Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

লেডি অব এমপাটো: পাঁচশো বছর আগের এক ইনকা সুন্দরীর গল্প

১৯৯০ সালের ঘটনা, দক্ষিণ পেরুর আন্দিজ পর্বতমালার নেভাডো স্যাবাংক্যায়া আগ্নেয়গিরি হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠলো। উত্তপ্ত লাভা আর ছাই ছড়িয়ে পড়তে লাগলো আশেপাশের অঞ্চলে। ফলে কাছাকাছি পর্বতচূড়া থেকে জমাটবাঁধা তুষার গলে যেতে থাকলো। এদেরই একটির নাম মাউন্ট এমপাটো।

এরও বছর পাঁচেক পরের কথা, ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নৃতত্ত্ববিদ জোহান রেইনহার্ড এবং তার সঙ্গী মিগুয়েল জেরাটে মাউন্ট এমপাটোতে চড়লেন। তাদের লক্ষ্য সক্রিয় আগ্নেয়গিরিটাকে স্বচক্ষে অবলোকন করা। বরফে ঢাকা পর্বতে তারা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ চূড়ার দিকে। এমন সময়ে সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ছয় হাজার ফুট উচুতে তারা অদ্ভুত কিছু দেখতে পেলেন। বরফের ভেতরে কয়েকটি উজ্জ্বল পাখির পালক তাদের দৃষ্টিগোচর হলো।

নৃতত্ত্ববিদ রেইনহার্ড থমকে দাঁড়ালেন। কারণ সেগুলো আর পাঁচটি সাধারণ পাখির পালক ছিলো না। সেগুলো ছিলো প্রাচীন ইনকাদের আনুষ্ঠানিক উৎসবের সময় মাথায় পরা মুকুটের অংশ। এই মুকুট তৈরি করা হতো বিশেষ পাখির পালক আর একধরনের ঝিনুকের খোলস থেকে। শীঘ্রই তারা আরো অবশিষ্টাংশ খুঁজে পেলেন। তারা আশেপাশে আরো অনুসন্ধান করলেন। অল্প সময়ের মধ্যে তারা একটি পাথরের কাঠামোর সামনে উপস্থিত হলেন।

মাউন্ট এমপাটো; Source: carrier.com

প্রফেসর রেইনহার্ড বুঝতে পারলেন, তারা প্রাচীন কোনো ইনকা মন্দির বা অনুষ্ঠান ক্ষেত্র খুঁজে পেয়েছেন। বহু বছর ধরে যা চাঁপা পড়ে ছিলো তুষার স্তরের নিচে, আগ্নেয়গিরির উত্তাপে বরফ গলে তা উন্মুক্ত হয়েছে তাদের সামনে। প্রফেসর রেইনহার্ড আরো কিছু নমুনা পাওয়ার সম্ভাবনা অনুমান করতে পারলেন। তারা আরো ব্যাপকভাবে খোঁজ করতেই পাহাড়ের একটি খাঁজে জমাটবদ্ধ একটি কাপড়ের বান্ডিলের সন্ধান পেলেন।

জেরাটে ত্বরিত নেমে গেলেন কাপড়ের বান্ডিল উদ্ধার করতে। কাছে যেতেই চিৎকার করে উঠলেন পর্বতারোহী জেরাটে! কারণ ততক্ষণে কাপড়ের বান্ডিলের ভেতরে থাকা একটি মৃতদেহ তার নজরে এসেছে। শীঘ্রই মৃতদেহটিকে উদ্ধার করা হলো। মেয়েটির গায়ের পোষাক পরিচ্ছদ দেখে তাদের ভ্রু কুচকে গেলো। আলপাকার লোম দিয়ে তৈরি বহুমূল্য পোষাকে সজ্জিত মৃতদেহটিকে পর্যবেক্ষণ করতেই প্রফেসর রেইনহার্ড বুঝতে পারলেন, এক ইনকা কিশোরীর দেহের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। অনেকদিন আগেই মারা গিয়েছে সে। কিন্তু কতদিন আগে?

প্রফেসর অনুমান করতে ব্যর্থ হলেন।

প্রিয় পাঠক, আপনি একটু চেষ্টা করে দেখবেন নাকি? অনুমান করুন তো, কতদিনের হতে পারে সেই দেহ- পাঁচ? দশ? পঞ্চাশ? আপনি যে অনুমানই করুন না কেন, মনে হয় না তাতে বিশেষ লাভ হবে! কারণ মেয়েটি মারা গিয়েছিলো আজ থেকে কমপক্ষে পাঁচশ বছর পুর্বে; ১৪৪০-৮০ সালের মধ্যে কোনো এক সময়ে।

শুধু ঐ একটি মৃতদেহ নয়, সেই সাথে আরো দুটি মৃতদেহ আবিষ্কৃত হলো। তিনটি দেহই অদ্ভুতভাবে সংরক্ষিত হয়ে মমিতে রুপান্তরিত হয়েছে! মৃতদেহের সাথেই পাওয়া গেলো হরেক রকম জিনিসের সমাহার। মাথায় দেওয়ার বিশেষ ধরনের কাপড়ের মুকুট, যাতে রয়েছে পাখির পালকের কারুকার্য। এছাড়া পাওয়া গেলো মাটির তৈজসপত্র আর অনেক মূর্তি। কিসের তৈরি সেগুলো জানেন? নিখাদ সোনার! আছে রুপা আর কাপড়ের তৈরি মূর্তিও। তারা বুঝতে পারলেন, এভাবে উন্মুক্ত আবহাওয়ায় ফেলে রাখলে মৃতদেহগুলো সূর্যালোক এবং আগ্নেয়গিরির ছাইয়ে নষ্ট হয়ে যাবে। আশেপাশে থাকা মূল্যবান সামগ্রীও চুরি হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া নৃতাত্ত্বিক হিসেবে এমন আকর্ষণীয় ব্যাপার আর হতে পারে না! তাই প্রত্নবস্তু সমেত মৃতদেহগুলোকে তারা পর্বতশিখর থেকে নামিয়ে নিয়ে এলেন। সেগুলোকে তারা পেরুর এরেকুইপাতে অবস্থিত ‘দ্য ক্যাথোলিক ইউনিভার্সিটি অব সান্তা মারিয়া’তে শীতল রুমে রেখে দিলেন। প্রথম মৃতদেহকে নাম দেওয়া হয় ‘দি ইনকা লেডি’। মাউন্ট এমপাটোতে পাওয়া যায় বলে একে ‘দি লেডি অব এমপাটো’ কিংবা স্প্যানিশে ‘মমি হুয়ানিতা’ও বলা হয়।

মৃত্যুর পাঁচ শতাধিক বছর পর মানুষের সামনে এলো ‘লেডি হুয়ানিতা’; source: aracari.com

১৯৯৬ সালে মমিগুলোকে আমেরিকায় আনা হয়। সেখানে ইনকা লেডির উপর বিস্তারিত গবেষণা চালানো হয়। বিভিন্ন ধরনের ফরেনসিক পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো হলো। অটোপসি বা ময়নাতদন্তের ফলে যাতে মমিটি ক্ষতিগ্রস্থ না হয়, তাই কম্পিউটেড টমোগ্রাফি বা সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে গবেষকেরা জানার চেষ্টা করেন, কী রহস্য লুকিয়ে আছে এই ইনকা লেডির মধ্যে?

কী জানা গেলো এই গবেষণায়? কে ছিলো এই ইনকা লেডি? কেনই বা এমন মৃত্যু হয়েছিলো তার? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আমাদের ঘুরে আসতে হবে ইনকা সমাজ থেকে। ইনকা দেবতাদের উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হয়েছিলো তাদের। এদের মধ্যে প্রথমে আবিষ্কৃত মেয়েটি বা ইনকা লেডির বয়স ছিলো বারো থেকে চোদ্দ। বাকি দুজনের একজন ছিলো ছিলো ছেলে, আরেকজন মেয়ে। এদের বয়স ছিলো পাঁচ আর ছয়। তবে তেরো বয়সী বালিকার দেহ অনেক অভিজাতভাবে সাজানো, অন্যদিকে বাকি দুজন ছিলো তার তুলনায় বেশ সাদামাটা। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সে ছিলো ‘স্যাক্রেড লেডি’ কিংবা ‘পবিত্র নারী’। আর বাকি দুজন ছিলো তার সেবক কিংবা সহচর।

কিন্তু কে এই স্যাক্রেড লেডি? কেনই বা তাদের উৎসর্গ করা হয়েছিলো? কী ছিলো তাদের অভিপ্রায়? এর উত্তর জানতে হলে আরেকটু গভীরে যেতে হবে।

যখন ইনকা সম্রাজ্য শাসন করতো দক্ষিণ আমেরিকা, তখনকার সময়ের কথা! অদ্ভুত ছিলো তাদের রীতিনীতি আর আচার আচরণ।এর মধ্যে সবচেয়ে অদ্ভুত ছিলো কাপাকোচা উৎসব। কাপাকোচা উৎসব অন্য আর পাঁচটা উৎসব থেকে আলাদা। এর জন্য চাই জীবন্ত মানুষ। তাদের যোগাড় করার ব্যবস্থাও ছিলো সারা সম্রাজ্যে বিস্তৃত।

তখন হয়তো ইনকা সম্রাজ্যের কোন এক অঞ্চলে একটি পাহাড়ের উপত্যকায় থাকতো মেয়েটি। বাবা কৃষক। জমিতে আলু আর নানা রকম ফসল ফলায়। সেগুলোই তাদের খাদ্য। মেয়েটিও মাঝে মাঝে বাবার কাছে ছুটে যায়। কতই বা হবে বয়স? বড়জোর দশ বা এগারো। নারীসুলভ বৈশিষ্ট্য তখনও প্রকাশ পেতে শুরু করেনি তার দেহে। তবু একটি লাবণ্য ভর করেছে সারা অঙ্গে। এমন সময়ে গ্রামের পুরোহিতের চোখে পড়লো মেয়েটি। গোপনে গোপনে সে খবর পাঠালো রাজ পুরোহিতকে। প্রভু, দেবতার অর্ঘ্য পাওয়া গেছে।

কয়েকদিন পরে হঠাৎ এক রাত্রে রাজার সৈন্য নিয়ে রাজপুরোহিত এসে হাজির হলো মেয়েটির বাড়ির দরজায়। গম্ভীর মুখে জানালো, তাদের মেয়েকে দেবতার সেবায় উৎসর্গ করা হবে। মেয়েটিকে নিতে এসেছে সে। সেদিনই মেয়েটিকে শেষবার দেখেছিলো তার মা। আর কোনোদিন তার দর্শন পায়নি।

কাপাকোচা অনুষ্ঠান; Source: ancientincanhistory.blogspot.com

ঠিক এভাবেই, দেবতার চরণে বলী দেওয়ার জন্য বেছে নেওয়া হতো একজন কিশোর কিংবা কিশোরী। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বালিকাদের বেছে নেওয়া হতো; অধিক সফলতার আশায়। বালিকা হলে তার কুমারী হওয়া বাধ্যতামূলক ছিলো। প্রথমেই তাদেরকে মা-বাবার কাছ থেকে আলাদা করে ফেলা হতো। তারপর তাদের বিশেষ পর্যবেক্ষণে রাখা হতো। যে পরিবার থেকে কাউকে বেছে নেওয়া হতো, সেই পরিবারকে অনেক সম্মানের চোখে দেখা হতো। আর মেয়েটি রীতিমত দেবীর মর্যাদা পেতো। তবে তা খুব দীর্ঘ সময়ের জন্য নয়। কারণ শীঘ্রই তাকে দেবতার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। অর্থাৎ দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হতো।

এই গোটা উৎসবটাই কাপাকোচা। এখানে দেবতার উদ্দেশ্যে দান করা হতো কিশোর বাচ্চা কিংবা কুমারী নারীকে। শুধুমাত্র বড় বড় ঘটনা উদযাপন করতেই কাপাকোচা পালন করা হতো। এর মধ্যে ছিলো সম্রাটের সিংহাসনে আরোহণ, যুদ্ধ জয় কিংবা নতুন রাজপুত্রের জন্মদান। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে বাঁচার জন্যও তারা কাপাকোচা উৎসবের আয়োজন করতো।

বাছাইকৃত ছেলে বা মেয়েকে শারীরিকভাবে খুবই নিখুঁত হতে হতো। এমনকি গায়ে কোনো তিল কিংবা আঁচড়ের দাগ থাকতে পারতো না। যতক্ষণ না চূড়ান্ত সময় আসতো ততক্ষণ তার সাথে রাজকীয় ব্যবহার করা হতো। তাকে প্রথমেই একজন পুরোহিতের তত্ত্বাবধানে রাখা হতো। সবথেকে মূল্যবান পোষাক নির্ধারিত থাকতো তার জন্য। তার চুলগুলো সুগন্ধী জলে ধুয়ে সুন্দর করে বিনুনি করা হতো। আর স্বয়ং রাজা যে খাবার খেতো, সেই খাবারই সে পেতো। তারপর চূড়ান্ত উৎসবের মাসকয়েক আগে থেকে তাকে প্রচুর অ্যালকোহল আর নেশাজাতীয় দ্রব্য খাওয়ানো হতো। এদের মধ্যে ছিলো কোকো পাতা, যা থেকে তৈরি হয় কোকেইন।

আমাদের শরীরে থেকে বিষাক্ত পদার্থ প্রধানত বের হয়ে যায় মলমূত্রের মাধ্যমে। সেই সাথে কিছু পরিমাণ নিঃসৃত হয় ঘামের মাধ্যমে। চুল এবং নখেও জমা হয় কিছু পরিমাণ। উদাহরণস্বরুপ বলতে গেলে, ধীরে ধীরে আর্সেনিক আক্রান্ত মানুষের চুল বিশ্লেষণ করে তাতে আর্সেনিক পাওয়া যায়।

বিজ্ঞানীরা মমি তিনটির দেহ থেকে প্রাপ্ত চুল বিশ্লেষণ করেন। তাতে দেখা যায়, মৃত্যুর প্রায় একুশ মাস আগে থেকে ইনকা লেডির খাদ্যে কোকেনের পরিমাণ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর ছয় মাস আগে সে সবচেয়ে বেশি কোকা খাবার হিসেবে গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে অ্যালকোহলের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি ছিলো মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ পূর্বে। কোকেইন ক্ষুধা কমিয়ে ফেলতে সাহায্য করে, রক্তনালীকে সংকুচিত করে। ফলে দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। প্রশ্বাসের বেগ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি হ্যালুসিনেশন গ্রাস করে নেয় ঐ ব্যক্তিকে। ফলে তার স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি লোপ পেতো। নিজের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা থাকতো না

ইউ-আই-ইয়াকো পর্বত থেকে উদ্ধার করা আরো ‘কাপাকোচা’ উৎসবের শিকার হতভাগ্যরা; sourec: buenavibra.es

আস্তে আস্তে সময় ঘনিয়ে আসতো। ওদিকে মদ এবং নেশা বস্তুর পরিমাণও বাড়তো। ফলে সারাক্ষণ নেশাগ্রস্থ হয়ে থাকতো তারা। উৎসবের দিন সবাই মিলে নাচ, গান, হৈ-হুল্লোড় করতে করতে মেয়েটিকে নিয়ে চলতো বহু দূরের এক পবিত্র পাহাড় চূড়ায়। সেখানে সমস্ত দিন নানা পর্ব পালন করে দিনের শেষে ফিরে আসতো তারা। কিন্তু মেয়েটিকে রেখে আসতো পাহাড় চূড়ায় একটি ছোট্ট কুঠিরে। তার মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করার জন্য মাথায় ভারি কিছু দিয়ে আঘাতও করতো।  দ্য মেইডেন লেডি অব ইনকা কিংবা ইনকা কুমারী ছিলো এমনই এক হতভাগা!

প্রকৃতির এক বিচিত্র খেয়ালে তার দেহ মৃত্যুর সাথে সাথে চাপা পড়ে গিয়েছিলো বরফের তলায়। কিংবা কে জানে? হয়তো জীবন্ত সমাধিই হয়েছিলো তার। কিন্তু সে যা-ই হোক, ইনকা কুমারী আবার আমাদের মাঝে ফিরে এলো ১৯৯৯ সালে। অথচ ততদিনে পৃথিবীতে কেটে গেছে পাঁচশ বছর। যে সম্রাট নিজ সমৃদ্ধির আশায় নিষ্ঠুর দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দিয়েছিলো একটি নিষ্পাপ প্রাণ, সে-ও হারিয়ে গেছে মহাকালের গর্ভে।

ফিচার ইমেজ- wordpress.com

Related Articles