মার্চ, ১৯৬৯; পাকিস্তানের ইতিহাস থেকে আইয়ুব খান অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে। সেই বছর ডিসেম্বরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে ওসমান গণির জায়গায় নিয়োগ পান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। এরপর, ১৯৭০ সালে আব্দুর রাজ্জাক অক্সফোর্ড থেকে দেশে ফেরেন। পাকিস্তান শিপিং কর্পোরেশনের একটি মালবাহী জাহাজে চেপে দেশে আসেন তিনি। সঙ্গে ছিল ১৫-১৬টি চায়ের বাক্স। তবে, তাতে চা ছিল না, ছিল বই!
এক বছরের বিভুই জীবন শেষে তিনি ফিরে আসেন প্রাণের শহর ঢাকায়। দেশ ছাড়ার পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় তখন তার কোনো চাকরি ছিল না। অন্যদিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে তার তুল্য একজন শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন বিভাগের প্রধান ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরী। ১৯৭০ সালের ৮ এপ্রিল তিনি উপাচার্য বরাবর একটি চিঠি লেখেন। যার মর্ম ছিল এই, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সিনিয়র লেকচারার আব্দুর রাজ্জাক ১৯৬৮ সালে অনিবার্য কারণবশত বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দেন। তিনি প্রবাস জীবন শেষে আবার ঢাকায় ফিরে এসেছেন। বিভাগে সিনিয়র লেকচারার পদের বিপরীতে একটি শূন্যপদ থাকায় অনতিবিলম্বে তাকে পুনরায় নিয়োগদান করা হোক।”
উপাচার্য আবু সাইদ মুজাফফর আহমেদ চৌধুরীর এই আবেদনের প্রেক্ষিতে আব্দুর রাজ্জাককে পুনরায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে যোগদানের অনুমোদন প্রদান করেন। অনুমোদন পাওয়ার পর আব্দুর রাজ্জাক ১৯৭০ সালের ১৪ এপ্রিল তার পূর্বের পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের আবেদন করেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার আবেদন বিবেচনায় ১৯৬৮ সালের ৮ এপ্রিল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তাকে বিনা বেতনের ছুটি প্রদান করে। ৯ এপ্রিল ১৯৭০ সাল থেকে তাকে পুনরায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে নিয়োগ কার্যকর দেখানো হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আব্দুর রাজ্জাকের এই অধ্যায়ের এক ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। কারণ, এসময় তিনি থাকতেন জগন্নাথ হলের বিপরীতের শিক্ষক কোয়ার্টারের একটি ফ্ল্যাটে। আর ঠিক এই সময়েই তার ফ্ল্যাট হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী নেতাদের আলোচনার এক বিশ্বস্ত জায়গা। আব্দুর রাজ্জাক বরাবরই ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের একজন বড় পৃষ্ঠপোষক। এ সময় ড. কামাল হোসেনসহ আব্দুর রাজ্জাকের কয়েকজন স্নেহভাজন বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন। তারা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহার তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। শিক্ষক হিসেবে আব্দুর রাজ্জাক সবসময় তাদের নৈতিক সমর্থন ও আশা জুগিয়েছেন।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালোরাতে আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন শিক্ষক কোয়ার্টারের সেই ফ্ল্যাটেই। অপারেশন সার্চলাইটের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের অংশ হিসেবে পাকিস্তানি সেনারা হানা দেয় এই বাড়িতেও। এই কোয়ার্টারেই থাকতেন ইংরেজি বিভাগের প্রখ্যাত অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। পাকিস্তানি সেনারা তাকে হত্যা করে। এছাড়াও পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মনিরুজ্জামান ও অর্থনীতির অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকেও হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী।
তারা যখন আব্দুর রাজ্জাকের দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে তখন আব্দুর রাজ্জাক ধীরপায়ে দরজার দিকে এগোচ্ছিলেন। ফলে দরজার সামনে দাড়িয়ে থাকা সেনারা ভাবে যে এই ফ্ল্যাটে হয়তো কেউ নেই। কিছুকাল পরে তারা সেখান থেকে চলে যায়। আব্দুর রাজ্জাক দরজা খুলে কাউকে দেখতে পাননি। কিন্তু, ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি হতবাক হয়ে যান। কাকতালীয়ভাবে বেঁচে গেলেও সেই রাতে প্রত্যক্ষ মৃত্যুর দর্শন পান আব্দুর রাজ্জাক। নীচতলায় দেখতে পান জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার লাশ। কালরাতের এই ভয়াবহ দৃশ্যের বিভীষিকার পরদিনই আব্দুর রাজ্জাক পরিবারসহ কলাতিয়ায় চলে যান। যুদ্ধের নয় মাস তিনি সেখানেই অবস্থান করেন। এর মধ্যে, যুদ্ধ চলাকালীন তাজউদ্দীন আহমেদ তার সাথে যোগাযোগ করেন এবং ভারতে নিরাপদ আশ্রয়ের কথা বলেন। কিন্তু, আব্দুর রাজ্জাক নিজ ভূমি ছেড়ে যেতে রাজি হননি।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আব্দুর রাজ্জাককে বেশ সাবধানে থাকতে হয়েছিল। কারণ, যুদ্ধ চলাকালীন সামরিক শাসকের নির্দেশ অমান্য করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে যোগদান না করায় তাকে বরখাস্ত করা হয়। পরবর্তীতে সামরিক আদালতে তার অনুপস্থিতিতেই তাকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ সময় আব্দুর রাজ্জাককে ছদ্মবেশ ধারণ করতে হয়। তিনি দাড়ি রাখেন এবং লুঙ্গি, গামছা দিয়ে টোকা বানিয়ে পরতেন। এর ফলে তার চেহারায় আসে আমূল পরিবর্তন। এ সম্পর্কে আহমদ ছফা লিখেছেন, “তার থুতনিতে একগোছা দাড়ি এই সময়ের মধ্যে গজিয়ে গেছে। এই নতুন জন্মানো দাড়ির গোছাটি মুখের আদল সম্পূর্ন বদলে দিয়েছে। পাঞ্জাবি-পাজামার পরিবর্তে তিনি যদি কলারহীন লম্বা শার্ট এবং প্যান্ট পরতেন, অবিকল ভিয়েতনামের হো চি মিন বলে চালিয়ে দেওয়া যেত।” মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে, অন্যসব শিক্ষকের মত তিনিও পুনরায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৩৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়া আব্দুর রাজ্জাকের ছাত্ররাও অনেকে অধ্যাপক হয়ে গিয়েছিলেন। তাদের কেউ কেউ আবার উপাচার্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু, লেকচারার হিসেবে যোগ দেওয়া আব্দুর রাজ্জাক থেকে গেছেন সে পদেই। কারণ, নিজেকে কখনই পদোন্নতির যোগ্য বিবেচনা করতেন না তিনি। ফলে, কখনো পদোন্নতির জন্য আবেদনও করেননি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বিভাগীয় প্রধান মুজাফফর আহমদ চৌধুরী রেজিস্ট্রার বরাবর আবেদন করেছিলেন আব্দুর রাজ্জাককে প্রফেসর পদে নিয়োগ করার জন্য। আব্দুর রাজ্জাক তখনও সেটি জানতেন না। তার গোচরে আসার পর আব্দুর রাজ্জাক নিজেই সেই প্রস্তাবে অস্বীকৃতি জানান। ফলে, তাকে আর প্রফেসর পদে নিয়োগ দেওয়া যায়নি। তবে, দেশ স্বাধীনের পর নতুন বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী সিনিয়র লেকচারার থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে উন্নীত হন তিনি।
১৯৭২ সালে প্রবীণ শিক্ষক হিসেবে আব্দুর রাজ্জাককে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। অন্য সময় হলে হয়তো আব্দুর রাজ্জাক সেই প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিতেন। কিন্তু, নতুন দেশে নিজের মতাদর্শে কাজ করতে পারবেন এই আশায় তিনি বিভাগীয় প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দায়িত্ব নেন। দায়িত্ব পাওয়ার পরেই তিনি বিভাগের জন্য ইতিবাচক ও গঠনমূলক কিছু সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৪৬ সালে দর্শন বিভাগে যোগ দেওয়া ফজলুল করিম কমিউনিস্ট পার্টির আদেশে ১৯৪৮ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি সরদার ফজলুল করিমকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ফিরিয়ে আনেন। ষাটের দশকে আইয়ুব খানের পুলিশি রিপোর্টে চাকরি হারানো বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরকেও তিনি পুনরায় বিভাগে আনেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকেও আনতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু, আনিসুজ্জামান অপারগতা জানানোয় সেটি আর সম্ভব হয়নি। বিভাগীয় দায়িত্বের মাঝেই ১৯৭২ সালের ২৯ জুলাই তিনি বাংলাদেশের শিক্ষা কমিশনের সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হন। এরপর ১৯৭৩ সালে আব্দুর রাজ্জাক একবার ভারত সফর করেন। উদ্দেশ্য ছিল দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডি লিট উপাধি গ্রহণ।
১৯৭৪ সালে আব্দুর রাজ্জাকের বয়স ৬০ বছর পূর্ণ হয়। এ বছরের ৩০ জুন আব্দুর রাজ্জাক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তার অবসরের পর তারই স্নেহধন্য ড. রওনক জাহান রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দায়িত্ব পান। দায়িত্ব পেয়েই অধ্যাপক রওনক জাহান আব্দুর রাজ্জাকের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখপূর্বক উপাচার্য বরাবর তার চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু, উপাচার্য তাতে সম্মতি না দিয়ে ড. রওনক জাহানকে জানান যে, অনেকেই তাকে আব্দুর রাজ্জাকের হাত থেকে মুক্তি পেতে পরামর্শ দিয়েছেন।
উপাচার্যের কথায় ক্রুদ্ধ ড. জাহান এ ঘটনা আব্দুর রাজ্জাককে জানালে আব্দুর রাজ্জাক হাসেন এবং রাগান্বিত হতে বারণ করেন। কিছুদিন পর উপাচার্য পুনরায় ড. রওনক জাহানকে ডেকে পাঠান এবং জানান যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সকালে তাকে ফোন করে আব্দুর রাজ্জাকের চাকরির মেয়াদ বর্ধিত করতে বলেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে তিনি পুনরায় যোগদান করতে পারেন। ঘটনার পেছনের গল্প ছিল এই, আব্দুর রাজ্জাকের ঘটনা কোনোভাবে তাজউদ্দীন আহমেদের কানে গিয়েছিল। তিনি বঙ্গবন্ধুকে এ বিষয়ে অবহিত করার পর বঙ্গবন্ধু নিজেই ফোনে উপাচার্যকে এই আদেশ দেন। এ ঘটনার কিছুদিন বাদে তাজউদ্দীন আহমেদ আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন, “আপনি মারা গেলেও কি আমরা কোনো খবর পাবো না?“
পূর্বেই বলা হয়েছে, আব্দুর রাজ্জাক লেকচারার হিসেবেই তার সিংহভাগ শিক্ষকজীবন অতিবাহিত করেছেন। নতুন আইনে তাকে সহকারী অধ্যাপক করা হলেও তিনি কখনোই পূর্ণ অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান নি। ১৯৭৫ সালের ১৩ মার্চ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মহান এই শিক্ষকের কর্মজীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ আব্দুর রাজ্জাককে জাতীয় অধ্যাপক পদে নিয়োগ প্রদান করে। ১৯৮০ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৮৫ সালে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে তার মেয়াদ শেষ হয়।
প্রাচীন গ্রিসের গুরুদের মতোই সংসার উপেক্ষা করে তিনি চালিয়ে গেছেন নিঃস্বার্থ জ্ঞানচর্চা। এই নিরলস জ্ঞানচর্চাই হয়তো তার চরিত্রে দৃঢ় গুণাবলীর সন্নিবেশ ঘটিয়েছিল। পঞ্চাশ থেকে আশির দশক পর্যন্ত এমন কোনো বড় চিন্তাবিদ এদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি আব্দুর রাজ্জাকের স্নেহদৃষ্টি পাননি। তবে, আব্দুর রাজ্জাক নিজে সবসময় থেকে গেছেন পাদপ্রদীপের আড়ালে। আড্ডা-বক্তৃতায় ব্যাপক স্বচ্ছন্দ্য হলেও, লেখার প্রতি তার ছিল ভয়ানক অনীহা। নিজে প্রায় কিছুই লিখে যাননি তিনি। কিন্তু, তার জ্ঞান, দর্শন, ভাবাদর্শ ছড়িয়ে দিয়েছেন শিষ্যদের মাঝে। সেই সাথে আব্দুর রাজ্জাক নিজে পরিণত হয়েছেন এক কিংবদন্তিতে। যার নাম শুনলে জানার আগ্রহ বাড়ে, কিছুটা জানলে আরো জানতে ইচ্ছে করে! আব্দুর রাজ্জাকের চরিত্রের এটাও একটা জাদু।
চল্লিশের দশক থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কথা ছড়িয়ে পড়েছিল, “আব্দুর রাজ্জাকের মতো এত বড় পন্ডিত এদেশে আর দ্বিতীয়টি জন্মায়নি।” শুধু কিতাবি জ্ঞানের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি তিনি। কোনো বিষয়ে মৌলিক চিন্তা করার অসামান্য ক্ষমতা ছিল আব্দুর রাজ্জাকের। নিজ জাতির ইতিহাস নিয়ে তার ছিল সূক্ষ্ম বিচার-বিবেচনা। এসব কারণে তার ঝুলিতে অসংখ্য প্রশংসার পাশাপাশি দুয়েকটি নিন্দাও যে জোটেনি এমন নয়। কিন্তু, একটা বিষয়ে আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন একেবারে আলাদা। নিজ দেশ ও জাতি সম্পর্কে সুউচ্চ গর্ববোধ ছিল তার। এ সম্পর্কে আহমদ ছফার একটি কথা দিয়ে শেষ করতে চাই,
প্রফেসর রাজ্জাকের চরিত্রের প্রণিধানযোগ্য যে বৈশিষ্ট্যটি আমি সব সময় সশ্রদ্ধ বিস্ময়ে লক্ষ্য করে আসছি, সেটি হলো তার নিজের দেশ ও সমাজের প্রতি নিঃশর্ত অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকারবোধই প্রফেসর রাজ্জাককে অন্য সকলের থেকে আলাদা করেছে।