অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তাদের অভিনয় ও রূপের যাদুতে বিমোহিত করে রাখেন আমাদের, ভাসিয়ে নিয়ে যান ফ্যান্টাসির জগতে। পর্দায় তাদের ঝলমলে উপস্থিতি আমাদের ভুলিয়ে দেয় তাদেরও একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে, আছে একান্ত নিজস্ব সুখ-দুঃখের অনুভূতি। এমনকি কখনো কখনো তাদের বিষাদময় জীবনের গল্প ছাড়িয়ে যায় ট্র্যাজিক সিনেমার কাহিনীকেও। এমনই এক জীবনের গল্প মধুবালার।
ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে সেরা সুন্দরী হিসেবে তাকে এক বাক্যে মেনে নেয় সবাই। শুধু অসামান্য রূপই নয়, অভিনয় প্রতিভার জোরে পঞ্চাশের দশকে নার্গিস, মীনা কুমারীদের ছাপিয়ে হিন্দি সিনেমায় নিজের সুদৃঢ় অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৪৮- ১৯৬০ সাল পর্যন্ত স্বল্প সময়ের ক্যারিয়ারে তিনি আরোহণ করেন যশ ও খ্যাতির শীর্ষে। কিন্তু এড়াতে পারেননি নিষ্ঠুর নিয়তিকে। সত্য হয়েছিল সে দরবেশের কথাই যিনি খুব ছোটবেলায় তাঁকে দেখে বলেছিলেন “এ মেয়ে অনেক খ্যাতি লাভ করবে, কিন্তু সুখী হতে পারবে না”।
১৯৩৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি দিল্লির এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মধুবালা। তার পারিবারিক নাম ছিল মমতাজ জাহান দেহলভী। বাবা আতাউল্লা খান পেশোয়ারের ইয়ুসুফজায়ি গোত্রের পাঠান। মধুবালার শৈশবে তার পরিবারকে অনেক কঠিন সময় পার করতে হয়েছিল।
তার বাবা পেশোয়ারের একটি তামাক কোম্পানিতে চাকরি হারানোর পর তারা ভাগ্যের সন্ধানে পাড়ি জমান বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই)। তার পরিবার আরও অসহায়ত্বের মাঝে পড়ে যখন পাঁচ-ছয় বছর বয়সেই তার পাঁচ ভাই-বোন মারা যায়। এরপর ১৯৪৪ সালের ১৪ই এপ্রিল মুম্বাই ডকে বিস্ফোরণের ঘটনায় হারিয়ে যায় তাদের ছোট্ট ঘরটিও। পরিবারের এমন দুর্দশার মধ্যে একমাত্র আশার আলো ছিলেন মমতাজ জাহান।
মাত্র নয় বছর বয়সে তিনি তখন শিশু শিল্পী হিসেবে অভিনয়ের ডাক পেয়েছিলেন বোম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। শিশুশিল্পী হিসেবে তার অভিনয় দেখেই তার মধ্যে জাত অভিনেত্রীর ছাপ খুঁজে পেয়েছিলেন অনেক ছবি নির্মাতা। অভিনয় জীবনে প্রবেশের কিছুদিন পর অভিনেত্রী দেবিকা রানী চৌধুরী তার অপরূপ রূপ ও প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তার নাম দেন মধুবালা। পরবর্তীতে এ নামেই পর্দায় হাজির হন তিনি আর নামটি জায়গা করে নেয় লাখো-কোটি দর্শকের হৃদয়-পটে।
মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে ‘নীল কমল’ (১৯৪৭) সিনেমায় প্রধান অভিনেত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। রাজ কাপুরের বিপরীতে অভিনয় করা এ সিনেমাই সর্বশেষ সিনেমা যেখানে তিনি ‘মধুবালা’ নয় ‘মমতাজ’ নামে পর্দায় হাজির হয়েছিলেন। এরপর ‘মধুবালা’র বড় পর্দায় আগমন আর পরবর্তী দু’বছরের গল্প শুধু এগিয়ে চলার, তার রূপের জাদুতে রূপোলী পর্দাকে মোহাবিষ্ট করার।
এরপর ১৯৪৯ সালের ‘মহল’ সিনেমার মাধ্যমে বলা যায় রাতারাতিই তিনি মহাতারকা বনে যান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ অবলম্বনে নির্মিত ‘মহল’ সিনেমাটির বিপুল সাফল্য তার ক্যারিয়ারে অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট হয়ে উঠে। এরপর মধুবালার জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়তেই থাকে। একে একে মুক্তি পায় ‘দুলারি’(১৯৪৯), ‘বেকসুর’(১৯৫০), ‘তারানা’(১৯৫১), ‘বাদল’(১৯৫১) সহ অন্যান্য ছবি। সবক’টি সিনেমাই ছিল বাণিজ্যিকভাবে সফল। মধুবালার তারকা-খ্যাতি ভারত পেরিয়ে সাড়া ফেলে হলিউডেও।
১৯৫২ সালের অামেরিকান ম্যাগাজিন ‘থিয়েটার আর্টস’ এ তাকে নিয়ে “The Biggest Star in the World – and she’s not in Beverly Hills” শিরোনামে একটি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়। এছাড়া একাডেমী এ্যাওয়ার্ড বিজয়ী আমেরিকান পরিচালক ফ্রাঙ্ক ক্যাপরা তাকে অভিনয়ও করতে চেয়েছিলেন হলিউডে। কিন্তু তার বাবা রাজি না হওয়ায় সে আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেন তিনি।
এ সময় ক্যারিয়ারের পাশাপাশি জোয়ার আসে মধুবালার ব্যক্তিগত জীবনেও। ‘তারানা’ ছবিতে তিনি অভিনয় করেন দিলীপ কুমারের বিপরীতে। এ ছবির সেটেই তারা একে অপরের প্রেমে পড়েন। শুটিং চলাকালীন একদিন মধুবালা তার হেয়ার ড্রেসারকে একটি লাল গোলাপ ও উর্দুতে লেখা চিরকুটসহ দিলীপ কুমারের কাছে পাঠান এবং তাকে ভালবাসলে ফুলটি গ্রহণ করতে বলেন। দিলীপ কুমার মুগ্ধ হয়ে ফুলটি গ্রহণ করেন। অনিন্দ্য সুন্দরী মধুবালার প্রেমপ্রার্থীর সংখ্যা কম ছিল না। আর তিনি এটি বেশ উপভোগও করতেন। কিন্তু সত্যিকারভাবে ভালবেসেছিলেন দিলীপ কুমারকেই। দিলীপ কুমারও ভালবেসেছিলেন মধুবালাকে। তারা একসাথে গাঁটছড়া বাঁধারও পরিকল্পনা করেছিলেন।
কিন্তু বাঁধা হয়ে দাঁড়ান মধুবালার বাবা আতাউল্লা খান। তিনি প্রথমে তাদের বিয়েতে রাজি ছিলেন। কিন্তু তিনি পুরো বিষয়টিকে দেখছিলেন ‘একটি বিজনেস ডিল’ হিসেবে। আতাউল্লা খান ততদিনে একটি প্রোডাকশন হাউসের মালিক। তার পরিকল্পনা ছিল দিলীপ কুমার ও মধুবালার বিয়ের পর তারা শুধুমাত্র তার প্রোডাকশনের সিনেমাতেই অভিনয় করবেন। কিন্তু আতাউল্লা খানের এ ধরনের অর্থলোভী আচরণ দিলীপ কুমারের পছন্দ হয়নি। তিনি সরাসরি জানিয়ে দেন সিনেমা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তিনি নিজস্ব পদ্ধতির বাহিরে যাবেন না, এমনকি তার নিজের প্রোডাকশন হাউস হলেও তিনি এ ধরণের সিদ্ধান্ত নিতেন না। এর ফলে আতাউল্লা খান ক্ষুব্ধ হন এবং মধুবালার সাথে দিলীপ কুমারের সম্পর্কের বিরোধিতা করতে শুরু করেন। পিতৃভক্ত মধুবালা পড়েন বিপাকে। একদিকে তার ভালবাসা অন্যদিকে পরিবার।
এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অঘটনটি ঘটে যায় ‘নয়া দৌড়’ সিনেমা নিয়ে। দিলীপ কুমারের বিপরীতে এ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন মধুবালা আর এর জন্য অগ্রিম টাকাও নেন তার বাবা। পনের দিন শুটিং এর পর সিদ্ধান্ত হয় পুরো শুটিং ইউনিট ভূপাল যাবে শুটিং এর জন্য। কিন্তু বেঁকে বসেন আতাউল্লাহ খান। তিনি মধুবালাকে ভূপাল যেতে অনুমতি দেননি। তিনি বলেন, দিলীপ কুমারের সাথে মধুবালার প্রেম করতে সুযোগ করে দেয়ার জন্যই এ বাহানা। আর পিতার বাধ্য মেয়ে মধুও মেনে নেন সেটি।
এদিকে বিপাকে পড়েন প্রযোজক ও পরিচালক বি আর শর্মা। শেষে মধুবালার পরিবর্তে বৈজয়ন্তীমালাকে অভিনয় করান তিনি। মধুবালার বাবার কাছে অগ্রিম টাকা ফেরত চাইলে তিনি তা দিতে অস্বীকার করেন। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত আদালত অবধি গড়ায়। আর এর অভিনেতা হিসেবে এ মামলার সাক্ষ্য দেন দিলীপ কুমার। প্রেমের বিপরীতে তার কাছে প্রাধান্য পায় সত্য ও নৈতিকতা, তিনি আদালতে মধুর বাবার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন।
বিষয়টি পিতৃভক্ত মধুবালাকে ভীষণ রকম আঘাত করে। পরে তিনি চেয়েছিলেন দিলীপ কুমার যাতে তার বাবার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়ে নেয়। কিন্তু দিলীপ কুমার তা করেননি। কারণ তিনি ভেবেছিলেন তিনি তো অন্যায় কিছু করেননি, তবে ক্ষমা চাইবেন কেন? মধুবালার বোন পরবর্তীতে এক স্মৃতিচারণে বলছিলেন, “তখন একবারের জন্য দুঃখ প্রকাশ করা হয়ত অনেক কিছু বদলে দিতে পারতো।”
সবশেষে দিলীপ কুমার মধুবালাকে বিয়ে করার জন্য দুটি শর্ত দিয়েছিলেন। প্রথমত, আতাউল্লাহ খানের অর্থলোভী এবং দাম্ভিক আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি তাকে পরিবার ছাড়তে বলেন। আর দ্বিতীয়ত, স্টুডিওর বদ্ধ পরিবেশে মধুবালা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তেন বলে অভিনয়ও ছাড়তে বলেন তিনি। মধুবালা অভিনয় ছাড়তে রাজী হলেও পরিবার ছাড়ার কথা মেনে নিতে পারেননি।
গভীর অভিমান বুকে চেপে তিনি সম্পর্ক ভেঙে দিয়েছিলেন দিলীপ কুমারের সঙ্গে। আর বলা হয়ে থাকে শুধুমাত্র প্রেমিকের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্যই তিনি বিয়ে করেছিলেন কিশোর কুমারকে। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য বিয়ে করলেও তাদের দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না। কিশোর কুমারও বুঝতে পারতেন যে মধুবালা দিলীপ কুমারকেই ভালবাসেন।
দিলীপ কুমার ও মধুবালার সম্পর্কের উত্থান পতনের সাক্ষী ছিল কালজয়ী হিন্দি সিনেমা ‘মুঘল-ই-আজম’। তাদের সম্পর্কের গুঞ্জন যখন ছড়াতে শুরু করেছে, এমন সময় পরিচালক কে আসিফ তাদের কাছে আসেন এ সিনেমা নিয়ে। তিনি চেয়েছিলেন তাদের বাস্তব জীবন মন দেয়া নেয়ার রসায়ন যাতে জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠে রূপোলী পর্দায়।
নয় বছর ধরে নির্মিত হওয়া এ সিনেমাটি সাক্ষী হয় আরও বেশী কিছুর। দিলীপ কুমার-মধুবালার বাস্তব জীবনের তুমুল প্রেম, সে প্রেমে ভাঙনের সুর, এরপর বেদনা-বিধুর বিচ্ছেদ জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠে পর্দার সেলিম-আনারকলির চরিত্রে। এ সিনেমার নির্মাণকালে এমন অনেক সময় গেছে যখন তারা পরস্পরের সাথে কথাও বলতেন না। তবু ক্ষত-বিক্ষত হৃদয় চেপে রেখে সিনেমার কাজটি তারা করেছিলেন নিজেদের সবটুকু দরদ দিয়ে, উপহার দিয়েছেন নিজেদের সেরা অভিনয়। আর এর ফলে সিনেমাটি কেবলমাত্র তাদের ক্যারিয়ার সেরা সিনেমাই নয়, গোটা হিন্দি সিনেমার ইতিহাসেই একটি মাইলফলক হয়ে আছে।
‘মুঘল-ই-আজম’ মুক্তি পায় ১৯৬০ সালে। এ সিনেমার পর আর মাত্র পাঁচটি সিনেমাতে অভিনয় করতে পেরেছিলেন মধুবালা। কারণ ততদিনে তার শারীরিক অসুস্থতা প্রকটাকার ধারণ করেছে। ছোটবেলা থেকেই তিনি হৃৎপিণ্ডের অসুখে ভুগছিলেন। তার হৃৎপিণ্ডে একটি ছিদ্র ছিল। শোনা যায় মধুবালা অনেক দিন আগে থেকেই নিজের এ অসুখ সম্পর্কে জানতেন। কিন্তু পাছে এর জন্য তিনি কাজের সুযোগ না পান, এ ভয়ে তার বাবা এটি প্রকাশ করতে বারণ করেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি নিয়মিত কাজ করে যান পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য।
এ অসুখের ফলে তিনি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। দুঃসহ যন্ত্রণায় নয়টি বছর পার করে ২৩ই ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে চলে যান কোটি মানুষের স্বপ্নের রানী, এক বুক অভিমান আর ভালবাসার জন্য বুভুক্ষু হৃদয় নিয়ে চলে যান রূপোলী পর্দার ভালবাসার প্রতিমা মধুবালা।