৯ মার্চ, ১৯৫১; গ্রেপ্তার হন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ র্যাংকের অফিসার, মেজর জেনারেল আকবর খান। তার সাথে আরো গ্রেপ্তার হন ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার এম এ লতিফ খান, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা এবং পাকিস্তান টাইমসের সম্পাদক ফাইয়াজ আহমেদ ফাইয়াজ এবং জেনারেল আকবরের স্ত্রী বেগম নাসিম। একে একে গ্রেপ্তার হন আরো ১৫ জন, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তনের। গ্রেপ্তার ১৭ জনের মধ্যে ১৩ জন ছিলেন সামরিক বাহিনীর অফিসার, জেনারেল আকবরের স্ত্রীসহ চারজন ছিলেন সিভিলিয়ান। একই বছরের জুলাইয়ে শুরু হয় রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলার বিচারকাজ, দুজন রাজসাক্ষীর বদৌলতে যেখানে সাজা হয় সকল অভিযুক্তের।
রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলার প্লট
রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলার প্রেক্ষাপট অনুসন্ধানে পাঠকদের শুরুতেই যেতে হবে প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে। কাশ্মীরকে অধিভুক্ত করা নিয়ে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আর অস্থিতিশীলতা সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয় অঞ্চলটিকে, কাশ্মীরকে নিজেদের সাথে সংযুক্ত করতে যুদ্ধে জড়ায় সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তানের পক্ষে নিয়মিত আর অনিয়মিত সকল বাহিনীর নেতৃত্ব দেন কর্নেল আকবর খান। যুদ্ধে অপর্যাপ্ত সামরিক সরঞ্জামের সরবরাহ আর রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতায় কর্নেল আকবর খান সেই সময়েই লিয়াকত আলী খানের নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। কাশ্মীরে ভারতের সাথে চুক্তির বিরুদ্ধে ছিলেন কর্নেল আকবর, তার মত ছিল ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে কাশ্মীরে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে। কাশ্মীরের অভিজ্ঞতা জেনারেল আকবরকে সিভিলিয়ান সরকারের ব্যাপারে হতাশ করে তোলে, পাশাপাশি প্রত্যয়ী করে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের ব্যাপারে।
কর্নেল আকবর খান বছর দুয়েকের মধ্যেই মেজর জেনারেল হিসেবে প্রমোশন পান, যুক্তরাজ্য থেকে ট্রেনিং করে এসে দায়িত্ব নেন পাকিস্তান সামরিক বাহিনী চিফ অব জেনারেল স্টাফ হিসেবে। জেনারেল আকবরের হাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর এ সময় সৈন্যদের কমান্ড ছিল না, জেনারেল হেডকোয়ার্টারে অফিসবন্দি হয়েই থাকতেন জেনারেল আকবর। জেনারেল আকবরের উচ্চাশার ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন কমান্ডার ইন চিন জেনারেল আইয়ুব খান। কিন্তু, জেনারেল আইয়ুব চাচ্ছিলেন জেনারেল আকবরকে চোখের সামনে রাখতে, সেজন্যই তাকে পদায়ন করেছিলেন চিফ অব জেনারেল স্টাফ হিসেবে।
চিফ অব জেনারেল স্টাফের হাতে ট্রুপস কমান্ড না থাকলেও, এটি ক্ষমতার কেন্দ্রের একটি পদ। ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকে জেনারেল আকবর সুযোগ পাচ্ছিলেন সামরিক বাহিনীর সর্বস্তরের অফিসারদের সাথে যোগাযোগ করার, পাশাপাশি নিজের পছন্দের একটি বলয় তৈরি করার। সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাকে সামনে রেখে জেনারেল আকবর একটি আলাদা বলয় তৈরির চেষ্টা করছিলেন, প্রচুর সময় ব্যয় করছিলেন আন-অফিসিয়াল আলোচনাতে। সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান এই ব্যাপারে সচেতন ছিলেন, ছিলেন কিছুটা বিরক্তও। একবার তিনি বলেছিলেন, চিফ অব জেনারেল স্টাফ হিসেবে আকবর খান যথেষ্ট সময় দিচ্ছেন না, সামরিক বাহিনী পাচ্ছে না জেনারেল আকবরের সার্ভিস।
জেনারেল আকবরের অভ্যুত্থান চেষ্টার আরেকটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে সেনাপ্রধান হিসেবে তার নিয়োগ না পাওয়া। জেনারেল আইয়ুব খানকে যখন সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, তখন অন্তত দুজন সিনিয়র সামরিক অফিসারকে ডিঙানো হয়, যার একজন ছিলেন জেনারেল আকবর। জেনারেল আকবর সামরিক বাহিনীতে কমিশনড হন ১৯২০ সালে, জেনারেল আইয়ুব খান কমিশনড হন ১৯২৮ সালে। নমিনেশন লিস্টে জেনারেল আইয়ুবের নাম না থাকলেও, ডিফেন্স সেক্রেটারি ইস্কান্দার মির্জার আনুকূল্যে সেনাপ্রধান হন আইয়ুব খান। অবশ্য, এই দুজন অফিসারের কেউই এত দ্রুত সেনাবাহিনীর ক্ষমতার শীর্ষে আসার পথটাও অনেকটা ভাগ্যের সহায়তা। ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন সিনিয়র দুই সামরিক অফিসার, মেজর জেনারেল ইফতিখার খান ও বিগ্রেডিয়ার শের খান। বিমান দুর্ঘটনায় এদের মৃত্যু না হলে, জেনারেল আকবর এত দ্রুত শীর্ষ পদে আসতে পারতেন না, করতে পারতেন না অভ্যুত্থান চেষ্টা।
রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলা: অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা
জেনারেল আকবর খানের দীর্ঘদিনে পরিকল্পনা ছিল সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে লিয়াকত আলী খানের সরকার উৎখাতের, সরকারের কাঠামোতে শৃঙ্খলা আর নৈতিকতা আনার। অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাকে সামনে রেখে জেনারেল আকবর সম্ভাব্য সহযোগী অফিসারদের একটি তালিকা তৈরি করেছিলেন, ছিল সৈন্য মোতায়েন আর শীর্ষ নেতৃত্বের গ্রেপ্তার করার পরিকল্পনাও।
জেনারেল আকবর অভ্যুত্থানের রূপরেখা ঠিক করতে ১১ জন সামরিক অফিসার আর ৪ জন বেসামরিক নাগরিককে নিয়ে আলোচনায় বসেন ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫১ সালে। আলোচনার স্থান ছিল জেনারেল আকবরের বাসা, আলোচনা দীর্ঘস্থায়ী হয় আট ঘন্টা। ফাইয়াজ আহমেদ ফাইয়াজ আর দুই কমিউনিস্ট পার্টির নেতার উপস্থিতি নিয়ে অস্বস্তি ছিল সামরিক বাহিনীর অফিসারদের মধ্যে, অস্বস্তি ছিল আলোচনায় জেনারেল আকবরের স্ত্রীর উপস্থিতি নিয়েও।
জেনারেল আকবরই প্রথমে সবাইকে ব্রিফ করেন অভ্যুত্থানের বিস্তারিত পরিকল্পনার ব্যাপারে। অভ্যুত্থান পরিকল্পনার মধ্যে ছিল, লিয়াকত আলী খানকে পেশোয়ার থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসা, গ্রেপ্তারের পরে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা এবং নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা করা। এর সাথে ছিল সৈন্য মোতায়েন সহ সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলা বজায় রাখা নিয়েও আলোচনা হয়। ১৯৫১ সালের ফেব্রুয়ারিতে হওয়া সেই মিটিংয়ে উপস্থিত ছিল ক্যাপ্টেন জাফরউল্লাহ পশনি, রাউয়ালপিন্ডিতে যার পোস্টিং ছিল সিগন্যাল কোরে। সম্প্রতি পাকিস্তানের বহুল পরিচিত সংবাদপত্র ডনে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ক্যাপ্টেন জাফরউল্লাহ পশনি সেদিনের কথা বর্ণনা করেছেন এভাবে,
আজ ষাট বছর পরেও আমি সেদিনের উত্তেজনা অনুভব করতে পারি, জেনারেল আকবরের প্রস্তাব শোনার পরে সবার উৎকণ্ঠা অনুভব করতে পারি। চিফ অব জেনারেল স্টাফ জেনারেল আকবর সেদিন সে পরিকল্পনা আমাদের সামনের উপস্থাপনা করেছিলেন, সেটির জন্য আমাদের কেউই প্রস্তুত ছিলাম না কেবল জেনারেল নিজে ছাড়া। উপস্থিত সবারই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সন্দেহ ছিল, জিজ্ঞাসা ছিল অভ্যুত্থানের পরে পূর্ব পাকিস্তানে কী হবে, পশ্চিমে অভ্যুত্থান সফল হলেও। আমার মনে পড়ে, ফাইয়াজ আহমেদ ফাইয়াজ খুব বেশি কথা বলছিলেন না, বরং তিনি সামরিক বাহিনীর অফিসারদের আলোচনা শোনার ব্যাপারেই বেশি মনোযোগী ছিলেন। আলোচনা আট ঘন্টা স্থায়ী হয়, আলোচনার পরে জেনারেল আকবর খানের প্রস্তাব গৃহীত হয়নি। পরবর্তী কোনো আলোচনার তারিখ নির্ধারণ না করেই আলোচনা শেষ হয়। কৌশলগতভাবে, সেখানে কোনো ষড়যন্ত্রই হয়নি, কারণ সেখানে কোনো চুক্তি হয়নি অভ্যুত্থানের ব্যাপারে।
রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলা: যেভাবে ফাঁস হলো
রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে দুই রাজসাক্ষীর মুখ্য ভূমিকা থাকলেও রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র ফাঁস হয় এক পুলিশ অফিসারের মাধ্যমে। পেশোয়ারে কর্মরত সেই পুলিশ অফিসারের নাম আসকার আলী শাহ, জেনারেল আকবরের সাথে যার সম্পর্ক গড়ে ওঠে কাশ্মীরে, পরবর্তীতে বিভিন্ন মিশনের দায়িত্ব তাকে দেন জেনারেল আকবর। পেশোয়ারের সিআইডিতে থাকার সময়ে আসকার আলী শাহ নিয়মিতই আসতেন জেনারেল আকবরের বাসায়, ছিলেন জেনারেল আকবরের বিশ্বস্ত তথ্যসূত্র। চূড়ান্ত আলোচনার দুদিন আগে জেনারেল আকবর আসকর আলী শাহকে রাউয়ালপিন্ডিতে ডেকে পাঠান, বিস্তারিত বলেন মার্চের শুরুতে পেশোয়ারে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে গ্রেপ্তারের পরিকল্পনার ব্যাপারে।
আসকর আলী শাহ পরিকল্পনাটি দ্রুতই তার সিনিয়রদের জানান, সিআইডির বিস্তারিত রিপোর্ট যায় প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের কাছে। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান তলব করেন সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান আর প্রতিরক্ষা সচিব মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জাকে। শুরু হয় ইনফর্মাল তদন্ত।
রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলা: অভিযুক্তদের বিচার
অনানুষ্ঠানিক তদন্ত শেষে মার্চের ৯ তারিখ গ্রেপ্তার করা হয় মেজর জেনারেল আকবর খানকে, তার সাথে গ্রেপ্তার হন ব্রিগেডিয়ার এম এ লতিফ খান। কয়েক দিনের মধ্যেই বাকি অভিযুক্তদেরও গ্রেপ্তার করা হয়। জেনারেল আকবরকে গ্রেপ্তার করেন মেজর জেনারেল হাইয়্যুদ দিন। ৭ম ডিভিশনের এই জিওসি দীর্ঘদিনের বন্ধু ছিলেন জেনারেল আকবরের।
অভিযুক্তদের বন্দি করা হয় হায়দারবাদ জেলে, জুনে বিচার শুরু হয় স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্টের মাধ্যমে। অভিযুক্তদের মধ্যে দুজন রাজসাক্ষী হয়ে যান, তারা সাক্ষী দেন ফেব্রুয়ারিতে জেনারেল আকবরের বাসায় অভ্যুত্থান পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চুক্তি হয়েছিল। চুক্তি না হলে আইনের দৃষ্টিতে সেটি কোনো অভ্যুত্থান চেষ্টা হতো না। দুজন রাজসাক্ষীর বয়ানে এগিয়ে চলে বিচার কাজ, রায় ঘোষিত হয় ১৯৫৩ সালের। জেনারেল আকবর খানকে দেওয়া হয় ১২ বছরের জেল, বাকিদের দেওয়া হয় ৪-৭ বছরের জেল। তবে, কারোরই পূর্ণ মেয়াদের সাজা খাটতে হয়নি, ১৯৫৫ সালে ছাড়া পান সকলেই।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সামরিক অভ্যুত্থান
জেনারেল আকবরের অভ্যুত্থ্যান চেষ্টা সফল হয়নি। তার বাড়ি থেকে উদ্ধার করা নথি থেকে দেখা যায়, তিনি অভ্যুত্থানের পরে কাকে কাকে হত্যা করবেন আর কাকে কাকে সার্ভিস থেকে অবসরে পাঠাবেন, তার বিস্তারিত তালিকা তৈরি করে রেখেছিলেন। ফলে, রাওয়ালপিন্ডিতে জেনারেল আকবরের পরিকল্পনা সফল হলেও, সেটি হতো অত্যন্ত রক্তক্ষয়ী এক অভ্যুত্থান।
জেনারেল আকবরের অভ্যুত্থান পরিকল্পনা সফল না হলেও, সামরিক বাহিনীর আরো অনেক অভ্যুত্থান চেষ্টা বেসামরিক সরকার মোকাবেলা করতে পারেনি। ১৯৫৮ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতাকে কাজে লাগিয়ে প্রথমে ক্ষমতায় আসেন মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা, তিন সপ্তাহের মাথায় ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল আইয়ুব খান। আইয়ুব খানকে সরিয়ে ১৯৬৯ সালে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। এরপরও, পাকিস্তান আরো দুটি সফল সামরিক অভ্যুত্থান দেখেছে, জুলফিকার আলী ভুট্টোকে সরিয়ে ক্ষমতার দখল নেন জেনারেল জিয়াউল হক। জেনারেল জিয়াউল হকই পাকিস্তানের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী সামরিক শাসক, পাকিস্তানকে শাসন করেন ১১ বছরের বেশি সময়। সর্বশেষ সামরিক শাসক হিসেবে ক্ষমতা দখলের ঘটনা ঘটিয়েছেন জেনারেল আসিফ আলী জারদারি।
গত দেড় দশক ধরে পাকিস্তানে হয়তো সামরিক শাসক নেই, কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতিতে এখনও সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান সামরিক বাহিনী। রাজনীতিতে শেষ কথাও সামরিক বাহিনীই বলে। পাকিস্তানে কোনো গণতান্ত্রিক সরকারই তাদের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি।