মানবজাতির ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনাই ঘটেছে, যেসব না জানলে হয়তো আমাদের ক্ষতি নেই। তবে জানলেও যে সেসব ঘটনা মস্তিষ্কের খুব বেশি জায়গা দখল করে নেবে তা কখনোই নয়। বরং নিখাদ আনন্দ লাভের উদ্দেশ্যে সেসব ঘটনা পড়ে গেলে তা যেমন হালকা হাসির খোরাক হতে পারে, তেমনই বন্ধুমহলে সুযোগ বুঝে জানিয়ে দিলে সেসব ঘটনা অন্য সকলের নির্মল আনন্দ লাভের উৎসও হতে পারে। আবার বলা যায় না, এ ধরনের টুকটাক ঘটনা জেনে এর সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের সম্পর্কে বিশদ অনুসন্ধান আপনার সামনে খুলে দিতে পারে জ্ঞানের আরও অনেক দুয়ারই!
ইবনে সিনার গরু জবাই
ইবনে সিনার নাম শোনেনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আসেন, এই পলিম্যাথেরই এক মজার কাহিনি শোনানো যাক।
একবার পারস্যের এক রাজপুত্র মানসিকভাবে বেশ অবসাদগ্রস্ততায় ভুগতে লাগল। খাওয়া-দাওয়া বলতে গেলে ছেড়েই দিল সে। সারাদিন কল্পনার এক জগতেই বাস করত। সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো, সে মনে করত যে সে আসলে মানুষ না, বরং একটা ‘গরু’। তাই তো মাঝে মাঝেই মানুষ হয়েও গরুর অনুকরণে “হাম্বা হাম্বা” ডাক ছাড়ত আর চিৎকার করে বলত, “আমাকে জবাই করে ফেল, তাহলে আমার মাংস দিয়ে খুব মজার খাবার রান্না করতে পারবা!“
শুরুতে অনেক চিকিৎসকই চেষ্টা করেছিলেন রাজপুত্রের বিচিত্র এই মানসিক রোগ সারাবার। কিন্তু সকলেই ব্যর্থ হলেন। ওদিকে বেচারা রাজপুত্র দিন দিন না খেয়ে স্বাস্থ্য আরও খারাপ করতে লাগল।
একসময় ইবনে সিনার কানেও গেল এই খবর। তিনি রাজপুত্রকে খবর পাঠালেন যে তার ডাক কসাইয়ের কাছে পৌঁছেছে, তিনি আসছেন! এই জবাব পেয়ে রাজপুত্রও খুশি। যাক, এতদিনে মানুষের খাবার হবার পথ তো খুলছে!
যথাসময়ে গরু জবাইয়ের জিনিসপাতি নিয়ে হাজির হলেন ইবনে সিনা। এসেই হাঁক দিলেন, “গরুটা কোথায়?” আনন্দিত রাজপুত্রও “হাম্বা হাম্বা” স্বরে নিজের অস্তিত্বের জানান দিল। ইবনে সিনার নির্দেশমতো সে জবাই হবার জন্য শুয়ে পড়ল। ছুরি নিয়ে গলা কাটার ভঙ্গি করে কাছে এসে তাকে ঠিকমতো পরীক্ষা করে হুট করে ইবনে সিনা বলে উঠলেন,
এহ্হে, গরুটা তো বেশ রোগা আর শুকনা লাগছে! একে এখন কোনোভাবেই জবাই করা যাবে না। আগে একে ঠিকমতো খাইয়েদাইয়ে মোটাতাজা করো তোমরা। এরপর আমি এটাকে নিশ্চয়ই জবাই করব!
কসাইয়ের কাছ থেকে এমন আশ্বাসবাণী আর নির্দেশনা পেয়ে রাজপুত্র খাওয়াদাওয়া শুরু করে দিল। ইবনে সিনার পরামর্শে কর্মচারীরা রাজপুত্রকে পুষ্টিকর খাবারের পাশাপাশি বিভিন্ন রকম ওষুধও খাওয়াতে থাকল, যেটা তার হারানো স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে সাহায্য করবে। ওদিকে ইবনে সিনা মাঝে মাঝেই তাকে এসে বলতেন, “খাও, ঠিকমতো খাও! এসব খেলেই গরুরা দ্রুত মোটা হয়ে যায়।“
এভাবে ইবনে সিনার বিচিত্র চিকিৎসাপদ্ধতিতে নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার আর ওষুধ খেয়ে রাজপুত্রের শারীরিক ও মানসিক উভয় স্বাস্থ্যই পুনরুদ্ধার সম্ভব হলো। ভ্রান্তির জগত থেকে ফিরে এসে নিজের সত্যিকার অস্তিত্ব অনুধাবন করল সে। আর ইবনে সিনার নামডাক আরও একবার চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: পলিম্যাথ বলতে সেসকল মানুষকেই বোঝানো হয়, জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যাদের রয়েছে সদর্প পদচারণা।
আব্রাহাম ডি ময়ভারের মৃত্যুরহস্য
ফরাসি গণিতবিদ আব্রাহাম ডি ময়ভারের মৃত্যুর কাহিনী জানেন কি? বিখ্যাত এই গণিতবিদের মৃত্যুর ঘটনা কিন্তু বেশ রহস্যজনক।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে ডি ময়ভারের শারীরিক দুর্বলতা বৃদ্ধি পেতে থাকে, ফলে তার ঘুমের মাত্রাও বাড়তে থাকে। একদিন তিনি হিসেব করে দেখলেন, প্রতি রাতেই তার ঘুমের পরিমাণ ১৫ মিনিট করে বাড়ছে। এ থেকে কী হিসাব করে যেন তিনি ঘোষণা করলেন, যেদিন এই সময়টা গিয়ে ২৪ ঘণ্টায় ঠেকবে, অর্থাৎ যেদিন তিনি সর্বমোট ২৪ ঘণ্টা ঘুমোবেন, ওটাই হবে তার শেষ ঘুম, চিরবিদায়ের ঘুম।
ডি ময়ভারের এই গাণিতিক ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী তার মৃত্যু হবার কথা ছিল ১৭৫৪ সালের ২৭ নভেম্বর। এবং অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সত্যি সত্যি সেদিনই তিনি মারা যান!
বিশেষ দ্রষ্টব্য: ইন্টারনেটে আপনি ‘abraham de moivre death’ লিখে সার্চ করলে এই ঘটনার কথাই বারবার পাবেন সত্য, তবে এর সত্যতা সন্দেহের উর্ধ্বে না। এ কথা সত্য যে জীবনের শেষ দিনগুলোতে শারীরিক দুর্বলতাজনিত কারণে ডি ময়ভারের ঘুম মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গিয়েছিল, তবে এই যে একেবারে গাণিতিক হিসেব করে মৃত্যুর দিন-ক্ষণ ঠিক করে দেয়া, এটা বেশ বিতর্কিত এক দাবি। এমনকি ডি ময়ভারের কাছাকাছি সময়ে যারা তাঁর জীবনী রচনা করেছিলেন, তারাও এই বিচিত্র ঘটনার কথা উল্লেখ করেননি। ফলে ময়ভারের ‘গাণিতিক মৃত্যু’র এই কাহিনী রহস্যাবৃতই রয়ে গেল।
স্বামী-স্ত্রীর বিচিত্র রেসলিং
মধ্যযুগীয় জার্মানিতে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ঝামেলা বাধলে সেটা আইনগতভাবেই মারামারি করে সমাধানের উপায় ছিল! এ জন্য অবশ্য কিছু নিয়ম-কানুন ছিল। যেমন- প্রকৃতিগতভাবেই পুরুষেরা নারীদের থেকে বেশি শক্তিশালী। তাই এমন অবস্থায় মারামারিতে ছেড়ে দিলে স্বামীদের জেতার সম্ভাবনাই যে অনেক বেড়ে যাবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এই সমস্যা দূরীকরণে স্বামীকে একটি গর্তে আবদ্ধ রাখার পাশাপাশি তার একটি হাতও পেছনের দিকে বেধে রাখা হতো। ফলে তাকে লড়তে হতো একহাতে, একস্থানে থেকেই। ওদিকে স্ত্রী থাকতো মুক্ত। দুজনের হাতেই দেয়া হতো দুটো মুগুর। ফাইটিং বিগিন্স!
অবশ্য এই লড়াইয়ে জয়-পরাজয় কীভাবে নির্ধারিত হত তা পরিষ্কার না। লড়াই কি আমৃত্যু চলতো নাকি একপক্ষ পরাজয় স্বীকারের আগপর্যন্ত চলতো- এমন নিয়মের ব্যাপারে জানা যায়নি।
ডায়োজিনিসের মূত্রবিসর্জন
আজ থেকে প্রায় ২,৪০০ বছর আগে গ্রীসে বাস করতেন এক দার্শনিক, নাম তার ডায়োজিনিস।
একবার এথেন্সের অভিজাত পরিবারগুলোর জন্য আয়োজিত এক ভোজোৎসবে ডায়োজিনিসও দাওয়াত পান। সেখানে যাবার পর আমন্ত্রিত অতিথিদের মাঝে কয়েকজন মজা করে তাকে কুকুরের সাথে তুলনা করেন এবং তার দিকে নিজেদের খাওয়া হাড্ডিগুলোও ছুঁড়ে দেন।
ডায়োজিনিসও দমে যাবার পাত্র নন। তিনি চুপচাপ তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন। এরপর কুকুর যেভাবে পা উঁচু করে প্রস্রাব করে, তিনিও ঠিক একইভাবে পা উঁচু করে তাদের গায়ে প্রস্রাব করে তবেই সেখান থেকে সরে আসেন!