১৮৩৭-১৯০১ সাল পর্যন্ত ৬৫ বছর রানী ভিক্টোরিয়া ইংল্যান্ড শাসন করেন। স্বামী প্রিন্স অ্যালবার্টের মৃত্যুর পর তিনি সম্পূর্ণ কালো বর্ণের জামা পরিধান করতে শুরু করেন। ঘোষণা করেন যে, তিনি তার স্বামীর জন্য শোক প্রকাশ করছেন এর দ্বারা। বাকি জীবন কালো জামাই পরিধান করেছেন রানী ভিক্টোরিয়া। তিনি দ্বিতীয়বার আর বিয়েও করেননি, এমনকি নিজ সন্তানদের দেখভালও করেছেন একাই।
ইংরেজদের কাছে এই ঘটনাটি অত্যন্ত শোচনীয় ও একইসাথে আবেগময় এক ঘটনা হিসেবে পরিচিত। মানুষের মাঝে তাই প্রিয়জনের প্রতি শোক প্রকাশের মাধ্যমটাও গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করলো। কালের বিবর্তনের সাথে সাথে একটা সময় এই নাটকীয় শোক প্রকাশ সংস্কৃতির মাঝে মূল গেড়ে বসে গেলো। মৃত ব্যক্তির পরিপার্শ্বে থাকা বিভিন্ন বস্তু সংগ্রহের মাধ্যমে শোক প্রকাশ তখনকার ভিক্টোরিয়ান যুগে দ্রুতই একটা রীতিতে পরিণত হলো।
স্বহস্তে লিখিত উইলনামা
মানুষকে আজকাল আর নিজ মৃত্যুচিন্তায় বিভোর হতে দেখা যায় না। একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর বয়সের ভারে শরীরে যখন টান পড়ে, তখন হয়তবা মৃত্যুচিন্তা করতে দেখা যায়। কিন্তু যুবক শ্রেণীর মাঝে সেই চিন্তা একদমই দেখতে পাওয়া যায় না। ভিক্টোরিয়ান যুগে এ চিত্র ছিলো পুরোপুরি উল্টো ধারার। মৃত্যুচিন্তা করা, নিজ মৃত্যু নিয়ে শোক প্রকাশ করা- এগুলোকে সেই সময়ে ফ্যাশন মনে করা হতো। জীবিত এবং সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থাতেই মানুষ লিখে রাখতো তাদের মৃত্যুর পর সবকিছু কেমন দেখতে চায় তারা। এই লেখাগুলো তাদের পরিবার এবং পরবর্তী প্রজন্ম সংরক্ষণ করে রাখতো, যার দরুন লেখকগণ পুরো ব্যাপারটিকে এমন অলঙ্কৃত করে লিখতেন যে, কেউ পড়লে মনে হবে সে কোনো কবিতার বই পড়ছে। মেরী ড্রিউ নামক এক ভদ্রমহিলা তো রীতিমতো বই লিখে বসলেন নিজের মৃত্যুশোক নিয়ে। সেই বইতে উল্লেখ ছিলো, তার মৃত্যুর পর কী কী করতে হবে পরিচিত মানুষজনকে, ৫৬ পৃষ্ঠার এক সুবিশাল উইল। ভিক্টোরিয়ান যুগে এগুলোর প্রতি মানুষজনের অগাধ শ্রদ্ধা ছিলো। সেই উইলে ছেলে বন্ধুদের সবার জন্য কিছু বই আর মেয়ে বন্ধুদের সবার জন্য মেরী তার নিজ গয়নাগুলো দেবার কথা উল্লেখ করে যান। যারা খালি হাতে ফিরে যাবে, তাদের কথাও উল্লেখ করেছিলো মেরী, তাদের সবাইকে যাতে মেরীর একগাছা করে চুল দিয়ে দেয়া হয়।
চুলের তৈরি অলংকার
রানী ভিক্টোরিয়া একটি বিশেষ লকেট সম্বলিত হার পরতেন গলায়। সেই লকেটের ভেতর রাখা ছিলো তার স্বামী প্রিন্স অ্যালবার্টের কিছু চুল। এই ঘটনা থেকেই প্রিয়জনদের মৃত্যুর পর চুল সংগ্রহ করে রাখার রেওয়াজ চালু হয়ে যায়। সেই যুগের মেয়েরা তখন রানী ভিক্টোরিয়ার মতো প্রিয়জনদের মৃত শরীরের কোনো অংশ নিজেদের কাছে রেখে দিতে আরম্ভ করে। সময়ের সাথে সাথে মানুষের সৃজনশীলতা চুল সংরক্ষণ করবার রীতিকেও ছাড়িয়ে যায়। একসময় কানের দুল, গলার হারেও চুলগুলোকে সুন্দর করে জুড়ে দেয়া শুরু হতে লাগলো। কখনো কখনো একাধিক প্রিয়জনের প্রত্যেকের এক গাছা করে চুল নিয়ে মালার মতো তৈরি করা হতো। যেহেতু চুল পঁচে যাবার সম্ভাবনা নেই, সেহেতু প্রিয়জনের শেষ নিদর্শন হিসেবে চুলকেই বাছাই করে নিতো মানুষেরা। চুলের তৈরি এই অলংকারগুলো এখনো বেশ ভালোভাবেই জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
শোক প্রকাশক আংটি
যদিও প্রিয়জনের চুল সম্বলিত অলংকারগুলো যেকোনো সময়, এমনকি মানুষটির মৃত্যুর পরও চুল সংগ্রহ করে তৈরি করা যেত, কিছু মানুষের তাতে মন ভরলো না। যদি কেউ নিজের মৃত্যুর সম্পর্কে জ্ঞাত হতো, অর্থাৎ কোনো এক দূরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে বুঝতে পারতো যে সে আর কয়েক মাস মাত্র বাঁচবে, তাহলে সে তার মৃত্যুশোকের নিদর্শন হিসেবে বিশেষ এক আংটি তৈরির ব্যবস্থা করতো। ১৮৫২ সালের দিকে অ্যাডা লাভলেস নামক জনৈকা ভদ্রমহিলার ক্যান্সার ধরা পড়লো। এখন তো কত-শত ক্যান্সার নিরাময়ের পথ আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু তৎকালীন সময়ে ক্যান্সার মানেই মৃত্যু সুনিশ্চিত। অ্যাডা লাভলেস যখন জানলেন তার ক্যান্সার হয়েছে, তিনি এক বিশেষ আংটি তৈরির ব্যবস্থা করলেন তার স্বামী এবং বড় মেয়ের জন্য। স্বামীর জন্য তৈরি আংটিতে তিনি লিখেছিলেন, “আমি চাই আমাদের পরমাত্মা চিরকাল একই বন্ধনে আবদ্ধ থাকুক।” আর দুই ছেলের জন্য তিনি কিছু অর্থ রেখে গিয়েছিলেন, ছেলেদের প্রতি নির্দেশনা ছিলো, তার সম্মানে যাতে তারা দুই ভাই দুটো আংটি কিনে নেয়। এভাবে মৃত্যুশোক প্রকাশে বিশেষ আংটি ব্যবহার করার রীতিটি যে একা অ্যাডা লাভলেস পালন করেছিলেন, তা নয়। ভিক্টোরিয়ান যুগের দলিল-দস্তাবেজ ঘাঁটলেই বোঝা যায় যে, তখনকার সময়ে অনেকেই এই কাজ করেছিলো, আর মানুষ অত্যন্ত সম্মানের সাথে নিয়মিত এই আংটি ব্যবহার করতো।
শোক পোশাক
যখুনি কোনো একটি পরিবারের কোনো সদস্যের মৃত্যু হতো, পরিবারের বাকি সদস্যদেরকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সামাজিকভাবে বাধ্য করা হতো কালো বর্ণের জামা পরিধানের জন্য। এই সাজপোশাকগুলো শোকের পোশাক হিসেবেই পরিচিত ছিলো। এই পোশাকগুলো শোকের নিদর্শন বহন করতো, এই পোশাকে কাউকে দেখলে মানুষ বুঝে নিতো পরিধানকারী মানুষটি প্রিয়জন হারানোর কষ্টে আছে এবং সে একা থাকতে চাইছে। শোক প্রকাশের নির্দিষ্ট সময়টিতে সেই মানুষগুলোকে কোনো সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে দেখা যেত না। আর যদিও বা কেউ এ সকল নিয়ম ভেঙে কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত হত কিংবা রঙিন জামা পরিধান করতো, মানুষ একে মৃতব্যক্তির প্রতি অসম্মানের নিদর্শন ভাবতো। এই সামাজিক আচারগুলো মানতে গিয়ে সবাইকেই কালো বর্ণের শোক পোশাক আগে থেকে প্রস্তুত রাখতে হতো, যেকোনো সময় প্রয়োজন হলে যাতে পরা সম্ভব হয়।
কীথ নরম্যান ম্যাকডোনাল্ড নামক এক ভদ্রলোক ১৮৭৫ সালে একটি পুস্তিকা লিখলেন, এতে তিনি কালো পোশাক পরিধানের রীতিটিকে পুরোপুরি এক হাস্যকর ও লজ্জাজনক কান্ড বলে উল্লেখ করলেন। যদিও মানুষের কাছে ধীরে ধীরে এমনি বোধগম্য হতে শুরু করেছিলো, তবু এই শোক পোশাকের রীতিটি আরো কয়েক দশক স্থায়ী হয়েছিলো।
মৃত্যুপরবর্তী চিত্রধারণ
ক্যামেরাতে ছবি তুলে রাখাটা যখন সহজলভ্য হয়ে গেলো মানুষের কাছে, তখন তারা ভাবলো প্রিয়জনদের সমাহিত করার পূর্ব মুহূর্তকার চেহারা স্মৃতিচারণ করতে ছবি তুলে রাখা প্রয়োজন। সেই সময়ে ছবি তোলার সময়ে মানুষদের বেশ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো, সামান্য নড়াচড়া করলেই যে ছবির ঝাপসা হয়ে যাবে। ঠিক এ কারণেই পুরনো ছবিগুলোতে আমরা দেখতে পাই মানুষ চোখ-মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে কিংবা বসে আছে। তাই মৃতদেহের ছবি তোলা অনেকখানি সহজ হয়ে এলো, যে মারা গিয়েছে তার তো আর নড়াচড়া করবার কিছু নেই, ছবি ঝাপসা হয়ে যাবার ভয়ও নেই।
একইসাথে আরেক ধরনের রীতি চালু হলো মানুষের মাঝে; ‘আত্মার চিত্রধারণ’। মানুষ তার নিজের ছবির মাঝে নিজেরই চেহারা স্বচ্ছভাবে জুড়ে দিতে, দেখে মনে হবে যে চেহারাটা আবছাভাবে মানুষটির উপর ভাসছে; একেই তারা বলতো ‘আত্মার চিত্র’। রানী ভিক্টোরিয়ার পুত্র আর্থারও তার নিজ ‘আত্মার চিত্র’ তৈরি করিয়েছিলেন।
মানুষজনের মনে একসময় এমন ধারণা জন্মালো যে, মৃত্যুর পর আত্মারা নাকি নিজেদের প্রকাশ করার রাস্তা খুঁজে পেয়েছে এই আত্মার চিত্রগুলোর মাধ্যমে। ন্যাশনাল সায়েন্স এন্ড মিডিয়া মিউজিয়ামে ভিক্টোরিয়ান যুগের থেকে পাওয়া এমন অসংখ্য ‘আত্মার চিত্র’ রাখা রয়েছে।
মৃতের স্কেচ
যেসকল পরিবার ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলানোর অর্থ সংকুলান করতে পারতো না, তাদের কাছে একমাত্র ভরসা হিসেবে ছিলো হাতে আঁকা চিত্রকর্ম।
জন ক্যালকট হোর্সলে নামক একজন চিত্রশিল্পীর নেশা ছিলো বিভিন্ন মর্গে ঘুরে ঘুরে শিশুদের স্কেচ তৈরি। হোর্সলের কাছে যদি কোনো শিশুর মারা যাবার সংবাদ পৌঁছাতো, তৎক্ষণাৎ সে গিয়ে উপস্থিত হতো সেখানে, যাতে করে মৃত শিশুটির মাংসপেশিগুলো তখনও স্থবির হয়ে না যায়, দেখে যেন মনে হয় শিশুটি মারা যায়নি, পরম নিদ্রায় শুয়ে আছে।
এছাড়াও অন্যান্য চিত্রশিল্পীদের পরিবারের কারো যদি প্রাণঘাতী ব্যাধি হতো, তাহলে তারা সেই সদস্যদের স্কেচ এঁকে রাখতো।
মৃতদেহের প্রতিমূর্তি
রানী ভিক্টোরিয়া তার স্বামীর মৃত্যুর পর কালো মার্বেল পাথর দিয়ে স্বামীর একটি প্রতিকৃতি নির্মাণ করান। ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর পর তাকে তার স্বামীর সাথে সমাহিত করা হয়। সমাধির উপর স্থাপন করা হয় সাদা অ্যালবাস্টারের তৈরি একটি প্রতিকৃতি।
এমন প্রতিকৃতি নির্মাণ একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া আর খুবই অর্থক্ষয়ী ব্যাপার। ইতিহাসে রাণী ভিক্টোরিয়াই প্রথম নন যিনি এমন প্রতিকৃতি তৈরি করিয়েছিলেন। তার শাসনকালেই অনেক ধনী পরিবার নিজেদের প্রিয়মানুষদের মৃত্যুর পর মৃতের প্রতিকৃতি তৈরি করাতো। মৃত্যুর সাথে সাথে ক্যামেরায় ছবি তুলে ফেলা হতো, সেই ছবি দেখেই নির্মিত হতো প্রতিকৃতি।
চিঠি ও স্মৃতিচারক চিত্র সম্বলিত কার্ড
ভিক্টোরিয়ান যুগে শোক প্রকাশের আরো একটি নিদর্শন পাওয়া যেতো কারো উদ্দেশ্যে পাঠানো চিঠিতে। সাদা রঙের খামে কালো রঙের বর্ডার দিয়ে চিহ্নিত করা হতো এই নিদর্শনটি, কেউ যদি এ ধরনের চিঠি পেতো, তাহলে খাম খোলার পূর্বেই বুঝে নিতো নিশ্চয়ই কারো মৃত্যু সংবাদ লেখা আছে এতে। এ ধরনের মৃত্যু সংবাদ সম্বলিত চিঠি আসলে বেশ উপকারই করেছিলো, কালো বর্ডারগুলো চিঠির প্রাপককে শুরুতেই মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তুলতো যে, চিঠিতে একটি খারাপ সংবাদ রয়েছে। যদি কোনো শিশুর মৃত্যু সংবাদ হতো, তাহলে সেই কার্ডটি তৈরি করা হতো সাদা কাগজে, আর প্রাপ্তবয়স্কদের মৃত্যু সংবাদে কার্ডটি তৈরি হতো কালো কাগজে।
সময় যতই অতিবাহিত হতে লাগলো, এভাবেই প্রিয়জনের মৃত্যুর পর শোক প্রকাশের জন্য কোনো বস্তু কেনা অথবা মানুষটির জীবদ্দশায় তার ব্যবহার্য বস্তুকে ব্যবহার করা হতে লাগলো।
ফিচার ইমেজ- commmons.wikimedia.org