রাশিয়া বা রুশ ফেডারেশন আয়তনের দিক থেকে বর্তমান বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্র। রাশিয়ার বর্তমান আয়তন ১,৭১,২৫,১৯১ বর্গ কি.মি., যা বিশ্বের মোট ভূমির এক–অষ্টমাংশ। ইউরেশিয়ার কেন্দ্রীয় অঞ্চলে অবস্থিত রাশিয়া আয়তনের দিক থেকে ইউরোপ, ওশেনিয়া ও অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ তিনটির চেয়ে বড় এবং দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের চেয়ে সামান্য ছোট! আয়তনের দিক থেকে ইউরোপ ও এশিয়া উভয় মহাদেশের বৃহত্তম এই রাষ্ট্রটিকে বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করলে বলা যায়, বাংলাদেশের সমান ১১৬টি ভূখণ্ডকে একত্রিত করলে সেই সম্মিলিত ভূখণ্ডটি রাশিয়ার সমান হবে! জনসংখ্যার দিক থেকে রাশিয়া ইউরোপের সবচেয়ে জনবহুল রাষ্ট্র, কিন্তু তারপরও রাশিয়ার জনসংখ্যা বাংলাদেশের জনসংখ্যার চেয়ে কম! ১১টি ‘টাইম জোন’ বিশিষ্ট এবং তুন্দ্রা, স্তেপ, তৈগা ও অর্ধ–মরু অঞ্চলে বিন্যস্ত রাশিয়াকে একটি ‘ভৌগোলিক দানব’ বললে অত্যুক্তি হবে না।
রাশিয়ার বিশাল ভূখণ্ড পশ্চিমে বাল্টিক সাগর থেকে পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত এবং উত্তরে আর্কটিক মহাসাগর থেকে দক্ষিণে কৃষ্ণসাগর ও ককেশাস পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত। রাশিয়ার সর্ব উত্তরের স্থান আর্খানজেলস্ক প্রদেশের অন্তর্গত ‘ফ্রানৎস–ইয়োসিফ’ উপদ্বীপের ফ্লিগেলি অন্তরীপ; সর্ব দক্ষিণের স্থান দাগেস্তান প্রজাতন্ত্রের বাজার্দিউজিউ পর্বতশৃঙ্গ; সর্ব পশ্চিমের স্থান কালিনিনগ্রাদ প্রদেশের ভিশ্চুলা ভূমির পরিত্যক্ত নার্মেলন গ্রাম; এবং সর্ব পূর্বের স্থান চুকোৎকা স্বায়ত্তশাসিত জেলার অন্তর্গত রাতমানভ/বৃহৎ ডায়োমিড দ্বীপ।
রাশিয়ার সঙ্গে ১৬টি রাষ্ট্রের স্থল সীমান্ত রয়েছে: নরওয়ে (১৯৫.৮ কি.মি.), ফিনল্যান্ড (১,২৭১.৮ কি.মি.), এস্তোনিয়া (১৩৮ কি.মি.), লাতভিয়া (২৭০.৫ কি.মি.), লিথুয়ানিয়া (২৬৬ কি.মি.), পোল্যান্ড (২০৪.১ কি.মি.), বেলারুশ (১,২৩৯ কি.মি.), ইউক্রেন (১,৯২৫.৮ কি.মি.), আজারবাইজান (৩৭২.৬ কি.মি.), জর্জিয়া (৩৬৫ কি.মি.), আবখাজিয়া (২৫৫.৪ কি.মি.), দক্ষিণ ওসেতিয়া (৭০ কি.মি.), কাজাখস্তান (৭,৫১২.৮ কি.মি.), মঙ্গোলিয়া (৩,৪৮৫ কি.মি.), চীন (৪,২০৯.৩ কি.মি.) এবং উত্তর কোরিয়া (১৭ কি.মি.)। এর পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গে দুইটি রাষ্ট্রের জল সীমান্ত রয়েছে: জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। জাপানের হোক্কাইডো দ্বীপ রাশিয়ার কুরিল দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত কুনাশির দ্বীপ থেকে মাত্র ২০ কি.মি. দূরে অবস্থিত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা অঙ্গরাজ্যের অন্তর্গত ক্ষুদ্র ডায়োমিড দ্বীপ রাশিয়ার রাতমানভ/বৃহৎ ডায়োমিড দ্বীপ থেকে মাত্র ৩ কি.মি. দূরে অবস্থিত।
আর্কটিক মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর, কাস্পিয়ান সাগর, কৃষ্ণসাগর, আজভ সাগর ও বাল্টিক সাগর বরাবর রাশিয়ার ৩৭,০০০ কি.মি.–এরও বেশি সমুদ্র উপকূল রয়েছে এবং আর্কটিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের মাধ্যমে রাশিয়া ব্যারেন্টস সাগর, শ্বেত সাগর, কারা সাগর, লাপ্তেভ সাগর, পূর্ব সাইবেরীয় সাগর, চুকচি সাগর, বেরিং সাগর, ওখোতস্ক সাগর ও জাপান সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত। রাশিয়ার অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমার আয়তন ৭৫,৬৬,৬৭৩ বর্গ কি.মি.। রাশিয়ার প্রধান সমুদ্রবন্দরগুলোর মধ্যে রয়েছে আজভ সাগরের তীরে অবস্থিত রোস্তভ, কৃষ্ণসাগরের তীরে অবস্থিত নভোরোসিয়স্ক, কাস্পিয়ান সাগরের তীরে অবস্থিত অস্ত্রাখান ও মাখাচকালা, বাল্টিক সাগরের তীরে অবস্থিত কালিনিনগ্রাদ ও সেন্ট পিটার্সবার্গ, শ্বেত সাগরের তীরে অবস্থিত আর্খানজেলস্ক, ব্যারেন্টস সাগরের তীরে অবস্থিত মার্মানস্ক এবং প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে অবস্থিত পেত্রোপাভলভস্ক–কামচাৎস্কি ও ভ্লাদিভোস্তক।
রাশিয়া এই বিশাল ভূখণ্ডের অধিকারী হলো কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়াটা সহজ নয়। রুশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১,০০০ বছরেরও বেশি সময় আগে। তখন থেকে যুদ্ধ–বিগ্রহ, সন্ধি, উপনিবেশ স্থাপন, অনুসন্ধান এবং কূটনীতির মাধ্যমে ক্রমে পূর্ব ইউরোপের একটি ক্ষুদ্র অঞ্চল থেকে রাশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। রুশরা মূলত একটি ইউরোপীয় জাতি, কিন্তু পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য জাতি (যেমন: ব্রিটিশ, ফরাসি, স্প্যানিশ, ডাচ, পর্তুগিজ ও অন্যান্য) যেভাবে সমুদ্র অতিক্রম করে দূরদূরান্তের অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করার মাধ্যমে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল, রুশরা সেভাবে সাম্রাজ্য বিস্তার করেনি। রুশদের সাম্রাজ্য বিস্তার ছিল মূলত বিভিন্ন এশীয় জাতির (যেমন: মোঙ্গল, চীনা, আরব, ভারতীয়, ইরানি, তুর্কি ও অন্যান্য) সাম্রাজ্য বিস্তারের অনুরূপ। চীনারা যেমন ইয়াংসি নদীর তীর থেকে স্থলপথে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে করতে বিরাট এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল, কিংবা আরবরা যেমন প্রথমে মদিনা ও পরে দামেস্ককে কেন্দ্র করে আশেপাশের অঞ্চলগুলো দখল করতে করতে একটি বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী হয়ে উঠেছিল, রুশরাও ঠিক তেমনই পূর্ব ইউরোপীয় সমভূমি থেকে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলো একে একে অধিকার করে নেয়ার মাধ্যমে নিজেদের সাম্রাজ্য সৃষ্টি করেছিল।
বর্তমান রুশদের পূর্বপুরুষ ছিল বিভিন্ন স্লাভিক জাতিগোষ্ঠী, যারা প্রথমে বর্তমান বেলারুশের প্রিপিয়াত জলাভূমি অঞ্চলে বসবাস করত। কালক্রমে এই স্লাভিক জাতিগোষ্ঠীগুলো বাল্টিক সাগর ও কৃষ্ণসাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং এই বিস্তৃত অঞ্চলে তাদের পাশাপাশি ফিনো–উগ্রিক ও বৃহত্তর তুর্কি জাতির অন্তর্গত বিভিন্ন জাতিও বসবাস করত। ক্রমে স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চল থেকে আগত ভাইকিংরা (রুশদের কাছে ‘ভারাঙ্গিয়ান’ নামে পরিচিত) এতদঞ্চলে বসতি স্থাপন করে এবং স্লাভদের সঙ্গে তাদের সংমিশ্রণ ঘটে। রুরিক নামক একজন ভাইকিং নেতা ৮৬২ সালে নভগরোদ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর মধ্য দিয়ে প্রথম রুশ রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। রুরিকের উত্তরসূরীরা ৮৭৯ সালে কিয়েভে রাজধানী স্থাপন করেন এবং কিয়েভকে কেন্দ্র করে পূর্ব ইউরোপে একটি বিস্তৃত রাষ্ট্র গড়ে তোলেন। এই রাষ্ট্রটি ইতিহাসে ‘কিয়েভস্কায়া রুশ’ (ইংরেজিতে ‘কিয়েভান রুশ’) বা ‘প্রাচীন রুশ’ নামে পরিচিতি অর্জন করে। এই রাষ্ট্রটি ছিল পূর্ব স্লাভিক ও ফিনিক জাতিগুলোর একটি ফেডারেশন, এবং উত্তরে শ্বেত সাগর থেকে দক্ষিণে কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত ও পশ্চিমে ভিশ্চুলা নদী থেকে পূর্বে তামান উপদ্বীপ পর্যন্ত রাষ্ট্রটি বিস্তৃত ছিল। ৯৬৫–৯৬৯ সালে কিয়েভস্কায়া রুশ তুর্কি–অধ্যুষিত এবং ভোলগা–দন স্তেপভূমি থেকে পূর্ব ক্রিমিয়া ও উত্তর ককেশাস পর্যন্ত বিস্তৃত খাজার খাগানাত দখল করে নেয়। এর মধ্য দিয়ে কিয়েভস্কায়া রুশ একটি বহুজাতিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১০০০ সালে রাষ্ট্রটির আয়তন ছিল প্রায় ১৩,৩০,০০০ বর্গ কি.মি.।
কিন্তু ক্রমে কিয়েভস্কায়া রুশে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পেতে থাকে এবং রাষ্ট্রটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বশাসিত রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১২৩৭–১২৪০ সালে চেঙ্গিস খানের নাতি বাতু খানের নেতৃত্বে মোঙ্গলরা প্রাচীন রুশ আক্রমণ করে এবং ব্যাপক হারে হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। রুশ রাষ্ট্রগুলো মোঙ্গল–শাসিত ‘সোনালি হোর্ড’ সাম্রাজ্যের করদ রাজ্যে পরিণত হয়। ১২৮৩ সালে নভগরোদ থেকে আগত রুরিকের উত্তরসূরীদের একাংশ মস্কোতে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গড়ে তোলেন, যেটি ‘ভেলিকোয়ে ক্নিয়াঝেস্তভো মস্কোভস্কোয়ে’ বা ‘বৃহৎ মস্কো রাজ্য’ (ইংরেজিতে ‘মাস্কোভি’ নামে পরিচিত) নাম ধারণ করে। মাস্কোভির শাসকরা সোনালি হোর্ডের সঙ্গে একটি ‘অধীনতামূলক মিত্রতা’ স্থাপন করেন এবং অন্যান্য রুশ রাষ্ট্রগুলোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু করেন। পরবর্তী দুই শতাব্দীতে ধীরে ধীরে মাস্কোভির সীমানা বিস্তৃত হতে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মাস্কোভি কর্তৃক ১৩২০–এর দশকে ভ্লাদিমির–সুজদাল এবং ১৪৭৮ সালে নভগরোদ জয়। ১৪৮০ সালে মাস্কোভি সোনালি হোর্ডের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং অবশিষ্ট রুশ রাষ্ট্রগুলোকে নিজস্ব শাসনাধীনে আনার প্রক্রিয়া আরম্ভ করে।
১৪৮৫ সালে মাস্কোভি ‘ৎভের’ দখল করে নেয় এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র লিথুয়ানিয়ার সঙ্গে বেশ কয়েকটি যুদ্ধের মাধ্যমে বিস্তৃত এক অঞ্চল দখল করে নেয়, যার ফলে ১৫০৩ সালের মধ্যে মাস্কোভির আয়তন তিনগুণ বৃদ্ধি পায়। মাস্কোভি ১৫১০ সালে পস্কভ, ১৫১২ সালে স্মোলেনস্ক (লিথুয়ানিয়ার কাছ থেকে), ১৫১৩ সালে ভোলোকোলামস্ক, ১৫২১ সালে রিয়াজান এবং ১৫২২ সালে নভগরোদ–সেভেরস্কি দখল করে নেয়। এর মধ্য দিয়ে জাতিগত রুশ–অধ্যুষিত সবগুলো স্বতন্ত্র রাষ্ট্র মাস্কোভির অন্তর্গত হয় এবং মাস্কোভির শাসকরা আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদেরকে বাইজান্টাইন সম্রাটদের উত্তরসূরী হিসেবে ঘোষণা করেন। প্রথম রোম (খ্রিস্টান–অধ্যুষিত রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী রোম) ও দ্বিতীয় রোমের (অর্থোডক্স খ্রিস্টান–অধ্যুষিত বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল) পর মস্কোকে ‘তৃতীয় রোম’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। ১৫৪৭ সালের ১৬ জানুয়ারি মাস্কোভির শাসক চতুর্থ ইভান জুলিয়াস সিজারের নামানুসারে ‘জার’ উপাধি গ্রহণ করেন এবং মাস্কোভিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘রোসিস্কোয়ে ৎসারস্তভো’ বা ‘রুশ জারতন্ত্র’ নামকরণ করেন।
বর্তমান রাশিয়া যে ইউরোপ ও এশিয়া জুড়ে বিস্তৃত ভূখণ্ডের অধিকারী একটি বহুজাতিক, বহুধর্মাবলম্বী ও বহুসাংস্কৃতিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠেছে, এটির মূল কৃতিত্ব জার চতুর্থ ইভানের (যিনি ‘ভয়ঙ্কর ইভান’ নামেই বেশি পরিচিত)। ইভানের নেতৃত্বে রাশিয়া ১৫৫২ ও ১৫৫৬ সালে মোঙ্গল–শাসিত তাতার মুসলিম–অধ্যুষিত দুইটি রাষ্ট্র কাজান ও অস্ত্রাখান জয় করে, এবং এর মধ্য দিয়ে তাতার মুসলিমরা রুশ রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। ইভানের সময়েই রুশরা সাইবেরিয়ার বিস্তৃত জনবিরল অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা ও উপনিবেশ স্থাপন আরম্ভ করে। কিন্তু লিভোনীয় যুদ্ধে (১৫৫৮–১৫৮৩) পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়া, ডেনমার্ক–নরওয়ে ও সুইডেনের সম্মিলিত জোটের কাছে রাশিয়া পরাজিত হওয়ার ফলে ইভানের বাল্টিক অঞ্চল দখলের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। এদিকে ১৫৮০ সালে রুশরা সাইবেরিয়ায় অবস্থিত মোঙ্গল–শাসিত বিশাল মুসলিম রাষ্ট্র সিবির খানাত দখল করতে শুরু করে এবং ১৫৯৮ সালের মধ্যে পুরো রাষ্ট্রটি দখল করে নেয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সিবির খানাত ছিল মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসে ভৌগোলিকভাবে সর্ব উত্তরে অবস্থিত রাষ্ট্র। রুশদের সাইবেরিয়া বিজয়কে পশ্চিম ইউরোপীয়দের উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা বিজয়ের সঙ্গে তুলনা করা চলে, এবং রুশদের সিবির খানাত বিজয় ছিল স্প্যানিশদের আজটেক ও ইনকা সাম্রাজ্য বিজয়ের অনুরূপ।
১৬০৫–১৬১৮ সালের রুশ–পোলিশ যুদ্ধে পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়া রাশিয়াকে পরাজিত করে স্মোলেনস্ক দখল করে নেয় এবং ১৬১১–১৬১৭ সালের রুশ–সুইডিশ যুদ্ধে সুইডেন রাশিয়াকে পরাজিত করে ইনগ্রিয়া দখল করে নেয়। কিন্তু সাইবেরিয়ায় রুশদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে এবং ১৬৪০ সালের মধ্যে রুশ রাষ্ট্র পূর্ব দিকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। ১৬৪০–এর দশক থেকে দূরপ্রাচ্যে রুশদের সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু হয়। ১৬৪৮ সালে পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়ার অধীনস্থ ইউক্রেনের জাপোরোঝীয় কসাকরা পোলিশ–লিথুয়ানীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং ১৬৫৪ সালে রাশিয়ার জারের কাছে সহায়তা প্রার্থনা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৬৫৪–১৬৬৭ সালের রুশ–পোলিশ যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে রাশিয়া স্মোলেনস্ক পুনরুদ্ধার করে এবং পূর্ব ইউক্রেন ও কিয়েভ লাভ করে। ১৬৮১ সালে রাশিয়ার করদ রাষ্ট্র তাতার–শাসিত কাসিম খানাতের সর্বশেষ শাসকের মৃত্যুর পর রাশিয়া খানাতটি অঙ্গীভূত করে নেয়, যেটি বর্তমানে রাশিয়ার রিয়াজান প্রদেশের অংশ। ১৬৮০–এর দশকে চীনের ‘কিং/মাঞ্চু সাম্রাজ্যে’র সঙ্গে দ্বন্দ্বে রুশরা পরাজিত হয় এবং এর মধ্য দিয়ে দূরপ্রাচ্যে রুশ অগ্রযাত্রা রুদ্ধ হয়। ১৬৮৯ সালে রাশিয়া ও চীনের মধ্যে স্বাক্ষরিত নের্চিনস্ক চুক্তি অনুযায়ী রুশরা আমুর নদীর উত্তরে অবস্থিত অঞ্চলের ওপর তাদের দাবি ছেড়ে দেয়, কিন্তু আর্গুন নদী ও বৈকাল হ্রদের মধ্যবর্তী দূরপ্রাচ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চল রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৬৯৬ সালে রাশিয়া ওসমানীয় তুর্কিদের পরাজিত করে এবং কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী আজভ ও এর আশেপাশের অঞ্চল লাভ করে। বস্তুত, ১৫৫১ থেকে ১৭০০ সাল পর্যন্ত ১৫০ বছর সময়ে প্রতি বছরে রাশিয়ার আয়তন গড়ে ৩৫,০০০ বর্গ কি.মি. করে বৃদ্ধি পায়।
১৭০০–১৭২১ সালে সংঘটিত উত্তরের মহাযুদ্ধে রাশিয়া সুইডেনকে পরাজিত করে ইনগ্রিয়া পুনরুদ্ধার করে এবং এস্তোনিয়া, লিভোনিয়া ও দক্ষিণ–পূর্ব ফিনল্যান্ড লাভ করে। কিন্তু ১৭১০–১৭১১ সালের রুশ–ওসমানীয় যুদ্ধে রুশরা পরাজিত হয় এবং ওসমানীয় সাম্রাজ্যের নিকট আজভ হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়। ১৭২১ সালের ২২ অক্টোবর জার প্রথম পিওতর (‘পিটার দ্য গ্রেট’) রাশিয়াকে একটি সাম্রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করেন এবং এটি ‘রোসিস্কায়া ইম্পেরিয়া’ বা ‘রুশ সাম্রাজ্য’ নাম ধারণ করে। ১৭২২–১৭২৩ সালের রুশ–পারসিক যুদ্ধে রাশিয়া পারস্য/ইরানের কাছ থেকে দেরবেন্ত, বাকু, গিলান, শিরভান, মাজান্দারান ও অস্ত্রাবাদ দখল করে নেয়, কিন্তু ১৭৩২–১৭৩৫ সালে ওসমানীয় তুর্কিদের বিরুদ্ধে পারসিকদের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনের জন্য অঞ্চলগুলো পারস্যকে ফিরিয়ে দেয়। ১৭৩০–এর দশক থেকে রুশরা বর্তমান কাজাখস্তানে সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করে। এ সময় কাজাখস্তান ‘বৃহৎ হোর্ড’, ‘মধ্যম হোর্ড’ ও ‘ক্ষুদ্র হোর্ডে’ বিভক্ত ছিল এবং ১৭৩০ সালে রুশরা কাজাখ ‘ক্ষুদ্র হোর্ড’ দখল করে নেয়। ১৭৩৩ সাল থেকে রুশরা আলাস্কায় বসতি স্থাপন শুরু করে এবং এর মধ্য দিয়ে আলাস্কায় রুশ উপনিবেশ সৃষ্টির প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়। ১৭৩৫–১৭৩৯ সালের রুশ–ওসমানীয় যুদ্ধে ওসমানীয় তুর্কিরা পরাজিত হয় এবং রাশিয়া পুনরায় আজভ অঞ্চলটি লাভ করে। ১৭৪১–১৭৪৩ সালের রুশ–সুইডিশ যুদ্ধে সুইডিশরা পরাজিত হয় এবং রাশিয়া সুইডেনের কাছ থেকে দক্ষিণ–পশ্চিম কারেলিয়া দখল করে নেয়।
১৭৭১ সালে রাশিয়া বর্তমান কালমিকিয়া ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অবস্থিত মোঙ্গল রাষ্ট্র কালমিক খানাতকে নিজ রাজ্যভুক্ত করে। ১৭৭২ সালে রাশিয়া ‘পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়ার প্রথম বিভাজনে’ অংশগ্রহণ করে এবং দ্ভিনা, দ্রুৎ ও নিপার নদীর পূর্বে অবস্থিত পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়ার সমস্ত ভূমি (পোলিশ লিভোনিয়া ও পূর্ব বেলারুশ) দখল করে নেয়। ১৭৬৮–১৭৭৪ সালের রুশ–ওসমানীয় যুদ্ধে রাশিয়া ওসমানীয় তুর্কিদের পরাজিত করে, এবং উত্তর ককেশাস অঞ্চলে কাবার্দিয়া আর ইউরোপে কার্চ ও ইয়েনি–কালে এবং ইয়েদিসান অঞ্চলের অংশবিশেষ রাশিয়ার হস্তগত হয়। ১৭৮৩ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া উপদ্বীপে অবস্থিত তাতার–শাসিত রাষ্ট্র ক্রিমিয়া খানাত দখল করে নেয়। ১৭৮৭–১৭৯২ সালের রুশ–ওসমানীয় যুদ্ধে রুশরা আবার ওসমানীয় তুর্কিদের পরাজিত করে এবং দনেস্তার ও বাগ নদীর মধ্যবর্তী সম্পূর্ণ অঞ্চল লাভ করে। ১৭৯৩ সালে রাশিয়া ‘পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়ার দ্বিতীয় বিভাজনে’ অংশগ্রহণ করে এবং পশ্চিম ইউক্রেন ও পশ্চিম বেলারুশ লাভ করে। ১৭৯৫ সালে রাশিয়া ‘পোল্যান্ড–লিথুয়ানিয়ার তৃতীয় বিভাজনে’ অংশগ্রহণ করে এবং লিথুয়ানিয়া রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৭৯৮ সালে কাজাখ ‘মধ্যম হোর্ড’ রুশ সাম্রাজ্যের কর্তৃত্বাধীনে আসে, এবং ১৭৯৯ সালে আলাস্কা আনুষ্ঠানিকভাবে রুশ সাম্রাজ্যের অংশে পরিণত হয়।
১৮০১ সালে জর্জীয় রাজ্য ‘কার্তলি–কাখেতি’ (পূর্ব জর্জিয়া) রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮০৮–১৮০৯ সালের রুশ–সুইডিশ যুদ্ধে রাশিয়া সুইডেনকে পরাজিত করে এবং সুইডেনের কাছ থেকে ফিনল্যান্ড, অ্যাল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ, ল্যাপল্যান্ডের অংশবিশেষ ও পশ্চিম বথনিয়া দখল করে নেয়, যেগুলো একত্রিত হয়ে রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ‘ফিনল্যান্ড বৃহৎ ডাচি’তে পরিণত হয়। ১৮১০ সালে আরেকটি জর্জীয় রাজ্য ইমেরেতি (পশ্চিম জর্জিয়া) রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮০৬–১৮১২ সালের রুশ–ওসমানীয় যুদ্ধে রাশিয়া ওসমানীয় সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে এবং বেসারাবিয়া দখল করে নেয়। ১৮১২ সালে রুশরা উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ায় (বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্গত) উপনিবেশ স্থাপন করে। ১৮০৪–১৮১৩ সালের রুশ–পারসিক যুদ্ধে পারস্য রাশিয়ার কাছে পরাজিত হয়, এবং রাশিয়া পারস্যের কাছ থেকে জর্জিয়া, মিনগ্রেলিয়া ও আবখাজিয়া এবং বাকু, শিরভান, দেরবেন্ত, কারাবাখ, গাঞ্জা, শাকি ও কুবা খানাতসমূহ আর তালিশ খানাতের অংশবিশেষ দখল করে নেয়। ১৮১৪ সালে রুশ অভিযাত্রীরা হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে একটি উপনিবেশ স্থাপন করে, কিন্তু রুশ সম্রাটের অনুমোদন না থাকায় ১৮১৭ সালে উপনিবেশটি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ১৮১৫ সালে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের চূড়ান্ত পরাজয়ের পর রাশিয়া ‘ওয়ারশ ডাচি’ দখল করে নেয় এবং এটি ‘কংগ্রেস পোল্যান্ড’ নামে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮১৭ সাল থেকে রাশিয়া উত্তর ককেশাসে সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করে, কিন্তু স্থানীয় পার্বত্য জাতিগুলোর তীব্র বাধার সম্মুখীন হয়।
১৮২০–এর দশকে রাশিয়া কাজাখ ‘বৃহৎ হোর্ড’ দখল করে নেয় এবং এর মধ্য দিয়ে বর্তমান কাজাখস্তানে রুশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮২৬–১৮২৮ সালের রুশ–পারসিক যুদ্ধে রুশদের কাছে পারসিকরা পরাজিত হয় এবং এর ফলে এরিভান ও নাখচিভান খানাত আর তালিশ খানাতের অংশবিশেষ রাশিয়ার অংশে পরিণত হয়। ১৮২৮–১৮২৯ সালের রুশ–ওসমানীয় যুদ্ধে রুশদের কাছে ওসমানীয় তুর্কিরা পরাজিত হয় এবং আখালতসিখে, আখাল্কালাকি, সুজুক–কালে, পোতি, আনাপা ও দানিউব নদীর বদ্বীপ অঞ্চল রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮৪২ সালে রুশরা উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ায় তাদের উপনিবেশটি বিক্রি করে দেয়। ১৮৫০–এর দশক থেকে রুশরা মধ্য এশিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করে। ১৮৫৩–১৮৫৬ সালের ক্রিমিয়ার যুদ্ধে রাশিয়া ব্রিটেন, ফ্রান্স, ওসমানীয় সাম্রাজ্য ও সার্ডিনিয়ার সমন্বয়ে গঠিত একটি জোটের কাছে পরাজিত হয় এবং ওসমানীয় সাম্রাজ্যের নিকট দক্ষিণ বেসারাবিয়া হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়। ১৮৫৬–১৮৬০ সালে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ‘দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধে’ পরাজিত করে। চীনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে রাশিয়া ১৮৫৮–১৮৬০ সালে আমুর নদীর উত্তরে ও উসুরি নদীর পূর্বে অবস্থিত সমস্ত অঞ্চল দখল করে নেয়। দখলকৃত ভূমির পরিমাণ ছিল প্রায় ৯,১০,০০০ বর্গ কি.মি.।
১৮৬৪ সালের মধ্যে রাশিয়া উত্তর ককেশাসের বিদ্রোহী পার্বত্য জাতিগুলোকে দমন করতে সক্ষম হয় এবং অঞ্চলটির ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। ১৮৬৭ সালে রাশিয়া আলাস্কা উপনিবেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করে দেয়। একই বছর রুশরা খোকান্দ খানাতকে একটি আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত করে। ১৮৭১ সালে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে বিদ্রোহের সুযোগে রুশ সৈন্যরা দক্ষিণ জিনজিয়াং দখল করে নেয়, কিন্তু ১৮৮১ সালে একটি চুক্তির মাধ্যমে অঞ্চলটি চীনের নিকট ফিরিয়ে দেয়। ১৮৭৩ সালের মধ্যে রাশিয়া বুখারা আমিরাত ও খিভা খানাতকে পরাজিত করে এদের অধিকাংশ ভূমি (উজবেকিস্তান ও উত্তর তুর্কমেনিস্তান) দখল করে নেয় এবং অবশিষ্ট বুখারা ও খিভা রাশিয়ার আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৮৭৫ সালে রাশিয়া ও জাপানের মধ্যে একটি সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং এর মধ্য দিয়ে শাখালিন দ্বীপ রাশিয়ার হস্তগত হয়। ১৮৭৬ সালে রুশরা খোকান্দ খানাতকে (বর্তমান কিরগিজস্তান ও পশ্চিম তাজিকিস্তান) সম্পূর্ণভাবে অঙ্গীভূত করে ফেলে। ১৮৭৭–১৮৭৮ সালের রুশ–ওসমানীয় যুদ্ধে রুশদের নিকট ওসমানীয় তুর্কিরা পরাজিত হয় এবং রাশিয়া দক্ষিণ বেসারাবিয়া পুনর্দখল ও আরদাহান, আর্তভিন, বাতুমি ও কার্স অঞ্চল লাভ করে।
১৮৮৫ সালের মধ্যে রুশরা তুর্কমেন ক্ষুদ্র জাতিগুষ্ঠীগুলোকে পরাজিত করে দক্ষিণ তুর্কমেনিস্তান দখল করে নেয় এবং একটি সীমান্ত সংঘর্ষের পর আফগানিস্তানের পাঞ্জদেহ অঞ্চল দখল করে নেয়। ১৮৯৩ সালের মধ্যে পামির অঞ্চল (পূর্ব তাজিকিস্তান) রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮৯৭ সালে রাশিয়া চীনের লিয়াওদং উপদ্বীপ দখল করে নেয় এবং ১৮৯৯–১৯০১ সালে চীনের বক্সার বিদ্রোহের সুযোগে মাঞ্চুরিয়ায় সামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। ১৯০৪–১৯০৫ সালের রুশ–জাপানি যুদ্ধে রাশিয়া জাপানের কাছে পরাজিত হয় এবং দক্ষিণ শাখালিন ও দক্ষিণ মাঞ্চুরিয়া জাপানের হস্তগত হয়। ১৯০৭ সালে রুশ–ব্রিটিশ চুক্তি অনুযায়ী উত্তর ইরানের ওপর রুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১১ সালে চীনা বিপ্লবের পর চীনের বাহির মঙ্গোলিয়া ও তুভা অঞ্চলদ্বয় স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং রাশিয়ার আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে রুশ সাম্রাজ্যের আয়তন ছিল প্রায় ২,২৮,০০,০০০ বর্গ কি.মি. এবং রুশ সাম্রাজ্য ছিল মানব ইতিহাসের তৃতীয় বৃহত্তম সাম্রাজ্য।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ রুশ সাম্রাজ্যের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে এবং ১৯১৭ সালের মার্চে রুশ সাম্রাজ্যের আনুষ্ঠানিক পতন ঘটে। ১৯১৭ সালের অক্টোবরে কমিউনিস্টরা রাশিয়ার শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় এবং কমিউনিস্ট–শাসিত সোভিয়েত রাশিয়া ১৯২২ সাল পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধ ও বৈদেশিক আক্রমণে বিপর্যস্ত ছিল। এমতাবস্থায় প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের বিশাল ভূখণ্ডের মধ্যে মূল রাশিয়া, মধ্য, পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেন, পূর্ব বেলারুশ, দক্ষিণ ককেশাস (জর্জিয়া, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান) এবং মধ্য এশিয়া নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। মঙ্গোলিয়া ও তুভায় সোভিয়েত কর্তৃত্ব বজায় থাকে। কিন্তু পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া, লাতভিয়া, এস্তোনিয়া ও ফিনল্যান্ড স্বাধীনতা লাভ করে; পোল্যান্ড পশ্চিম ইউক্রেন ও পশ্চিম বেলারুশ দখল করে নেয়; রুমানিয়া বেসারাবিয়া দখল করে নেয়; সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৮৭৭–১৮৭৮ সালে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের কাছ থেকে এশিয়ায় দখলকৃত অঞ্চলগুলো তুরস্কের কাছে হস্তান্তর করে; এবং উত্তর মাঞ্চুরিয়া ও উত্তর ইরানের ওপর রুশ সাম্রাজ্যের দাবি সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রত্যাহার করে নেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৩৯ সালে জার্মানি কর্তৃক পোল্যান্ড আক্রমণ ও দখলের সুযোগে সোভিয়েত ইউনিয়ন পোল্যান্ডের কাছ থেকে পশ্চিম ইউক্রেন ও পশ্চিম বেলারুশ পুনর্দখল করে নেয়। ১৯৩৯–১৯৪০ সালের সোভিয়েত–ফিনিশ যুদ্ধে ফিনল্যান্ড পরাজিত হয় এবং কারেলিয়ান ইস্থমাস, লাদোগা কারেলিয়া, সাল্লা, রিবাচি উপদ্বীপ ও ফিনল্যান্ড উপসাগরের দ্বীপসমূহ সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়। ১৯৪০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন লিথুয়ানিয়া, লাতভিয়া ও এস্তোনিয়াকে অঙ্গীভূত করে ফেলে। একই বছর সোভিয়েত ইউনিয়ন রুমানিয়ার কাছ থেকে বেসারাবিয়া পুনর্দখল এবং উত্তর বুকোভিনা ও দানিউব নদীর ৬টি দ্বীপ দখল করে নেয়। ১৯৪৪ সালে তুভা রাষ্ট্রটি সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগদান করে। একই বছর অক্ষশক্তির সদস্য ফিনল্যান্ড সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে পরাজিত হয় এবং পেটসামো প্রদেশটি সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়। ১৯৪৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাজিত জার্মানির কাছ থেকে মেমেল বন্দর ও পূর্ব প্রাশিয়ার একাংশ (বর্তমান কালিনিনগ্রাদ প্রদেশ) এবং পরাজিত জাপানের কাছ থেকে কুরিল দ্বীপপুঞ্জ ও দক্ষিণ শাখালিন লাভ করে। একইসঙ্গে চেকোস্লোভাকিয়ার কার্পেথিয়ান রুথেনিয়া অঞ্চলটিও সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্র এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাষ্ট্রটির আয়তন ছিল ২,২৪,০২,২০০ বর্গ কি.মি.। রাষ্ট্রটি পশ্চিম থেকে পূর্বে ১০,০০০ কি.মি.–এর বেশি এবং উত্তর থেকে দক্ষিণে ৭,২০০ কি.মি.–এর বেশি বিস্তৃত ছিল। তুন্দ্রা, স্তেপ, তৈগা, মরু ও পার্বত্য অঞ্চলে বিন্যস্ত এই বিশাল রাষ্ট্রটি ছিল পূর্ব স্লাভিক, বৃহত্তর তুর্কি, ফিনো–উগ্রিক ও মঙ্গোলয়েড বিভিন্ন জাতির একটি ফেডারেশন, যেটি ১৫টি ‘সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ নিয়ে গঠিত ছিল। উত্তর ও মধ্য এশিয়ার সিংহভাগ, পূর্ব ইউরোপের অধিকাংশ এবং বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের কিয়দংশ নিয়ে গঠিত এই ‘দৈত্যাকৃতি’র সমাজতান্ত্রিক পরাশক্তি আয়তনের দিক থেকে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আড়াই গুণ এবং সমগ্র উত্তর আমেরিকা মহাদেশের চেয়ে সামান্য ছোট। বিশ্বের মোট ভূমির এক–ষষ্ঠাংশ নিয়ে গঠিত এই রাষ্ট্রটি পশ্চিমে বাল্টিক সাগর থেকে পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত এবং উত্তরে আর্কটিক মহাসাগর থেকে দক্ষিণে আফগানিস্তানের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
১৯৯০–১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে এবং তদস্থলে ১৫টি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়, যাদের মধ্যে বৃহত্তম রাষ্ট্র রুশ ফেডারেশন। প্রায় ৫০ লক্ষ বর্গ কি.মি. ভূমি হারানোর পরও রাশিয়া এখনো বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্র। কিন্তু রাশিয়ার সীমানা এখনো স্থায়ী হয়নি। ২০০৪ সালে রাশিয়া ও চীনের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি সীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া দামানস্কি ও তারাবারভ দ্বীপ এবং বলশয় উসুরিয়স্কি দ্বীপের অর্ধাংশসহ প্রায় ৭০০টি দ্বীপ চীনের কাছে হস্তান্তর করে, যেগুলোর মোট আয়তন প্রায় ৭২০ বর্গ কি.মি.। ২০১৪ সালে ইউক্রেনের গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়া ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয়। সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উত্তর মেরু বা আর্কটিক অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে এবং উত্তর মেরুর বিস্তৃত অঞ্চলে রাশিয়া নিজস্ব অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে। তদুপরি, দক্ষিণ মেরু বা অ্যান্টার্কটিকা অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্যও সম্প্রতি রাশিয়া আগ্রহ দেখিয়েছে। শেষ পর্যন্ত রুশ রাষ্ট্রের ব্যাপ্তি কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করবে, সেটি এখনও দেখার বিষয়।