ময়ূর দেবতা, শয়তানের পূজারি এবং একটি হতভাগ্য জনগোষ্ঠী

২০১৪ এর জুনের দিকে ইরাকে কী হয়েছিলো মনে আছে? কালো পতাকা উড়িয়ে হাজার দেড়েক সুন্নি যোদ্ধা মরুভূমি ফুড়ে উদয় হয়ে কব্জা করে নেয় ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুল এবং এর আশেপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। বিশাল সরকারি বাহিনী রাতারাতি স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। উত্তর ইরাকের বিরাট অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামিক স্টেট এর খেলাফত। এসবই মানুষ জানে।

জুনের এই হামলার মাস দুই পরে, আইএস জঙ্গীরা শুরু করলো ঐ অঞ্চলের কুর্দিদের ওপরে নির্মম অত্যাচার। কুর্দিদের একটি গোত্র ইয়াজিদিরা এই হামলার মূল শিকার হল। হাজারে হাজারে ইয়াজিদি মারা গেল, আরো অনেককে বানানো হল দাস কিংবা যৌনদাসী। সে সময়ে সিনজার পাহাড় হয়ে পলায়নরত ইয়াজিদি জনগণ বা কুর্দি আধা সামরিক বাহিনী পেশমারগা নিয়ে সংবাদপত্রে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে বিধায় ইয়াজিদি নামটা এখন কারো অপরিচিত নয়। কিন্তু তাদের নিয়ে বিস্তারিত অনেকেই জানেন না।

উত্তর ইরাকের যুদ্ধ; Source: ABC news

ইয়াজিদি কারা এ নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেকে এদেরকে কুর্দি জনগোষ্ঠীর একটি গোত্র হিসেবে দাবি করেন। অনেকে আবার বলেন ইয়াজিদিরা বরাবরই আলাদা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী ছিল। ওরা কুর্দি নয়। পণ্ডিতদের এই বিতর্ক কতদিন চলবে তা নিরূপণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় আমরা আপাতত ঐ আলাপে যাবো না। তবে এটা সত্যি যে হাজার হাজার বছর ধরেই আর্মেনিয়া, জর্জিয়া, সিরিয়া আর ইরাকে ইয়াজিদিরা ছড়িয়ে আছে এবং নিজেদেরকে তারা কুর্দি বা আরবদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা মনে করে। জাগরোস পর্বতমালার এই প্রাচীন অধিবাসীদের মোট সংখ্যা পাঁচ লক্ষ থেকে বারো লক্ষের মধ্যে। বর্তমানে তুরস্ক আর জার্মানিতেও অনেক ইয়াজিদি থাকে। ইয়াজিদি শব্দটা এসেছে প্রাচীন পারসিক ভাষা থেকে। এর অর্থ ‘পবিত্র’। কুরমাঞ্জি কুর্দিশ নামের একটি কুর্দি উপভাষায় তারা কথা বলে।

ইয়াজিদি লিপি; Source: Pinterest

ইয়াজিদিদের ধর্ম

ইয়াজিদিরা কিন্তু অন্যান্য কুর্দিদের মতো সুন্নি মুসলিম নয়। ইয়াজিদিদের ধর্মের নাম ইয়াজিদিজম। এই ধর্ম এসেছে প্রাচীন ধর্ম ইয়াজদানিজম থেকে। প্রাক-ইসলামিক যুগে কুর্দিরা ইয়াজদানিজম এর অনুসারী ছিল। কালক্রমে ওই ধর্মের একটি শাখার সাথে জরথুস্ত্রবাদ, ইসলাম, খ্রিস্টান আর ইহুদি ধর্মের নানা তত্ত্বের সংমিশ্রণে বর্তমানের ইয়াজিদি ধর্মটি রূপ পেয়েছে। শেখ আদি ইবন মুসাফির ইয়াজিদিদের কাছে খুব পবিত্র একজন মানুষ। একাদশ শতাব্দীর এই মানুষটিকে ইয়াজিদিরা তাদের অন্যতম নবী জ্ঞান করে। ‘কিতাব আল জিলওয়া’ আর ‘মেশেফা রেস’ তাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। গ্রন্থগুলোতে অনেকগুলি ‘কাওল’ আছে। কাওল হচ্ছে একধরনের কবিতা বিশেষ। এই কাওলগুলো বহু প্রাচীন আমল থেকে মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। পরে একাদশ বা দ্বাদশ শতাব্দীতে এগুলোকে সংগ্রহ করে লেখ্য রুপ দেওয়া হয়।

ইয়াজিদিদের দেশ; Source: wikimedia commons

সাতদিন ব্যাপী ‘সেজনা সেমাইয়া’ ইয়াজিদিদের সব থেকে বড় ধর্মীয় উৎসব। হেমন্তকালে ষাড় জবাই দিয়ে তারা আসন্ন শীত ও পরবর্তী আনন্দের দিনগুলোর জন্য প্রার্থনা করে। ইরাকের নিনেভ প্রদেশের লালিস পাহাড়ে শেখ আদি ইবন মুসাফিরের সমাধিক্ষেত্র তাদের পবিত্রতম তীর্থস্থান। ডিসেম্বর মাসে তারা তিন দিন রোযা রাখে। অন্যান্য ধর্মের পবিত্র স্থান, যেমন আরাফাত পাহাড়ও ইয়াজিদিজমে একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র। ইয়াজিদি ধর্মে সাপ খুব গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্র।

ইয়াজিদি ধর্মে অন্যান্য ধর্মের লোকেদের সাথে বিয়ের পিড়িতে বসা তো দূরের কথা, বেশিক্ষণ তাকানোও বারণ। ইয়াজিদিরা মাটিতে থুতু ফেলে না বা আগুনে বেমক্কা পানি ঢালে না। কারণ তাদের ধর্মে বায়ু, আগুন, মাটি ও পানিকে পবিত্র বস্তু হিসেবে জ্ঞান করা হয়। সূর্যের দিকে মুখ করে তারা প্রার্থনা করে নিজস্ব উপাসনালয়ে।

ইয়াজিদি তীর্থক্ষেত্র; Source: Atlas Obscura

ইয়াজিদিরা বিশ্বাস করে, তারা কেবল হযরত আদম (আ) এর বংশধর। আদমের (আ) সন্তানের সাথে জনৈকা হুরির বিবাহের পরিণতিতে পৃথিবীতে ইয়াজিদিদের সৃষ্টি হয়। অন্যান্য সকল ধর্মের লোকেরা এসেছে আদম (আ) আর বিবি হাওয়া (আ) মিলন থেকে। কিন্তু ইয়াজিদিরা বিশ্বাস করে, আদম পবিত্র হলেও হাওয়া নন। কাজেই অন্যান্য ধর্মের লোকেদের মধ্যে ভালো মন্দ মিশে গেল, কিন্তু ইয়াজিদিরা রয়ে গেল পবিত্রতম। অবশ্য তাই বলে ইয়াজিদিরা পাপ করে না তা নয়। ইয়াজিদিদের বিশ্বাস, পাপ বাসা বাধে মানুষের ভুলে। এর সাথে শয়তান বা ইবলিশের কোনো সংস্রবের কথা তাদের ধর্মে নেই। তাদের ধর্মে আসলে নরকের কোনো জায়গাই নেই। ইয়াজিদিরা পুনর্জন্মে বিশ্বাসী।

ইয়াজিদি যোদ্ধা; Source: fiveprime

কিন্তু সেই ওসমানীয় শাসকদের আমল থেকেই ইয়াজিদিদের ওপরে অত্যাচার নিপীড়ন চলছে। সাদ্দাম পরবর্তী ইরাকেও এরা বারবার গণহত্যা ও বোমা হামলার শিকার হয়েছে। আর আইএসের হাতে হাজার হাজার ইয়াজিদির মৃত্যুর কথা তো সবার জানা। ইয়াজিদিদেরকে হত্যা করবার সময় আইএসের মিডিয়া বারবার তারস্বরে চিৎকার করেছে এই বলে যে, তারা শয়তানের পূজারিদের বিরুদ্ধে লড়ছে। অনেক আরব আর কুর্দিও ইয়াজিদিদেরকে এই নজরেই দেখে।

কেন ইয়াজিদিদেরকে শয়তানের পূজারি বলা হয়? সে কথার উত্তর জানতে হলে আগে পড়তে হবে মেলেক তাউসের আখ্যান। ইয়াজিদিদের ধর্মে এ এক বিচিত্র চরিত্র, অন্যান্য আব্রাহামিক ধর্মে সে হাজির হয় বহুল নিন্দিত শয়তানের বেশে। কী তার আখ্যান?

মেলেক তাউস

ইয়াজিদি ধর্মমতে বিধাতার নিজের রোশনাই থেকে মেলেক তাউস সৃষ্টি হন। ইনি একজন ফেরেশতা। পরে বিধাতা আরো ছয়জন ফেরেশতা সৃষ্টি করে মেলেক তাউসকে তাদের নেতা বানান। মেলেক তাউস এর সহজতম বাংলা হচ্ছে ‘ময়ূর দেবতা’

মেলেক তাউস দারুণ অনুগত ফেরেশতা ছিলেন। বিধাতা একবার পৃথিবী থেকে ধুলি আনিয়ে আদমকে সৃষ্টি করলেন। এরপরে ফেরেশতাদেরকে আদেশ দিলেন আদমকে সেজদাহ করতে। সবাই সেজদাহ করলেও মেলেক তাউস করলেন না।

চেনা ঠেকছে? ইহুদি, খ্রিস্টান আর ইসলাম ধর্মেও অনেকটা এমনই বলা হয়েছে না? শয়তান আদমকে কুর্নিশ করলেন না। পরে বিবি হাওয়াকে গন্ধম ফল খাওয়ানো ও মানবজাতির ওপরে তার ভর করে বসার কথা সবারই মোটামুটি জানা। আর ঠিক এখানেই ইয়াজিদিদের ধর্মবিশ্বাস আলাদা মোড় নিয়েছে।

শিল্পীর কল্পনায় মেলেক তাউস; Source: Cradle of Civilization.

মেলেক তাউস বিধাতার অনুচর, তিনি বিধাতার অংশ, বিধাতা কেন মানুষকে সিজদাহ করবেন? তাছাড়া বিধাতা চাইলেই মেলেক তাউসকে বাধ্য করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি মেলেক তাউসের পরীক্ষা নিলেন। আদমকে মেলেক তাউস সিজদাহ করলেন না দেখে বিধাতা খুশি হলেন। মেলেক তাউসকে মানবজাতি আর নিজের মধ্যে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে কাজ করবার আদেশ দিলেন।

বহু বছর পরের কথা। আদম আর হাওয়ার বংশধরে পৃথিবী সয়লাব। সব জায়গায় তখন মার মার কাট কাট অবস্থা। মানব সমাজ বিষিয়ে উঠেছে। মেলেক তাউস এই অন্যায়-অবিচার দেখে কেঁদে উঠলেন। সাত হাজার বছর ধরে তার অশ্রুধারা বইলো, নিভে গেলো নরকের আগুন। কিন্তু মানুষ মেলেক তাউসকে ভুল বুঝলো। তারা সবাই মেলেক তাউসকে ফিরিয়ে দিলো বিধাতার অবাধ্য অনুচর ভেবে। কিন্তু ইয়াজিদিরা বুঝলো আসল কাহিনী। মেলেক তাউস বিধাতার পরীক্ষায় সফল হয়েছেন, ফেরেশতারূপে আবির্ভূত হয়েছেন, এই বিশ্বাসে ইয়াজিদিরা তাকে দিলো সুবিপুল সম্মান আর ভক্ত আরাধনা। এই বর্ণনার সাথে ইবলিশ তথা শয়তানের কাহিনী মিলে যায়। ফলে শত শত বছর ধরে অন্যান্য ধর্মের লোকেরা ইয়াজিদিদেরকে শয়তানের পূজারি হিসেবে নিপীড়ন করে চলেছে। যদিও ইয়াজিদিরা মেলেক তাউস আর অন্যান্য ধর্মের শয়তানকে একই চরিত্র মনে করে, এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ইয়াজিদিদের ধর্মকাহিনীটা একান্তই তাদের নিজস্ব।

ইয়াজিদি নববর্ষ; Source: yezidihumanrights

মেলেক তাউস প্রতি বছর এপ্রিল মাসের প্রথম বুধবারে পৃথিবীতে নেমে আসেন। এই দিনটিকে ইয়াজিদিরা নিজেদের নববর্ষ হিসেবে জ্ঞান করে। ইয়াজিদি ক্যালেন্ডার কিন্তু অনেক প্রাচীন। ২০১৮ সালে এপ্রিলে তাদের ৬,৭৬৮ তম বছরটি শুরু হবে। তাউসগেরান নামের পরবের সময় ইয়াজিদিরা মেলেক তাউসের প্রতিমা গড়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়ায়। শেখ আদি ইবন মুসাফিরকে অনেক ইয়াজিদি মেলেক তাউসের অবতার হিসেবে সম্মান করে।

আসল প্রশ্নটার উত্তর দেওয়া হল না। কেন এই নাম? ময়ূরের সাথে কি সম্পর্ক? ইয়াজিদিরা বিশ্বাস করে, ময়ূর অমরত্বকে নির্দেশ করে। এজন্য তাদের মেলেক তাউস দেখতে ময়ূরের মতো। ময়ূর দেবতার অসংখ্য ছবি, প্রতিকৃতি, অংকন চিত্র ইয়াজিদিদের বাসা-বাড়ি আর ধর্মীয় স্থানগুলোতে দেখতে পাওয়া যায়।

বর্তমান

ইয়াজিদিরা কট্টরভাবে নিজস্ব ধর্ম ও সমাজব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে চায়। অন্যান্য ধর্ম ও জাতিগুলো থেকে আলাদা থাকবার ব্যাপারে কড়া কড়া সব নিয়ম আছে তাদের। বহুবিবাহ ইয়াজিদি সমাজে বারণ হলেও নেতাদের এক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় রয়েছে। আমীর তাহসিন সাইদ তাদের সর্বোচ্চ নেতা। আর বর্তমান ধর্মীয় নেতার নাম হচ্ছে শেখ হাজি ইসমাইলি।

ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কায় ইয়াজিদিরা; Source: huffingtonpost

নানা বাধা নিষেধের বেড়াজালে ইয়াজিদিদের ধর্ম আর অন্যান্য প্রথা অনেকটা আড়ালে রয়ে গিয়েছে। রহস্যপ্রিয় এই জাতি সম্পর্কে তাই খুব বেশি তথ্য জানা যায় না। হাজার বছরের ধারাবাহিকতায় চলে আসা নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে বহু ইয়াজিদি পালিয়ে যাচ্ছে ইউরোপসহ নানা জায়গায়। ইরাকের উত্তরে অস্ত্রের জোরে প্রতিষ্ঠা করা শান্তি বিরাজ করছে বটে, কিন্তু সে শান্তি যে কতটা ভঙ্গুর, তা সংবাদপত্রে চোখ বোলালেই বোঝা যায়। পেশমারগার অধীনে ইয়াজিদিদেরও একটি নিজস্ব মিলিশিয়া বাহিনী আছে, তবে তা নেহাতই অপ্রতুল। বাবা-মা দুজনেই ইয়াজিদি না হলে তাদের সন্তানকে ইয়াজিদি হিসেবে গণ্য করা হয় না। যুদ্ধের ফলে ক্রমেই ভেঙ্গে পড়ছে এই রক্ষণশীল ব্যবস্থা, কমছে ইয়াজিদিদের সংখ্যা। আর এভাবেই প্রাচীন একটি রহস্যময় জাতি ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে কালের অন্তরালে।

ফিচার ইমেজ: Youtube

Related Articles

Exit mobile version