Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মার্শ আরব: রাজনৈতিক আক্রোশের বলি যে জনপদ

ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলের মরুভূমি বেষ্টিত জলাভূমিতে ১৯৯২ সালের ২০ জানুয়ারি সকালটা ছিলো আর বাকি দশটা দিনের মতোই। জলাভূমির উপর কিছুক্ষণ আগে ওঠা সূর্যের নরম রোদ, মোহাম্মদ আর তার পরিবারের কাছেও দিনটা ছিলো স্বাভাবিক। ঘুম থেকে উঠেই নলখাগড়া পোড়ানো আগুনে ঝলসানো রুটি আর দই দিয়ে প্রাতঃরাশ সেরেই সে তার মেয়ে হানাহকে নৌকায় নিয়ে নেমে পড়ল মাছ ধরতে। কিন্তু খুবই ঠান্ডা আবহাওয়ার ঐ দিনে তারা কোনো মাছ পেলো না।

বৈঠা বেয়ে আরো কিছুদূর যেতেই দিগন্ত রেখা থেকে এক স্কোয়াড্রন যুদ্ধবিমান ছুটে এলো ‘মার্শ আরব’ নামের সেই জলাভূমির ভাসমান গ্রামের আকাশে। কিছুক্ষণের গোলাবর্ষণেই পুরো গ্রাম ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল, যুদ্ধবিমানগুলো চলে গেলে পেছনে পড়ে রইল গোলাবর্ষণের আগুনে পুড়ে যাওয়া নলখাগড়ায় তৈরী কুঁড়ে ঘর গুলো। এটা ছিলো শিয়া বিদ্রোহীদের আশ্রয় দেয়ার কথিত অভিযোগে সাদ্দাম হোসেনের তরফ থেকে শাস্তি। এতটুকু শাস্তি হলেও বাঁচা যেত, কিন্তু এরপরে সাদ্দাম হোসেনের পরবর্তী পদক্ষেপের ফলে পাঁচ হাজার বছরের পুরনো এই জনপদ, জলাভূমি আর জীব বৈচিত্র পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেল।

মার্শ আরবের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা; Source: messynessychic

‘মার্শ আরব’: আরব জলাভূমির পরিচিতি

বিশ্বের প্রথম ও সবচেয়ে প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতার স্থানটি ছিলো বর্তমান ইরাকের দক্ষিণাঞ্চল, যে জায়গা সংলগ্ন বর্তমান ‘মার্শ আরব’ অবস্থিত। ইংরেজী Marsh শব্দের অর্থ জলাভূমি, মরুভূমির মাঝখানে জলাভূমি সত্যিই এক আশ্চর্যের বিষয় এবং এরূপ বিশ্বের আর কোথাও নেই। সুমেরীয় সভ্যতার পতনের পর আরব জাতির এ অঞ্চল আয়ত্তে আসে। এরপর মা’দান নামক আরব উপজাতীয়রা এই জলাভূমিতে বসবাস করা শুরু করে, এই মা’দানরাই পরবর্তীতে মার্শ আরব নামে পরিচিত হয়।

জলাভূমিতে ছুটে চলেছে এক মার্শ নারীর নৌকা; Source: Julia Harte

মরুভূমির মধ্যকার এই জলাভূমিতে মার্শ আরব জনগোষ্ঠী গত পাঁচ হাজার বছর ধরে প্রকৃতির সাথে সহাবস্থান করে আসছে। এদের বাসস্থানগুলো তৈরী হয় নলখাগড়া দিয়ে যা ঐ জলাভূমিতে প্রাকৃতিকভাবেই উৎপন্ন হয়। স্থাপত্যের দিক থেকে অনন্য এই বাড়িগুলোকে বলা হয় ‘মুদিফ’, যা তৈরী হয় কোনো প্রকার কাঠ, পেরেক, কাঁচ ছাড়াই। বাড়িগুলো তৈরী হয় একেকটা দ্বীপের উপর, যে দ্বীপগুলো আবার তৈরী হয় খড়খুটো আর মাটি জমা করে। ফলে মার্শ আরব অধিবাসীদের গ্রামগুলো উপর থেকে দেখলে হাজার হাজার দ্বীপের সমষ্টি বলে মনে হয়। আর এই কারণেই এই জায়গাকে বলা হয় ‘ভেনিস অব মেসোপটেমিয়া’।

ভেনিস অব মেসোপটেমিয়া; Source: messynessychic

স্থাপত্যের দিক দিয়ে এদের বাড়িগুলো খুবই দৃষ্টিনন্দন এবং সহজে নির্মাণযোগ্য। ২০০৩ সালে মার্কিন আগ্রাসনের পর আমেরিকান সেনারা মার্শ আরবদের বাড়ি তৈরীর এসব কলাকৌশলকে ইরাকের অন্য অঞ্চলের মানুষদেরকে শিখতে উৎসাহিত করে। এতে যুদ্ধপীড়িত ইরাকের নানা অঞ্চলের গৃহহীন মানুষের আশ্রয় প্রদানে সুবিধা হয়েছিলো।

অনন্য স্থাপত্যের নিদর্শন মার্শ আরবদের এই ‘মুদিফ’; Source: messynessychic

এ বাড়িগুলোর আরো কিছু বাড়তি সুবিধা আছে, যেমন পুরো বাড়িটাই বহন যোগ্য, অর্থাৎ খুব সহজেই খুলে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া যায়। বসন্তকালে জলাভূমির পানির উচ্চতা বেড়ে যায়, ফলে চাইলে খুব দ্রুত খুলে ফেলে উঁচু ভূমিতে নিয়ে স্থাপন করে ফেলা যায়। কিছু কিছু বাড়ি আবার মাটির উপরে না বানিয়ে নলখাগড়ার তৈরী ভাসমান বেদির উপর বানানো হয়। এ জাতীয় বাড়ি নোঙ্গর করে রাখতে হয়, যাতে ভেসে না যায়। ভালোভাবে যত্ন নিলে এরকম একেকটি বাড়ি প্রায় ২৫ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে।

মুদিফ তৈরীর কৌশল, ঠিকভাবে রাখলে যা ২৫ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে; Source: messynessychic

মার্শ আরব অধিবাসীগণ মূলত শিয়া মুসলিম। সমাজ ব্যবস্থা আরবের অন্যান্য গোত্রভিত্তিক সমাজের মতোই। তারা পেশাগতভাবে মূলত দুই ভাগে বিভক্ত, একদল মোষ লালন পালন করে, আরেকদল জলাভূমিতে ধান, যব আর গমের চাষ করে। এপ্রিল মাসের দিকে যখন জলাভূমিতে পানির গভীরতা অনেক কম থাকে, সে সময় ফসলের চারা রোপণ করা হয়ে থাকে। এছাড়াও জলাভূমিতে মাছ ধরেও অনেকে জীবিকা নির্বাহ করে। এই জলাভূমি থেকেই ধরা মাছ দিয়ে সমগ্র ইরাকের মাছের একটা বড় অংশ জোগান দেয়া হতো। এছাড়াও গত শতাব্দী থেকে মার্শ আরবেরা নলখাগড়া দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে কার্পেট বুননকেও তাদের পেশা বানিয়ে নিয়েছে।

মুদিফের ভেতরের দৃশ্য, বামে মার্শ আরবদের গ্রাম; Source: messynessychic

যেভাবে ধ্বংস করা হয় মার্শ আরব জলাধার

মরুভূমির প্রাণ এই জলাধার ধ্বংস করার কারণ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক, যেটা শুরুর বীজ লুকিয়ে ছিলো ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের ভেতর। সংখ্যার দিক দিয়ে ইরাকের শিয়া সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। ‘৭৯ সালে ইরানে আয়াতুল্লাহ খোমেনীর ইসলামী বিপ্লব হলে ইরাকী রাজনৈতিক নেতারা চিন্তায় পড়ে যান। কারণ এই বিপ্লবের জোয়ারে ইরাকেও শিয়া সম্প্রদায় ক্ষমতার আন্দোলন শুরু করতে পারে। ফলে শুরু হয় শিয়াদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন।

ধর্মের দিক থেকে মার্শ আরবরা শিয়াপন্থী; Source: abbis

মূল সমস্যা শুরু হয় ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের পর। জলাধারটির অবস্থা ইরাক ইরান সীমান্ত ঘেঁষে। ইরাক সরকারের সন্দেহ ছিলো যে শিয়াপন্থী বিদ্রোহীরা সীমান্ত ঘেঁষা এই জলাভূমিতে মার্শ আরবদের মাঝে লুকিয়ে আশ্রয় নিতে পারে। সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বাধীন সামরিক বাহিনী শিয়া অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে হামলা চালালে প্রতিপক্ষের অনেক রাজনৈতিক সদস্য এসব অঞ্চলে আশ্রয় নেয়। ফলে এই অঞ্চল যাতে কোনোভাবেই প্রতিপক্ষের অভয়ারণ্য না হয়ে ওঠে তার জন্যে নেয়া হয় এক অভিনব ব্যবস্থা।

মার্শ আরব জলাধারটি অবস্থিত বিখ্যাত টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর সংলগ্ন স্থানে। মূলত এই দুই নদীই হল জলাধারটির পানির উৎস। ইরাকি সরকার এই দুই নদীতে বাঁধ দিয়ে পানির গতিপথ পরিবর্তন করে দেয়, যাতে জলাধার অঞ্চলে পানি প্রবাহিত হতে না পারে। উদ্দেশ্য পুরো মার্শ আরব অঞ্চলটিকে মরুকরণ করে ফেলা, যাতে কোনো বিদ্রোহী গোষ্ঠী এই অঞ্চলে এসে আশ্রয় না নিতে পারে।

নলখাগড়া সংগ্রহ করে ফিরছে এক গ্রামবাসী; Source: AFP

পুরো কাজটি করার জন্যে সাদ্দাম হোসেন তার সমস্ত সামর্থ্য প্রয়োগ করেন। দেশের সমস্ত পুরকৌশল নির্মাণ যন্ত্রপাতি, সমস্ত খননকারী যন্ত্র এনে জড়ো করে দ্রুত গতিতে বাঁধ নির্মাণ করে টাইগ্রিস নদীর পানি প্রবাহ বন্ধ করা হয়। ১৯৯৩ সাল নাগাদ পুরো জলাধারের দুই-তৃতীয়াংশ শুকিয়ে ফেলা হয়, যেটা ধীরে ধীরে ২০০০ সালের ভেতর পুরো ৯০% জলাধার শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হয়। একসময়কার ২০,০০০ বর্গ কি.মি. আয়তনের বিশাল জলরাশি পরিণত হয় মরুময় ধু ধু বালুচরে।

মরুকরণের ফলাফল

বামের ছবিতে পূর্বে জলাভূমির অবস্থা, ডানে বর্তমানে বাঁধ ভেঙ্গে দেয়ার পর সামান্য উন্নতির ছোঁয়া; Source: Hassan partow

সাদ্দাম হোসেনের মূল উদ্দেশ্য সফল হয়। পুরো এলাকা মরুকরণের ফলে প্রায় ২,৫০,০০০ মার্শ আরব জনগোষ্ঠী ঐ অঞ্চল ছেড়ে বিভিন্ন জায়গায় উদ্ভাস্তু হয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। কারণ জীবন-জীবিকা সব দিক থেকেই এরা জলাধারের উপর নির্ভরশীল, চাষবাস, মহিষ চরানো, মাছ শিকার সব কিছু। মার্শ আরবদের এই নির্বাসনের সাথে হুমকির মুখে পড়ে তাদের পাঁচ হাজার বছরের পুরনো সংস্কৃতি।

একসময়কার জলাভূমিকে পরিণত করা হয় মরুভূমিতে; Source: pbs

এ ঘটনার পরিবেশগত প্রভাব আরো ভয়াবহ। এই জলাধারে ইউরেশিয়া থেকে যেসব অতিথি পাখি শীতে আফ্রিকায় যেত তাদের যাত্রাবিরতি হত, ফলে জলাধারটি না থাকায় ইউরেশীয়া অঞ্চলে পাখির সংখ্যা ব্যাপক হ্রাস পায়। মরুকরণের ফলে বহু প্রজাতির গাছপালা ও প্রাণী ইতিমধ্যে বিলুপ্তির খাতায় চলে গেছে। মাটির লবাণাক্ততা বেড়ে গেছে, চাষাযোগ্য জমির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে, মহিষ চারণ বন্ধ হয়ে গেছে এবং মাছ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। মোট কথা, মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ভারসাম্য আর থাকেনি।

বাইবেলে এ জায়গাটিকে উল্লেখ করা হয়েছে ‘গার্ডেন অব ইডেন’ হিসেবে; Source: Julia Harte

২০০৩ সালে মার্কিনীরা আসলে বাঁধের বিভিন্ন অংশ ভেঙ্গে দিয়ে অঞ্চলটিকে পুনরায় জলমগ্ন করার প্রয়াস চালানো হয়। ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তকমা পাওয়া এই অঞ্চলটি ধীরে ধীরে আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিছু অধিবাসী ফিরে এসে মরুভূমির এই বাগানে আবার প্রাণ সঞ্চারের চেষ্টা চালাচ্ছে, যদিও যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে তা আর কোনোদিনই পূরণ হওয়ার নয়। পবিত্র বাইবেলে যাকে উল্লেখ করা হয়েছে দুই নদীর মাঝে থাকা ‘গার্ডেন অব ইডেন’ বা স্বর্গের বাগান হিসেবে (Genesis chapter 2, verse 14)

ফিচার ছবি- messynessychic

Related Articles