মিশরীয়দের রীতিনীতি, স্থাপত্য আর ইতিহাসের বিষয়ে যার বিস্তর পড়াশোনা নেই, সে-ও মিশরকে চিনবে পিরামিডের জন্যই। প্রাচীন এই স্থাপত্য মিশরকে যেমন দিয়েছে পরিচিতি, তেমনি এর রহস্য মানুষকে টেনেছে বারবার। পিরামিড নিয়ে তৈরি হয়েছে মানুষের অনেক ভুল ধারণা, যাকে তারা এতদিন সত্য বলেই ধারণা করে এসেছে। সেসব ধারণা নিয়েই আজকের লেখা।
মৃত্যু নিয়ে মাতামাতি
অতিকায় পিরামিড, হাজার বছরের সংরক্ষিত মমি, দেবতাদের বাহার দেখলে মনে হতে পারে, মৃত্যু নিয়ে মাতামাতিটা একটু বেশিই করত প্রাচীন মিশরের বাসিন্দারা। অন্তত মমি আর মিশর নিয়ে চলচ্চিত্রে খুনোখুনির মাত্রা দেখলে এমন ধারণা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতা এর ধারেকাছে দিয়েও যায় না। প্রাচীন মিশরীয়রা যে অমানবিক পরিশ্রম দিয়ে পিরামিড তৈরি করেছিল, তাতে জীবনের জয়গানই ছিল মূলকথা। তাই মারা যাবার পরেও মানুষ যেন মৃত্যুর আগের জীবনের মতো কাজ করে যেতে পারে, তার সাধ্যমতো চেষ্টা করা হত। পিরামিডগুলোর মাঝে অনেক শিকার, চাষাবাদ, মাছ ধরার খোদাইকৃত ছবি আছে। দেহগুলোকে এত সংরক্ষণ করার কারণ ছিল মানুষ যেন তার স্বাভাবিক আকারেই থাকে। মৃতদের সাথে তাদের ব্যবহৃত অলঙ্কারকেও সমাহিত করা হতো, যাতে কোনো বাধা ছাড়াই মৃত ব্যক্তি তার পরের জীবন চালিয়ে যেতে পারে। স্পষ্টতই তারা মৃত্যুকে নয়, জীবনকে, জীবিত থাকাকে ভালোবাসত।
মমি প্রক্রিয়ায় হৃদযন্ত্র
বিখ্যাত গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস মমি তৈরির প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত লিখে গেছেন। তার পদ্ধতিতে বিখ্যাত আর জনপ্রিয় একটা ধাপ হলো মৃতের হৃদযন্ত্রকে রেখেই মমি তৈরি করা। যদিও মিশরীয়রা চাইত মৃতদের অবিকৃত রাখতে, তবু হৃদয় রেখে দেওয়ার সুযোগ কেবল রাজকীয় এবং ধনবানেরাই পেত।
মহাকাশে মিত্রতা
পিরামিডের মতো অতিকায় স্থাপত্য কীভাবে সম্ভব হলো, কীভাবে তার বিরাট বিরাট পাথরগুলোকে দূর থেকে বয়ে আনা হলো- এসব রহস্য নিয়ে ভাবতে ভাবতে মানুষ অনেক তত্ত্বের জন্ম দিয়েছে। এর মাঝে সবচাইতে জনপ্রিয়টি হলো ভিনগ্রহী প্রাণী তত্ত্ব। গিজার পিরামিডের নির্মাণশৈলী এখনকার মানুষকে স্তম্ভিত করে দিতে পারে, তবে তা ঐ সময়ের গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদদের অজানা ছিল না। তাদের প্রকৌশলীদের দক্ষতা আর দৃঢ় মনোবলই ছিল পিরামিড তৈরির মূল রহস্য। হিস্টোরি চ্যানেলের ‘প্রাচীন ভিনগ্রহী প্রাণীরা’(Ancient Aliens) এর মতো অনুষ্ঠানগুলো জনমনে এ ধরনের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীকে বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। খোদাইকৃত ছবিগুলোতে ফুলদানি ও বিভিন্ন আকৃতির জিনিসকে ভিনগ্রহের প্রাণী বলার চেষ্টাও কম হয়নি। পিরামিড নিয়ে এখন বেশ কিছু তত্ত্ব দাঁড়িয়ে গেছে, যার একটি হলো- পিরামিড পর্যন্ত খাল কেটে নৌকায় পাথর বয়ে আনা হতো, যা বিশ্বাসযোগ্য। দেখতে অতিমানবীয় পরিশ্রমের হলেও একে ভিনগ্রহের প্রাণীদের অবদান বলে দেওয়াটা প্রাচীন মিশরের মানুষের মেধা ও দক্ষতার অপমান।
সম্পূর্ণ আবিষ্কৃত
অনেকেই বিশ্বাস করেন, পিরামিড খুঁজে পাওয়ার পর মিশর সম্পর্কে মানুষের সবকিছু জানা হয়ে গেছে, যা একেবারেই ভ্রান্ত ধারণা। আজও প্রতিনিয়ত সেখানে কিছু না কিছু আবিষ্কার হয়েই চলেছে। গিজার পিরামিড থেকে পাওয়া গেছে সূর্য প্রতীক সম্বলিত নৌকা। ধারণা করা হচ্ছে, এই নৌকা রাখার কারণ ফারাওয়ের সাথে সূর্য দেবতা ‘রা’য়ের যোগাযোগের পথ করে দেওয়া। অন্ধকারের দেবতা আপেপের সাথে রায়ের লড়াইয়ে যেন সঙ্গ দিতে পারেন ফারাও, তাই এমন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রচলিত বিশ্বাসমতে, প্রতিরাতে সৌর নৌকা দিয়ে রা যুদ্ধ করতে যান আপেপের সাথে, ভোরবেলায় ফিরে আসেন বিজয়ীর বেশে।
পিরামিডের সাজসজ্জা
অনেক মিশরীয় সমাধিসৌধে হায়ারোগ্লিফিকের ছড়াছড়ি দেখা গেলেও পিরামিডগুলো সেই তুলনায় সাদামাটা। গিজার পিরামিড আবিষ্কারের সময়ে মনে করা হয়েছিল, এর ভেতরটা হয়ত ফাঁকা। তারপর আবিষ্কৃত হয় গুপ্ত কুঠুরি। এর পেছনে লুকিয়ে ছিল অনেক হায়ারোগ্লিফ। ৪০০০ বছর আগে পিরামিডগুলোর সবটুকু চুনাপাথরের রঙের ছিল না। পিরামিডের ভেতরের স্তম্ভের রঙ ছিল লাল বা সাদা। রঙ হোক বা লেখা, পিরামিডের সাজসজ্জা সাধারণ মানুষের কল্পনার চেয়ে অনেক কম। পিরামিডকে খ্যাতি দিয়েছে তার অলঙ্কার নয়, বরং প্রকৌশল। তবে ফারাওদের সমাধিগুলো তাদের উপযুক্ত সম্মানের করেই তৈরী হতো। পিরামিডের বহিরাবরণ তৈরি ছিল মসৃণ, পালিশ করা সাদা চুনাপাথর দিয়ে। পাথরগুলোকে ততক্ষণ পালিশ করা হতো, যতক্ষণ না সূর্যের আলোয় চকচক করে। এমনকি রাতের আলোয় মরুভূমিতে বহুদূর থেকে দেখা যেত পিরামিডকে। একদম উপরের পাথরটাকে সোনা বা কোনো চকচকে ধাতুর প্রলেপ দেওয়া হতো। শত শত বছর আগের এই চকচকে রঙ মুছে গেছে সিংহভাগ দেয়ালের।
পিরামিডে ফারাওয়ের দাসেরা
প্রচলিত বিশ্বাসমতে, ফারাওরা তাদের দাসদের হত্যা করে নিজের সাথে পিরামিডে সমাহিত করতেন, যাতে পরের জীবনে আরাম-আয়েশে কমতি না হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রথমদিকের কয়েকজন ফারাও এমনটা করলেও বেশিরভাগ ফারাও দাসহত্যা করেননি। তারা হয়তো বুঝে গিয়েছিলেন, মৃত দাস থেকে জীবিত দাসকে বেশি কাজে লাগানো যায়। এর বদলে তারা ‘শাবতি’ নামের একধরনের পাথরের মূর্তি নিয়ে সমাহিত হতেন।
পিরামিড দাসেদের হাতে তৈরি
খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম অব্দে হেরোডোটাস পিরামিড নিয়ে বিস্তর লিখেছিলেন। দাসেরা যে পিরামিড তৈরি করেছে, এ ধারণার জন্ম হয় হেরোডোটাসের মতবাদ থেকেই। আরো ধারণা করা হতো, পিরামিড নির্মাণ এতই কষ্টসাধ্য কাজ ছিল যে কেউ এই কাজ করতে রাজি হতো না। ফলে ফারাওরা অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে দাসে পরিণত করতেন ও তাদের জোর করে খাটিয়ে পিরামিড বানাতেন। ধারণাটি ভুল প্রমাণিত হয়, যখন পিরামিড নির্মাতাদের সমাধি খুঁজে পাওয়া যায় গিজার পিরামিডের পাশে। ফারাওয়ের পাশাপাশি সমাহিত হওয়ার সম্মান যা-তা কথা নয়, আর তৎকালীন সমাজে দাসদের যে সম্মান ছিল, তাতে এই সমাধি কোনোমতেই তাদের নয়। তাদের সমাধিতে আছে বিশাল সংখ্যক গরুর হাড়। সেই সময়ের মিশরে গরুর মাংস বেশ বিলাসী খাবার ছিল। সুতরাং এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, পিরামিডের প্রস্তুতকারকেরা দক্ষ নির্মাতা ছিলেন, যাদেরকে খুব সম্ভবত আশেপাশের এলাকা থেকে সংগ্রহ করা হতো। তারা কিছুতেই হলিউড চলচ্চিত্রের দেখানো দাস ছিলেন না।
ফারাওয়ের অভিশাপ
‘অভিশাপ’ সম্বলিত যেকোনো গল্পই রোমাঞ্চকর। মুখে মুখে ছড়িয়ে গজায় নানা ডালপালা। এভাবেই তুতেনখামেন হয়ে যায় টাইটানিক ডোবার দায়ে অপরাধী। তুতেনখামেনের অভিশাপ–ফারাওদের অভিশাপ-পিরামিডের অভিশাপ এসবই মিডিয়াতে ভুল সংবাদের প্রভাব আর একটু খতিয়ে দেখার অভাব। প্রচলিত উপকথায় তুতেনখামেনের রেখে যাওয়া অভিশাপের কারণে মারা গিয়েছিল অভিযানের স্পন্সর সহ অন্য অনেক সদস্য। এই মৃত্যুকে অনেকে পিরামিডের ভেতরে থাকা ফাংগাস ও বিষাক্ত গ্যাসের কারণ বলে দাবি করে থাকেন। আসলে ৫৮ জনের মাত্র ৮ জন মারা গিয়েছিল পরবর্তী ১২ বছরে, যা তেমন কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। অভিযানের নেতা ছিলেন কার্টার। সুতরাং কোনো অভিশাপ থাকলে সবার আগে তাকে আক্রমণ করার কথা। কিন্তু তিনি অভিযানের ১৬ বছর পর মারা যান। টাইটানিকের ডুবে যাওয়া, বিভিন্ন সময় তুতেনখামেনের মমি বাহকদের মৃত্যু ও দুর্ভাগ্যের যত গল্প শোনা যায় ও বিশ্বাস করা হয়, জাদুঘর থেকে পাওয়া সূত্রে জানা যায় মমিটিকে আসলে কোথাওই সরানো হয়নি। একবার প্রদর্শনীর জন্য পাঠানো হলেও বহাল তবিয়তে অক্ষত অবস্থায় তা ফেরত আসে।
কোনো ঘটনা যত পুরনো হয়, তাকে ঘিরে আমাদের কৌতূহল বাড়তে থাকে। হাজার হাজার বছর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা পিরামিড, হায়ারোগ্লিফিক ভাষা, নানা দেবদেবী আমাদের এই কৌতূহলের খোরাক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সময়ের পার্থক্যটা যেহেতু কম দিনের নয়, অনেক তথ্যই আমাদের নাগালের বাইরে, এখনো আমরা অনেক অন্ধকারে। এই অন্ধকার আর মানুষের কল্পনাশক্তি একের পর এক জন্ম দিয়েছে ধারণার, যা অনেক মানুষ বিশ্বাসও করেছে।