে এক প্রতারণা, যাতে করে শিকার ফাঁদে এসে ধরা দেয়। জেমস চাকরিতে যোগ দিতে আসলে তাকে পোর্টসমাউথ বন্দরে নোঙর করে রাখা প্রুশিয়ান জাহাজে কাজের নাম করে পাঠানো হয়।
জেমস সরলমনেই সেদিকে রওয়ানা দিল। ওদিকে পোর্টসমাউথ বন্দরে আগে থেকেই তার জন্য অপেক্ষা করে ছিল রাজার লোকজন। সে উপস্থিত হওয়ামাত্রই হাত-পা-মুখ বেঁধে জাহাজে তুলে ফেলা হয়। এরপর জাহাজটি রওয়ানা দেয় প্রুশিয়ার উদ্দেশ্যে!
মিশন সাক্সেসফুল!
অপহরণ করে আনা যদি হয় একপ্রকার নির্যাতন, তাহলে সেটাকে বলতে হবে নির্যাতনের কেবলমাত্র প্রথম ধাপ। এরপর থেকে রাজার মনোরঞ্জনের জন্য বিভিন্ন সময়ই বিভিন্ন কিছু করতে হতো তাদের।
যেমন, যদি রাজা অসুস্থ হয়ে পড়তেন, তাহলে মন ভাল করার জন্য এই সৈন্যদেরকে তাদের রুম দিয়ে মার্চ করে যেতে হত। এতে তিনি মানসিক শান্তি লাভ করতেন। যদি রাজার মন খারাপ থাকত, তাহলে তিনি দু-তিনশ দানবকে ডেকে কসরতের ব্যবস্থা করতেন মন ভাল করার জন্য। কখনও আবার অবসর সময়ে তিনি রংতুলি আর ক্যানভাস নিয়ে বসে পড়তেন। যে সৈন্যকে তার ভাল লেগে যেত, এবং অবশ্যই যার চেহারা তার ঠিকমতো মনে থাকতো, তার ছবিই আঁকতে শুরু করতেন রাজা!
শুধু কি এটুকুই? রাজা উইলিয়াম একেবার প্রজনন পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন। তিনি চাইতেন, ইউরোপের সবচেয়ে লম্বা সেনাদের বাহিনীটা হোক কেবলমাত্র তারই। ফলে লম্বা লম্বা নারীদের এনে তার এই লম্বা সেনাদের সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করতেন তিনি, চাইতেন তাদের মিলনের ফলে নতুন যে সন্তানরা আসবে, তারাও যেন তাদের বাবা-মায়ের মতোই অতিরিক্ত লম্বা হয়। বলা বাহুল্য, রাজার এই প্রচেষ্টা সফলও হয়েছিল। আঠারো শতকের শেষের দিকে পটসড্যামে অস্বাভাবিক লম্বা মানুষজন একটু বেশিই চোখে পড়ত।
এখানেই কি শেষ রাজার উন্মাদনা? না। রাজার নির্দেশে এক যন্ত্র বানানো হয়েছিল যেটায় এই লম্বা সেনাদের টানা হতো, যাতে তারা আরও লম্বা হতে পারে! কখনও কখনও রাজা নিজে এসেই এই কাজের উদ্বোধন করতেন আর দুপুরের খাবার খেতে খেতে সৈন্যদের উপর চলা এই অমানবিক কাজটি উপভোগ করতেন। তবে নিশ্চিতভাবেই এটা উচ্চতা নিয়ে বাড়াবাড়িই ছিল বলতে হবে। ফলে অনেক সময়েই এর মধ্য দিয়ে যাওয়া আহত সৈন্যরা মৃত্যুবরণও করত। একসময় রাজা নিজের ভুল বুঝতে পেরে অবশ্য এই যন্ত্রের ব্যবহার থেকে সরে আসেন। এত নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে কেউ যদি সেনাবাহিনী থেকে পালাতে চাইত, তবে তার একমাত্র শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড।
এত ঝামেলা করে সংগ্রহ করা হতো যে সেনাদের, আদর-যত্ন-বেতন দেয়া হতো যাদের, তারা কী কী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরত্বের কী কী স্বাক্ষর রেখেছিল জানতে চান? তারা আসলে কোনো যুদ্ধেই অংশ নেয়নি। আসলে ‘নেয়নি’ না বলে তাদের ‘নিতে দেয়া হয়নি’ বলাটাই ভাল, কেননা রাজা উইলিয়াম মনে করতেন, এরা এতটাই মূল্যবান যে কোনো যুদ্ধেই তাদের পাঠানো উচিত হবে না। ফলে প্যারেড গ্রাউন্ডে করা সামরিক নানা প্রশিক্ষণই ছিল তাদের একমাত্র কাজ।
১৭৪০ সালে মারা যান রাজা প্রথম ফ্রেডেরিক উইলিয়াম। ততদিনে তার বিশেষ এই সেনাবাহিনীর সৈন্যসংখ্যা আড়াই হাজারে গিয়ে ঠেকেছিল। তার ছেলে ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেট অবশ্য বাবার এই খামখেয়ালীপনাকে ভালভাবে নেয়নি। এই সেনাদের পেছনে এত খরচ তার কাছে অপচয় ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি। ফলে বাবার মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসে তিনি এই সেনাদের বিভিন্ন অ্যাক্টিভ কম্ব্যাট ইউনিটে স্থানান্তরিত করতে থাকেন।
অবশেষে ১৮০৬ সালে এসে পুরোপুরিভাবেই বিলুপ্ত হয়ে যায় অতিরিক্ত লম্বা মানুষদের নিয়ে গঠিত রাজা উইলিয়ামের স্বপ্নের সেই ইউনিটটি।