প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বেশিরভাগ যুদ্ধ হতো পরিখার ভেতর থেকে। যুদ্ধের সেই পদ্ধতি তখনকার সময়ে প্রায় সব দেশ অনুসরণ করলেও বর্তমানে তা প্রায় বিলুপ্তই বলা চলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পরিখার ভেতরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থেকে সৈনিকদের যে নাজেহাল দশা হয়েছিল, সেখান থেকে শিক্ষা নিয়েই মূলত আর কোনো দেশ সম্মুখ যুদ্ধের জন্য এই পরিকল্পনা গ্রহণ করে না। কেমন ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তৈরি করা পরিখাগুলোর পরিবেশ? এগুলোর ভেতর থেকে কীভাবে যুদ্ধ করতো তখনকার সৈনিকরা? নিজেদের যত্নই বা তারা কীভাবে নিতো? চলুন জেনে নেওয়া যাক সে সকল কথা।
শত্রুপক্ষের আক্রমণ থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখার জন্য খনন করা বিশেষ গর্তকে বলা হয় পরিখা। এই গর্তগুলো সাধারণত হতো বেশ লম্বা এবং সরু প্রকৃতির। যুদ্ধের সময় এর ভেতর থেকেই যুদ্ধ পরিকল্পনাসহ প্রতিপক্ষের গতিবিধি নজরদারি করা হতো। বর্তমান সময়ের তুলনায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক সামরিক-প্রযুক্তিকে ‘মান্ধাতার আমল’-এরই বলা যেতে পারে। সেই প্রেক্ষাপটে সমরকৌশলের একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ ছিল পরিখা। কোনো নির্দিষ্ট যুদ্ধক্ষেত্রে নির্দিষ্ট দূরত্ব বুঝে যুদ্ধের দু’পক্ষই পরিখা খনন করে রাখতো।
খালি চোখেও দেখা যাবে না, আবার শত্রুর সরাসরি আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে- এমন দূরত্বের কথা চিন্তা করেই পরিখাগুলো খনন করা হতো। দু’পক্ষের পরিখার মাঝের জায়গাটিকে বলা হয় ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’। বর্তমান সময়ে পাশাপাশি দুই দেশের সীমান্তের মাঝখানে খালি জায়গা থাকার মতোই ছিল বিষয়টি। সামনের সারির পরিখার পেছনে আরো অনেক পরিখা তৈরি হতো, যেখানে সৈনিকরা বিশ্রাম নেওয়ার পাশাপাশি তাদের শরীরের পরিচর্যা করতো। যেহেতু পরিখা থেকে গার্ড ছাড়া নো ম্যানস ল্যান্ডে বের হয়ে আসলে শত্রুপক্ষের সরাসরি গুলি খাওয়ার সম্ভাবনা থাকতো, তাই সৈনিকরা সাধারণত পরিখার ভেতরেই তাদের যুদ্ধের পুরোটা সময় কাটিয়ে দিতো।
সৈনিকদের খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে নিয়মিত ঘুম, গোসল, টয়লেট ব্যবহার সবই হতো পরিখার ভেতর থেকে। নো ম্যানস ল্যান্ডে বের হয়ে সামনাসামনি যুদ্ধ করা ছাড়া পরিখা থেকে বের হওয়ার তেমন কোনো উপলক্ষও তখন ছিল না। রুটিন মাফিক খাওয়াদাওয়ার পাশাপাশি সৈনিকরা পরিখার ভেতর ঘুমানোর জন্য বিকেলের আলোয় ঘন্টা খানেক এবং রাতের আলোতেও মাত্র ১ ঘন্টা সময় পেতো। এছাড়া বাকি সময় তাদের কাটতো অস্ত্র পরিষ্কার করে এবং পরিখা খননের কাজ করে। আর যুদ্ধের জন্য তো সবধরনের পরিস্থিতিতেই সদা প্রস্তুত থাকা লাগতো।
ব্যতিক্রম দেখা গিয়েছিল ১৯১৪ এর বড়দিনে। বেলজিয়াম ও লুক্সেমবার্গের অংশে (ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট) ব্রিটিশ ও জার্মান দু’পক্ষের সৈন্যরাই সেদিন অস্ত্র বিরতি দিয়েছিল। নো ম্যানস ল্যান্ডে একসাথে মিলিত হয়ে সৌজন্য বিনিময়ের পর সম্মিলিত কণ্ঠে গেয়েছিল বড়দিনের গান ‘সাইলেন্ট নাইট’। আয়োজনের সমাপ্তিপর্ব ছিল উপহারে মোড়া- ব্রিটিশরা জার্মানদের দিয়েছিল চকলেট এবং জার্মানরা ব্রিটিশদের সসেজ। জানা যায়, নতুন বছরের পূর্ব পর্যন্ত চলেছিল এই অঘোষিত যুদ্ধ বিরতি। এরই মাঝে নাকি ব্রিটিশ ও জার্মানদের মাঝে একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচও আয়োজিত হয়, যেখানে জার্মানরা ব্রিটিশদের ৩-২ গোলে পরাজিত করে। যদিও ইতিহাসের পাতায় এই ফুটবল ম্যাচ ও অস্ত্র বিরতি নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। শুধু তাই নয়, ১৯১৪ এর পরবর্তী বড়দিনগুলোতে এমন অস্ত্র বিরতি ছিল কিনা, সেটি নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা।
তবে তখনকার পরিখাগুলোতে থাকার পরিবেশের কথা বললে সৈনিকদের প্রতি বেশ করুণাই হয়। জার্মান পরিখাগুলো মোটামুটি ছিমছাম ধরনের হলেও ব্রিটিশ ও ফ্রেঞ্চ পরিখাগুলোতে ছিল যাচ্ছেতাই অবস্থা। নর্দমার পানি, টয়লেটের পানি, বৃষ্টির পানি সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। এসবের মাঝে থাকতে থাকতে সৈনিকরা দ্রুতই বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছিল। অনেকক্ষেত্রে পরিখার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থেকে ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হয়ে সৈনিকদের মৃত্যুবরণ করার খবরও অস্বাভাবিক ছিল না। এসব কিছুর মাঝেও সৈনিকদের নিজেদের স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখতে হতো, যাতে অন্তত বন্দুকের সাথে যুদ্ধের আগে পানির সাথে যুদ্ধ করে মরতে না হয়!
বিভিন্ন উপায়েই সৈনিকরা তখন নিজেদের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে বাঁচিয়ে রাখতো। বিভিন্ন নথিপত্র ঘেঁটে এবং যুদ্ধ থেকে বেঁচে আসা সৈনিকদের অভিজ্ঞতা থেকে শুনে বেশ কয়েকটি পন্থার কথা জানা যায়, যেগুলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈনিকরা ব্যবহার করতো নিজেদের সুরক্ষার জন্য। জেনে নেয়া যাক সেই উপায়গুলো–
পরিষ্কার পানি পান করা
পরিখার ভেতরে থাকা খাওয়ার যা পরিবেশ, তাতে খাবার পানিটিও যদি হয় দূষিত, তাহলে তো বেঁচে থাকাই মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। পরিখাগুলোতে পানি সরবরাহ করা হতো পেট্রোল-পাত্রের মাধ্যমে। খাবার পানি যে খুব একটা পানের উপযুক্ত থাকতো, তাও না। ওষুধ দিয়ে সেই পানি দূষণমুক্ত করে ও ফুটিয়ে তবেই পান করতে হতো। অনেক সৈনিক নিজের বোতলে করে সেই বিশুদ্ধ পানি সাথে রাখতো। এতো কিছুর পরেও পানিতে দুর্গন্ধ থেকেই যেতো। সেই পানি দিয়ে সৈনিকরা চা বানিয়ে ফেলতো, যাতে গন্ধ কিছুটা হলেও দূর করা যায়।
নিয়মিত ওষুধ খাওয়া
পরিখার নোংরা পরিবেশে অসুস্থ হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তার উপর বর্ষা এবং শীতের সময় এর ভেতরের পরিবেশ হয়ে উঠতো ভয়াবহ। ঠাণ্ডা, জ্বর, কাশি ছিল নিত্যদিনের অসুখ-বিসুখ। এগুলো থেকে রক্ষার জন্য অনেক সময় সৈনিকরা বাসা থেকেই আগে ওষুধ নিয়ে আসতো। তা না হলে তাদের জন্য আলাদা ওষুধ সরবরাহ করা হতো।
ছারপোকা ও ইঁদুর থেকে রক্ষা
ছারপোকা ও ইঁদুরের সাথে মানুষের যুদ্ধটা বোধ হয় সেই আদিমকাল থেকেই চলে আসছে। পরিখার ভেতরেও বিছানার তোষক, গায়ে দেয়ার কাপড়- সব জায়গাতেই এগুলো ছড়িয়ে পড়েছিল। এগুলো মারাও ছিল আরেক ঝামেলার কাজ। দুই আঙ্গুলের মাঝে চিমটি দিয়ে অথবা সিগারেটের ধোঁয়ায় পুড়িয়ে মারাই ছিল ছারপোকা থেকে রক্ষার একমাত্র উপায়। আর ইঁদুর থেকে রক্ষার জন্য পরিখার ভেতর সৈনিকরা কুকুর ও বিড়াল পালন শুরু করে। দেখামাত্র ইঁদুর মেরে ফেলবার প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো এদের। বেশ কাজেও দিয়েছিল এ পদ্ধতি।
শরীর এবং পরিধেয় পোশাক পরিচ্ছন্ন রাখা
যেহেতু পরিখার কর্দমাক্ত মাটির কারণে পায়ের খুব বাজে অবস্থা তৈরি হয়ে যেতো এবং পায়ে ময়লা জমে থাকলে তা শরীরে রক্ত চলাচলে বাধা প্রদান করে, তাই সৈনিকরা বিশেষভাবে পায়ের যত্নআত্তি করতো। নিয়ম করে প্রতিদিন পা পরিষ্কার করে শুকনো মোজা পরতো তারা। যাদের প্রথম সারির পরিখায় দায়িত্ব থাকতো না, তারা পেছনে গিয়ে নিজেদের পোশাক বদলে সেটি ধুয়ে পরিষ্কার করতো। সেই সাথে তারা সুযোগ পেতো গরম পানিতে গোসল করার। তাদের শরীরকে জীবাণুমুক্ত রাখার জন্য এটি ছিল অত্যন্ত জরুরী। সেই সাথে নিয়মিত দাড়ি কামানোও ছিল পরিচ্ছন্নতার একটি অংশ।
টয়লেট ব্যবহার করা এবং আবর্জনা পরিষ্কার করা
যুদ্ধের সময় পরিখার পরিবেশের ভয়াবহতার কথা চিন্তা করে, থাকার জায়গা থেকে যত বেশি সম্ভব দূরে সরিয়ে রেখে নির্মাণ করা হয়েছিল টয়লেটগুলোকে। এতে থাকার জায়গার পরিবেশ কিছুটা হলেও পরিচ্ছন্ন রাখা সম্ভব হতো। সেই সাথে একজন ‘স্যানিটারি ম্যান’ থাকতেন, যার কাজ ছিল নিয়মিত সব ধরনের জমা হওয়া আবর্জনা সরিয়ে তা যথাস্থানে ফেলে আসা। এ ধরনের পন্থা তখনকার সময়ে সৈনিকরা অবলম্বন করতেন যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের এবং থাকার পরিবেশ পরিষ্কার রাখতে।
ফলে এমনটা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, প্রয়োজনের তাগিদেই বর্তমান সময়ের যোদ্ধাদের চেয়ে সেই আমলের যোদ্ধারা নিজেদের পরিচ্ছন্নতার পিছে বেশিই সময় ব্যয় করতেন।