![](https://assets.roar.media/assets/6udow2Px6qEt9dob_143526-gadgets-feature-military-technologies-that-changed-civilian-life-image1-8payukbpgo.jpg?w=1200)
সামরিক আবিষ্কার মানেই ধ্বংসযজ্ঞের হাতিয়ার – আমাদের অনেকের কাছে এমনটা মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন সামরিক বাহিনী যুগে যুগে এমন সব হাতিয়ার আবিষ্কার করেছে, যেগুলো দিয়ে চালানো সম্ভব নারকীয় সব তাণ্ডব। কালাশনিকভ থেকে লিটল বয় – সবধরনের সামরিক আবিষ্কারই ধ্বংসের কাজটি খুব সুচারুরূপে সম্পন্ন করে। অন্যদিকে এসব আবিষ্কার বা প্রযুক্তি দিয়ে বেসামরিক লোকজনের তেমন কোনো উপকার হয় না, বেসামরিক জীবনে এগুলোর কোনো সরাসরি উপযোগিতাই নেই।
কিন্তু সামরিক বাহিনী যে শুধু ধ্বংসের প্রতীক সমরাস্ত্র তৈরি করে, তা-ই নয়, বরং বিভিন্ন সময়ে তাদের বিভিন্ন আবিষ্কার মানবসভ্যতার উন্নয়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকাও রেখেছে। এসব আবিষ্কার সামরিকক্ষেত্রে ব্যবহারের কথা থাকলেও, আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নিজেদের জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে এসব আবিষ্কার ব্যবহার করে চলছি, এগুলোর সুফল ভোগ করছি। এমন কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয়, নিত্যব্যবহৃত সামরিক আবিষ্কারের কথাই জেনে নেওয়া যাক আজ।
![](https://assets.roar.media/assets/zd6SFyB6WHq22uAi_car-gps-2019-2x1-lowres5593.jpg)
গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম
গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বা জিপিএস এখন আমাদের নিত্যব্যবহার্য একটি প্রযুক্তি। হাতের স্মার্টফোনটি থেকে শুরু করে একটা আস্ত উড়োজাহাজ, সব জায়গায় রয়েছে জিপিএস এর অবাধ বিচরণ। স্যাটেলাইটের সাহায্যে কোনো স্থানের নির্ভুল অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ বের করার জন্য জিপিএস প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
এই জিপিএসের মূল আবিষ্কারক হচ্ছে মার্কিন সামরিক বাহিনী। ষাটের দশকে মার্কিন নৌবাহিনী ট্রানজিট স্যাটেলাইট দ্বারা তাদের সৃষ্ট প্রাথমিক জিপিএস ব্যবস্থা পরিচালনা করতো। সোভিয়েত স্পুতনিক স্যাটেলাইটের বিপরীতে এই প্রযুক্তি এনেছিল মার্কিনীরা।
তবে জিপিএসের মূল কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ১৯৬৪ সাল থেকে। সেসময় কক্ষপথে দশটির মতো স্যাটেলাইট আবর্তন করতো। মার্কিন নৌবহর জিপিএস পদ্ধতি ব্যবহার করে সাবমেরিন ও অন্যান্য নৌযানের অবস্থান-সংক্রান্ত তথ্যাদি পাঠাতো। পরবর্তীকালে নিখুঁতভাবে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের কাজে জিপিএসের ব্যবহার শুরু হয়।
১৯৮৩ সালে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান সামরিক প্রযুক্তিকে বেসামরিকভাবে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন করেন। বর্তমানে জিপিএস মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। আকাশ, সমুদ্র বা ভূমি যেকোনো স্থানের নেভিগেশনের ক্ষেত্রে জিপিএস এখন একটি অত্যাবশ্যকীয় প্রযুক্তি। উদ্ধার অভিযানের ক্ষেত্রে জিপিএস বিজ্ঞানের আশীর্বাদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
ডাক্ট টেপ
১৯৪৩ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে উত্তাল সারাবিশ্ব। সেসময় ভেস্টা স্টুট নামক জনৈক মার্কিন ভদ্রমহিলা প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের কাছে একটি চিঠি লিখলেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, তার দুই ছেলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। যুদ্ধে তাদের গোলাবারুদের বাক্সগুলো সাধারণ পেপার-টেপ দিয়ে মোড়ানোর কারণে ভেঙ্গে যাচ্ছে। এতে করে গোলাবারুদ পানিতে ভিজে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আবার টেপের মুখ ছিঁড়ে যাওয়ার কারণে সৈন্যদেরকে জোরপূর্বক বাক্স খুলতে হচ্ছে, যা তাদের জীবনের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। সেই ভদ্রমহিলা প্রেসিডেন্টকে পরামর্শ দেন আরও শক্ত টেপ ব্যবহার করার জন্য!
![](https://assets.roar.media/assets/2BurrBtGBSvM3GpB_Duct-tape.jpg)
তার কথামতো, অবশেষে জনসন অ্যান্ড জনসন কোম্পানিকে নতুন টেপ বানানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোম্পানিটি পরবর্তীকালে ডাক্ট টেপ বাজারজাত করে। এই নতুন আবিষ্কৃত টেপটি ছিল হালকা অথচ শক্ত, পানিরোধী এবং খুবই আঠালো। পানিরোধী হওয়ার কারণে শুরুর দিকে টেপটি ‘ডাক টেপ’ নামে প্রচলিত ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈনিকেরা তাদের ছোটখাটো নানান মেরামত-কাজও এই টেপ দিয়েই সারতেন। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে টেপটি জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য বাজারে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। গৃহস্থালি কাজে, বিশেষত কোনো বস্তুর ক্ষতিগ্রস্ত অংশ বা ছিদ্র (duct) বন্ধ করার জন্য এই টেপটি যথেষ্ট ব্যবহৃত হয় বলে, এর নামই হয়ে যায় ডাক্ট টেপ।
সুপার-গ্লু
প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা মার্কিন কোম্পানি ইস্টম্যান কোডাক-এর হ্যারি কুভার সর্বপ্রথম সুপার-গ্লু আবিষ্কার করেন। কুভার ছিলেন একজন রসায়নবিদ। প্রাথমিকভাবে তিনি চেয়েছিলেন এমন এক ধরনের পদার্থ তৈরি করতে, যা দিয়ে প্লাস্টিকের স্বচ্ছ গান-সাইট তৈরি করা যাবে। এ লক্ষ্যে তিনি সায়ানোঅ্যাক্রিলেট (cyanoacrylate) আবিষ্কার করেন। কিন্তু সায়ানোঅ্যাক্রিলেট এত বেশি আঠালো ছিল যে, তা দিয়ে গান-সাইট তৈরি করা সম্ভব হয়নি।
এ ঘটনার নয় বছর পর সায়ানোঅ্যাক্রিলেট পুনরায় দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয়। কোরীয় যুদ্ধের সময় কুভার, ককপিটের ওপরে জেট ক্যানোপি নামক তাপ-প্রতিরোধী আচ্ছাদন তৈরির করার চেষ্টা করছিলেন। তিনি খেয়াল করলেন, তার একসময়ের আবিষ্কার দিয়ে ক্যানোপির প্রিজমগুলো খুব শক্তভাবে লাগানো যাচ্ছে।
![](https://assets.roar.media/assets/hfm4pSFUtHLf0sF4_super_glue_x1.jpg)
পরবর্তীকালে এই সুপার-গ্লু যুদ্ধক্ষেত্রে মার্কিন বাহিনীর সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে অনেকদিন। কথিত আছে, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় সৈন্যরা ক্ষতস্থান অস্থায়ীভাবে বন্ধ করার জন্য সুপার-গ্লু ব্যবহার করেছিলেন।
১৯৫৮ সাল থেকে সুপার-গ্লু নাম দিয়ে সায়ানোঅ্যাক্রিলেটের বাণিজ্যিক বাজারজাতকরণ শুরু হয়।
মাইক্রোওয়েভ আভেন
মাইক্রোওয়েভ আভেন এখন আমাদের রান্নার কাজকে সহজ করে দিলেও এর আবিষ্কার হয়েছিল আকস্মিকভাবে। রাডার থেকে মাইক্রোওয়েভ আভেন- শুনতে অবিশ্বাস্য হলেও এমনটাই ঘটেছিল আভেন আবিষ্কারের বেলায়! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাডার যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল, তেমনিভাবে আভেনও এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
১৯৪৫ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী পার্সি স্পেন্সার একটি রাডার স্টেশনে কাজ করার সময় টের পান, রাডার ট্রান্সমিশনের ফলে যে পরিমাণ তাপ উৎপন্ন হচ্ছে, তার পরিমাণ নেহায়েত কম নয়। এই তাপ এত বেশি ছিল যে, তার পকেটে থাকা একটি চকলেট বার গলে যায়। এটা দেখে স্পেন্সার পরে আরও কিছু খাবার নিয়ে পরীক্ষা চালান। পপকর্ন ও ডিম নিয়ে পরীক্ষা করে সফল হওয়ার পর স্পেন্সার প্রথমবারের মতো একটি আভেনের মডেল তৈরি করেন।
স্পেন্সার তখন রেথিয়ন কোম্পানি-এর সাথে জড়িত ছিলেন। স্পেন্সারের সুবাদেই রেথিয়ন কোম্পানি মার্কিন সামরিক বাহিনীতে রাডার নিয়ে কাজ করার সুযোগ পায়। সেই বছরের অক্টোবর মাসে রেথিয়ন কোম্পানি সর্বপ্রথম মাইক্রোওয়েভ আভেনের পেটেন্টের জন্য আবেদন করে। এভাবেই রাডার স্টেশন থেকে উদ্ভূত হয় অধুনা মাইক্রোওয়েভ আভে
![](https://assets.roar.media/assets/NIAUtDbefWEL2VOt_1024px-Microwave_oven.jpg)
প্রাথমিকভাবে আবিষ্কৃত আভেনকে রাডারেঞ্জ বলা হতো। রাডারেঞ্জের আকৃতি প্রায় রেফ্রিজারেটরের মতো ছিল। ছয় ফুট লম্বা ও সাড়ে সাতশ পাউন্ডের মতো ভারী এই যন্ত্রটির দাম ধরা হয়েছিল পাঁচ হাজার ডলার, যা ছিল সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। ১৯৬৭ সালে আজকের মাইক্রোওয়েভ আভেন প্রথমবারের মতো সর্বস্তরের জনসাধারণের ব্যবহারযোগ্য হয়ে ওঠে।
জেট ইঞ্জিন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ই আকাশযুদ্ধের সূচনা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধবিমানের ভূমিকা আরও বেড়ে গিয়েছিল। এ সময়ই ফাইটার ও বম্বার জেটগুলো ভবিষ্যতের যুদ্ধে যুদ্ধবিমানের গুরুত্ব বুঝিয়ে দিয়েছিল। যুদ্ধের সময় দু’পক্ষের প্রকৌশলীরাই আরও শক্তিশালী ও দ্রুতগামী প্লেন তৈরির প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন। ১৯৪৩ সালে জার্মানি ও ব্রিটেন জেট ফাইটার-কে প্রথমবারের মতো যুদ্ধের ময়দানে পরিচয় করিয়ে দেয়। তাদের তৈরি প্রথম জেট ইঞ্জিনযুক্ত যুদ্ধবিমানের নাম ছিল ম্যাসারশমিত মি ২৬২ (Messerschmitt Me 262)।
![](https://assets.roar.media/assets/8gnBVQ7hq7qiAFOc_Me-262-High-Angle-LR.jpg)
এই জেট ইঞ্জিন বর্তমানে বাণিজ্যিক বিমানগুলোতে অহরহ ব্যবহার করা হয়।
এভিয়েটর সানগ্লাস
সানগ্লাস বা রোদচশমা আমাদের কাছে ফ্যাশনের একটি অনুষঙ্গ বলে বিবেচিত হলেও আসলে এটি আবিষ্কার করা হয়েছিল সামরিক পাইলটদের জন্য।
যথেষ্ট উচ্চতায় সূর্যের আলোর তীব্রতা বেশি হওয়ায় পাইলটদের দৃষ্টিপথ বাধাগ্রস্ত হতো। এই সমস্যা সমাধানে ত্রিশের দশকে রে-ব্যান ব্র্যান্ড এক ধরনের গ্লাস তৈরি করে, যেগুলোর কাচ ছিল গাঢ় সবুজ। তবে এই লেন্সগুলো গতানুগতিক ধারার সানগ্লাসের লেন্সের চেয়ে যথেষ্ট বড় ছিল।
![](https://assets.roar.media/assets/saHld6p1rrc1PJz8_tom-cruise-top-gun-aviators-1.jpg)
এই সানগ্লাস কার্যকর প্রমাণিত হলে এর ব্যবহার বেসামরিক পর্যায়ে বিস্তৃত হয়। শিকার, মাছধরা, হাইকিং ইত্যাদির সাথে জড়িত মানুষেরা সানগ্লাস ব্যবহার শুরু করেন। সানগ্লাসের জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, বর্তমানে যতটা না প্রয়োজনে তা ব্যবহৃত হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যবহৃত হয় কেবলী ফ্যাশনের তাগিদে।
ইন্টারনেট
ইন্টারনেট ছাড়া এখন একটা দিনও কল্পনা করা যায় না। একদিন ইন্টারনেট না থাকলে আমাদের কী অবস্থা হতো ভাবুন তো? রোর বাংলা-ই বা কীভাবে পড়তে পারতেন! আমাদের অন্যতম একটি মৌলিক চাহিদায় পরিণত হওয়া ইন্টারনেটও কিন্তু কোনো বেসামরিক আবিষ্কার নয়। সমরবিদ্যার প্রয়োজনেই ইন্টারনেট-এর আবির্ভাব ঘটেছে এই ধরাধামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তার পর থেকেই আধুনিক প্রোগ্রামেবল কম্পিউটারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। মার্কিন সামরিক বাহিনী তাদের কম্পিউটারগুলোকে একটি নির্দিষ্ট নেটওয়ার্কের আওতায় আনার লক্ষ্যে ইন্টারনেটের ধারণার ওপর কাজ শুরু করে। এই প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ, ১৯৬৯ সালে আর্পানেট (ARPANET) চালু করা হয়।
এরপর থেকে ইন্টারনেটের অগ্রগতি অব্যাহত থাকে। ১৯৮৯ সালে টিম বার্নাস-লি কর্তৃক ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে ইন্টারনেট পরিপূর্ণতা পায়।
![](https://assets.roar.media/assets/lCqht5Mi21KJueul_in-701x394.jpg)
তবে শুধু ইন্টারনেট নয়, কম্পিউটারের ইতিহাসের সাথেও সামরিক বাহিনী কিছুটা জড়িত। যদিও কম্পিউটার আবিষ্কারের জন্য সামরিক বাহিনীকে পুরোপুরি কৃতিত্ব দেওয়া যায় না; তবে প্রথম প্রোগ্রামেবল ইলেকট্রনিক কম্পিউটার এনিয়াক (ENIAC) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সামরিক বাহিনীর জন্য তৈরি করা হয়েছিল।
ওয়ান-টাইম রেজর
আজ থেকে কয়েকশ’ বছর আগেও শেভিং বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ও ঝক্কিমূলক কাজ ছিল। সেই সময়ে মূলত ক্ষুর দিয়ে ক্ষৌরকর্ম সারতে হতো। একটু ভুল হলেই গালের অবস্থা হয়ে যেতো দফারফা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সামরিক বাহিনীতে ডিজপোজেবল রেজরের প্রচলন শুরু হয়। সৈন্যদের জন্য স্ট্যান্ডার্ড ইস্যু করা এই রেজর যুদ্ধের পরও সমানভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরবর্তী সময়ে মহিলারাও এর ব্যবহার শুরু করেন। ফলে এই রেজরের চাহিদা হু হু করে বেড়ে যায়, একইসাথে বিশ্বব্যাপী রেজরের বাজারও প্রসারিত হয়।
কৃত্রিম রাবারের টায়ার
প্রাকৃতিক রাবার তৈরি করা হয় রাবার গাছের কষ থেকে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাবারের চাহিদার সাথে যোগানের বিস্তর ফারাক তৈরি হয়। যুদ্ধের সময় বিপুল পরিমাণ টায়ার সরবরাহে হিমশিম খেতে হয় দেশগুলোকে। ফলে কৃত্রিম রাবারের টায়ার আবিষ্কারের জন্য প্রচুর গবেষণা শুরু হয়। এসময় আমেরিপোল (Ameripol) নামক নতুন ধরনের সিনথেটিক রাবার তৈরি করা হয়, যা দিয়ে মার্কিন সামরিক চাহিদা পূরণ করা হয়। বর্তমানে কৃত্রিম রাবারের ব্যবহার শুধু টায়ার তৈরিতেই সীমাবদ্ধ নেই।
এপিপেন
অ্যালার্জির চিকিৎসায় ব্যবহৃত এপিপেন হচ্ছে একধরনের ইনজেকশন, যার ভেতরে এপিনেফ্রিন নামক রাসায়নিক পদার্থ থাকে। বর্তমানে এপিপেন চিকিৎসাবিদ্যার একটি অপরিহার্য উপাদান হলেও, একসময় শুধু সামরিক বাহিনীর লোকজন এটি ব্যবহার করতো। সৈনিকদের কেমিক্যাল ও নার্ভ এজেন্ট থেকে রক্ষা করতে এপিপেন সামরিক বাহিনীতে ব্যবহৃত হতো।
মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (U. S. Food and Drug Administration: FDA) ১৯৮৭ সালে এপিপেনকে বেসামরিক ব্যবহারের জন্য অনুমতি দিলেও প্রথমদিকে এর ব্যবহার তেমন একটা জনপ্রিয় হয়নি। যদিও বর্তমানে এপিপেন বেসামরিকভাবে বহুল ব্যবহৃত একটি চিকিৎসা সামগ্রী, কিন্তু মার্কিন সামরিক বাহিনীর সদস্যরা এখনো Mark I NAAK মডেলের নার্ভ এজেন্ট এন্টিডোট কিট ব্যবহার করেন।
![](https://assets.roar.media/assets/620FZLom6kW9npqG_epipen.jpg)
টিনজাত খাবার
খাবারকে ক্যানের ভেতরে বায়ুরোধী অবস্থায় রেখে সংরক্ষণ করার প্রক্রিয়াটি বেশ পুরনো- সেই নেপোলিয়নের সময় থেকে টিনজাত খাবার ব্যবহার করা হচ্ছে। নেপোলিয়নের সৈন্যদলের জন্য খাবার সংরক্ষণ করা বেশ দুরূহ ব্যাপার হয়ে উঠছিল। ১৮১০ সালে ফরাসি সরকার এক ঘোষণার মাধ্যমে সস্তায় খাবার সংরক্ষণের কোনো উপায় আবিষ্কারের জন্য পুরস্কার হিসেবে নগদ-নারায়ণের ঘোষণা দেয়।
জনৈক আবিষ্কারক দেখতে পান, খাবারকে বয়ামের ভেতর রান্না করার পর সিল না ভাঙা পর্যন্ত খাবার ভালো থাকে। নেপোলিয়নের দিগ্বিজয়ী সৈন্যরা তখন তাদের খাবার সংরক্ষণের জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহার শুরু করে। এরও অনেক বছর পরে ধাতব কৌটা বা বয়ামে খাবার সংরক্ষণ করা শুরু হয়।
![](https://assets.roar.media/assets/Rsyy1ZPhaQTW7icq_crations-museumdisplay.jpg)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈনিকরা অনেকটা টিনজাত খাবারের ওপর টিকে ছিল। সেই নেপোলিয়নের যুগ পার হয়ে টিনজাত খাবার এখন সুপারমার্কেটের অন্যতম প্রধান পণ্যদ্রব্য হয়ে উঠেছে।
ব্লাড ব্যাংক ও রক্ত পরিবহন পদ্ধতি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ই ব্লাড ব্যাংক ও দ্রুত অথচ সহজ উপায়ে রক্ত পরিবহন পদ্ধতির প্রয়োজন উপলব্ধ হয়েছিল। কানাডিয়ান লেফটেন্যান্ট লরেন্স ব্রুস রবার্টসন সর্বপ্রথম রক্ত পরিবহনের কলাকৌশল আবিষ্কার করেন। তার সাফল্যের হাত ধরেই এই পদ্ধতির প্রয়োগ বৃদ্ধি পায়।
রক্ত দ্রুত তঞ্চিত হওয়ার কারণে প্রথমদিকে রক্তদানের ক্ষেত্রে সরাসরি ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে রক্ত পরিবহন করা হতো। সময়ের সাথে সাথে রক্ত পরিবহন ও সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার উন্নয়ন ঘটলে ব্লাড ব্যাংকের উদ্ভব হয়।
অ্যাম্বুলেন্স
প্রথম অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবহার দেখা গিয়েছিল আজ থেকে প্রায় পাঁচশ বছরেরও বেশি আগে, ১৪৮৭ সালের দিকে। স্প্যানিশ সেনাবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আহতদের স্থানান্তরের জন্য অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবহার করে। অবশ্য এসব অ্যাম্বুলেন্স যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেই রণক্ষেত্রে পাঠানো হতো, ফলে অনেক আহতই নিহতের তালিকায় চলে যেত। পরবর্তী বছরগুলোতে অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করা হয়।
মোটরচালিত গাড়ি আবিষ্কার হওয়ার পর অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে সেগুলোর ব্যবহার শুরু হয়, এবং খুব দ্রুতই অ্যাম্বুলেন্স বেসামরিক জীবনে ত্রাতা হয়ে আবির্ভূত হয়।
![](https://assets.roar.media/assets/N0L6U0dUpo9GJbho_KDMGAR.jpg)
মহাকাশ প্রযুক্তি
মহাকাশ প্রযুক্তির সাথেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নাম জড়িয়ে আছে। সেই সময় নাৎসি বিজ্ঞানীরা লং-রেঞ্জ রকেট তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন। যুদ্ধের পর মার্কিন কর্তৃপক্ষ ভি২ রকেট প্রোগ্রামের সাথে জড়িত নাৎসি বিজ্ঞানীদের যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসে। এই বিজ্ঞানীরাই যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ ও চন্দ্র জয়ে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল।
এভাবে সামরিক পরিধি থেকে ছাড়িয়ে মহাকাশ গবেষণা এখন বেসামরিক ও অনেকক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পরিধিতে ছড়িয়ে পড়েছে। এলন মাস্কের মতো লোকেদের কাছে মহাকাশ ভ্রমণ এখন প্যাশনের বিষয়। স্পেস ট্রাভেল এখন একটি বাণিজ্যিক বিষয় হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।
নাইট-ভিশন
জার্মান সেনাবাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রথম নাইট-ভিশন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করে। ১৯৪০-এর দশকের মাঝামাঝিতে প্যান্থার ট্যাংকে প্রথম নাইট-ভিশন স্কোপ ও রেঞ্জফাইন্ডার সংযুক্ত করা হয়। এর পরে আরেকটি ছোট ও মনুষ্যপরিবাহী নাইট-ভিশন সিস্টেম স্টমগেভিয়া’ ৪৪ তথা এসটিজি ৪৪ (Sturmgewehr 44 aka The StG 44) অ্যাসল্ট রাইফেলে লাগানো হয়।
![](https://assets.roar.media/assets/xSMTBdlESCONJqMW_panther-FG-1250.jpg)
নাইট-ভিশন প্রযুক্তি এখন হরহামেশাই ক্যামেরা, গাড়ি ইত্যাদিতে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ওয়াকিটকি
আরও অনেক কিছুর মতো ওয়াকিটকিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আবিষ্কৃত হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে পদাতিক সৈনিক, গোলন্দাজ ও ট্যাংক ক্রুদের মধ্যে যোগাযোগের প্রাথমিকভাবে ওয়াকিটকি তৈরি করা হয়েছিল।
জিপ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এবড়োখেবড়ো রাস্তায় চলাচলের জন্য জিপ তৈরি করা হয়। এই জিপগুলো মার্কিন বাহিনীর আইকনিক ভেহিকলে পরিণত হয়। সৈন্য ও মালামাল সরবরাহের জন্য জিপ ব্যবহার করা হতো। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জিপের বেসামরিক মডেল তৈরি করা হয়।
জেরিক্যান
১৯৩০ এর দশকে জার্মান সামরিক বাহিনী জেরিক্যানের ব্যবহার শুরু করে। পরবর্তীকালে মার্কিন, ব্রিটিশ ও সোভিয়েত বাহিনীতে জেরিক্যানের প্রচলন ঘটে।