৭১১ সাল। ইসলামের ইতিহাসের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর। এই বছরেই সেনাপতি মূসা ইবনে নূসাইর ও তারিক বিন জিহাদ স্পেনে মুসলিমদের পরিচালিত অভিযানে নেতৃত্ব দেন। স্পেন বিজয় ছিল মুসলিমদের ইতিহাসে বড় বিজয়গুলোর একটি। তৎকালীন মুসলিম সাম্রাজ্যের কেন্দ্র দামেস্কভিত্তিক উমাইয়া খেলাফতের খলিফা ছিলেন ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক (৭০৫-৭১৫ খ্রিস্টাব্দ)। খলিফা ওয়ালিদের শাসনকালে এই বিজয় অর্জিত হয়।
তৎকালীন উত্তর আফ্রিকা
আন্দালুস বিজয়ের সত্তর বছর পূর্বেই আফ্রিকার উত্তরাঞ্চল মুসলিমদের অধিকারে চলে যায়। আফ্রিকার এই অঞ্চলে আমাজিগ (Amazighs) নামক এক গোত্র বাস করতো। তারা ছিল অত্যন্ত একরোখা, যুদ্ধবাজ ও সাহসী জাতি। তারা একাধিকবার ইসলাম গ্রহণের পর ধর্মত্যাগ করে। ফলে তাদের সাথে মুসলিমদের অনেকগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয়। অবশেষে ৭০৫ খ্রিস্টাব্দে এই অঞ্চলে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয় এবং যুদ্ধাবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটে।
মূসা ইবনে নূসাইর
মূসা বিন নূসাইর ছিলেন একজন সুদক্ষ সেনাপতি। তার শাসনামলেই উত্তর আফ্রিকায় উমাইয়াদের ভিত মজবুত হয়। তিনি উমাইয়া প্রশাসনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করেন। ৭৭হিজরিতে খলীফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের শাসনামলে তিনি ইফ্রীকিয়া (বর্তমান তিউনিশিয়া) ও মাগরেবের (বর্তমান মরক্কো, আলজেরিয়া ও লিবিয়ার পশ্চিমাঞ্চল) প্রশাসকের দায়িত্ব পান। প্রশাসকের দায়িত্ব লাভ করেই মূসা তার শাসনাধীন অঞ্চলের স্থিতিশীলতার দিকে জোর দেন। তার মাধ্যমে সিউটা ব্যতীত পুরো মাগরেব অঞ্চলে উমাইয়া শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
তারিক বিন জিয়াদ
মুসলিমদের স্পেন বিজয়ের কথা আসলেই যার কথা আর বীরত্ব আমাদের সামনে আসে তিনি তারিক বিন জিয়াদ। তিনি আরব বংশোদ্ভূত ছিলেন না। তিনি ছিলেন উত্তর আফ্রিকার আমাজিগ (বার্বার) বংশোদ্ভূত।আফ্রিকা অঞ্চলের অধিবাসীদের দৈহিক বৈশিষ্ট্যের বিপরীতে আমাজিগরা ছিল শ্বেতাঙ্গ। এ কারণে বংশমূলের বিচারে কেউ কেউ তাদের ইউরোপীয় মনে করেন। দীর্ঘদেহী তারিক বিন জিয়াদ ছিলেন অসাধারণ নেতৃত্বগুণের অধিকারী। তিনি অনারব হলেও আরবিতে অনর্গল কথা বলতে পারতেন। ফলে তিনিই ছিলেন আমাজিগ ও আরবদের মিশ্র সেনাবাহিনীর যোগ্য সেনাপতি। তাকে সেনাপতি নিয়োগ দিয়ে মূসা ইবনে নূসাইর দূরদর্শীতার পরিচয় দেন।
তরীফ বিন মালিকের নেতৃত্বে স্পেনে মুসলিমদের অগ্রাভিযান
মূসা খলিফার কাছে অনুমতি প্রার্থনা করে বসে থাকেননি। অনুমতি পাওয়ার সাথে সাথেই যেন অভিযান শুরু করতে পারেন সেই উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী গঠন করতে থাকেন। তখন খলীফার অনুমতি পাওয়া মাত্র মূসা পাঁচশো সৈন্যের এক বাহিনী পাঠিয়ে দেন। এদের মধ্যে একশো ছিল অশ্বারোহী আর চারশো পদাতিক। তাদের কাজ ছিল অভিযানের জন্য আন্দালুসের পরিবেশ-পরিস্থিতি নিরীক্ষা করা। অবশেষে ৭১০ খ্রিস্টাব্দে তারা তরীফ বিন মালিকের নেতৃত্বে আন্দালুস-ভূমিতে পা রাখে। অভিযান শেষে তরীফ মূসা ইবনে নূসাইরের কাছে তার চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা ও আন্দালুসের ভূ-চিত্র তুলে ধরেন। এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্যই ছিল আন্দালুস সংক্রান্ত যাবতীয় গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ। তাদের সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতেই মূসা ইবনে নূসাইর তার পরবর্তী রণকৌশল ঠিক করেন।
তারিক বিন জিয়াদের আন্দালুস অভিযান
তরীফের অভিযানের প্রায় এক বছর পর ৭১১ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে মাত্র সাত হাজার সৈন্যের সমন্বয়ে গঠিত মুসলিম বাহিনী তারিক বিন জিয়াদের নেতৃত্বে আন্দালুসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। এই বাহিনীর অধিকাংশ সৈন্যই ছিল বার্বার বংশোদ্ভূত, আর প্রায় ৩০০ জনের মতো আরব সৈন্যও এতে ছিল। তারিকের সহযোগী হিসেবে এই বাহিনীতে ছিল বিখ্যাত সেনাপতি মুগীস রূমী।
তারিক তার বাহিনী নিয়ে আন্দালুসের যে স্থানে অবতরণ করে তার নাম ছিল লাইনজরাক। পরবর্তীতে এর নাম পরিবর্তিত হয় জাবালুত তারিখ বা জিব্রাল্টার।
আন্দালুস ভূমিতে তারিক বিন জিয়াদ
মুসলিম বাহিনী জাবালুত তারিখ থেকে নিকটবর্তী আলজেসিরাস (Algeciras) পৌঁছালে সর্বপ্রথম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। প্রতিরোধকারী বাহিনীটি ছিল মূল বাহিনীর একটি আঞ্চলিক টহল বাহিনী, যার নেতৃত্বে ছিল সেনাপতি টুডমির। মুসলিমরা খুব সহজেই এই বাহিনীকে পরাজিত করে।
পরাজিত আন্দালুস বাহিনীর সেনাপতি টুডমির আসন্ন বিপদ টের পেয়ে তৎক্ষণাৎ আন্দালুসের শাসক রডারিকের কাছে জরুরি বার্তা প্রেরণ করেন। কিন্তু রডারিক তার সাম্রাজ্যে এই নতুন আগন্তুকের সংবাদে খুব একটা বিচলিত হলেন না। তিনি ভাবলেন, তারা হয়তো সীমান্ত অঞ্চলে লুটপাট করে চলে যাবে। কিন্তু রডারিকের ঘুম ভাঙলো যখন শুনলেন মুসলিম বাহিনী কর্ডোভার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তিনি খুব দ্রুত সৈন্যসমাবেশ ঘটালেন আর তার ভাগ্নে ও স্পেনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাপতি বেনশিয়োর নেতৃত্বে মুসলিমদের প্রতিরোধ করার জন্যে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী প্রেরণ করলেন।
এ বাহিনীও তারিকের হাতে পরাজিত হলো। পর পর এই দুটি যুদ্ধে মুসলিমদের ক্ষয়ক্ষতি তেমন একটা হয়নি বললেই চলে। পরাজয়ের সংবাদ রডারিকের মাথায় বজ্রপাতের মতো আঘাত করলো। তিনি এই বাহিনীর মোকাবেলায় আরও একটি বিশাল বাহিনী প্রস্তুত করলেন। নতুন এই বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় এক লক্ষ।এই বিশাল বাহিনীর সংবাদে তারিক বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি মূসা বিন নূসাইরের কাছে সাহায্য চেয়ে বার্তা পাঠালেন। বার্তা পেয়ে মূসা বিন নূসাইর তারীফ বিন মালিকের নেতৃত্বে আরও পাঁচ হাজার সৈন্যের সাহায্যকারী বাহিনী প্রেরণ করেন। এতে মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় বারো হাজারে পৌঁছে।
বারবাত প্রান্তরের ঐতিহাসিক যুদ্ধ
মুসলিমদের মোকাবিলায় এবার স্বয়ং রডারিক নিজেই তার বিশাল বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসলেন। অন্যদিকে তারিক বারাবাত উপত্যকাকে (de Guadalete) রডারিকের মোকাবিলায় উপযুক্ত মনে করে সেখানেই মুসলিম বাহিনী নিয়ে অবস্থান নিলেন। ভৌগলিকভাবে বারবাত উপত্যকার দুটি দিক পাহাড় আর একটি দিক হ্রদ দ্বারা বিছিন্ন। তারিক মুসলিম বাহিনীর পেছন দিকে পাহাড় রেখে তার সামনে মুসলিম বাহিনীকে স্থাপন করলেন।মুসলিম বাহিনীর ডানেও ছিল পাহাড় আর বামে ছিল প্রাকৃতিক হ্রদটি। তাছাড়া তিনি তারীফ বিন মালিকের নেতৃত্বে উপত্যকার দক্ষিণের (মূল বাহিনীর পেছনে) একমাত্র প্রবেশপথে একদল সেনা মোতায়েন করেন।ফলে মুসলিমরা বাহিনীকে পেছন থেকে আক্রমণের পথও রুদ্ধ হয়ে যায়।
অন্যদিকে, স্বর্ণের সিংহাসনে উপবিষ্ট হয়ে এক লক্ষ সৈন্যের নেতৃত্ব রাজা রডারিক নিজেই দিচ্ছিলেন। ৭১১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জুন মোতাবেক ৯২ হিজরীর ২৮ রমজান রোজ রবিবার উভয় বাহিনী মুখোমুখি হলো। আট দিন যুদ্ধ শেষে রডারিকের নেতৃত্বাধীন গোথ বাহিনী মুসলিমদের কাছে পরাজিত হলো। রডারিক যুদ্ধক্ষেত্রেই নিহত হন।
পরাজিত গোথ বাহিনী তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে দক্ষিণ আন্দালুসের অন্যতম নগরী ইসিজাতে (Ecija) একত্রিত হচ্ছে। এই সংবাদ পাওয়ামাত্র তারিক বিন জিয়াদ ইসিজার দিকে অগ্রসর হন। পথিমধ্যে তিনি সিডোনিয়া (Sidonia) ও মুরুর (Moron de la Frontera) নগরী জয় করেন। ইসিজায় মুসলিমদের সাথে গোথদের প্রচন্ড যুদ্ধে গোথরা আবার পরাজিত হয়। ইসিজা জয়ের পর তারিক বিন জিয়াদ তার বাহিনীকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে ভাগ করে বিভিন্ন শহরের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন, আর মূল বাহিনী রওয়ানা হয় আন্দালুসিয়ার তৎকালীন রাজধানী টলেডোর উদ্দেশ্যে।
ক্ষুদ্র সেই বাহিনীগুলোর মাধ্যমেই আন্দালুসিয়ার গুরুত্বপূর্ণ নগরী কর্ডোভা, গ্রানাডা, মালাগা ও মুরসিয়া মুসলিমদের হাতে আসে। অন্যদিকে টলেডো ছিল গোথ শাসিত স্পেনের রাজধানী। এটি স্পেনের বর্তমান রাজধানী মাদ্রিদ থেকে ৯১ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। টলেডো নগরী তিন দিকেই টাজু নদী (Tagus River) দ্বারা সীমাবদ্ধ অত্যন্ত সুরক্ষিত একটি নগরী ছিল। এর উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম- তিন দিক থেকে পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত ছিল, আর দক্ষিণে ছিল বিশালাকার নগরপ্রাচীর বিশিষ্ট দুর্গ।
পর পর অনেকগুলো পরাজয়ে গোথদের মনোবল ভেঙে যায়। ফলে মুসলিমদের আগমনের সংবাদে গোথরা কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই টলেডোকে মুসলিমদের হাতে তুলে দিয়েছিল। তারিক বিন জিয়াদ টলেডো জয় করেই ক্ষান্ত হলেন না। তিনি উত্তরে তার অভিযান অব্যহত রাখলেন। অন্যদিকে, মূসা ইবনে নুসাইর ৭১২ খ্রিস্টাব্দের জুনে আরও আঠারো হাজার সৈন্যের বিশাল দল নিয়ে তারিক বিন জিয়াদের সাহায্যে এগিয়ে আসলেন। এরপর উভয়ের সম্মিলিত বাহিনীর হাতে বার্সেলোনা (Barcelona) ও উত্তর-পূর্ব আন্দালুসের সর্বোবৃহৎ নগরী জারাগোযার পতন হয়।
অভিযানের এই পর্যায়ে উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ বিন আবদুল মালিক উত্তর আফ্রিকার গভর্নর মূসা ইবনে নুসাইর ও আন্দালুস বিজয়ী সেনাপতি তারিক বিন জিহাদকে রাজধানী দামেশকে তলব করেন। ফলে তারা তাদের এই আন্দালুস অভিযান অসমাপ্ত রেখেই দামেশকের পথে রওয়ানা হন।
এভাবেই মাত্র সাড়ে তিন বছরের এই অভিযানে (৭১১-৭১৪ খ্রিস্টাব্দ) উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের সাখরাতু বুলাইয়া (Covadonga) নামক জনপদ বাদে পুরো আন্দালুস মুসলিম অধিকারে চলে আসে।এর মাধ্যমে আন্দালুসে শুধু নতুন এক শাসনই নয়, তার সাথে নতুন এক যুগেরও সূচনা হয়।
স্পেনের প্রথম মুসলিম শাসক
তারিক এবং মূসা উভয়েই স্পেনের বিজেতা ছিলেন। তাদের স্পেনে অবস্থান করা সময় পুরোটাই বিভিন্ন জনপদ ও দুর্গ জয়ে অতিবাহিত হয়ে যায়। তাই তাদের দুজনেই স্পেনের বিজয়ী। কিন্তু স্পেনের সর্বপ্রথম নিয়মিত শাসক ছিলেন আবদুল আযিয ইবনে মূসা। তারপর থেকে একে একে অনেকেই স্পেন শাসন করেন। এদের কেউ খলিফার দ্বারা নিযুক্ত হন, কেউ নিযুক্ত হন কায়রোয়ানে নিযুক্ত গভর্নরের মাধ্যমে, কেউ কেউ আবার স্প্যানিশ মুসলিমদের দ্বারাও নির্বাচিত হয়েছেন।
এই মুসলিম নেতৃবৃন্দের হাতেই স্পেনে সূচিত হয়েছিল এক নতুন যুগের। আর স্পেন পরিণত হয়েছিল ইসলামী জগতের অন্যতম সমৃদ্ধশালী সাম্রাজ্যে, যার সমৃদ্ধি মুসলিমদের তৎকালীন কেন্দ্র বাগদাদের আব্বাসীয় খেলাফতের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না।